লেখক মুহম্মদ জাফর ইকবাল ।
জাফর ইকবাল সারের জন্ম , ১৯৫২ সালের ২৩ ডিসেম্বর তারিখে সিলেটে। তার পিতা মুক্তিযোদ্ধা শহীদ ফয়জুর রহমান আহমদ এবং মা আয়েশা আখতার খাতুন। বাবা ফয়জুর রহমান আহমদের পুলিশের চাকরির সুবাদে তার ছোটবেলা কেটেছে বাংলাদেশের বিভিন্ন জায়গায়। মুহম্মদ জাফর ইকবালের নাম আগে ছিল বাবুল। পিতা লেখালেখির চর্চা করতেন এবং পরিবারের এই সাহিত্যমনস্ক আবহাওয়ায় জাফর ইকবাল খুব অল্প বয়স থেকেই লিখতে শুরু করেন। এটিকেই তিনি তার সহজ ভাষায় লিখতে পারার গুণের কারণ বলে মনে করেন। তিনি তার প্রথম বিজ্ঞান কল্পকাহিনী লেখেন সাত বছর বয়সে। ১৯৭১ সালের ৫ মে পাকিস্তানী আর্মি এক নদীর ধারে তার দেশপ্রেমিক পিতাকে গুলি করে হত্যা করে। বিশ্ববিদ্যালয়-পড়ুয়া জাফর ইকবালকে পিতার কবর খুঁড়ে তার মাকে স্বামীর মৃত্যুর ব্যাপারটি বিশ্বাস করাতে হয়েছিল। আমেরিকাতে পড়ার সময় তিনি তার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সহপাঠী ইয়াসমিন হকের সাথে বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হন। ড. ইয়াসমিন হক শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে পদার্থবিজ্ঞান বিভাগে শিক্ষকতা করছেন। ১৯৯৪ সালে তিনি আমেরিকা ছেড়ে দেশে ফিরে আসেন। তাঁর দুই সন্তান - বড় ছেলে নাবিল ইকবাল যুক্তরাষ্ট্রের কর্ণেল বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পদার্থবিজ্ঞান ও গণিতে স্নাতক সম্পন্ন করে বর্তমানে যুক্তরাষ্ট্রের ম্যাসাচুসেটস ইনস্টিটিউট অব টেকনলজিতে পদার্থবিজ্ঞানে পিএইচডি করছেন এবং কন্যা ইয়েশিম ইকবাল কর্ণেল বিশ্ববিদ্যালয়ে স্নাতক সম্পন্ন করে হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে মনোবিজ্ঞানে পিএইচডি করছেন। ইয়েশিম ইকবাল তার কিশোর উপন্যাস আমার বন্ধু রাশেদ ইংরেজিতে রূপান্তর করেছেন Rashed, my friend নামে । (সংক্ষিপ্ত)
কেপলার টুটুবি
সবাই এবার ঘুরে টুরানের দিকে তাকাল, সুহা বলল, ‘বলো।’
টুরান বলল, ‘তোমাদের মনে আছে, আমরা যখন মহাকাশযানে করে আমাদের যাত্রা ঠিক শুরু করতে যাচ্ছিলাম, ঠিক তখন ইহিতা আমাদের সবার সঙ্গে একবার কথা বলতে চাইছিল?’
সবাই মাথা নাড়ল। টুরান বলল, ‘আমি একধরনের গোয়ার্তুমি করে ইহিতাকে কথা বলতে দিইনি। তার সঙ্গে খুব খারাপ ব্যবহার করেছিলাম। অপমানসূচক কথা বলেছিলাম।’
ইহিতা নিচু গলায় বলল, ‘তুমি এমন কিছু অপমানসূচক কথা বলোনি।’
‘বলেছিলাম। আমার খুব কাছাকাছি থাকা একটি মেয়ে আমাকে ছেড়ে চলে গিয়েছিল, সেই থেকে আমি পুরোপুরি নারী জাতির বিদ্বেষী হয়ে গিয়েছিলাম, কোনো মেয়েকে সহ্যই করতে পারতাম না—কোনো মেয়ের কথাও শুনতে চাইতাম না। বিষয়টা খুবই বড় নির্বুদ্ধিতা হয়েছিল।’
কেউ কোনো কথা না বলে নিঃশব্দে টুরানের দিকে তাকিয়ে বোঝার চেষ্টা করল সে কী বলতে চাইছে।
‘ইহিতা তখন যে কথাগুলো বলতে চাইছিল, আমি এখন তোমাদের সঙ্গে সেই কথাগুলো বলতে চাই।’
টর জিজ্ঞেস করল, ‘সেই কথাগুলো কী?’
