সায়মা যখন কেবল এস, এস, সি পাস করে কলেজে ভর্তি হয়েছে,এমন সময় ওর বিয়ে হল। বাপের বাড়ীর অবস্থা তেমন ভাল না,সুন্দরী মেয়ে, অনেক বেশী লেখা-পড়া শিখে ফেললে উপযুক্ত বর পাওয়া পরিবারের জন্য কঠিন হবে, তাই মেধাবী হওয়া সত্ত্বেও লেখা পড়া বন্ধ করে তাড়াতাড়ি বিয়ে দিয়ে নিশ্চিন্ত হওয়া।
সায়মার শ্বশুর বাড়ির অবস্থাও একই রকম। শ্বশুর নাই, শাশুড়ি আছেন, দুই ননদের বিয়ে হয়েছে, ছোট টা স্কুলে পড়ে। ভাসুর ছোট খাঁট ব্যবসা, সাথে কৃষি কাজ করে। জা আছে, তাদের দুই বাচ্চা। সায়মার স্বামী থাকে বিদেশে।
বিয়ের পরে এক মাস সে স্বামী সঙ্গ পেয়েছে। নতুন বৌ রেখে স্বামী তার প্রবাসী, এই প্রায় তিন বছর হোল। প্রবাসী ছেলে বিয়ে করার তার কোন ইচ্ছে ছিল না। ওর বোনদের অনেকেরই এরকম জীবন দেখেছে, আর মনে মনে ভেবেছে, দিন মজুর, কৃষকও যদি হয় তাও ভাল, তবু প্রবাসী স্বামী না। কিন্তু ভাগ্য ওর চাওয়া পূরণ করে নি।
শ্বশুর বাড়িতে সায়মার অনেক কদর। সুন্দরী, বুদ্ধিমতি, দায়িত্বশীল, সকল কাজে চটপটে, সকলের প্রতি যত্নশীল সে। তাছাড়া ওর বিয়ের পর থেকে ওর স্বামী জামালের আয় অনেক বেড়েছে, তাই সবাই ওকে বলে লক্ষ্মীমন্ত বৌ।
কিন্তু সায়মা এই জীবনের কোন অর্থ খুঁজে পায় না। প্রায়ই ওর মন খারাপ থাকে। সে ভাবে এ আবার কিসের সংসার? যে সংসারে স্বামী নাই, তা আবার সংসার হয় কিভাবে! ভাল শাড়ি পরতে ইচ্ছে করে না সায়মার, সাজ গোঁজ তো করেই না। কার জন্য সুন্দর শাড়ি পরা! কার মুগ্ধ চোখে সার্থক হতে সাজ করা! কসমেটিকস যা ছিল সব বের করে বাচ্চাদের দিয়ে দিয়েছে।
অথচ কত স্বপ্ন ছিল ওর স্বামীর সাথে প্রেম, ভালবাসা, ঝগড়া, ভাব, খুনশুটি করে দিন কাটাবে। একটা রাতেও ওর ভাল ঘুম হয় না।
সকালের রান্নাটা প্রতিদিন সায়মাই করে। ওর জা একটু দেরি করে রান্না ঘরে আসে। তার স্বামী বাইরে যাওয়ার আগ পর্যন্ত তাকে কাছ ছাড়া হতে দেয়না।
আর স্বামী ঘর থেকে বের হলেই, দ্রুত ছুটে আসে সায়মার কাছে। লজ্জিত, অপরাধীর মত করে, ওকে সরিয়ে দিয়ে নিজে সব কাজ শুরু করে আর বলে, তোমার আর এখন কিছু করতে হবে না। তুমি এখানে আমার কাছে বসে থাক, না হয় ঘরে যাও। তোমার দাদা যে কি পাগলামী করে! একেবারে অতিষ্ঠ হয়ে যাই। এখনও যেন উনি নতুন বর, অসহ্য!
