কিরপিন মা হাসান ভাই দেখি বহুদিন নিখোঁজ। বহুত টেনশানে আছি, কিরপিনগিরি করতে যাইয়া কই হারাইলো। আশা করি কিরপিনগিরির সানডে মানডে কইরা তাড়াতাড়িই ফিরা আসবেন। যাহোক, উনার অনুপস্থিতিতে কিরপিন পোস্ট মিস করছি তাই আমার দেখা কিছু কিরপিনের কিরপিনগিরি নিয়া আসলাম এবার ।
আমি তখন চাকরী করতাম একটা ইর্ন্টান্যাশনাল প্রতিষ্ঠানে। আমার মাথার উপর ছিল একজন ইন্টারন্যাশানাল বস্। যিনি প্রতিবেশী দেশের একজন। তো সেই ভদ্রলোকের মাসিক বেতন ছিল প্রায় ১০ লাখ টাকা। জ্বী, হার্টফেল করার কোন কারন নাই ব্লগবাসী। বাংলাদেশে এরকম ১০ লাখ টাকা মাসিক বেতনে অনেক অপদার্থ পোষা হয়। প্রায় তিন বছর তার সাথে কাজ করেছিলাম। এ বছর তিনেকে সে আমার জীবন সহ প্রজেক্টের বারোটা বাজিয়ে ছেড়েছিল। যতদিন এ দেশে ছিল তাকে দেখেছি সকাল থেকে রাত পর্যন্ত আমাদের দেশের বদনাম করতে। আর আমাদের দেশের কিভাবে বাঁশ দেয়া যায় তা নিয়ে বিস্তর গবেষনা নিয়ে ব্যাস্ত থাকতে। যাহোক, তার কিছু দৈনন্দিন গাল-গপ্প নিয়ে আমার আজকের পোস্ট।
তার ফানি সব কাজের মাঝে আমার সবচেয়ে সবচেয়ে মজা লাগতো যখন পিয়নের সাথে ২ টাকা ৮০ পয়সা নিয়া আশি মিনিট ঝগড়া করতো। বিষয়টা এরকম, ভদ্রলোক প্রায় রিক্সা করে অফিসে এসে ভাংতি নাই অজুহাতে দাড়োয়ান পিয়ন সবার কাছ থেকে টাকা ধার নিতেন। তারপর সে টাকা দেবার কথা বেমালুম ভুলে যেতেন। যার কারনে উনাকে রিক্সা দিয়ে আসতে দেখলেই দাড়োয়ানরা গেইট ছেড়ে পালাতো। সে একটা দেখার মতো দৃশ্য হতো। আমার দোতালা জানালা বরাবর গেইট দেখা যেত। যখনই দেখতাম দায়োনরা ভো দৈাড় দিচ্ছে তখনই বুঝতাম বস আইসা পড়ছে।
দাড়োয়ানকে না পেলে ভদ্রলোক সোজা অফিসরুমে ঢুকেই বেল টিপে পিয়নকে বলতো রিক্সাওয়ালাকে টাকা দিয়ে আসতো। প্রথম দিকে হয়তো কিছু দিতো বেচারা পিয়ন কিন্তু পরে সে চালাক হয়ে যায়। মুখের উপর টাকা নাই বলে দিব্বি দাড়িয়ে থাকতো। তখন বস সাহেব তার পকেট চেক করতে চাইতো। আর পিয়ন তার পকেটের সব খুচরা একসাথ করে টেবিলে রাখতো। আর ভাঙ্গা ভাঙ্গা ইংরেজি হিন্দি মিশিয়ে বলতে থাকতো "খুচরা নেহি হায়, নো টাকা পয়সা। সব খরচ হো গিয়া"। এ দৃশ্য ছিল এক দেখার মতো। আমি ফ্রি তে সিনেমা দেখতাম আর নিজের মতো করে হাসতাম।
