‘পান খাইয়া ঠোঁট লাল করিলাম, বন্ধুর দেখা পাইলাম না’ জনপ্রিয় কণ্ঠশিল্পী রুনা লায়লার কন্ঠে আবেদনভরা এই গানটি শোনেন নি এমন লোক পাওয়া ভার।
পান খেয়ে ঠোঁট লাল করে বন্ধুর দৃষ্টি আকর্ষন করা-এই পান এখন আর শুধু বাংলাদেশের মানুষের ঠোঁটই রাঙায় না! গ্রামবাংলার বরজের (বাগান) পান এখন মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোর মানুষের ঠোঁটও লাল করছে।
খুলনায় অন্যান্য অর্থকরী ফসল চাষের পাশাপাশি পান চাষ অনেক জনপ্রিয় ও লাভজনক হয়ে উঠেছে। সনাতন নিয়ম ছেড়ে আধুনিক জ্ঞানের আলোয় গবেষণাভিত্তিক পান চাষ করে এক বিঘা জমি থেকে বছরে ২/৩ লাখ টাকা আয় করছেন এ জেলার পান বরজ মালিকরা।
সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, এবার পানের বাম্পার ফলন হয়েছে। তাদের এ পান রাজধানী ঢাকা, সিলেট, চট্টগ্রাম ছাড়িয়ে সৌদি আরব, কুয়েতসহ মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন দেশে রফতানি হচ্ছে।
জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর সূত্র জানায়, খুলনায় প্রায় ৬শ’ হেক্টর জমিতে পান চাষ করা হয়েছে। এর মধ্যে রূপসা, ডুমুরিয়া, ফুলতলা ও পাইকগাছা উপজেলায় বেশি। এছাড়া পাশ্ববর্তী জেলা বাগেরহাট ও যশোরেও পান চাষ করছেন কৃষকরা।
রূপসা উপজেলার স্বল্পবাহিরদিয়া গ্রামে বরজে বসে কথা হয় পানচাষি মনির উদ্দিন শেখের সঙ্গে।
তিনি জানান, এ এলাকার জমি ও আবহাওয়া পান চাষের উপযোগী এবং অন্যান্য ফসলের তুলনায় পান চাষ অধিক লাভজনক।
ফলে তার মতো অনেকেই অন্য ফসলের পরিবর্তে ব্যাপক হারে পান চাষের দিকে ঝুঁকছেন বলে জানান এই চাষি।
‘আবহাওয়া অনুকুল থাকায় এবং রোগবালাই না হওয়ায় এ বছর পানের ব্যাপক ফলন হয়েছে এবং পানের দামও ভালো পাওয়া যাচ্ছে,’ যোগ করেন তিনি।
মনির উদ্দিন জানান, এবার পানের দাম বেশ ভালো পাওয়া যাচ্ছে। অবস্থা এমন হয়েছে যে, পাইকারদের চাহিদার পর্যাপ্ত যোগান দিতে পারছেন না চাষিরা।
তিনি জানান, স্বল্পবাহিরদিয়া ছাড়াও রূপসা উপজেলার গিলাতলা, মানসা বাজার, মৌভোগ, কামটা, বড়বাহিরদিয়া, খাজাডাঙ্গা, বুড়িরবটতলায় এবার ব্যাপক পান চাষ করা হয়েছে। এসব পান ঢাকা থেকে ব্যাপারীরা এসে কিনে নিয়ে যান। যা কিনা বিদেশেও রফতানি করা হয়।
চাষের প্রক্রিয়া প্রসঙ্গে খাজাডাঙ্গা এলাকার বরজ মালিক হাসান জানান, দো-আঁশ মাটি পান চাষের জন্য উপযোগী। নিচু জমি থেকে মাটি উঁচু করে পানের চাষ করতে হয়। এক বিঘা জমিতে ৫০/৬০ মণ জৈব সার ছিটিয়ে চাষ দিতে হয়। সাত দিন পর এক কেজি তুঁতে ও ৩ মণ পাথুরে চুন ফুটিয়ে গুড়া করে জমিতে ছিটিয়ে পানি সেচ দিতে হয়। তারপর মই দিয়ে সমতল করে ঘন ঘন সেচ দিয়ে মাটি শক্ত করে নিতে হবে। এরপর বাঁশ, খুঁটি, চটা ইত্যাদি দিয়ে বরজ তৈরি করতে হয়। পান চাষ ছায়াযুক্ত স্থান লাগে।