সায়মা দেখে, ওর জায়ের সমস্ত অবয়বে সুখ যেন ছুঁয়ে ছুঁয়ে যাচ্ছে। শাড়ীর ভাঁজ আর ভেজা চুল থেকে মিষ্টি একটা গন্ধ আসছে। হেসে দিয়ে বলে ও, কেন এত ব্যস্ত হচ্ছেন ভাবী? আমার কোন অসুবিধা হচ্ছে না। সকালে আমার আর কি বা করার ছিল।
সকালের এই কাজটুকু বরং ওর দরকার। ঘুম ভাঙ্গার পরে, শরীর মনে এক বিষাদিত বিষণ্ণতা ভর করে থাকে। জীবনের সেই নিস্পন্দতা কাটানোর জন্য এই কাজটুকু ওর উপকারেই আসে।
বাড়ীতে বিল্ডিং তৈরি হচ্ছে, সমানে কাজ চলছে। এ পাশে রাজমিস্ত্রী দেয়াল গাঁথছে, ও পাশে মহিলারা তালে তালে ইট ভাঙ্গছে। কর্ম চঞ্চল এক উৎসব মুখর পরিবেশ। জানালার গ্রীল ধরে দাঁড়িয়ে আছে সায়মা, কাজ করা দেখছে।
যারা কাজ করছে, তাদের মধ্যে দুইজন আবার স্বামি-স্ত্রী। স্বামী রাজমিস্ত্রি, আর বৌ খোয়া ভাংছে। বৌয়ের গায়ে রোদ পড়েছে দেখে উঠে এসে, একটা লাঠির মাথায় কচুর পাতা বেঁধে ছাতার মত করে টাঙ্গিয়ে দিয়ে গেল।
ইস! কি পরম মমতা! আসলে রাজমিস্ত্রীটা ওর বৌকে দিয়ে কাজ করাতে চায় না। কিন্তু স্বামীর কাছে থাকার জন্য মেয়েটা জোর করে রোজ ওর সাথে কাজে আসে।
একজন শ্রমিকের মোবাইলে গান বাজছে, “যোগী ভিক্ষা লয় না, কথা হারে কয় না, ও যোগীর মনে কি তা বুঝা যায় না রে, যোগী ভিক্ষা ধর। মালঞ্চতে ফুল ও রে শুকায়, ও আমার হাসি যে অধরে ফুরায়, রে যোগী ভিক্ষা ধর।-----------------------------। ” সায়মার কানের মধ্যে শুধু ওই কথাটুকুই বেজে যাচ্ছে “মালঞ্চতে ফুল ও রে শুকায়, ও আমার হাসি যে অধরে ফুরায়,”
মোবাইলের রিং শুনে সম্বিত ফিরে এল ওর। দেখে স্বামীর নাম্বার। রাগে ওর গা জ্বলে ওঠে। ফোন রিসিভ করেই ঝাঁঝের সাথে বলে, কি চাও তুমি? বাড়ির কাজ কদ্দুর হল? টাকা পেয়েছি কি না, কে কেমন আছে এই জানতে চাও তো? তার জন্য আমাকে কেন? অন্য কাউকে ফোন দিতে পার না? এ খবর তো বাড়ির সবাই জানে। এক নিঃশ্বাসে কথাগূলো বলে ফোন কেটে দিল।
জামাল আবার রিং করে, সায়মা ফোন ধরে না, জামাল রিং করতেই থাকে। সায়মা তখন ফোন বন্ধই করে দেয়।
ঘন্টা খানিক পরে মোবাইল অন করে দেখে মেসেজ পাঠিয়েছে জামাল, “ সোনা বৌ, ফোন দাও প্লীজ, খুব জরুরী কথা আছে।”
সায়মা জবাব দেয়, “তোমার কোন জরুরী কথায় আমার দরকার নাই।”
মোবাইল খোলা আছে বুঝে, জামাল আবার রিং করে, এবার ফোন রিসিভ করে কানে ধরে চুপ করে বসে থাকে সায়মা, কোন কথা বলে না।
জামাল বলে, কি হল কথা বলবা না? এভাবে তুমি যদি রাগ কর, আমি কি করি বল তো? তোমার চেয়ে আমার কি কষ্ট কম হয়?
