পাবলো নেরুদা: একজন কবির জীবন ...
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
Tweet
পাবলো নেরুদা: পরাবাস্তব এক বিপ্লবী কবি। কলোম্বিয়ান ঔপন্যাসিক গ্যাব্রিয়েল গার্সিয়া মারকেজ এর মতে নেরুদা কুড়ি শতকের যে কোনও ভাষার অন্যতম কবি। আমরা জানি পরাবাস্তববাদ তাঁর হাতেই সফলভাবে কর্ষিত হয়েছে। পাবলো নেরুদার আসল নাম নেফটালি রিকার্ডো রেইয়েস বাসোয়ালটো । তাহলে পাবলো নেরুদা? ... পাবলো নেরুদা ছদ্মনাম। জা নেরুদা ছিলেন একজন চেক কবি । নেরুদা শব্দটা নিয়েছেন ওখান থেকেই। আর পাবলো? সম্ভবত ফরাসি কবি পল ভার্লেইন থেকে নেওয়া। কিন্তু, ছদ্ম নাম নেওয়ার কি কারণ? প্রথমত ছদ্মনাম নেওয়া অনেকটা সেকালের প্রথা। আর দ্বিতীয় কারণ ... বাবার চোখ এড়ানো। নেরুদার বাবা ছিলেন কট্টর নীতিবাগীশ -চাইতেন ছেলে কবিতা-টবিতা না লিখে বাস্তবসম্মত কিছু একটা করুক ...
চিলি।
১৯০৪ সালের ১২ জুলাই; পাররাল নামে চিলির একটি শহরে নেরুদার জন্ম। কট্টর নীতিবাগীশ বাবা চাকরি করতেন রেলওয়েতে। মা ছিলেন স্কুল শিক্ষিকা। জন্মের কিছু দিন পরেই অবশ্য মারা যান মা।
পাররাল।
পাররাল।
কয়েক বছর পর ছোট্ট নেরুদা বাবার সঙ্গে টিমুকো শহরে চলে আসে। নেরুদার বাবা বাস্তববাদী বলেই আবার বিয়ে করেন। নেরুদার শৈশব, কৈশর ও তরুণ বয়েস কেটেছিল টিমুকো শহরেই। অতি অল্প বয়েসেই লেখালেখি শুরু। মাত্র তেরো বছর বয়েসেই লেখা ছাপানো। ষোল বছর বয়েসে পুরোদস্তুর লিখিয়ে। ছদ্মনামটি তখনই নেওয়া। কেন। তা আগেই বলেছি।
টিমুকো
টিমুকো
টিমুকো শহরেই কবি গ্যাব্রিয়েলা মিস্ত্রাল-এর সঙ্গে পরিচয়। মিস্ত্রাল মেয়েদের স্কুলের প্রধান শিক্ষয়িত্রী ছিলেন। মিস্ত্রাল পছন্দ করতেন নেরুদাকে। কবিতা লেখার জন্য যোগাতেন উৎসাহ । বলতেন,‘ধুরও, বাবার কথা বাদ দাও, তুমি লিখে যাও তো ...
গ্যাব্রিয়েলা মিস্ত্রাল
১৯২১ সাল। চিলির রাজধানী সানতিয়াগো শহরে চলে গেল তরুণ নেরুদা। ভর্তি হল চিলি বিশ্ববিদ্যালয়ে-ফরাসি ভাষা ও সাহিত্য বিভাগে। ইচ্ছে, শিক্ষক হওয়া; অথচ সে সময় আনখশিরকবিতায় পেয়ে বসেছে।
সানতিয়াগো
চিলি বিশ্ববিদ্যালয়
১৯২৩ সালে বেরুল প্রথম কাব্যগ্রন্থ । সে বইয়ের নাম: “গোধূলির বই।” পরের বছর বেরুল,“ কুড়িটি প্রেমের কবিতা ও একটি বেপরোয়া গান।” কবির বয়স কম-কাজেই বইটি তুমুল হইচই ফেলে দিয়েছিল। কেন? বইয়ে যাকে বলে বেপরোয়া যৌনতার ছড়াছড়ি। যাক। সমালোচক মহলে দারুন প্রশংসিত হল বইটি আর নানা ভাষায় অনূদিতও হল।