‘আমরা সাতজন মানুষ অত্যন্ত বিপজ্জনক একটা পথ পাড়ি দিচ্ছি, এইমাত্র একটা খুব বড় বিপদ থেকে উদ্ধার পেয়েছি। সামনে পাব কি না জানি না। বিপদ আসবে সে বিষয়ে বিন্দুমাত্র সন্দেহ নেই। এ রকম অসম্ভব বিপজ্জনক অবস্থা হলে খুব দ্রুত সিদ্ধান্ত নিতে হয়—সব সময় সবচেয়ে ভালো সিদ্ধান্তটি নেওয়া যায় না—তার সময় থাকে না। তখন খুব দ্রুত মোটামুটি সঠিক একটা সিদ্ধান্ত নিতে হয়। সেটা খুবই জরুরি।’
টর বলল, ‘আমি এখনো বুঝতে পারছি না, তুমি কী বলতে চাইছ!’
‘তুমি বুঝতে পারছ না কারণ, আমি এখনো কথাটি বলিনি।’
‘তাড়াতাড়ি বলে ফেল।’
টুরান বলল, ‘আমি যদি ঠিক করে অনুমান করে থাকি, তাহলে ইহিতা আমাদের বলতে চেয়েছিল, মানুষের একটা দল হিসেবে আমাদের একটা দলপতি থাকা দরকার। যে দ্রুত সিদ্ধান্ত নিতে পারে। শুধু তা-ই না, দলপতিকে মেনে নিলে আমরা সবাই তার সিদ্ধান্তটি কোনোরকম প্রশ্ন না করে মেনে নিতে পারব।’
টুরান একটু থামল এবং সবাই তার দিকে তাকিয়ে রইল। সে সবার দিকে চোখ বুলিয়ে বলল, ‘এই মুহূর্তে আমাদের একজন দলপতি দরকার। আমি দলপতি হিসেবে ইহিতার নাম প্রস্তাব করছি। একটু আগে ইহিতা আমাদের যে কথাগুলো বলেছে, তার প্রত্যেকটি কথা সত্যি বের হয়েছে। সে আমাদের ভয়ংকর বিপদে নিজে থেকে নেতৃত্ব দিয়েছে।’
টর বলল, ‘আমাদের মাঝে দুজন রবোমানব আছে, তুমি কেমন করে জানো ইহিতা একজন রবোমানব না?’
টুরান থতমত খেয়ে বলল, ‘সেটা আমি জানি না। কেউই জানে না।’
নুট একটু এগিয়ে এসে বলল, ‘আমি জানি, ইহিতা রবোমানব না।’
টর মাথা ঘুরিয়ে নুটের দিকে তাকিয়ে বলল, ‘তুমি জানো না। তুমি অনুমান করছ।’
নুট বলল, ‘না। আমি জানি। আমার টুরানের প্রস্তাবটা খুব পছন্দ হয়েছে। আমিও ইহিতাকে আমাদের দলপতি হিসেবে গ্রহণ করছি।’
নীহা বলল, ‘আমিও।’
সুহা বলল, ‘আমিও তাকে দলপতি হিসেবে চাই।’
ক্লদ সবার মুখের দিকে তাকিয়ে আলাপটা বোঝার চেষ্টা করল। সে এমনিতে খুবই ছটফটে ছেলে, কিন্তু একটু আগে এত কাছে থেকে তেজস্ক্রিয় প্রাণীগুলো দেখার পর থেকে সে হঠাৎ করে চুপ হয়ে গেছে। সে কিছুক্ষণ ইহিতার দিকে তাকিয়ে বলল, ‘আমিও চাই।’
টর বলল, ‘তার মানে বাকি রয়েছি শুধু আমি?’
কেউ কোনো কথা বলল না। টর বলল, ‘আমার অবশ্যি কোনো পথ বাকি থাকল না। আমাকেও মেনে নিতে হচ্ছে।’
টুরান বলল, ‘চমৎকার।’
ইহিতা বলল, ‘আমার এখনো বিশ্বাস হচ্ছে না, মঙ্গল গ্রহের এই পাহাড়ের নিচে, এই ধূলিঝড়ের মাঝে, তেজস্ক্রিয় প্রাণীদের আনাগোনার মাঝে আমরা বসে বসে একটা নাটক করছি! কিন্তু আমি এ নিয়ে তর্কবিতর্ক করব না। সময় খুব মূল্যবান। আমি সময়টা বাঁচাতে চাই। আমাকে যেহেতু দলপতির দায়িত্ব দিয়েছে, আমি সেই দায়িত্ব নিচ্ছি—শুধু এই বিপজ্জনক পথের অংশটুকুতে। যদি ঠিকভাবে মানুষের আবাসস্থলে পৌঁছাতে পারি, তখন অন্য কাউকে দায়িত্ব নিতে হবে।’
‘সেটি তখন দেখা যাবে।’ টুরান বলল, ‘তা ছাড়া আমরা একটি খেলার টিম তৈরি করছি না যে একেক খেলায় একেকজন দলপতি হবে।’
ইহিতা বলল, ‘সেই আলোচনা থাকুক। তোমরা সবাই এখনই রওনা দাও। দ্রুত আমি আসছি।’
নীহা জিজ্ঞেস করল, ‘তুমি কোথা থেকে আসছ?’
