somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

খাই খাই দেশের অন্য মানুষ

২১ শে সেপ্টেম্বর, ২০১২ বিকাল ৩:২৩
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

বাংলাদেশকে বিশ্বে যে ক’জন মানুষ ইতিবাচকভাবে পরিচিত করেছেন তাদের একজন বিজ্ঞানী মাকসুদুল আলম। আমাদের জন্য প্রথমে পাটের জীবনরহস্য উন্মোচন করেছেন তিনি, এরপর ছত্রাকের জীবন রহস্য। এর আগে যুক্তরাষ্ট্রের হয়ে পেঁপেঁ এবং মালয়েশিয়ার জন্য রাবারের জীবনরহস্যও উন্মোচন করেন এই জিন বিজ্ঞানী।

আমরা বাংলাদেশের মানুষ বিজ্ঞানী মাকসুদুল আলমকে প্রথম চিনেছি পাট নিয়ে তাঁর সফল গবেষণার পর। আমাদের সৌভাগ্য বাইরের দুনিয়ায় এরকম যে বাংলাদেশীরা আছেন, অন্তত তাঁদের একজনকে কাজে লাগাতে পেরেছে বাংলাদেশ। এক্ষেত্রে কৃষিমন্ত্রী মতিয়া চৌধুরী অভিনন্দন পাওয়ার মতো যোগ্য কাজ করেছেন। আবার একথাও বলা যায়, আমন্ত্রণে সাড়া দিয়ে জন্মভূমির কাছে তাঁর ঋণ শোধ করেছেন মাকসুদুল আলম।

পাটের জীবনরহস্য উন্মোচনের পর সোনালি আঁশের সুদিন ফিরিয়ে আনার স্বপ্ন আমাদের সামনে। আর পাটসহ ৫০০ উদ্ভিদের জন্য ক্ষতিকর ছত্রাকের জীবনরহস্য উন্মোচন সেই স্বপ্ন বাস্তবায়নের পথে বড় এক অগ্রগতি। মাকসুদুল আলমসহ বাংলাদেশের যে বিজ্ঞানীরা পাট এবং ছত্রাকের জীবনরহস্য উন্মোচন করেছেন তাদের অভিনন্দন।

তবে মাকসুদুল আলম এবং তাঁর সঙ্গী বিজ্ঞানীদের আবিষ্কার কিংবা এর প্রায়োগিক অর্থনৈতিক মূল্য এ লিখার বিষয় নয়। আবিষ্কারের পথে মানুষ হিসেবে মাকসুদুল আলম ও তাঁর সহযোগীরা যে অনন্য দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছেন সেই দিকটিও একটু উন্মোচনের চেষ্টা।

জিন বিজ্ঞানী মাকসুদুল আলম এবং তাঁর সঙ্গী বিজ্ঞানীদের জন্য ছত্রাকের জীবনরহস্য উন্মোচন প্রকল্পে সময় ছিলো পাঁচ বছর। কিন্তু সেই কাজ তাঁরা করেছেন মাত্র এক বছরে। সাক্ষাতকারে বিনয়ী মাকসুদুল আলম বলেছেন, সূত্রটা একবার ধরে নিতে পারলে বাকি কাজগুলো অনেক সহজ হয়ে যায়। তাঁর একথা শতভাগ সত্য। তবে এটাও ঠিক শুধু মেধা দিয়ে তাঁরা পাঁচ বছরের কাজ এক বছরে শেষ করেননি। এক্ষেত্রে তাদের দেশপ্রেম, কাজের প্রতি নিষ্ঠা এবং টিমওয়ার্কও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে।

