হ্যালো, কে বলছেন?
আমি আলম, ভাইজান।
তুমি কি অসুস্থ? তোমার কণ্ঠ অমন লাগছে কেন?
ভাইজান, শান্তা নাই।
কি বলছ তুমি? কি হয়েছে শান্তার?
গত রাতে ও মারা গেছে; ও তো অনেক দিন থেকে অসুস্থ ছিল; আমি সব রকম চেষ্টা করেছি ভাইজান, কিন্তু রাখতে পারলাম না।
কি হয়েছিল শান্তার? ও যে অসুস্থ তা আমাদের জানাও নি কেন?
ওর হার্টের সমস্যা ছিল অনেকদিন থেকে। গতরাতে অপারেশনের পর আর জ্ঞান ফেরেনি। আপনাদের জানাতে ও নিষেধ করেছিল। আমি কতবার জানাতে চেয়েছি; বলত আপনাদের জানালে ও চিকিৎসাই করাবে না। আপনি যেদিন দেশে আসলেন সেদিনই ওকে ক্লিনিকে ভর্তি করাই। আমায় বলল ভাইজান যদি বাসায় আসতে চায় বলে দিও আমরা এখানে নাই। আমি ওকে নিয়ে আপনাদের বাড়িতে আসছি ভাইজান। ও মায়ের পাশে থাকতে চেয়েছিল। আপনারা শান্তাকে রাখার ব্যবস্থা করেন।
কি বলবে কামরুজ্জামান! সব ভাষা তার থমকে গেছে; সে কি আলমকে সান্ত্বনা দেবে, না নিজেকে? তার অতি আদরের একমাত্র ছোট বোন , নীরব অভিমানে তাকে এমন নীরব শাস্তি দিয়ে চলে গেল!
একে একে মনে পড়ছে তার সব কথা। সেই যখন শান্তা হল, জামানের বয়স তখন আট বছর। ফুট ফুটে বোন টা কে সে নিতান্তই নিজের করে নিয়েছিল। সে ছিল তার খেলার পুতুল, তাকে যত্ন করে সাজানো, হাসানো কাঁদানো এই ছিল জামানের সবচেয়ে পছন্দের খেলা।
খুব ব্রিলিয়ান্ট ছিল শান্তা। বরাবর ই জামানের চেয়ে ভাল রেজাল্ট করত সে, আর জামান তার মধ্যে খুঁজে পেত সুন্দর কিছু সৃষ্টির অনাবিল আনন্দ। কারণ তার সব দায়িত্ব জামান ই পালন করত।
ডানপিটে শান্তা একমাত্র জামান ছাড়া বাড়ির আর কাউকে ভয় পেত না। এস,এস,সি, তে অংক পরীক্ষা দিয়ে বের হওয়ার পরে জামান জিগ্যেস করল সরলের উত্তর কত হয়েছে? শান্তা বলল, জিরো, সব কাটাকাটি হয়ে গেছে; আমার একবারেই অংক মিলে গেছে।
সব হারানো কণ্ঠে জামান শুধু বলল উপরে নীচে কাটাকাটি হয়ে গেলে বুঝি শূন্য থাকে! সে মুহূর্তে জামান এবং শান্তা দুই ভাই বোনের অনুভূতি ছিল একই। জামানের মনে হচ্ছিল পৃথিবীর সব মাটি সরে যাচ্ছে, আর সে তার বোনটিকে নিয়ে তলিয়ে যাচ্ছে মাটির গহ্বরে। রেজাল্টে যখন শান্তা অংকে লেটার মার্কস পেল না, তখন শান্তা না কাঁদলেও জামান কান্না আটকাতে পারে নাই।
এস, এস, সি পাস করার পরে শান্তা ভর্তি হল খুলনাতে, জামান তখন ঢাকায় অনার্স পড়ে। সব ছুটিতেই দুই ভাই-বোন এক সাথে বাড়ি আসত। একবার ছুটিতে জামান বাড়ি এসেছে, শান্তার যাওয়ার কথা ছিল কলেজ থেকে শিক্ষা সফরে।শান্তা সেখানে না গিয়ে বাড়িতে এসে হাজির।