কষ্ট না ছাঁই হয় তোমার, কষ্ট হলে তুমি এভাবে থাকতে?
থাকি কি সাধে! তুমি জান না প্রতিদিন কাজ থেকে ফেরার পর, তোমাকে কাছে পেতে, তোমাকে আদর করতে আমার কেমন ইচ্ছে করে? ইচ্ছে করে যখন গা এলিয়ে দিয়ে তোমার কোলে মাথা রেখে শুয়ে থাকি, তখন আমার রান্না করতে হয়। এসব কষ্ট তুমি বোঝ না?
এই শোন এসব কথা শুনতে আমার একদম ভাল লাগে না। অনেক শুনেছি, কি তোমার জরুরী কথা তাই বল।
বৌ, তোমাকে খুব কাছে পেতে ইচ্ছে করছে।
এই তোমার জরুরী কথা? তোমায় না বলেছি, এভাবে কখনও বলবা না। প্লীজ, আমায় তুমি আর ফোন দিও না। তোমার সাথে কথা বললে যতটুকু ভাল লাগে, তার চেয়ে অনেক বেশী কষ্ট হয় আমার।
তোমার কষ্ট যদি দূর করে দেই?
কেন মিথ্যে লোভ দেখাও? এ জীবনে তা কখনও হবে না। আমার বোনদের দেখি না?
হবে গো হবে, এখন আমি তোমাকে যে খবরটা দেব, তাতে তোমার সব রাগ এক নিমেষে উবে যাবে।
যাবে না, কি বলবা তুমি? বলবা দেশে আসছ? ভাবছ তাতে আমি খুশি হব? ক’দিন কাছে পাওয়া, তার পরে আবার যা তাই, একই কষ্ট, একই অপেক্ষা, একই যন্ত্রণা। চাই না তোমার অমন দেশে আসা। আমি এই ভাল আছি।
আমি কি আমার বৌয়ের মনের খবর জানি না? জানি না আমার বৌ কি চায়? আমি যা বলব, তাতে তোমার খুশির ফোয়ারা বইবে।
তাহলে বল।
উহু, এত সহজে? অনেক জ্বালিয়েছ আজকে, আগে কিছু দাও।
পারব না।
ঠিক আছে। আমিও না বলেই রেখে দিচ্ছি। তোমার সাথে কথা বলা হয়েছে, এখন আর আমার ঘুম আসতে দেরি হবে না।
এই! ফোন রাখবা না, দেখ ভাল হচ্ছে না কিন্তু, বল কি বলবা?
আমিতো বলতে চাই, তুমি ট্যাক্সটা দিয়ে দিলে তো আমি দেরি করি না। দেরি তুমি করাচ্ছ।
আচ্ছা, আগে তুমি বল। তারপর দেব।
ঠিক তো?
হ্যাঁ,ঠিক।
শোনেন ম্যাডাম, আমি সামনে সপ্তায় দেশে আসছি এবং আপনাকে আমার সাথে নিয়ে আসব, সব ব্যবস্থা পাকা। আর তোমাকে আমি ছাড়া থাকতে হবে না, সোনা। তোমাকে সারপ্রাইজ দেয়ার জন্য আগে বলি নি।
বলছ কি তুমি? আমি স্বপ্ন দেখছি না তো! সায়মা যেন এক লাফ দিয়ে স্বামীর গলা জড়িয়ে ধরল; তার কাঁধে ওর নিঃশ্বাস। আবেশে মুদে আসছে দু চোখের পাতা------------------------------

অনুগ্রহ করে অপেক্ষা করুন। ছবি আটো ইন্সার্ট হবে।




