somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

একটি কলসী ও নারীর জীবন

০৯ ই জানুয়ারি, ২০২১ রাত ১:৫১
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

একটি কলসী না একজন নারীর জীবনের মূল্য বেশী ? তোমরা কি জানতে চাও -এমনি এক জীবনের গল্প ? সেই তিন যুগ আগের কথা । তখনকার দিনে গ্রামে খাবার পানির বড়ই অভাব । একমাত্র ভরসা ছিল কূয়া যা কুয়ো নামে পরিচিত । নলকুপের কোন বালাই ছিল না । আবার এক মুজহার বিশ্বাসের কুয়ো থেকেই গ্াঁয়ের সবাই পানি খেত। এই শালঘর মধুয়া কাচাড়ী পাড়াতে প্রায় চার -পাঁচ শ' লোকের বাস । কিন্তু খাবার পানির জন্য কুয়া ছিল মাত্র দুটি । একটি মুজাহার বিশ্বেসের বাড়রি কুয়ো আর একটা মইনুদ্দি বিশ্বেসের পরিত্যক্ত পুরাতন কুয়ো । বিশ্বেস গুষ্ঠির প্রায় ১০০ ঘর মানুষের তাই মুজাহার বিশ্বেসের কুয়োর উপর নির্ভর করতে হতো । রাত নেই দিন নেই বাড়ির বয়স্ক মহিলারা শুধু মাটির কলসীতে খায়ার পানি নিয়ে যাচ্ছে । ৩০ হাত গভীর কুপ থেকে দড়ি দিয়ে পানি টেনে তুলে কাঁকে করে নিযে যেতে হয় এ বাড়ি ও বাড়ি হাফ মাইল দূরে । সবাই মুখে মুখে কই চাম্পা বাড়ির কুয়োর পানি খুব ভাল । আবার কেউ বলে কাশেমের বাড়ি পুকুরের পানি খুব নিজল । আবার গোসল করার জন্যও কাশেমের রড় পুস্কনী সবার কাছে সুপরিচিত, কেউ কেউ আবার হোসেন-হাসানের কাজলাদিঘী বলে জানে । বড় একটা পুকুর তিন চার বিঘা জমি নিয়ে কাজল কাল গভীর পানি তাতে আবার অনেক মাছ । কাশেমের মা মরিয়ম বিবি এখানে একবার দেওদো দেখেছলি । তারপর সবাই বরই তলার কালো পানির দিকে যেতে ভয় পেত । ঐ দিকে গেলেই মনে হত দেওদোতে ধরে নিয়ে যাবে । আশ্চর্য়ের বিষয় একবার চয়নার মহিষ এই পুকুরের তাল তলাতে ডুবে মরে গিয়েছিল, তখন লোকে বলল দেওদোতে মহিষ ডুবা নিয়ে গেছে । ছেলে বুড়া সবাই এখানে সকাল থেকে রাত পর্যন্ত গোছল করত , সব সময় হৈচৈ লেগেই থাকত । পাকা ঘাট বাঁধা , পাড়ার মা চাচীরা গল্প গুজবে মেতে থাকত । জীবনের গল্প, সংসারের সুখ-দুঃখের গল্প , ঘরে তো কাজ আর কাজ, তাই ঘাটে বসেই মনের কথা খুলে বলা যায় ।