মাকসুদুল আলমের কথা থেকেই আমরা এর প্রমাণ পাই। তিনি বলেছেন, ছত্রাক নিয়ে কাজ শুরুর সময় অনেকে বলেছিলেন, সরকারি লোকেরা অলস এবং অদক্ষ। তাদের দিয়ে কাজ হবে না। এ ধারণা ভুল প্রমাণ করার কথা উল্লেখ করে তিনি বলেছেন, গবেষকরা দিন-রাত কাজ করেছেন। কারও কোনো অফিসের সময়সূচি বেঁধে দেওয়া ছিলো না।

তিনি জানাচ্ছেন, পাটের জীবনরহস্য উন্মোচনের সময় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অনুপ্রাণ বিজ্ঞান বিভাগ এবং বেসরকারি তথ্যপ্রযুক্তি সংস্থা ডাটাসফট তাঁর সঙ্গে কাজ করলেও ছত্রাক গবেষণায় কাজ করেছেন সব সরকারি লোকজন। বাংলাদেশ পাট গবেষণা ইন্সটিটিউটের তরুণ বিজ্ঞানীদের তিনি যাচাই-বাছাই করে নিয়েছেন। কারিগরি ও তথ্যপ্রযুক্তির দিকটি দেখেছে রাষ্ট্রায়ত্ত্ব বিটিসিএল।

সাক্ষাতকারে মাকসুদুল আলম জানাচ্ছেন, সরকারি প্রতিষ্ঠানের গবেষক এবং তথ্যপ্রযুক্তি কর্মকর্তাদের মালয়েশিয়া, ডেনমার্ক এবং চীনে প্রশিক্ষণের জন্য পাঠানো হয়েছিলো। তারা ওই প্রশিক্ষণের সঙ্গে মেধা ও দেশপ্রেম দিয়ে কাজ করেছেন। বেতন বা আর্থিক সুবিধার কথা তারা চিন্তা করেননি।

শুধু তাই নয়, গবেষকদের আরো অনেক ত্যাগের কথা জানিয়েছেন মাকসুদুল আলম। গবেষণার অন্যতম তত্ত্বাবধানকারী মঞ্জুরুল আলমের স্ত্রী অসুস্থ হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হলেও তিনি যেতে পারেননি। মেয়ের উচ্চমাধ্যমিক পরীক্ষার সময়ও দিন-রাত গবেষণাকেন্দ্রে কাজ করে গেছেন।

ওই সাক্ষাতকারেই মাকসুদুল আলম জানিয়েছেন, রাত ১০টার আগে কেউ গবেষণাকেন্দ্র ছেড়ে যেতে পারেননি। অনেকসময় মধ্যরাত পর্যন্ত কিংবা সারা রাতও কাজ করতে হয়েছে। সবাই দেশের সাফল্য এবং সম্মানের জন্য সবকিছু হাসিমুখে মেনে নিয়েছেন।

মাকসুদুল আলম এভাবে তাঁর সঙ্গী বিজ্ঞানীদের দেশপ্রেম আর নিষ্ঠার কথা বলেছেন। কিন্তু নিজের বিষয়ে কিছু বলেননি। শুধু ওই বিজ্ঞানীদলকে যোগ্যতার সঙ্গে নেতৃত্ব দেওয়াই নয়, নিজ থেকেও যে এক অনন্য দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছেন সেকথা তিনি না জানালেও আমরা জানতে পেরেছি।

সরকারি হিসাবে ২০১০ সালের নভেম্বর মাসে শুরু হওয়া পাটবিষয়ক মৌলিক ও ফলিত গবেষণা প্রকল্পের জন্য ২০১৩ সাল পর্যন্ত বরাদ্দের পরিমাণ ৬৬ কোটি টাকা। প্রধান গবেষক হিসেবে মাকসুদুল আলমের মাসিক সম্মানি ১৬ লাখ, অর্থাৎ সম্মানি হিসেবে তাঁর পাওয়ার কথা পৌণে ছয় কোটি টাকা। কিন্তু মাকসুদুল আলম সেই সম্মানি নেননি। পুরো কাজটি তিনি করেছেন নিজের জন্য এক পাই-পয়সা না নিয়ে।