‘সেটা নিয়ে দুশ্চিন্তা করো না। সবাই হাঁটতে শুরু করো।’
সবাই হাঁটতে হাঁটতে দেখল, ইহিতা পিঠ থেকে তার ব্যাকপেক নামিয়ে মাটিতে উবু হয়ে কিছু একটা করছে। কী করছে কেউ অনুমান করতে পারল না।
ইহিতা তার কাজ শেষ করে একটু জোরে হেঁটে ছোট দলটির সঙ্গে যোগ দিল। টর জিজ্ঞেস করল, ‘কাজ শেষ হয়েছে?’
‘হ্যাঁ হয়েছে।’
টর আশা করছিল, ইহিতা বলবে, সে কী করেছে, ইহিতা বলল না। তখন টর নিজেই জিজ্ঞেস করল, ‘তুমি পেছনে কী করে এসেছ?’
‘এমন কিছু নয়।’
‘তার মানে তুমি আমাদের বলতে চাইছ না?’
‘না।’
‘কেন?’
‘টর, তোমার একটা বিষয় বুঝতে হবে। তোমরা আমাকে তোমাদের দলপতি বানিয়েছ, এখন আমার ওপর কিছু বাড়তি দায়িত্ব এসে পড়েছে। শুধু আমাকে বেঁচে থাকলে হবে না—তোমাদেরও বাঁচিয়ে রাখতে হবে। সে জন্য আমাকে কিছু বাড়তি কাজ করতে হবে। আমি সেটা করছি। যখন তোমাদের এটা জানার প্রয়োজন হবে, আমি তোমাদের জানাব।’
টর কিছু বলল না, ইহিতার কথাটা তার খুব পছন্দ হলো বলে মনে হয় না।
ছোট দলটি চার ঘণ্টা হাঁটার পর ইহিতা বলল, ‘আমরা এখন বিশ্রাম নেব।’ নীহা বলল, ‘তোমার এই অসাধারণ সিদ্ধান্তের জন্য অনেক ধন্যবাদ ইহিতা। আমি ভেবেছিলাম তুমি আর কোনো দিন বুঝি একটু বিশ্রাম নেওয়ার কথা বলবে না।’
ইহিতা বলল, ‘শক্তি থাকতে থাকতে আমি যতটুকু সম্ভব পথ অতিক্রম করে ফেলতে চাইছিলাম।’
ক্লদ ক্লান্ত হয়ে ঘুমিয়ে পড়েছিল, টুরান এতক্ষণ তাকে ট্রান্সপোর্টারে শুইয়ে এনেছে, এবারে তাকে নিচে শুইয়ে দিয়ে বলল, ‘ভাগ্যিস, মঙ্গল গ্রহে মাধ্যাকর্ষণ বল অনেক কম, তা না হলে ক্লদকে নিয়ে যাওয়া কঠিন হয়ে যেত।’
সুহা টুরানের হাত স্পর্শ করে বলল, ‘আমি যে তোমাকে কী বলে ধন্যবাদ দেব বুঝতে পারছি না! কতটুকু পথ ক্লদকে ট্রান্সপোর্টারে করে এনেছ!’
টুরান পাথরে পা ছড়িয়ে বসে বলল, ‘ধন্যবাদ দেওয়ার তুমি আরও ভালো সুযোগ পাবে—এবারে খানিকক্ষণ বিশ্রাম নিয়ে নেওয়া যাক।’
ইহিতা বলল, ‘সবাইকে মনে করিয়ে দিই—এবার যখন রওনা দেব, তখন কিন্তু আর থামাথামি নেই। রওনা দেওয়ার আগে সবাই খানিকটা স্নায়ু-উত্তেজক পানীয় খেয়ে নিয়ো। তাহলে খিদেও পাবে না, ক্লান্তও হবে না। ঘুমাতেও হবে না।’
নীহা বলল, ‘যখন রওনা দেব, তখন সেটা দেখা যাবে। এই মুহূর্তে আমার ঘুমে চোখ বন্ধ হয়ে আসছে। আমি একটু ঘুমাই, যখন রওনা দেবে তখন ডেকে তুলো।’
সুহা বলল, ‘তুমি নিশ্চিন্ত মনে ঘুমাও। তোমাকে দেখে আমার হিংসা হচ্ছে।’
‘কেন? হিংসা হচ্ছে কেন?’
‘এ রকম একটা পরিবেশে যার ঘুম পায়, তাকে দেখে হিংসা হতেই পারে!’
নীহা চোখ বন্ধ করতে করতে বলল, ‘তোমাকে কুগুরাভ সমস্যাটা শিখিয়ে দেব—তার সমাধানের কথা চিন্তা করতে করতে ঘুমিয়ে যাওয়ার মতো আনন্দ আর কিছুতেই নেই!’ (অসমাপ্ত-সংগ্রহীত)
বইটির গায়ের মূল্যঃ ২০৫ টাকা (আপনার হাতের কাছে যেকোন বুক শপে পেতে পারেন)
ইবুক আকারে ফ্রি পাবেন এখানে
ধন্যবাদ।
সর্বশেষ এডিট : ১০ ই অক্টোবর, ২০১৬ বিকাল ৫:৫৫