জামান খুব বকা দিল, তুই সারাজীবন আনকালচার্ড ই রয়ে গেলি, এসব শিক্ষা সফর থেকে অনেক কিছু জানা যায় শেখা যায়। শুধু পুঁথিগত বিদ্যা শিক্ষাকে পূর্ণতা দিতে পারে না ইত্যাদি বলে বলে শান্তার কান ঝালা-পালা করে দিচ্ছিল ।
পর দিন খবর এলো কলেজের গাড়ি ফেরার পথে এক্সিডেন্ট করেছে কয়েকটা মেয়ে মারাও গেছে; সেদিনের ভালো লাগা জামানের আজও মনে আছে।
জামান সব দিনই একটু উদাসীন প্রকৃতির ছিল, একবার শান্তা বাড়িতে এসে দেখল, মা খুব টেনশনে আছে। প্রায় এক মাস জামান বাড়ি থেকে গিয়েছে, কিন্তু পৌঁছার খবর ছাড়া এই পর্যন্ত বাড়িতে আর কোন চিঠি লেখে নাই।
শান্তা তাকে চিঠি লিখল, ছোট্ট একটা চিঠি; সে চিঠি জামানের সমস্ত অস্তিত্বকে একটা জোর ঝাঁকুনি দিল। তার অতীত, বর্তমান, ভবিষ্যৎ, মায়ের প্রতি দায়িত্ব, জীবনের প্রতি দায়িত্ব সবকিছু তাকে চোখে আঙ্গুল দিয়ে বুঝিয়ে দিল। চিঠি পড়ে ভাবনার গভীরে তলিয়ে গেল জামান।
ওর বন্ধু জিগ্যেস করল কিরে কার চিঠি এসেছে? সেই থেকে বুদ্ধুর মত বসে ভাবছিস! জামান তখন বন্ধুর হাতে চিঠিটা ধরিয়ে দিতে দিতে বলল আমার বড় বোনের লেখা।
ইন্টারমিডিয়েট পাস করার পর শান্তা অনার্সে ভর্তি হল ঢাকায়; জামান তখন লেখা-পড়া শেষ করে ছোট্ট একটা চাকরিতে ঢুকেছে। অফিসের মেসে থাকে। ঢাকায় এসেই শান্তা বায়না ধরল, সে হল-হোস্টেলে থাকবে না, বাসা নিতে হবে। সত্যি সত্যি এক রুমের একটা বাসা নিলো জামান, সরকারি কোয়ার্টারে সাব-লেট।
শুরু হল দুই ভাই-বোনের সংসার। প্রথম দিন বাসায় উঠার পরে শান্তা রেঁধেছিল ডিম, আলু ভর্তা আর ডাল-ভাত। সেদিন জামানের মনে হয়েছিল ঢাকায় থাকা এই দীর্ঘ জীবনে এই প্রথম সে তৃপ্তির সাথে খাবার খেল।
আদরের শান্তা বাড়ি থাকতে কোন দিন রান্না করে নি, নিজের কাপড় ধুয়ে পরে নি, এমন কি মা তাকে প্রায়ই খাইয়ে দিত। কাজেই রান্না হত কোন দিন লবণ ছাড়া, কোন দিন লবণে পুড়া, আজ হাত পুড়ছে তো কাল কাটছে, কিন্তু ওদের মজার কোন কমতি ছিল না।
একবার এক ছুটির দিনে জামান আধা কে,জি, গরুর মাংস কিনে নিয়ে এসেছে। রান্না চড়ানোর কতক্ষণ পরে শান্তা এসে বলল ভাইজান কি মাংস আনছেন! শুধু হাড্ডি। জামান বলল একটু উঠায় নিয়ে আয় তো দেখি। মাংসটা ছিল ছিনার, হাড্ডি হলেও খাওয়ার মত; উঠায় নিয়ে আসছে, দুই ভাই-বোন চাখছে, রান্না যখন শেষ হল, খাওয়াও শেষ ।
পরে আলু ভর্তা আর ডাল রান্না করে দুই ভাই-বোন ভাত খেল।
সকালে খেয়ে দেয়ে জামান অফিসে যেত, শান্তা কলেজে আবার এসে কাজ-কর্ম খেলা, ঘুরে বেড়ানো, বাজার করা সবই দুজন একসাথে করত।
একদিন শান্তার কলেজ বন্ধ, জামান অফিসে যাওয়ার সময় দেখল ওর গা টা একটু গরম; বলে গেল তুই শুয়ে থাক, উঠবি না আজ দরকার হয় হোটেল থেকে এনে খাব।