১৯২৭ থেকে ১৯৩৫ সাল অবধি নেরুদা চিলি সরকারের রাস্ট্রদূত নিযুক্ত হলেন তৎকালীন বার্মায়, শ্রীলঙ্কায়, জাভা, সিঙ্গাপুর, আর্জেন্টিনা ও স্পেনে । যতই সরকারি কাজ থাক না কেন-কবিতা লেখাও চলছিল। স্পেনে থাকাকালীন সেখানকার বিদগ্ধ কবি লোরকাকে চিনতেন নেরুদা। স্পেনিশ জাতীয়তাবাদীরা লোরকাকে খুন করে বসে! সেইসব প্রতিক্রিয়াশীলদের বিরুদ্ধে তীব্র আন্দোলন চলছিল। নেরুদাও সে সংগ্রামে শরিক হয়েছিলেন। প্রথম স্পেনে পরে ফ্রান্সে।
ফ্রান্সে পরাবাস্তবাদ ততদিনে বেশ জনপ্রিয় হয়ে উঠেছিল। ওই শিল্পধারাটি নেরুদার হাতে সফলভাবে কর্ষিত হল। তাঁর ‘সাদা মৌমাছি’ কবিতাটি পাঠ করা যাক:
সাদা মৌমাছি, তুমি আমার ভিতরে গুনগুন কর- তুমি মধু পান করে মাতাল
ধোঁওয়ার ধীর কুন্ডলীতে তুমি ঘুরে ঘুরে উড়ছ
আমি দিশেহারা, প্রতিধ্বনিশূন্য শব্দ,
সকলই হারিয়েছে যে- অথচ যার সকলই ছিল।
সর্বশেষ বাঁধন, আমার আকাঙ্খায় তুমি তোল ঝড়
আমার বিরানভূমিতে তুমিই সর্বশেষ গোলাপ।
আহ্, তুমি কী নিশ্চুপ!
তোমার গভীর চোখ বন্ধ কর। রাত্রি নামছে
ওহ্, তোমার শরীর এক সুগন্ধী ভাস্কর্য, নগ্ন।
তোমার গভীর চোখে রাত্রি নামে
ফুলের শীতল হাত আর গোলাপের কোল।
সাদা শামুকের মতন তোমার স্তন
তোমার নাভীর ওপর ছায়ার প্রজাপতিরা ঘুমাতে এসেছে।
আহ্,
তুমি কী নিশ্চুপ!
এই নির্জনতায় তুমি নেই।
বৃষ্টি ঝরছে। সমুদ্রবাতাস শঙ্খচিলদের তাড়িয়ে দিচ্ছে
ভেজা রাস্তায় খালি পায়ে হাঁটছে জল
গাছের পাতারা বলছে ওদের শরীর খারাপ
সাদা মৌমাছি, যখন তুমি আমার ভিতরে গুনগুন কর
তুমি আবার সময়ে বাঁচ, তন্বি-নীরব।
আহ্ তুমি কী নিশ্চুপ!
যা হোক। ১৯৩৭ সালে নেরুদা দেশে ফিরে এলেন। চিলির রাজনীতি ও সামাজিক ইস্যূতে পড়লেন জড়িয়ে। ১৯৩৯ সালে আবার প্যারিস এলেন। নিযুক্ত হলেন কনসাল ফর দ্যা স্পেনিশ এমিগ্রেশন। এর কিছুকাল পরে মেক্সিকোর কনসাল জেনারেল নিযুক্ত হলেন। সে সময়ই লিখলেন তাঁর বিখ্যাত “ক্যান্টো জেনেলের দ্য চিলি।” এটি মূলত দক্ষিণ আমেরিকার মহাদেশ নিয়ে একটি মহাকাব্য। বিষয়: প্রকৃতি, জনগন, ইতিহাস ও নিয়তি। ১৯৫০ সালে প্রকাশিত হয় মেক্সিকোয়। বইটি দশটি ভাষায় অনুদিত হয়। “ক্যান্টো জেনেলের দ্য চিলি”-র অর্ন্তগত একটি কবিতা- দ্বাদশ ক্যান্টো: মাচো পিচুর উচ্চতা থেকে ...
