somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

মধ্যযুগীয় চিনা মেয়েদের পা ছোট করে রাখার কুপ্রথা এবং কনফুসীয় অপ-দর্শন

০৩ রা ফেব্রুয়ারি, ২০১১ দুপুর ২:১১
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :


সেই খ্রিস্টপূর্ব যুগ থেকেই নারীর স্বাভাবিক বিকাশের পথটি রুদ্ধ করতে পুরুষতান্ত্রিক সমাজ কত বিধিবিধানই না রচনা করেছে। নারীর স্বাধীনতা খর্ব করতে উদ্ভাবন করেছে অজস্র পদ্ধতি । চিনা মেয়েদের পা ছোট করে রাখা সেই নির্মম ইতিহাসেরই অংশ। আশ্চর্য এই-সেই অমানবিক মানবতাবিরোধী পদ্ধতির পিছনে ছিল তথাকথিত চৈনিক দার্শনিকদের প্রত্যক্ষ মদদ এবং সে সব একদেশদর্শী দার্শনিকদের রচনা নারী সম্বন্ধে হীন মন্তব্যে পরিপূর্ণ। যেমন দার্শনিক কনফুসিয়াস বিশ্বাস করতেন: A husband may marry twice, but his wife must never remarry.এভাবে নারীকে হীন এবং অধঃপতিত করে দেখালে নারীকে বিকলাঙ্গ করে রাখতে সহজ হত ...



চিনের মানচিত্র। চিনে আজ নারী স্বাধীনতা স্বীকৃত হলেও প্রাচীন কাল থেকেই চিনা নারীরা ছিল পুরুষতান্ত্রিক সমাজের খেয়ালখুশির শিকার। আর পুরুষ চিন্তাবিদের তাতে সমর্থ ছিল।


চিনে কীভাবে উদ্ভব হল ওই কুপ্রথার?
বলা হয়ে থাকে-কোন্ চিনা রাজপুত্রের মেয়েদের ছোট পায়ের ওপর fetish ছিল। fetish মানে- object arousing sexual desire. এর মানে হল: মেয়েদের ছোট পা দেখে সেই চিনা রাজপুত্রের যৌনবোধ জাগ্রত হত । ব্যস। এরপর চিনদেশে মেয়েদের পা ছোট রাখার পদ্ধতি আবিস্কার হল। বলা বাহুল্য পদ্ধতিটি ছিল যন্ত্রণাদায়ক। তথাপি চিনে সমাজে এই ধারণা ছড়িয়ে পড়ল যে -ছোট পা হল আভিজাত্যের প্রতীক, সেই ছোট পা কে বলা হল ‘পদ্ম-পা’।



এতটুকু মেয়েদের বিকলাঙ্গ করা হত

চিনে মেয়েদের পা ছোট করে রাখার প্রথা প্রচলিত হয় সুং শাসনামলে। সময়কাল- ৯৬০ থেকে ৯৭৬ খ্রিস্টাব্দ। কারও কারও মতে অবশ্য সপ্তম শতকে এই প্রথার উদ্ভব। প্রথম প্রথম এর চর্চা ছিল সীমিত। পরবর্তীকালে, অর্থাৎ, দশম শতকের পর ব্যাপক হারে ছড়িয়ে পড়ে। কেবলমাত্র অভিজাত সমাজই নয়- এমনকী মধ্যবিত্ত সমাজেও পদ্মপায়ের লোভে মেয়েদের পা বিকৃত করে ফেলা হত। ... কেবল মাত্র নিম্নবিত্ত ঘরের মেয়েরা রেহাই পেয়েছিল। যেহেতু ওদের কাজ করে খেতে হত।



যুগ যুগ ধরে চিনা মেয়েদের ওপর এই অমানবিক নির্যাতন চলেছে

তিন বছর বয়েসি শিশুর পা বিকলাঙ্গ করা হত ;এসময় পায়ের বাঁকা হাড় ও আঙুল ঠিক মতো বিকাশ লাভ করে না। সাধারনত শীতকালে এই বিকৃতিকরণ করা হত। এ সময় ঠান্ডায় পা জমে থাকত বলে ব্যথা কম হত। প্রথমে দুটি পা-ই উষ্ণ ভেষজ ও পশুরক্তে ভিজিয়ে নেওয়া হত। এতে পা নরম হত, আঙুলগুলি বাঁকিয়ে বেঁধে ফেলতে সুবিধে হত। এরপর যদ্দূর সম্ভব পায়ের আঙুলের নখ কেটে ফেলা হত । তারপর ম্যাসেজ করা হত। তুলার ব্যান্ডেজ উষ্ণ ভেষজ ও পশুরক্তে ভিজিয়ে নেওয়া হত। এরপর আঙুল ও বাঁকানো হাড় নীচের দিকে চাপ দিয়ে ভেঙে ফেলা হত! ভাঙা পায়ে শক্ত করে ব্যান্ডেজ পেঁচিয়ে বাঁধা হত। শিশু তীব্র যন্ত্রনায় কাৎরাত। কী আর করা ! প্রথা বলে কথা! মেয়েরা হাঁটত গোড়ালির ওপর ভর রেখে।



