ছবির এ চমৎকার ছেলেটির নাম মিনহাজ জামান। কানাডার প্রথম সারির ইউনিভার্সিটি ইয়র্কের ইন্জিনিয়ারিং এর ছাত্র ছিল। এখানে বলে রাখা ভালো কানাডার কোন ইউনিভার্সিটিতে ভর্তি হওয়া খুব সোজা ব্যাপার নয়। শুধু ভালো রেজাল্ট থাকলেই হবে না, তাকে হতে হবে সব কিছুতে চৈাকশ। এবং এর সব শর্ত পূরণ করেই ছেলেটি ইউনিভার্সিটিতে ভর্তির সুযোগ পায়। বাবা মা ছেলেটির ভর্তির সুযোগের পর বাসায় বিশাল পার্টির আয়োজন করে। তাদের আনন্দ সবার সাথে ভাগাভাগি করে নিয়েছিল।
এক বোন আর সাথে দাদীকে নিয়ে চমৎকার একটি সুখী পরিবার। অভিবাসী পরিবারের সেকেন্ড জেনারেশানের সন্তান তাই বাবা মায়ের সকল স্ট্রাগলের কিংবা সকল কষ্টের সমাধান চেয়েছিল ছেলে মেয়েকে প্রতিষ্ঠার মাঝে। ছেলের এ সাফল্যে বরাবরেই গর্বিত ছিল বাবা মা। তাই যখনই নতুন কারো সাথে পরিচয় হতো গর্বভরে ছেলের সাফল্যের গল্প শোনাতো।
এ বছরই ছেলেটির ইউনিভার্সিটি থেকে গ্রাজুয়েশান করার কথা। বাবা মা অধীর আগ্রহে দিন গুনছে কবে তারা গ্রাজুয়েশান পার্টিতে যাবে আর ছেলের গ্রাজুয়েশান ইউনিফর্মের সাথে ছবি তুলবে। ইউনিভার্সিটিতে ভর্তির পর ছেলেটির মাঝে অনেক পরিবর্তন আসে। ছেলে একা একাই রুমে পড়াশুনা করতে চায় ডোর ক্লোজ করে। কোথাও যেতে চায় না, কারো সাথে মিশতে চায় না। তাই তারা কেউই ছেলেটিকে কোনভাবেই ডিস্টার্ব করে না। তাকে তার মতো থাকতে দেয়।
২৯ জুলাই, ২০১৯ কানাডার পুলিশের কাছে একটি অনলাইন গেইম পোর্টাল ( Discord forum “Perfect World Void”) থেকে কল আসে যে তাদের একজন এ্যাক্টভি প্লেয়ার বেশ কিছু ছবি পোস্ট করেছে তাদের পোর্টালে। সেখানে সে রক্তাক্ত ছুরি হাতে এবং নিজের পরিবারের সদস্যদের খুন করেছে বলে দাবী করে। এবং তার নীচে ম্যাসেজে লিখে যে, “I don’t want my parents to feel the shame of having a son like me.”
কানাডা পুলিশ দ্রুত ছেলেটির এ্যাড্রেস বের করে বাসায় হানা দেয় এবং উদ্ধার করে বাবা মা বোন দাদীর রক্তাত লাশ। নিজেই হত্যার দায় স্বীকার করে পুলিশের কাছে মেহনাজ। কেন এমন করেছে তার উত্তরে সে জানায়;
গেমের নেশায় আসক্ত হয়ে পড়েছিল। যার ফলে প্রথম বর্ষেই ফেল করে সে। কিন্তু লজ্জায় বাবা মা সহ কাউকেই জানাতে পারেনি। এবং এর থেকে বের হবারও চেস্টা করেনি। তারপর দিনের পর দিন বাবা মাকে মিথ্যে বলে আসছিল। ক্লাসের কথা বলে শপিং মলে ঘুরে বেড়াতো আর গেইম খেলতো। কিন্তু যখন গ্রাজুয়েশানের সময় আসলো ও বাবা মা তার রেজাল্ট ও অনুষ্ঠানের ডেইট জানতে চাইলো তখন সে এ লজ্জার হাত থেকে বাচাঁর জন্য এ খুনের পরিকল্পনা করে।
-
-
-
এবার আমার পাঠকদের উদ্দেশ্যে বলছি, এর থেকে আমরা বা আমি অনেক কিছু শিক্ষা নিয়েছি কি?
১) আমাদেরকে কি সন্তানদেরকে সবসময়ই নজরে রাখা উচিত নয় কি? ওরা কি করছে, কি পড়ছে, ওদের মানসিকতা, ওদের কষ্ট, দু:খ, ভালোলাগা, মন্দলাগার খোঁজ রাখি কি?
২) ওদেরকে স্বাধীনতা দেয়া উচিত, কিন্তু তা কতটুকু? তা নিয়ে হিসেব করা উচিত নয় কি?
৩) সন্তানের সাফল্য যেমন উদযাপন করা উচিত তেমনি ব্যার্থতাও মেনে নেয়া উচিত নয় কি? ওদের উপর নিজের প্রত্যাশার পাহাড় চাপানো উচিত কি?
৪) অনলাইন গেইম নামের এ অভিশাপ যেন আপনার আমার সন্তানকে গ্রাস না করে তার দিকে নজর দেয়া উচিত কি? (ব্যাক্তিগতভাবে আমি কোনভাবেই অনলাইন গেইম পছন্দ করি না। এটা আপনার জীবনকে ধ্বংস করে দিতে পারে..... সে গল্প আরেকদিন)
৫) সন্তানের সাথে কঠোর টিচার নয়, শুধু অভিবাবক নয়, বন্ধুত্বমূলক সম্পর্ক গড়ে তোলা উচিত; পরিবারই তার আশ্রয়ের স্থান হিসেবে গড়ে তোলা উচিত; তাই নয় কি?
৬) প্রতিদিনের কতটুকু সময় আমরা বরাদ্দ করি সন্তানদের জন্য, তার হিসেব রাখি কি?
-
-
প্রায় এক বছর হয়ে যাচ্ছে এ ঘটনার। এখনো আমি মনে করি সুন্দর মুখগুলি। আর ভীষন মন খারাপ করি। এ পরিবারটি বাস ছিল আমার বাসার খুব কাছে, যদিও ব্যাক্তিগতভাবে চিনতাম না। তারপর আর দশটা বাংলাদেশী পরিবারের মতোই পরিপূর্ণ পরিবার ছিল।
সর্বশেষ এডিট : ২১ শে জুলাই, ২০২০ সন্ধ্যা ৭:৩২