করিমনের এটি চতুর্থ সন্তান পেটে, প্রায় ৮ মাসের শেষের দিকে। ভ্যান চালক হারুনের যা আয় তা দিয়ে এতোগুলো পেটের আহার জোটানোই কষ্ট সেখানে গর্ভবতী বউ এর বাড়তি খাবার জোগাড় কোনভাবেই সম্ভব নয়। হাড়জিরজিরে করিমনের এ নিয়ে চাহিদা থাকলেও থাকতে পারে কিন্তু কোন দু:খবোধ নেই।
গত তিনদিন ধরে তলপেটের ব্যাথার সাথে সন্তানটি পৃথিবীতে আসার জন্য আগমনী বার্তা জানান দিতে থাকে। হারুনকে বলতেই কোন গুড়ুত্ব দিল না। বললো, ময়নার মা আয়াতো আছেই। আগের ছাওয়ালগুলাতো তার হাতেই হইছে, এ নিয়ে প্যারেশানীর কিছু নাই। এই বলে অভয় দিল করিমনকে। কিন্তু করিমন বুঝতে পারলো এবারের ব্যাথা অন্যরকম। একটু পরপর তলপেটে খুব ঘাই দিতে থাকে। পুরুষমানুষ হারুন জানে না এ ব্যাথার কি কষ্ট, একটু সহ্য করো বলেই দায়িত্ব পালন শেষ করে হারুন।
সকাল থেকেই এ ব্যাথা বাড়ার সাথে সাথে পানি ভাঙ্গতে থাকে করিমনের। উপায় না দেখে ময়নার মাকে ডাকতে যায় হারুন। কিন্তু সব দেখে ময়নার মা জানায় এ তার সাধ্যের বাইরে। কারন পেটের পানি ভাঙ্গছে কিন্তু বাচ্চা নীচে নামছে না। তাকে তাড়াতাড়ি হাসপাতালে নেবার পরামর্শ দিল ময়নার মা। করোনায় সব যাতায়াত বন্ধ থাকায় কোনভাবেই কোন ট্রান্সপোর্টের ব্যবস্থা করতে না পেরে আট বছরের বড় মেয়েটিকে নিয়ে নিজের ভ্যান নিয়েই রওনা দিল হারুন।
দীর্ঘ ছয় ঘন্টা ভ্যান চালিয়ে হাসপাতালের কাছাকাছি পৈাছানোর আগেই একটি মৃত সন্তান প্রসব করে করিমন। করিমনের ব্যাথার চিৎকার, আট বছরের বড় মেয়েটির কান্না আর হারুনের আহাজারিতে চারপাশ থেকে ছুটে আসে মানুষ। কিছু মানুষের সহায়তায় তাকে পৈাছে দেয় হাসপাতালে। এরই মাঝে দেখা যায় একজন স্থানীয় রিপোর্টারকে। দারুন একটি মর্মশ্পর্শী গল্পের মাল মসলা পেয়ে দ্রুতই লিখে পাঠায় হেড অফিসে।
হাসপাতালে তখন ডিউটি ডাক্তার রেখা। তার সাধ্যমত প্রাথমিক চিকিৎসা দেবার পর বুঝতে পারলো সদ্যপ্রসূত মা'কে বাচাঁনোর মতো জ্ঞান তার নেই। সে কল দিলো বিভাগীয় প্রধান কে। গাইনী বিভাগের বিভাগীয় প্রধান ডা: রাহেলা মাত্রই ডিউটি শেষ করে বাসায় রওনা দিচ্ছিল। খবর পেয়েই দৈাড়ে ফিরে আসে ও এ্যাটেন্ড করে রোগীকে। প্রয়োজনীয় সব ব্যাবস্থা নেবার পর রোগীর অবস্থা যখন স্টাবল হলো তখন বাকিদের সব বুঝিয়ে দিয়ে হাসপাতাল ছাড়েন ডা: রাহেলা।
পরদিন হাপাতালে ওয়ার্ড ডিউটির মাঝে প্রিন্সিপাল স্যার ডেকে পাঠায় ডা: রাহেলাকে, মিনিস্ট্রি থেকে কল করে খুজঁছে তাকে। একটু অবাক হলেও ফোন ধরে রাহেলা। তীর্যক ভাষায় আক্রমন করে জানতে চায় কেন রোগীকে ফিরিয়ে দিয়েছে সে, যার কারনে পথেই বাচ্চা প্রসবে বাধ্য হয়। কোন রোগী, কেন, কোথায় কিছুই বুঝতে না পেরে অবাক হয়ে কথা খুঁজতে লাগলো রাহেলা। তাড়াতাড়ি প্রিন্সিপাল সাহেব ফোনটি ধরে কোনরকমে বিষয়টি দেখবেন বলে সামাল দিলেন তৎক্ষনাত।
ফোনটি রেখেই পত্রিকা খুজঁতে লাগলেন প্রিন্সিপাল সাহেব। হাঁ, খুজে পেলেন খবরটি.....