দীর্ঘ সময় যুক্তরাষ্ট্র এবং মালয়েশিয়াসহ উন্নত বিশ্বে গবেষণা করেছেন জিন বিজ্ঞানী মাকসুদুল আলম। যুক্তরাষ্ট্রের বাসিন্দাও তিনি। তারপরও পৌণে ছয় কোটি টাকা অথবা পৌণে এক মিলিয়ন ইউএস ডলার তার জন্য খুব ছোট অংক হওয়ার কথা নয়। আর হলেও দেশের জন্য এমন ছেড়ে দিতে আমরা আর ক’জন কিংবা কাকে দেখেছি!

বরং খাই খাই এর এদেশে আমরা একের পর এক শুধু খেকোই পেয়েছি। ছোটবেলায় জানতাম মানুষখেকো বাঘ। বয়স হওয়ার পর দেখছি সেই মানুষ আবার অনেক ধরণের খেকো। কেউ বনখেকো, কেউ নদীখেকো, কেউ সেতুখেকো, কেউ ভূমিদস্যু আবার কারো ক্ষমতায় যাওয়ার পর দস্যুর মতো আচরণ। উপর থেকে নীচ যেভাবেই হোক আরো বেশি অর্থ-বিত্ত-সম্পদের মালিক হওয়ার বাসনা। সেই বাসনা থেকে জনগণের ভোটে নির্বাচিত হওয়ার পর ডিউটি ফ্রি গাড়ি বাগিয়ে নেওয়ার মতো নির্লজ্জ আচরণ। ওই এক আইন আর তার সুবিধা নেওয়ার মানসিকতা থেকেই স্পষ্ট কতো বেশি লোভ আমাদের ক্ষমতাবানদের।

সেই দেশের মানুষ বিজ্ঞানী মাকসুদুল আলম গবেষণায় এক পয়সাও নেননি। মাসে ১৬ লাখ হিসাবে ওই টাকা নিলেও তার সম্মানের কম-বেশি হতো না। তারপরও সম্মানির টাকা না নিয়ে তিনি সম্মানিত হওয়ার সঙ্গে মহানও হয়েছেন।

মাকসুদুল আলমকে পুরো দেশ অভিনন্দন জানাচ্ছে, রাজনীতিকরাও। কিন্তু ওই রাজনীতিকরা যদি তাঁর মতো নির্লোভ হতে পারতেন! তাহলে তারা দেশের গায়ে শীর্ষ দুর্নীতিবাজ দেশের তকমা লাগাতে দিতেন না, হলমার্ক-শেয়ারবাজার কেলেংকারির মতো ঘটনার জন্ম হতো না। শেষ পর্যন্ত নাকে অনেক খত দিয়ে শেষ রক্ষা হলেও রাজনীতিবিদরা পদ্মাসেতুর মতো কলংকের জন্মও দিতেন না।

রাজনীতিবিদরা যেহেতু দেশ চালান, তাই আমাদের রাজনীতিকরা টাকার লোভী না হলে দেশে এতো অনিয়ম-দুর্নীতি হতো না; ক্ষমতার লোভী না হলে এতো অশান্তিও থাকতো না। রাজনীতিবিদরা নির্লোভ হলে অনেক বেশি স্বস্তি আর শান্তিতে থাকতো মানুষ।

তার জন্য যা দরকার তার কথাও বলেছেন বিজ্ঞানী মাকসুদুল আলম। তিনি বলেছেন, এই দেশকে বদলে ফেলতে হলে একটা জাগরণ দরকার। বাংলাদেশকে যারা নেতৃত্ব দিচ্ছেন তাদের দেশটাকে বদলে ফেলার প্রতিজ্ঞা থাকতে হবে।