অফিসে গিয়ে জামান কিছুতেই কাজে মন বসাতে পারল না। বস বললেন কি ব্যাপার জামান কোন সমস্যা? হ্যাঁ স্যার আমার বোনটাকে অসুস্থ দেখে এসেছি। অফিসের সবাই জানত জামানের সাথে তার ছোট বোন থাকে, যে তার অনেক আদরের। বস হেসে দিয়ে বললেন আচ্ছা তুমি বাসায় চলে যাও।
এদিকে শান্তা কেবল ঘর-দোর গুছিয়ে পড়তে বসেছে এমন সময় জামান ফিরে এসে হন্ত দন্ত হয়ে ঘরে ঢুকে ওর কপালে হাত দিয়ে বলল তোর জ্বর আসে নি তো? স্নেহের আনন্দে ভিজে গেল বোনের দুই চোখের পাতা।
এমনি মাখা-মাখি করে চলতে চলতে কখন যে জামান কে শান্তার সম্বোধন আপনি থেকে তুমি, তুমি থেকে তুইতে নেমে এলো দুজনের কেউই তা বুঝল না। যথেষ্ট মেধাবী হওয়া সত্ত্বেও জামানের রেজাল্ট ভাল ছিল না, তাই তাকে ছোট চাকরি করতে হত, যা মেনে নেয়া শান্তার জন্য খুব কষ্টের ছিল।
একবার ও খুব করে বলল ভাইজান তুই ইম্প্রুভমেন্ট পরীক্ষা দে। তোর রেজিস্ট্রেশন, ফর্ম ফিল আপ, নোট-সাজেশন যোগাড় সব আমি করে দেব। বল তুই পরীক্ষা দিবি? দে না ভাই, দেখিস এবার তোর অনেক ভাল রেজাল্ট হবে। অনেক জোরাজুরির পর রাজী হল জামান।
প্রচণ্ড খুশি হল শান্তা। পড়া-শুনাও জামান বেশ ভাল করল। প্রথম পরীক্ষা হল, দ্বিতীয় পরীক্ষার দিন ফিরে এসে জামান বলল, আজ গণ্ডগোল হয়ে পরীক্ষা হয় নাই, কবে হবে তা পরে জানিয়ে দেবে।
থার্ড পেপার পরীক্ষা দিতে গিয়ে একটু পরেই জামান বাসায় ফিরে এলো শান্তা জিগ্যেস করল কিরে আজো তোর পরীক্ষা হল না? জামান বলল হচ্ছে, কিন্তু, আমি না দিয়ে চলে এসেছি।
কেন?
আমি লেখা শুরু করার পর শুনলাম সেকেন্ড পেপার পরীক্ষাটা ছুটির দিনে হয়ে গেছে। আমি এক বন্ধুকে বলে রেখেছিলাম তারিখ জানাতে, সে জানায় নাই।
কেন বললি তারিখটা তুই জেনে নিবি? নাহলে আমি খবর রাখতাম, ভালোই করেছিস তুই ওই কেরানী হয়েই থাক,নিজের উন্নতির তো তোর দরকার নাই।
আসলে মেঝ ভাইয়ের অকাল মৃত্যু,নিজের অ্যাকসিডেন্ট জামানের জীবন থেকে সব সাধ, স্বপ্ন, সুন্দরভাবে বেঁচে থাকার ইচ্ছে এবং শক্তি সবই কেড়ে নিয়েছিল।জামান বেঁচে ছিল যেন শুধু শান্তাকে একটা সুন্দর জীবন গড়ে দেয়ার জন্য।
শান্তা যখন অনার্স ফাইনাল ইয়ারে পড়ে তখন ওর বিয়ে হল; বিবাহিত জীবন তার সুখের ছিল না। কিন্তু চাপা স্বভাবের শান্তার কাছ থেকে কারো জানার সাধ্য ছিল না কোথায়, কিসে তার কষ্ট।
জামান ভাবত বিয়েতে শান্তাকে কিছু দিতে পারে নাই তাই হয়ত শ্বশুর বাড়ির লোকেরা তাকে কষ্ট দেয়। জামানের মনে হত গায়ের রক্ত বিক্রি করেও যদি ও শান্তাকে একটু সুখ কিনে দিতে পারত!