আমার জন্মের সঙ্গে জেগে ওঠ ভাই আমার
গভীর থেকে বাড়িয়ে দাও তোমার মলিন হাত ।
এইসব পাথরের দৃঢ় শাসন থেকে ফিরবে না তুমি।
পাতালের সময় থেকে উঠবে না জেগে ।
ফিরে আসবে না তোমার খসখসে কন্ঠস্বর,
কোটর থেকে তোমার বিস্ফারিত চোখ দুটি উঠে আসবে না।
মৃত্তিকার গভীর থেকে এই আমাকে দ্যাখো,
ফসলের মাঠের কর্মি, তাঁতী, মৌন মেষপালক,
টোটেমিয় প্রাণির রক্ষক,
উচুঁ ঝুঁকিপূর্ন ভারার রাজমিস্ত্রি
আন্দেজের কান্নার বরফমানুষ
থেঁতলানো আঙুলের স্বর্ণকার
কচি ফসলের মাঠে উদ্বিগ্ন চাষা
অপচয়ী কাদায় কুমাড়
পাত্রে নতুন এই জীবন আনে
তোমার প্রাচীন সমাহিত দুঃখ।
দেখাও তোমার রক্ত, দেখাও তোমার ক্ষত;
আমাকে বল: এখানে আমি নির্যাতিত হয়েছিলাম
কারণ, নিম্নমানের রত্নপাথর কিংবা পৃথিবী সময়মতো
শষ্য ও রত্নপাথর দিতে পারেনি।
আমাকে দেখাও কোন্ পাথরের ওপর তুমি ছটফট করেছ
কোন অরণ্যের কাঠে তারা তোমায় করেছে ক্রশবিদ্ধ।
পুরনো পাথর ঘষ
জ্বালাও প্রাচীন প্রদীপ, আলোকিত কর চাবুক
শতাব্দী ধরে তোমার ক্ষতে আঠার মতন লেগে আছে
আর আলোকিত কর তোমার রক্তে ভেজা কুঠার ।
আমি তোমার মৃত মুখের ভাষা দিতে এসেছি।
বিশ্বজুড়ে
মৃত ঠোঁট একত্রিত হও,
গভীর থেকে উঠে এসে এই দীর্ঘ রাত্রি আমার সঙ্গে ঘূর্নায়মান হোক
যেন আমি তোমার সঙ্গে নোঙরে বাধা।
আর আমাকে সব বল, স্তর থেকে স্তরে বল
খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে বল, ধাপে ধাপে বল।
যে ছোরাটি লুকিয়ে রেখেছ সেটিতে ধার দাও
বিদ্ধ কর আমার পাঁজরে, আমার হাতে,
সূর্যবিস্ফোরনের ঝঞ্ছার মতো
সমাহিত জাগুয়ারের আমাজন
এবং আমাকে কাঁদতে দাও, ঘন্টা, দিন ও বছর
অন্ধ সময়, সৌর শতাব্দী।
আর আমায় স্তব্দতা দাও, জল দাও, আশা দাও।
সংগ্রাম দাও, লৌহ, আগ্নেয়গিরি।
শরীরগুলি আমার শরীরে চুম্বুকের মতন আটকে
আমার শিরায় আমার মুখে আসুক দ্রুত
কথা বলুক আমার ভাষায় আমার রক্তে ।
মাচো পিচু
১৯৪৩ সালে নেরুদা চিলিতে ফিরে এলেন। ১৯৪৫ সালে সিনেটর নির্বাচিত হলেন। চিলির কমিউনিস্ট পার্টিতেও যোগ দিলেন। কমিউনিস্ট পার্টিতে যোগ দেওয়ার কারণটি ওপরের কবিতাটিতে প্রকাশ পেয়েছে। এজন্যই আমি তখন বলছিলাম নেরুদা পরাবাস্তব এক বিপ্লবী কবি।
যাক। ১৯৪৭ সাল । চিলির খনি শ্রমিকরা চিলির কমিউনিস্ট পার্টির নেতৃত্বে বিভিন্ন দাবীদাওয়ায় বনধ ডেকেছে। চিনি প্রেসিডেন্ট তখন গোনজালেস ভিডেলা-ভারি রক্ষণশীল লোক। তিনি চিলির কমিউনিস্ট পার্টি নিষিদ্ধ করা উদ্যেগ নেন। নেরুদা তীব্র প্রতিবাদ করলেন। নেরুদাকে অ্যারেষ্ট করার জন্য ওয়ারেন্ট ইস্যূ করার নির্দেশ দিলেন।
চিলির বন্দরনগরী ভালপারাইসো-সেখানেই এক বন্ধুর বাড়ির বেসমেন্টে কবি লুকিয়ে থাকলেন কয়েক মাস। চিলির পূবে আর্জেন্টিনার সীমান্ত। সীমান্তে সুউচ্চ পাহাড় ও মাইহুই হ্রদের গভীর নীল জল ।