বিকৃত পায়ের এক্সরে।

পুরুষশাসিত সমাজে পা বিকৃত না করে উপায় ছিল না। তার ওপর এটি হয়ে উঠেছিল ফ্যাশন। কর্মহীন পায়ের মর্যাদা গড়ে উঠেছিল। পা যত ছোট তত অভিজাত। মধ্যবিত্ত সমাজেও চলত প্রতিযোগীতা- কার মেয়ের পা কত ছোট। যদিও মেয়েরা সংসারের কাজ ঠিকঠাক করতে পারত না।



বিকলাঙ্গ পায়ের জন্য নির্মিত বিশেষ জুতা।উচ্চবিত্ত সমাজে কন্যার পা ছোট না থাকলে বিয়েই কঠিন হয়ে পড়ত।

তবে পা বিকৃতির মূল উদ্দেশ্য ছিল মেয়েরা যাতে স্বাধীন ভাবে চলাফেরা করতে না পারে। আমরা জানি প্রাচীন ও মধ্যযুগে চিনা সমাজে দার্শনিক কনফুসিয়াসের (৫৫১-৪৭৯ খ্রিস্টপূর্ব) দারুন সম্মান ছিল। এই নৈতিকতার ধ্বজাধারী ব্যাক্তিটি একবার বলেছিলেন ... A woman's business is simply the preparation and supplying of food and wine. She may take no step of her own motion, and may come to no conclusion in her own mind. Beyond the threshold of her apartments she should not be known for good or evil. She may not cross the boundaries of a state to accompany a funeral. (মেয়েদের কাজ হল রান্নাবান্না করা ও মদ তৈরি করা এবং সেসব পরিবেশন করা। সে স্বেচ্ছায় এক পাও নড়বে না। নিজস্ব বিবেচনায় কোনও সিদ্ধান্তে উপনীত হবে না। বাড়ির বাইরের ভালোমন্দ সম্বন্ধে জানবে না। রাষ্ট্রের সীমানা পেরিয়ে শেষকৃত্যে যোগ দেবে না। )
এখন যেন মেয়েদের পা ছোট করে রাখার বিষয়টি অনেকখানি পরিস্কার হয়ে যাচ্ছে।
মেয়েরা যেন হাঁটতে না পারে তাই এই ব্যবস্থা। কারও সাহায্য ছাড়া বেশি দূর যেতে পারত না। যন্ত্রণা হত।



২৮ সেপ্টেম্বর কনফুসিয়ারে জন্মদিন। প্রতি বছরই চিনা বিশ্বে মহাসমারোহে দিনটি পালিত হয়। হংকং-এ কনফুসিয়াসের জন্মবার্ষিকীর অনুষ্টানে নারীর উপস্থিতি বিস্ময়কর ঠেকতেই পারে।

চিনা সমাজে কনফুসীয় এই নারী বিদ্বেষী কুপ্রথা টিকেছিল প্রায় ১০০০ বছর। ১৯১১ সালে চিনে মাঞ্চু রাজবংশের পতনের পর নতুন প্রজাতন্ত্র গঠিত হয়। তার পর এই প্রথা নিষিদ্ধ করা হয়। পথাটিকে ‘চাইল্ড অ্যাবিউজ’ বলে আখ্যাহিত করা হয়। তবে সে সময় যাদের পায়ের বাঁধন খুলে ফেলা হয়েছিল তাদের পায়ে দীর্ঘকাল ক্ষত বহন করতে হয়েছিল। এমন কী ১৯৯০ সালেও কোনও কোনও চৈনিক বৃদ্ধার পায়ের সমস্যা ছিল।



সমগ্র বিশ্বের চোখ এখন প্রচন্ড গতিতে অগ্রসরমান চিনের দিকে । কিন্তু প্রশ্ন হল- চিনা সমাজে মেয়েদের ওপর পুরুষতন্ত্রের শাসন কতখানি শিথিল হয়েছে?