ওদের বাসা ছিল, রেল লাইনের উপরে, কতবার জামান ভেবেছে কবে ও দেখবে রেল লাইনের উপরে শান্তার লাশ পড়ে আছে।
পরিবার এবং শান্তার চাপের মুখে অনিচ্ছা সত্ত্বেও জামান ওই অস্বচ্ছলতার মধ্যেই বিয়ে করতে বাধ্য হল।কিন্তু বৌকে ঢাকায় রেখে সংসার চালানো তার পক্ষে সম্ভব ছিল না। তাই বৌ বাড়িতেই থাকত।
কিছুদিন পরে জামানের অফিসেই তার বৌয়ের চাকরি হল। চাকরিটা যাতে হয় সেজন্য শান্তাও তার সাথে অ্যাপ্লাই করল, পাশা-পাশি বসে রিটেন পরীক্ষা দিল।রিটেন টেষ্টে ওরা দুজন হাইয়েষ্ট মার্কস পেল, কিন্তু ভাইভাতে স্কোর অনেক নেমে গেল। যাহোক তবু চাকরিটা হল।
ভাগ্যের নির্মম পরিহাস! যে ভাবীকে শান্তা ভাইয়ের বৌ ভাবী না, বন্ধুর বৌ বন্ধু বলে মনে করত, সেই ভাবী তাকে কেন যেন প্রথম থেকেই শত্রু ভেবে নিলো। হয়ত শান্তার প্রতি জামানের অনেক বেশী ভালোবাসা তার মনে হিংসে জাগিয়েছিল।
উপরে উপরে ভাল ব্যবহার করলেও শান্তার প্রতি তার মনোভাব ছিল এমন যেন শান্তার চেয়ে খারাপ মেয়ে আর নাই, তার ছবিটা ছিঁড়ে ফেলতে পারলে, তার ছায়াটা পাড়ায় ধরতে পারলে তার ভাল লাগত।
যা হোক কিছু দিন পরে শান্তা স্বামীর সাথে ঢাকা ছেড়ে চলে গেল। আর জামানের সারা জীবনের বঞ্চনা পুষিয়ে দেয়ার জন্য ভাগ্য তাকে ডি,ভি, উপহার দিল। সপরিবারে আমেরিকা চলে গেল সে।
তাও প্রায় বার তের বছর হবে। এর মধ্যে শান্তাকে সে তেমন কিছুই দেয় নাই।দু এক বার শান্তা প্রয়োজনে তার কাছে থেকে টাকা ধার নিয়েছে আবার ফিরিয়েও দিয়েছে। অবশ্য শান্তা যতবার তার কাছ থেকে ধার নিয়েছে, ধার দিয়েছে তার চেয়ে বেশী বার।
বছর দুই আগে শান্তা বলল, ভাইজান আমারে তিন লাখ টাকা দে, আমি দেশের বাইরে চলে যাব। জামান টাকা দেয় নাই, এমন কি বুঝতে পারে নাই, বুঝতে চায় নাই যে তার বৌয়ের গায়ে পড়া শত অপমান, দুর্ব্যবহার সত্ত্বেও কেন সে জামানের কাছে টাকা চাইল।
এত দিন সংসার করার পরে কোন কষ্টে সে আজ স্বামী-সন্তান ছাড়তে চাইছে, দেশ ছাড়তে চাইছে। টাকা তার অনুভূতিকে এমনি অথর্ব করে দিয়েছিল।
মেয়েটা হয়তো চেষ্টা করেছিল তার দুর্ভাগ্যকে মেনে নিতে, হয়ত শেষ পর্যন্ত আর না পেরেই যে ভাই এক সময় তার জীবনে একই সাথে বাবা-মা, ভাই-বোন, বন্ধু সকলের ভূমিকা একাই পালন করত, সেই ভাইয়ের কাছে মুক্তির আবেদন জানিয়েছিল।
সে ও যখন মুখ ফিরায়ে নিলো, তখন তার আর কিছু করার ছিল না। তাই প্রকৃতিই তাকে মুক্তি দিল। সীমাহীন মুক্তি।
চিৎকার করে কেঁদে উঠল জামান।
এ কি করলি শান্তা, কি শাস্তি দিলি আমায়! তুই ফিরে আয়, ফিরে আয় শান্তা, আর তোরে আমি কোন কষ্ট পেতে দেব না।কোন কষ্ট না, তুই ফিরে আয়।
সর্বশেষ এডিট : ১১ ই ডিসেম্বর, ২০১২ দুপুর ২:৩১

অনুগ্রহ করে অপেক্ষা করুন। ছবি আটো ইন্সার্ট হবে।