"করোনা সন্দেহে হাসপাতাল থেকে ফিরিয়ে দেয়া হয় গর্ভবতীকে, তাই পথেই মৃত বাচ্চা প্রসব।"
............................
উপরের লিখাটি সত্য ঘটনার উপর ভিত্তি করেই লিখা। তবে কিছু প্রশ্ন সবার কাছে...
১) একজন সাংবাদিক তার পত্রিকার কাটতি বাড়ানোর জন্য মিথ্যে সংবাদ বা রং লাগিয়ে সংবাদ পরিবেশন কতটুকু নৈতিক?
২) নৈতিকতা, সেবা, মানবতা এসব কঠিন কঠিন শব্দের একমাত্র সোল এজেন্ট কি শুধু ডাক্তাররা? নেতা, সাংবাদিক সহ বাকি সবার জন্য বড্ড সেকেলে কি?
৩) একজন ডাক্তারের কি পরিবার থাকতে পারে না বা নিজের অসুস্থতা? তাদেরকে কি করোনা সালাম জানায়. আক্রান্ত করে না?
৪) একজন ডাক্তার কি পরিমান পরিশ্রম করে তা কি আপনারা জানেন? নিজের পরিবারকে কতটুকু সময় দেয় তারা তার কতটুকু খোঁজ রাখেন আপনারা?
৫) হয়তো কিছু কসাই ডাক্তার অবশ্যই আছে। যারা নিজেদেরকে টাকার মেশিন বানিয়েছে। কিন্তু এ স্বল্প সংখ্যক কসাই ছাড়াও কি কোন ভালো ডাক্তার এর দেখা আপনার পান নাই? নিজেকে প্রশ্ন করুন?
একজন ডা: তুষার ডাক্তারদের নিরাপত্তায় পিপিই কথা বলাতে আজকে তাঁকে নিয়ে ট্রোল করছেন, হুমকি দিচ্ছেন। একবারও কি ভেবে দেখেছেন তারা অসুস্থ হলে আপনার সেবা কে করবে? বড় বড় নেতারা না হয় বুঝলাম সিঙ্গাপুর যাবে, মাদ্রাজ যাবে কিন্তু আপনি কি করবেন? এ কসাই ডা: তুষারই আপনাকে ভালো করবে, তারাই আপনার ও আপনার প্রিয়জনের জীবন বাচাঁতে লড়ে যাবে।
সারা বিশ্বে আজ ডাক্তারদেরকে হিরোর মর্যাদা দিচ্ছে আর তার বিপরিতে আমরা তাদেরকে অপদস্থ করার জন্য আমরা মুখিয়ে আছি। রচনা করে চলছি আধা সত্য গল্প। অবশ্য এ নৈতিকতা বা আদর্শ সাংবাদিকদের কাছে জানতে চাওয়াও আমার কাছে হাস্যকরই মনে হয়। কারন অনেক পেশার মতো সাংবাদিক পেশাও এখন একটি আদর্শবিহীন পেশা!
আমার পরিবারের সবাই এ ডাক্তারী পেশায় আছে বিধায় আমি জানি কি অমানুষিক পরিশ্রম করে যাচ্ছে তারা। দিন নেই রাত নেই, পরিবার নেই, কাজ করে যাচ্ছে। এমন কি নিজের টাকায় পিপিই কিনেই কাজ শুরু করেছিল তারা। তারপরও আপনাদের খুশি করা যায় না। আপনারা কি চান একটু বলবেন কি??
শুভ বুদ্ধির উদয় হোক সবার! ভালো থাকুন, গৃহে থাকুন, সুস্থ থাকুন।
সর্বশেষ এডিট : ২৬ শে সেপ্টেম্বর, ২০২০ ভোর ৫:৪৪