চিনে পা বিকৃতির কারণ সম্বন্ধে কোন্ এক চিনা রাজপুত্রের মেয়েদের ছোট পায়ের ওপর fetish এর কথা বলা হয়। আসলে সেই রাজপুত্র রক্ষিতাদের বন্দি করে রাখতেই এক কুপ্রথার জন্ম দিয়েছিল আর সে ‘যথার্থ’ কাজে ফনফুসিয় ‘মহান’ বাণীর দৃঢ় সমর্থন তো ছিলই ...এভাবে পুরুষেরা যুগ যুগ ধরে শাস্ত্রের বাণী ইচ্ছে মতো ব্যাখ্যা করে নিজ উদ্দেশ্য সিদ্ধি করে চলেছে ...



হাই হিল। সম্ভবত এই আধুনিক শৈলীর পাদুকাটির পিছনে রয়েছে চিনে মেয়েদের গোড়ালীর ওপর ভর দিয়ে হাঁটার দুঃসহ স্মৃতি ... অনেকে যেমন বলেন বাঙালি মেয়ের হাতে রিনরিন করে বাজা চূড়ি হল পূর্বযুগের দাসত্বের চিহ্ন ...


তথ্যসূত্র

Click This Link
২১টি মন্তব্য ২২টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

=তুমি সুলতান সুলেমান-আমি হুররাম=

লিখেছেন কাজী ফাতেমা ছবি, ২৮ শে এপ্রিল, ২০২৪ রাত ৮:৩৬



©কাজী ফাতেমা ছবি

মন প্রাসাদের রাজা তুমি, রাণী তোমার আমি
সোনার প্রাসাদ নাই বা গড়লে, প্রেমের প্রাসাদ দামী।

হও সুলেমান তুমি আমার , হুররাম আমি হবো
মন হেরেমে সংগোপনে, তুমি আমি রবো।

ছোট্ট প্রাসাদ দেবে... ...বাকিটুকু পড়ুন

মৃত্যুর আগে ইবলিশ ঈমান নিয়ে টানাটানি করে

লিখেছেন মহাজাগতিক চিন্তা, ২৮ শে এপ্রিল, ২০২৪ রাত ১১:০২



ইউটিউব হুজুর বললেন, মৃত্যুর আগে ইবলিশ ঈমান নিয়ে টানাটানি করে। তখন নাকি নিজ যোগ্যতায় ঈমান রক্ষা করতে হয়। আল্লাহ নাকি তখন মুমিনের সহায়তায় এগিয়ে আসেন না। তাই শুনে... ...বাকিটুকু পড়ুন

মহিলা আম্পায়ার, কিছু খেলোয়ারদের নারী বিদ্বেষী মনোভাব লুকানো যায় নি

লিখেছেন হাসান কালবৈশাখী, ২৯ শে এপ্রিল, ২০২৪ সকাল ১১:০৯



গত বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল প্রাইম ব্যাংক ও মোহামেডানের ম্যাচে আম্পায়ার হিসেবে ছিলেন সাথিরা জাকির জেসি। অভিযোগ উঠেছে, লিগে দুইয়ে থাকা মোহামেডান ও পাঁচে থাকা প্রাইমের মধ্যকার ম্যাচে নারী আম্পায়ার... ...বাকিটুকু পড়ুন

জানা আপুর আপডেট

লিখেছেন আরাফআহনাফ, ২৯ শে এপ্রিল, ২০২৪ সকাল ১১:৫৭

জানা আপুর কোন আপডেট পাচ্ছি না অনেকদিন!
কেমন আছেন তিনি - জানলে কেউ কী জানবেন -প্লিজ?
প্রিয় আপুর জন্য অজস্র শুভ কামনা।



বি:দ্র:
নেটে খুঁজে পেলাম এই লিন্ক টা - সবার প্রোফাইল... ...বাকিটুকু পড়ুন

বন্ধুর বউ কে শাড়ি উপহার দিলেন ব্যারিস্টার সুমন। বাটার প্লাই এফেক্ট এর সুন্দর উদাহারন।

লিখেছেন নাহল তরকারি, ২৯ শে এপ্রিল, ২০২৪ বিকাল ৪:০৭



এক দেশে ছিলো এক ছেলে। তিনি ছিলেন ব্যারিস্টার। তার নাম ব্যারিস্টার সুমন। তিনি একজন সম্মানিত আইনসভার সদস্য। তিনি সরকার কতৃক কিছু শাড়ি পায়, তার জনগণের মাঝে বিলি করার জন্য।... ...বাকিটুকু পড়ুন

×