মুজহার বিশ্বেসের পাঁচ ছওয়াল ও দুই মেয়ে । বড় ছওয়াল দিয়ানত বিশ্বেস, মুসল্লী বা ছিনার বাপ নামে পরিচিত । মেজ ছওয়াল আজিমুদ্দনি ওরফে ফকির থাকে উত্তর পাড়া শ্বশ্মানের পাশে ৫ ছেলে নিয়ে কালী নদীর ধারে । বড় ছেলে ছিনা বাড়ি নদীর পাড়ে পুরাতন বাড়ি । আর কাজলাদিঘী পুকুরপাড়ে থাকে তিন ছওয়াল-। সেজ জন খোকা নেই, তার ছেলে শুকরো ও তার মা, যাকে সবাই খুদির মা বলে ডাকে । নুয়াজন হোসেন বা কাশেমের বাপ আর ছোট জন হাসেন -চাম্পার বাপ নামে পরিচিত । মুজহার বিশ্বেসের অনেক জমিজমা প্রায় ২০০ বিঘা । কাশেমের বাড়ি অনেক বড় বাড়ি , প্রায় ১০ বিঘা জমি নিয়ে অবস্থিত - আম কাঁঠাল, বেল, বড়ই বাাঁশ বাগান দিয়ে ঘিরা । কালি নদীর ধারে আবার জিকে ক্যানেলের পাশে । বাড়ির পূব পাশে দিয়ে রাস্তা, পশ্চিম পাশে কেনেল মাঠ, উত্তর পাশ খোলা মাঠ আর দক্ষণি দিকে পুকুর বাগান ।
পশ্চমি দিকেই চাম্পার ঘরের পাশে মিঠে আম গাছের তলায় সবার পানি খাওয়ার সেই কুয়ো । কুয়োর চার পাশ আবার সান বাঁধানো , সকলে কাপড় কাঁচে । বৃষ্টির সময় সাঁওলা পড়ে পিছলে হয়ে যায় । মাটির চাকার কুয়ো, খুর বেশী উঁচু হবে না, ৩/৪ ফুট হবে হয়ত । যে দড়ি দেয়ে পানি তুলা হয় সেটা পানি তুলার পর কুয়োর পাড়ে রেখে দেয়া হত ভিজা অবস্থায় । কখনও আবার বৃষ্টিতে ভিজা থাকত । বাচ্চাদের কে সবাই মিলে চোখে চোখে রাখত, কখন যেন কুয়ায় পড়ে না যায় । এ ব্যাপরে ছোট বউ মানে চাম্পার মা বেশী খেয়াল রাখত , কারন তার জানলা দিয়ে কুয়ো দেখা যেত । বালতি ছিল না বললেই চলে, বেশী ভাগ মাটির কলসীর গলায় দড়ি বেঁধে পানি তুলা হত কুয়ার কিনারে ঝুঁকে, তাই কুয়াতে পড়ে যাওয়ার ভয় ছিল বেশী । অবশ্য রব্বেলের ছেলে জোলে গরম কালে হন হন করে কুয়োয় নেমে সব ময়লা তুলে পরস্কিার করত, ওর কোন ভয় ডর ছিল না । মাথায় শুধু একটা বেতের আড়ি পড়ে নিতো ।

বর্ষাকালে পানি তুলা ও আনা নেওযা ছিল খুব কষ্টের কারন কুয়োর পাড় ছিল যেমন ভিজা ,পথও থাকত কাদা ও ‍পিছলে তেমন । অনেকে ভরা কলসী নিযে কাদায় ঢপাস করে পড়ে যেত । ছিনাবাড়ি থেকে কাশেমের বাড়ি যাওয়ার পথ ছিল একপায়া চিকন। হারো ও মুবা বাড়ির মধ্যি দিয়ে কানা পুকুরের ধার হয়ে বাঁশ তালার নীচ দিয়ে খানকার পাশ কেটে যেতে হতো ভযে ভয়ে । পায়ে হাঁটা পথ ছিল কাদা শাপ ব্যাঙে ভর্তি । উঁচু নীচু কাঁচা পথ । পথের দুধারে আবার ঝোপঝাড়ে ভর্তি । এই পথের পাশেই ছিল লিখির মার ছনের ঘর । লিখির বাপ সাদেক আলী ঘরে -বাইরে দুজনে বিড়ি বাঁদে খুবই কষ্টে সংসার চালাতো । লিখির মা চাঁদপুরের মানুষ - ভাল হিসাব জানত, তাই বিড়ির পাশাপাশি তেল লবন চকলেট ভাজা বেচত । এই মুদির দোকান ভালই চলত, কারন আশে পাশে বাজার বা দোকান ছিল না । তবে অনেক সময় ধান চাল ফেসারী নিতে হতো দাম হিসেবে এবং বাকিতে দিতে হতো । সকলের হাতে নগদ টাকার অভাব ছিল ।