তিনি জানান, বর্তমানে ছোট পানের কুড়ির (এক কুড়ি=৬৪ পোন ও এক পোন= ৮০টি পান) দাম দুই থেকে তিন হাজার টাকা। বড় পানের কুড়ি ৮ থেকে ১০ হাজার টাকা।
‘পানের সঙ্গে কেউ কেউ আদা, হলুদ, মরিচ, পটল, সুপারিও চাষ করছেন। আবার বরজ ভাঙা জমিতে লাউয়ের চাষ করছেন কেউ কেউ,’ যোগ করেন হাসান।
সরিজমিনে দেখা যায়, খুলনার ডুমুরিয়া উপজেলার বিল ডাকাতিয়ায় পানের চাষ করে অনেক পরিবারে স্বচ্ছলতা ফিরে এসেছে।
স্থানীয় কলেজ শিক্ষক মাহবুব হোসেন জানান, ফুলতলা উপজেলার দামোদর, আটরা ও জামিরা ইউনিয়নের চাষিরা পানের ওপর নির্ভরশীল। এসব বরজ থেকে প্রতিবছর যে পরিমাণ পান উৎপন্ন হয় তা থেকে চাষিরা লাখ লাখ টাকা আয় করে থাকেন।
তিনি জানান, পান চাষে সরকারের কৃষি মন্ত্রণালয় অগ্রণী ভূমিকা পালনের পাশাপাশি ঋণব্যবস্থা ও প্রশিক্ষণ দিলে পান চাষে তারা আরও সফলতা পাবেন।
নগরীর সাতরাস্তার মোড়ের পান বিক্রেতা বেলাল বলেন, দেশের অন্যান্য স্থানের চেয়ে খুলনার পান আকারে বড়। খেতেও স্বাদ।
তিনি বলেন, বিয়ে বাড়িতে কিংবা আত্মীয়-স্বজনের বাড়ি বেড়াতে গিয়ে অথবা নিজ বাড়িতে খাওয়া-দাওয়ার পর পান না খেলে অনেকেরই চলেনা। এছাড়া নিয়মিত অনেকেই পান খান।
রূপসা উপজেলা কৃষি কর্তকর্তা শরীফ ইসমাঈল হোসেন বলেন, বর্তমানে আধুনিক পদ্ধতিতে চাষ করে কম জমিতে বেশি পান উৎপাদন হচ্ছে। এছাড়া বাজারে চাহিদা বাড়ায় দাম বেড়েছে কয়েক গুণ।
তিনি জানান, রূপসা উপজেলায় দুই শ’ হেক্টর জমিতে পান চাষ করা হয়েছে। বরজে বিভিন্ন ধরনের জৈব সার ও খইলের পাশাপাশি ব্যবহার করা হচ্ছে রাসায়নিক সার ও বিভিন্ন কীটনাশক। এতে পানের উৎপাদন বেড়েছে দ্বিগুণ।
পানের প্রকারভেদ : সাচি,বাংলা, মিঠা, কর্পূরী, গ্যাচ, নাতিয়াবাসুত, উজানী, মাঘি, দেশি, মহানলী, চেরফুলি, ভাবনা, সন্তোষী, জাইলো, ভাওলা, ঝালি প্রভৃতি জাতের পান আমাদের দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে পাওয়া যায়।
পানের ঔষধী গুণ : পানের অনেক ঔষধী গুণ আছে। পানে প্রচুর মাত্রায় ক্লোরোফিল থাকে৷ এইজন্য পানের রস ওষুধের মত কাজ করে৷ ‘ইন্টারন্যাশনাল এজেন্সি ফর রিসার্চ অন ক্যান্সার [আইএআরসি]’ তাদের এক গবেষণা প্রতিবেদনে বলেছে, সুপারী দিয়ে পান চিবানো স্বাস্থ্যের জন্য অনেক ভালো। সুপারী খেলে অনেক জটিল রোগের হাত থেকে ভালো থাকা যায়।
পানে ইউজিনল এবং সুপারীতে অ্যারেকোলিন ও টারপিনিয়ল পদার্থ আছে। এগুলো দাঁতের ক্ষয় রোধ, দাঁতের এন্টিসেপ্টিক, মুখের দুর্গন্ধ দূর ও কাজ করার ক্ষমতাও বাড়ায়।
সর্বশেষ এডিট : ২৩ শে মে, ২০১৫ দুপুর ১২:৩৯