ছবি -গুগল।
সম্প্রতি ঘটে যাওয়া কিছু রোমহর্ষক ঘটনার প্রেক্ষাপটে যে প্রশ্নটি বার বার মনে উদয় হচছে বা আসছে, তা হলো - আমাদের সমাজের যুবসমাজের নৈতিক মূল্যবোধের অবক্ষয়ের পাশাপাশি সামাজিক নিরাপত্তার চেইন অব কমান্ড কি ভেঙে পড়ছে? যেভাবে নিরীহ অসহায় মানুষের ওপর প্রভাবশালী ব্যক্তিদের আক্রোশ চরম মাত্রায় পৌঁছেছে, সামাজিক শ্রদ্ধাবোধ ও ভালোবাসা গড়ে ওঠার পরিবর্তে যুবসমাজের মাঝে এক প্রকার ‘কোন কিছু পরোয়া না করার’ মনোভাব সৃষ্টি হয়েছে। সমাজে একের পর এক ধর্ষণ, হত্যা-খুন, সংঘর্ষ, মারামারি-হানাহানিতো লেগেই আছে। পারিবারিক কলহ এখন নিত্যনৈমিত্তিক ব্যাপার।আর এসব ঘটনার প্রেক্ষাপটে সামজিক নিরাপত্তা তথা নীতি-নৈতিকতা নিয়ে আমাদের সবার নতুন করে নতুন ভাবে দ্রুত কিছু ভাবার অবকাশ রয়েছে বলে মনে হয়।
মাদকাসক্ত ছেলের হাতে বাবা-মা খুন হচ্ছেন। রাস্তাঘাটে নারী উত্ত্যক্ত করা বখাটে যুবকদের ব্যাধিতে পরিণত হয়েছে। ঠুনকো বিষয় নিয়ে মানুষ পিটিয়ে হত্যার মতো জঘন্য ঘটনাও এখন চোখে পড়ে। সমাজের প্রতিটি রন্ধ্রে রন্ধ্রে উঠতি বয়সীদের হাতে অবৈধ অর্থের প্রভাব এত বেশি যে এলাকার মুরব্বিদেরও তারা তোয়াক্কা করে না।আর সর্বোপরী আমাদের নীতি-নৈতিকতা কতটা অধঃপাতে গিয়েছে তা আংগুল দিয়ে দেখিয়ে দিচছে এই সমাজে মানুষরুপী জানোয়ারদের দ্বারা গঠিত নানা রোমহর্ষক ঘটনার মাধ্যমে।
সামাজিক নিরাপত্তাবেষ্টনী ভেঙে প্রতিটি পাড়া-মহল্লা নিজেদের কবজায় নেয়ার জন্য গড়ে উঠেছে ‘কিশোর গ্যাং’ নামের একটি মাস্তান বাহিনী। যাদের ভয়ে সমাজের সভ্য ও ভদ্র মানুষের পক্ষে পরিবার-পরিজন নিয়ে স্বাভাবিক জীবনযাপন করা অনেকটা দুর্বিষহ হয়ে উঠেছে।
ছবি -গুগল।
এক নজরে দেশজুড়ে কিছু চাঞ্চল্যকর ঘটনার বর্ণনা -
** গত মাসের শেষের দিকে বুড়িমারী মসজিদে ধর্ম অবমাননার অভিযোগ তুলে রংপুর নগরের শালবন এলাকার শহীদুন্নবী জুয়েলকে পিটিয়ে ও পুড়িয়ে নির্মমভাবে হত্যা করা হয়। যা মধ্যযুগীয় বর্বরতাকেও হার মানিয়েছে।
** গত ৬ অক্টোবর নোয়াখালীর সুবর্ণচর উপজেলা চরজব্বর ইউনিয়নের ১নং ওয়ার্ডে মা নুরজাহান বেগমকে হত্যার পর পাঁচ টুকরা করে পাশের ধানক্ষেতে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে রাখে ছেলে হুমায়ুন ও তার সহযোগীরা।
** গত মাসে পারিবারিক বিরোধের জেরে সাতক্ষীরার কলারোয়া উপজেলার খলিসা গ্রামে বড় ভাই-ভাবী এবং ভাতিজা ও ভাতিজিকে চাপাতি দিয়ে কুপিয়ে নির্মমভাবে হত্যা করে ছোট ভাই রায়হানুল।
** গত ২৯ অক্টোবর রংপুরের মিঠাপুকুরে এক মাদরাসাছাত্রীকে ঘরের মধ্যে ঢুকে ধর্ষণ করে এলাকার বখাটে রেজোয়ান মিয়া। একই গ্রামের ওই বখাটে রেজোয়ান মিয়া বিভিন্ন সময় উত্ত্যক্ত করত এবং কুপ্রস্তাব দিয়ে আসছিল। এর আগে নোয়াখালীর একলাশপুরে গৃহবধূকে বিবস্ত্র করে নির্যাতনের ঘটনা দেশ-বিদেশে আলোড়ন সৃষ্টি করে।
** কিছুদিন আগে নোয়াখালী জেলার চাটখিলে বসতঘরে ঢুকে চাচীকে ধর্ষণ করে এবং ভিডিও ধারণ করে প্রতিবেশী ভাসুরের ছেলে শরীফ বাহিনীর প্রধান মজিবুর রহমান শরীফ ও তার লোকজন।
দেশের প্রায় প্রতিটি গ্রামেগঞ্জে, হাটাবাজারে, পাড়া-মহল্লায় প্রতিনিয়ত খুন, হত্যা-ধর্ষণের মতো নির্মম ও পৈশাচিক অপরাধ সংঘটিত হচ্ছে। বাসা-বাড়িতে ঘুমিয়ে থাকলেও সামাজিক নিরাপত্তা পাচ্ছেন না পরিবারের কোনো সদস্য। ঘরে ঢুকে ধর্ষণ, ধর্ষণের পর হত্যাসহ নানা অজানা আতঙ্ক প্রতিনিয়ত তাড়া করছে। নারী ও শিশুরা স্কুলে যাওয়ার পথে বখাটে ছেলেরা তাদের কখনো কখনো উত্ত্যক্ত করছে আবার কখনো কখনো অপহরণ করে পরিবারের কাছ থেকে বড় অঙ্কের টাকা হাতিয়ে নিচ্ছে।
