‘ঠিকা’ হিসাবে প্রতিদিন সকালে যেসব শ্রমিক ‘বিক্রি’ হতেন, হরতালে তাদের অপেক্ষায় থাকতে হয়- কখন ‘কিনবে’ কেউ। কেউ আসে না। তাই রোজগারহীন দিন কাটে তাদের, যার সঙ্গে রাতের হিসেবটা যোগ হয় দুশ্চিন্তা হয়ে- কী খাওয়াবেন বউ-সন্তানদের!
রাজধানীর কয়েকটি সুনির্দিষ্ট পয়েন্টে ভোরে দলবেঁধে হাজির হন এসব শ্রমিক, যারা বিভিন্ন ধরনের কাজ করেন ‘ঠিকা শ্রমিক’ হিসাবে।
আগারগাঁও পাসপোর্ট অফিসের পাশে মঙ্গলবার সকাল সাড়ে ৯টার দিকে কোদাল আর টুকরি নিয়ে জটলা করে বসে ছিলেন এমনই ৩০-৩৫ জন শ্রমিক।
এদেরই একজন মো. হাজাক মিয়ার ক্ষোভ কোনো হরতালেই তাকে কেউ কিনেনি বলে।
শেরপুরের এই বাসিন্দা বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, এমনিতেই মাসের ৩০ দিন কাজ পাওয়া যায় না। এর মধ্যে হরতাল হলে কেউ কিনতেই আসে না।
হাজাক মিয়ার সঙ্গে কথা বলার সময় কিছুটা দূরে বসে থাকা এক শ্রমিক একটু উচ্চ স্বরেই বলেন, “কোন বিড়ির কোম্পানির লোক রে?”
হাজাক মিয়ার উত্তরে ‘উনি সাংবাদিক’ শুনেই আগ্রহ নিয়ে পাশে এসে বসেন সালাম। ক্ষোভের সঙ্গে বলেন, “আগের হরতালেও কেউ আমাদের কিনতে আসেনি। ওই দিন দুপুরের দিকে গুণে দেখলাম আমরা দেড়শর মত আছি। ভাবছিলাম মিছিল করে হরতাল দিয়ে দেই।”
আপনারা হরতাল দেবেন- প্রশ্ন শুনেই বলেন, “কাম না থাকলে চুলা জ্বলে না। এর মধ্যে পোলাপাইনের লেখাপড়ার খরচ আছে। কেমনে চলে বলেন।”
শ্রমিকরা জানান, প্রতিদিন সাড়ে তিনশ থেকে চারশ টাকায় কাজ করেন পুরুষ শ্রমিকরা। আর মহিলা শ্রমিকরা পান আড়াইশ থেকে তিনশ টাকা। সকাল ৮টা থেকে বিকাল ৫টা পর্যন্ত কাজ করতে হয়। দুপুরের খাওয়া খরচ নিজের।
সকাল ৮টার মধ্যে কাজে যোগ দিতে হয় বলে সকাল ৬টা থেকে সাড়ে ৭টার মধ্যেই তাদের নিতে আসেন অনেকেই। এজন্য ভোরেই তারা হাজির হন রাজধানীর সুনির্দিষ্ট কিছু পয়েন্টে।
বেশির ভাগ পুরুষ শ্রমিকদের সঙ্গে ঠিকা শ্রমিক হিসেবে কাজ করা সাজেদার ক্ষোভটা একটু অন্য রকম। পুরষদের চেয়ে টাকা কম পান বলে মনে দুঃখও আছে তার।
মধ্যবয়সী এই মহিলা বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, ঠিকা কাজ করি বলে অন্যের বাসার কাজ নেই না। কিন্তু যেসব দিনে কাজ পাওয়া যায় না সেসময় অনেক সমস্যা হয়।
কাজ না থাকলে কীভাবে সংসার চলে- প্রশ্ন করতেই তিনি বলেন, “খুব মনে করেন প্রবলেম। কেমনে যে কী করুম সেই চিন্তায় অস্তির থাকি।”
শেরপুরের মুক্তার হোসেন থাকেন আগারগাঁও এলাকার একটি মেসে। তিনি বলেন, “কাজ না করতে পারলে মাস চলে না। ঘর ভাড়া নিয়ে মালিকের সাথে কাইজ্যা হয়। এমোন করে আর চলে না।”
জীবিকার সন্ধানে ময়মনসিংহ থেকে ঢাকায় আসা আব্দুল জলিল মিয়া বলেন, “সরকার নাকি দেশ জিডিটাল করছে। তাইলে আমগো চাকরি নাই ক্যান। একটা ছোট চাকরি থাকলেও তো ডেইলি সকালে আইসা এমুন কইরা বইসা থাকুন লাগত না।”
মিরপুর-১ নম্বর সেক্টরের ফুটওভার ব্রিজের নিচেও মঙ্গলবার সকাল থেকেই বসে ছিলেন কয়েকশ ঠিকা শ্রমিক। বিক্রি না হওয়ায় এদের অনেকেই সকাল ১১টার পরে চলে যান।
একটি গ্রুপে থেকে রংয়ের কাজ করেন জানিয়ে ফজলুল হক বলেন, হরতালে হাতেগোণা দু’একজন শ্রমিক কাজ পান। বেশিরভাগকেই বসে থেকে বাসায় ফিরে যেতে হয়।
“কেউ যদি একটু কম দামও বলত তাহলেও কাজ করা যেত। বসে থেকে লাভ কী? কিন্তু হরতালের দিন কেউ যে কিনতেই আসে না।”
বিএনপি নেতৃত্বাধীন ১৮ দলীয় জোটের মঙ্গলবারের হরতালে রাজধানীর মিরপুর-১৪ নম্বর সেক্টরেও অনেক শ্রমিককেই দেখা গেছে ‘অবিক্রিত’ বসে থাকতে।