সেদিন ছিল আষাঢ় মাসের বর্ষার দিন, টিপ টিপ করে বৃষ্টি হচ্ছিল, কাঁচা পথও ছিল পানি কাদায় ভিজা । সাঝেঁর সময় বড় বু ছিনার মা এই কাদা পানি পাড়ি দিয়ে নেপুর মার সাথে চাম্পা বাড়ি কলসী করে কুয়োর পানি নিতে আসে , কুয়োর পাড় ছিল অন্ধকার ও ভিজা । নেপুর মা রাবি ছিল খুব লম্বা,তাজা ও সাহসী । পানি তুলার দড়িও ভিজা ছিল। খাওয়ার পানি তো তবুও তুলা লাগবিই । এরই মধ্যি ছিনার মা পা টিপ টিপ করে কুয়োর ধারে যায় । নেপুর মাকে ডেকে কয়, কিছুই তো দেখা যায় নারে । নেপুর মা কয় , আল্লার নাম করে কলসী কুয়োয় নামা তো দেখি ভাবী । বড় ভাবী ভয়ে ভয়ে আস্তে আস্তে ভিজা দড়ি দিয়ে পানির কলসী কুযোয় নামায় হাতের আন্দাজে । পানি ভরে দড়ি টানে তুলতেই হঠাৎ পা পিছলে কুয়োর মুদ্দি পড়ে যেতে থাকে । চেঁচেঁয়ে ছিনার মা কয়,ও আল্লা, ওরে নেপুর মা আমি পড়ে গেলাম ,মরে গেলাম, আমার বাঁচা ! নেপুর মা টের পেয়ে ঝাঁপ দিয়ে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে সাহস করে ছিনার মার দু‘পা ধরে ফেলে । আর শোর করে বলতে থাকে , ও চাম্পার মা, ও খুদির মা, কাশেমের মা ! ওরে তুরা কে কোনে, তাড়াতাড়ি আয় এদিকে, ছিনার মা পড়ে গেল । আমি একা পাড়তিছিনে । ও ভাবীরা আয় আয় ! নেপুর মার ডাক শুনে ,চাম্পার মা, খুদীর মা দৌড়ো ‍কুয়োর পাড়ে আসে । নেপুর মার সাথে ওরাও ছিনার মার পা ধরে ফেলে । কাশেমের মা বাতি নিয়ে আসে । সবাই একসাথে আল্লার নাম ও কাঁদাকাটি করতে থাকে । তিন জন মিলে পা ধরে আস্তে আস্তে থেকে বড় ভাবীকে তুলতে থাকে । খোদার রহমতে তারা ছিনার মাকে কুয়োর উপোর উঠাতে পারে ।
কুয়োর উপরে উঠানোর সময কাশেমের মা কয় , বড় বু তোমার কাপড় ঠিক কর । একথা শুনে খুদরি মা রাগ করে কয় , এই পাগল তুই এ কি কস- জান আগে না , ইজ্জত আগে । কুয়ো থেকে যখন উপরে প্রায় উঠানো হয়ে গেছে--তখন চাম্পার মা দেখল বড় বু কলসীর দড়ি ধরে আছে । জীবন চলে যায় তবু কলস ছাড়ে নাই । আরো অবাক হয়ে ছোট বউ কয়- ও বড় বু তুমি একি করেছ- তোমার জীবনের চেয়ে কলসীর দাম বেশী হলো ! একটা মাটির কলসীর মায়া ছাড়তে পাড়লে না । ছিনার মা হাফ ছেড়ে কয়- নারে ছোট বউ আমার মুসল্লী খুব কড়া, কলস ভেঙ্গে গেলে খুব রাগ করতোনে, আমার কলসীডা খুব পুরানো, দশ বার বছর ধরে পানি খাচ্ছি, তাই ছাড়ে দিতে খুব মায়া লাগছিল । কাশেমের মা কাঁদে বলে , বু তুই যে আমার কত আপন, তুই ডুবে মরে গেলি আমরা কি করতাম । কলসীর দাম বেশী না তোর জানের দাম বেশী । কাশেমের মা আর ছিনার মার বাপের বাড়ি একই গ্রাম জোতপাড়াতে , তাই একটু দরদ বেশী । ছিনার মা হাফ ছেড়ে কেঁদে কই, তোরা সবাই আমার জীবন বাঁচাইছিস, তোরা না থাকলি আমি ডুবে মরেই যাতাম । খোদা তোদের ভাল করুক । খোদারও রহমত ছিল । এবার আমার নাতি ছওয়াল হলি তার নাম রাখপ রহমত আর দর্গায় ছিন্নি দিব । এমনি ছিল একে অপরের প্রতি মায়া, দরদ ও ভালবাসা- সবাই একজনের বিপদে আর একজন দৌড়ে যেত । পল্লীর মা বোনদের জীবনধারা এমনিভাবেই পানি আর কলসীর সাথে শত বছর ধরে মিশে আছে । তাহলি পল্লী গাঁয়ের নারীদের জীবনের মূল্য কখনও কখনও কলসীর চেয়েও কি কম ?
সর্বশেষ এডিট : ৩১ শে জানুয়ারি, ২০২১ বিকাল ৫:২৫
৩টি মন্তব্য ১টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