এসব খবরের কোনোটা গণমাধ্যমে উঠে আসছে আবার কোনোটা হারিয়ে যাচ্ছে। প্রত্যন্ত অঞ্চলের বেশির ভাগ অপরাধের খবরতো গণমাধ্যমে আসে না। যার হিসাবও হয়তো থানা পুলিশের রেকর্ডেও থাকছে না। অপরাধী প্রভাবশালী হলেতো কথাই নেই। ক্ষমতার দাপটে অথবা টাকার প্রভাবে ঘটনা ধামাচাপা পড়ে যাওয়ার মতো ঘটনা ঘটছে অহরহ।
বর্তমানে আমাদের দেশে যে বিদেশী চ্যানেলে যে সিরিয়ালগুলো হচ্ছে সমাজে এর কুপ্রভাব পড়ছে। আগে যৌথ পরিবারের যে অনুশাসন পরিবারে সবাই মেনে চলত, পরিবারের কর্তাকে মেনে চলা, সমাজের মুরব্বি বয়োজ্যেষ্ঠদের মান্য করা, পারিবারিক, সামাজিক শ্রদ্ধাবোধ- এগুলো এখন আর দেখা যায় না। সমাজে ধর্মীয় অনুশাসনগুলো শিথিল হয়ে পড়েছে"।
আর আইনের প্রতি যে শ্রদ্ধাবোধ তা এখন আর দেখা যায় না বললেই চলে। যার কারণে একের পর এক খুন হত্যা ধর্ষণ লেগেই আছে, যুবসমাজ মাদকাসক্ত হয়ে পড়ছে, ছেলের হাতে বাবা-মা খুন হচ্ছেন। সমাজের চেইন অব কমান্ড ভেঙে পড়ার কারণে কিন্তু এগুলো হচ্ছে"।
যখনই কোন অনাকাংখিত ঘটনা ঘটে আমরা দেখি ,বিভিন্ন স্থানে যারা সমাজের অনভিপ্রেত কাজের সাথে জড়িত তারা কিন্তু স্থানীয় পর্যায়ে বেশ ক্ষমতাশালী। সুতরাং তাদের ক্ষমতার দাপটের কারণে তাদের মধ্যে ন্যায়-অন্যায় বোধ কাজ করছে না। চরম জিঘাংসা হিসেবে তারা খুন-ধর্ষনের মত জঘন্য পথ বেছে নেয়। সমাজে যারা অসহায় যারা অবহেলিত তাদের ওপর নির্যাতন চালানো হচ্ছে। সামাজিক নিরাপত্তার চেইন অব কমান্ড ফিরিয়ে আনতে হলে আইনের শাসনের কোনো বিকল্প নেই।
এখন আমাদের চারিদিকে মানুষের মাঝে যে অস্তিরতা চলছে সেটারই একটা প্রভাব পড়ছে সমাজে, পরিবারে। ফলে মানুষ যেকোনো অপরাধ করতে পারে এবং তা থেকে ক্ষমতার প্রভাব খাটিয়ে পার পেয়েও যেতে পারবে - এরকম একটা বিশ্বাস যারা চালাক-চতুর তাদের মধ্যে চলে এসেছে। চুরি-চামারি, ছিনতাই করে রক্ষা পাওয়া যায়, দুর্নীতি করে সহজেই বিত্ত-বৈভবের মালিক হওয়া যায়, যখন এসব লোভ পেয়ে বসে তখন বিবেকবোধ থাকে না। ঠিক তখনই ভাইয়ের হাতে বোন, সন্তানের হাতে পিতা হত্যার মতো ঘটনা ঘটে, সমাজে নানা অনাচার বেড়ে যায়। সমাজের যে শৃঙ্খলা তা আর থাকে না। এজন্য বর্তমানে সমাজের শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনতে হলে রাষ্ট্রকে সমাজের এসব বিষয়ে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিতে হবে।আর সবাইকে শুধু নৈতিক শিক্ষার কথা মুখে মুখে আদেশ করলে বা বললে হবে না, সমাজের সকল ক্ষেত্রে,সবার জন্য এর বাস্তবায়নও জরুরি। তার সাথে সাথে গুরুত্ব দিতে হবে ধর্মীয় রীতি-নীতি মেনে চলার ।আর এ সকল কাজ যার যার পরিবার থেকে শুরু করতে হবে ।কারন পরিবারই মানুষের নৈতিক শিক্ষার প্রাণকেন্দ্র।
** তথ্য উৎস :- দৈনিক সংবাদপত্র।
সর্বশেষ এডিট : ৩১ শে জানুয়ারি, ২০২১ দুপুর ১:০৭