আর তা হলে মেধা এবং মনুষ্যত্ব দুই দিক দিয়েই আরো অনেক মাকসুদুল আলম পাবে বাংলাদেশ। মাকসুদুল আলম নিজেই বলেছেন, কাজের পরিবেশ দিতে পারলে বাংলাদেশের তরুণরা যে বিশ্বমানের কাজ করতে পারে তার প্রমাণ হচ্ছে তাদের গবেষণার ফলাফল। কিন্তু সেই পরিবেশটা তাদের কে দেবে? মাকসুদুল আলমের মতো মানুষেরা যখন সেই পরিবেশের জন্য পরিবর্তনের কথা বলেন তখন ক্ষমতাসীনদের ক্ষমতার ভিত্তি থেকেই যে প্রথম আঘাত আসে।
০টি মন্তব্য ০টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

নিউ ইয়র্কের পথে.... ২

লিখেছেন খায়রুল আহসান, ১৫ ই মে, ২০২৪ রাত ৯:০২


Almost at half distance, on flight CX830.

পূর্বের পর্ব এখানেঃ নিউ ইয়র্কের পথে.... ১

হংকং আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে প্লেন থেকে বোর্ডিং ব্রীজে নেমেই কানেক্টিং ফ্লাইট ধরার জন্য যাত্রীদের মাঝে নাভিশ্বাস উঠে গেল।... ...বাকিটুকু পড়ুন

সামুতে আপনার হিট কত?

লিখেছেন অপু তানভীর, ১৫ ই মে, ২০২৪ রাত ৯:০৩



প্রথমে মনে হল বর্তমান ব্লগাদের হিটের সংখ্যা নিয়ে একটা পোস্ট করা যাক । তারপর মনে পড়ল আমাদের ব্লগের পরিসংখ্যানবিদ ব্লগার আমি তুমি আমরা এমন পোস্ট আগেই দিয়ে দিয়েছেন ।... ...বাকিটুকু পড়ুন

ডেল্টা ফ্লাইট - নিউ ইয়র্ক টু ডেট্রয়ট

লিখেছেন ঢাকার লোক, ১৬ ই মে, ২০২৪ সকাল ৮:২৬

আজই শ্রদ্ধেয় খাইরুল আহসান ভাইয়ের "নিউ ইয়র্কের পথে" পড়তে পড়তে তেমনি এক বিমান যাত্রার কথা মনে পড়লো। সে প্রায় বছর দশ বার আগের ঘটনা। নিউ ইয়র্ক থেকে ডেট্রিয়ট যাবো,... ...বাকিটুকু পড়ুন

ল অব অ্যাট্রাকশন

লিখেছেন সায়েমুজজ্জামান, ১৬ ই মে, ২০২৪ সকাল ৮:৪৫

জ্যাক ক্যান ফিল্ডের ঘটনা দিয়ে লেখাটা শুরু করছি। জ্যাক ক্যানফিল্ড একজন আমেরিকান লেখক ও মোটিভেশনাল স্পিকার। জীবনের প্রথম দিকে তিনি হতাশ হয়ে পড়েছিলেন। আয় রোজগার ছিলনা। ব্যাংক অ্যাকাউন্টে অর্থ ছিলনা।... ...বাকিটুকু পড়ুন

নতুন গঙ্গা পানি চুক্তি- কখন হবে, গ্যারান্টি ক্লজহীন চুক্তি নবায়ন হবে কিংবা তিস্তার মোট ঝুলে যাবে?

লিখেছেন এক নিরুদ্দেশ পথিক, ১৬ ই মে, ২০২৪ বিকাল ৫:২৬


১৬ মে ঐতিহাসিক ফারাক্কা দিবস। ফারাক্কা বাঁধ শুষ্ক মৌসুমে বাংলাদেশে খরা ও মরুকরণ তীব্র করে, বর্ষায় হঠাৎ বন্যা তৈরি করে কৃষক ও পরিবেশের মরণফাঁদ হয়ে উঠেছে। পানি বঞ্চনা এবং... ...বাকিটুকু পড়ুন

×