কবি সে পথে লুকিয়ে দেশ ছেড়ে পালিয়ে গেলেন। এবার আবার গেলেন ইউরোপ, প্রথমবারের মতো সোভিয়েত ইউনিয়ন ও দ্বিতীয়বারের মতো মেক্সিকো । কবিতা লেখাও চলছিল।
১৯৫২ সালে চিলি ফিরে এলেন কবি। কেননা, ঐ বছরই কমিউনিস্ট পার্টির ওপর থেকে নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার করা হয়েছিল। সালভাদর আলেন্দে ছিলেন চিলির বিশিষ্ট এক সমাজতন্ত্রী নেতা; তাঁর সঙ্গে ঘনিষ্ট হলেন নেরুদা। ১৯৭০ সালে বিপুল জনসমর্থন নিয়ে ক্ষমতায় এলেন সালভাদর আলেন্দে। তাঁরই বিশেষ অনুরোধে ১৯৭০ থেকে ১৯৭২ অবধি ফ্রান্সে চিলির রাষ্ট্রদূত হিসেবে রাষ্ট্রীয় দায়িত্ব পালন করেন নেরুদা।
১৯৭৩। চিলির স্বৈরাচারী জেনালের পিনোশে সমাজতন্ত্রী আলেন্দেকে হত্যা ও উৎখাত করে। নেরুদা সে সময় চিলির এক হাসপাতালে, ক্যান্সারের সঙ্গে লড়ছেন। কবি হার মানলেন।
সমগ্র বিশ্ব শোকে নিমজ্জিত হয়।
স্বৈরাচারী পিনোশে কবির শেষকৃত্যের অনুমতি দেননি। খলনায়কটি সান্ধ্যআইন জারী করে। লক্ষ লক্ষ মানুষ কারফিউ উপেক্ষা করে রাস্তায় নেমে এসে কবির অন্ত্যেষ্টিক্রিয়ায় অংশ নেয়। সেটিই ছিল সামরিক শাসনের বিরুদ্ধে চিলির জনতার প্রথম বিক্ষোভ।
কবির জয় এখানেই।
১৫টি মন্তব্য ১৫টি উত্তর
আলোচিত ব্লগ
One lost eye will open thousands of Muslims' blind eyes
শিরোনাম'টি একজনের কমেন্ট থেকে ধার করা। Mar Mari Emmanuel যিনি অস্ট্রেলীয়ার নিউ সাউথ ওয়েলসের একটি চার্চের একজন যাজক; খুবই নিরীহ এবং গোবেচারা টাইপের বয়স্ক এই লোকটি যে... ...বাকিটুকু পড়ুন
রাফসান দ্য ছোট ভাই এর এক আউডি গাড়ি আপনাদের হৃদয় অশান্ত কইরা ফেলল!
রাফসান দ্য ছোট ভাইয়ের প্রতি আপনাদের ঈর্ষার কোনো কারণ দেখি না।
আউডি গাড়ি কিনছে ইনফ্লুয়েন্সার হইয়া, তো তার বাবা ঋণখেলাপী কিনা এই লইয়া এখন আপনারা নিজেদের অক্ষমতারে জাস্টিফাই করতে নামছেন!
এই... ...বাকিটুকু পড়ুন
বাঁচতে হয় নিজের কাছে!
চলুন নৈতিকতা বিষয়ক দুইটি সমস্যা তুলে ধরি। দুটিই গল্প। প্রথম গল্পটি দি প্যারবল অব দ্যা সাধু। লিখেছেন বোয়েন ম্যাককয়। এটি প্রথম প্রকাশিত হয় হার্ভার্ড বিজনেস রিভিউ জার্নালের ১৯৮৩ সালের সেপ্টেম্বর-অক্টোবর সংখ্যায়। গল্পটা সংক্ষেপে... ...বাকিটুকু পড়ুন
আমার অন্যরকম আমি এবং কিছু মুক্তকথা
২০১৯, ডিসেম্বরের একটি লেখা যা ড্রাফটে ছিল এতদিন। নানা কারণে যা পোস্ট করা হয়নি। আজ হঠাৎ চোখে পড়ায় প্রকাশ করতে ইচ্ছে হলো। আমার এই ভিডিওটাও ঐ বছরের মাঝামাঝি সময়ের।... ...বাকিটুকু পড়ুন
সামুতে আপনার হিট কত?
প্রথমে মনে হল বর্তমান ব্লগাদের হিটের সংখ্যা নিয়ে একটা পোস্ট করা যাক । তারপর মনে পড়ল আমাদের ব্লগের পরিসংখ্যানবিদ ব্লগার আমি তুমি আমরা এমন পোস্ট আগেই দিয়ে দিয়েছেন ।... ...বাকিটুকু পড়ুন