যখন পিয়ন থেকে কিছু খসাতে পারতো না তখন বলতো, যাও অফিসের অন্য যাও কারো কাছ থেকে নিয়ে আসো। এর পর থেকে পিয়ন বেচারা আমাদের যাকেই সামনে পেতো তার থেকে টাকা চাইতো। এভাবে জনে জনে টাকা খোঁজা আর নীচ থেকে রিক্সাওয়ালার চেঁচামেচি....। আরেকটা নতুন দৃশ্যের স্যুটিং।
কিন্তু আমার দশ লাখ টাকা বেতনের বস সে টাকা শোধ দিতে বেমালুম ভুলে যেত। এবং এ নিয়ে তুমুল ঝগড়া চলতো তাদের মাঝে। পিয়ন সাহেবও ছেড়ে দেবার বান্দা ছিল না কোনভাবে! হিসাব নিকাশ নিয়ে বসে পড়তো। আর এ টাকার হিসাব রাখার জন্য সে রীতিমত নোটবই পকেটে নিয়ে ঘুরতো।
যাহোক, তো বস একবার আমারে বললো, তোমাদের দেশের কেকের স্বাদ এতো খারাপ। প্রতি কামড়ে বালি দাঁতে লাগে।
আমি খুব অবাক হলে বল্লাম, সারা বিশ্বের বেস্ট কেক আমরা বানাই। একবার খেলে নাম ভুলে যেতে হয়। তা তুমি কোথা থেকে কেক কিনেছো?
সে উত্তর দিলো, ওই যে রাস্তার পাশের ঠেলাওয়ালারা যে কেক নিয়ে বসে থাকে সেখান থেকে।
আমার হার্টফেল অবস্থা। অনেক কষ্টে সামলে বল্লাম, ওইখানেতো আমাদের রিক্সাওয়ালারা বসে চা সিগারেট আর কেক খায়। সেটা একান্তই তাদের উপযোগী করে সস্তায় বানানো। তুমি আর কোথাও থেকে কেক খাও নাই?
সে বললো, না। আমি বাংলাদেশ থেকে কিছু কিনি না। দুই মাসে একবার ইন্ডিয়া যাই আর আসার সময় চাল ডাল তেল পেয়াজ আদা রসুন থেকে শুরু করে তার যাবতীয় দুই মাসের বাজার করে আনি। কিন্তু নাস্তার আইটেম শেষ হয়ে যাওয়াতে বাধ্য হয়ে কেক কিনলাম।
শুনে আমার আবেগে দু'চোখে পানি এসে গেল। আহারে, এমন গরীব মানুষ, দশ লাখ টাকা বেতনেও তার হয় না। ফুটপাথ থেইকা কেক কিনে খায়।
যাক ভাবলাম ব্যটা আমার দেশের এভাবে বদনাম হয়ে যাচ্ছে তাই তারে ভালো কিছু কেক খাওয়াই। তাই একদিন কুপার ও মি: বেকার থেকে কিছু কেক কিনে তার জন্য নিয়ে গেলাম। সেটা খেয়ে খুব অবাক হয়ে বললো, আরে এতো দেখি অসাধারন! কেমন দাম নিলো?
কেকের দাম শুনে তার এবার হার্টফেইল করার অবস্থা। বললো, ও নো, ইটস্ ভেরী এক্সপেন্সিভ। আই কেন্ট বিয়ার!