সৎ মানুষ দেশে নেই,ব্লগে আছে তো?

লিখেছেন শূন্য সারমর্ম, ২৮ শে এপ্রিল, ২০২৪ রাত ১:৪৮








আশেপাশে সৎ মানুষ কেমন দেখা যায়? উনারা তো নাকি একা থাকে, সময় সুযোগে সৃষ্টিকর্তা নিজের কাছে তুলে নেয় যা আমাদের ডেফিনিশনে তাড়াতাড়ি চলে যাওয়া বলে। আপনি জীবনে যতগুলো বসন্ত... ...বাকিটুকু পড়ুন

গরমান্ত দুপুরের আলাপ

লিখেছেন কালো যাদুকর, ২৮ শে এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ১:৫৯




মাঝে মাঝে মনে হয় ব্লগে কেন আসি? সোজা উত্তর- আড্ডা দেয়ার জন্য। এই যে ২০/২৫ জন ব্লগারদের নাম দেখা যাচ্ছে, অথচ একজন আরেক জনের সাথে সরাসরি কথা... ...বাকিটুকু পড়ুন

রাজীব নূর কোথায়?

লিখেছেন অধীতি, ২৮ শে এপ্রিল, ২০২৪ বিকাল ৩:২৪

আমি ব্লগে আসার পর প্রথম যাদের মন্তব্য পাই এবং যাদেরকে ব্লগে নিয়মিত দেখি তাদের মধ্যে রাজীব নূর অন্যতম। ব্যস্ততার মধ্যে ব্লগে কম আসা হয় তাই খোঁজ-খবর জানিনা। হঠাৎ দু'একদিন ধরে... ...বাকিটুকু পড়ুন

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা বৃষ্টির জন্য নামাজ পড়তে চায়।

লিখেছেন নূর আলম হিরণ, ২৮ শে এপ্রিল, ২০২৪ বিকাল ৪:৩৮



ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কিছু শিক্ষার্থী গত বুধবার বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের কাছে বৃষ্টি নামানোর জন্য ইসতিসকার নামাজ পড়বে তার অনুমতি নিতে গিয়েছে। বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ এটির অনুমতি দেয়নি, যার জন্য তারা সোশ্যাল... ...বাকিটুকু পড়ুন

=তুমি সুলতান সুলেমান-আমি হুররাম=

লিখেছেন কাজী ফাতেমা ছবি, ২৮ শে এপ্রিল, ২০২৪ রাত ৮:৩৬



©কাজী ফাতেমা ছবি

মন প্রাসাদের রাজা তুমি, রাণী তোমার আমি
সোনার প্রাসাদ নাই বা গড়লে, প্রেমের প্রাসাদ দামী।

হও সুলেমান তুমি আমার , হুররাম আমি হবো
মন হেরেমে সংগোপনে, তুমি আমি রবো।

ছোট্ট প্রাসাদ দেবে... ...বাকিটুকু পড়ুন

×