আমি ভাষা হারায়ে ফেল্লাম তার গরীবানা শুইনা।
যতদিন আমাদের সাথে ছিল কোনদিনই তাকে একটা পয়সাও দেশে খরচ করতে দেখি নাই। অফিসের কোন প্রোগ্রামে চাঁদা দেবার কথা শুনলে সে পালিয়ে বেড়াতো। কিন্তু খাবার সময় ঠিকই হাজির হতো। এবং অনুষ্ঠান শেষে কোন খাবার বাঁচলো কিনা তার হিসাব নিয়ে প্যাকেট করতো। তার এ হামলে পরার দৃশ্য ছিল দেখার মতো।
সে যে এ দেশে একটা টাকাও খরচ করে না তা নিয়ে বেশ গর্ব করে বলতো।
একবার তাকে জিজ্ঞাসা করলাম কেন সে এরকম বাজার মাথায় করে আনে ইন্ডিয়া থেকে। সে উল্টা অবাক হয়ে আমাকে হিসাব দিলো এ দুই মাসে সে কত টাকা সেইভ করেছে বাংলাদেশে বাজার না করে। তারউপর সে টাকা নিজের দেশেই খরচ করতে চায় অন্য দেশে নয়।
তবে আমি সবচেয়ে অবাক হতাম যে প্রায় আমার দেশে বসে আমার দেশের বদনাম করতো সে অথচ কিছু চামচা হা হা হি হি বলে তার সাথে যোগ দিতো। কাউকে তেমনভাবে প্রতিবাদ করতে দেখিনি। দেশের মিলিয়ন ডলারের প্রজেক্ট সে বন্ধের সুপারিশ করে। সমস্ত ফান্ড বন্ধ করে দেয়।
একবার আমি প্রচন্ড রাগে ও বিরক্ত হয়ে তার কাছে কৈফিয়ত চাইলাম, এ প্রজেক্ট তোমার ভাত রুটির বন্দোবস্ত করছে আর তুমি তা বন্ধের সুপারিশ করছো কেন?
সে খুব সহজে উত্তর দিলো, দেখো আমি আমার স্বার্থই দেখবো সবসময়। ইন্টারন্যাশানাল কনসালটেন্ট হিসেবে আমার সর্বোচ্চ মেয়াদ ৩ বছর। আর ছয় মাস পরেই আমার কন্ট্রাক্ট ক্লোজ হয়ে যাবে। তারপর বাংলাদেশে আমি আর চাকরী করতে পারবো না। এখন এ প্রজেক্ট বাংলাদেশ না পেলে ইন্ডিয়া অথবা আফ্রিকা পাবে। আর ইন্ডিয়া বা আফ্রিকা পেলেই আমার সেখানে জব হবে। কারন বাংলাদেশে আমি যে অভিজ্ঞতা অর্জন করেছি তা দিয়ে সহজেই সেখানে কন্ট্রাক্ট পাবো। বাংলাদেশ প্রজেক্টটা পেলেতো সে সুযোগ আমার থাকবে না।
তারপর তার সব ষড়যন্ত্র উপেক্ষা করেকিভাবে প্রজেক্টটা উদ্ধার করেছিলাম তার গল্প আরেকদিন হবে।
যাইহোক, এ জীবনে যত কিরপিনের দেখা পেয়েছি সবই বলতে গেলে ছিল প্রতিবেশী রাস্ট্রের। এখন কানাডায় বসেও আমার এক কলিগ আছে। প্রতিদিন তার কাজ-কর্ম দেখে নিজেই হাসতে হাসতে অজ্ঞান হ্ই। সেই গল্পও আরেকদিন হবে।
সবাই ভালো থাকেন। আর পারলে দয়া করে কিরপিন মা হাসান ভাই আর শেরশাহ ভাইরে যেখান থেকে পারেন ধইরা আনেন। উনাদেরকে ছাড়া ব্লগ মরুভূমি হয়ে যাচ্ছে। এদিকে কাভা ভাইও দুইদিন পর পর কান্নাকাটি কইরা পোস্ট দেয় উনাদের খরায় ।
ও ভালো কথা, আমি কিন্তু এখন টিন এইজে। মানে ১৩ তে পা দিলাম। তাই বুইঝা শু্ইনা কথা কইয়েন। টিন এইজরে সামাল দেয়া কিন্তু বহুত কঠিন ।
ছবি: গুগুল মামা!
সর্বশেষ এডিট : ২৭ শে এপ্রিল, ২০২২ রাত ১২:৪৮