somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

গল্প: আরও একজন

২৬ শে ফেব্রুয়ারি, ২০১১ দুপুর ২:৫৪
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

কলেজে পড়ার সময় রওশনকে তার বড় ভাই বেল্ট দিয়ে নির্দয় ভাবে মেরেছিল। প্রচন্ড মারের পর রওশন জ্ঞান হারিয়ে ফেলেছিল। ফরসা পিঠে দগদগে দাগ বসে গিয়েছিল। সে অপমানজনক দাগ ঢেকে রাখার জন্য রওশন অনেক দিন আর শাড়ি পড়তে পারেনি। সালোয়ার-কামিজ পরতে হয়েছে। যদিও শাড়ি পরতে ভালোবাসে রওশন। রওশনের জন্য পয়লা ফাল্গুন, একুশে ফেব্রুয়ারি, পয়লা বৈশাখ নিষিদ্ধ হয়ে যায়। এসব বিশেষ দিনে সালোয়ার-কামিজ বড় বেমানান। শাড়ি পরা চাই ...তো, শাড়ি পরলে আবার পারিবারিক নির্যাতনের চিহ্নটি প্রকট হয়ে পড়ার সম্ভাবনা।
তা মোজাম্মেল ভাই কেন যে মারল রওশনকে?
কলেজে ওঠার পর পুরনো ঢাকার বাংলা বাজারের তাপস সাহার প্রেমে পড়ে গিয়েছিল রওশন। ওই বয়েসটায় আবেগই ক্ষুরধার হয়ে থাকে-জাতপাত বড় হয়ে দাঁড়ায় না। কলেজ ফাঁকি দিয়ে রমনা পার্কের সামনের ফুটপাতে তাপসের সঙ্গে হাঁটত রওশন। দৃশ্যটা রওশনের এক ছোট মামা (রওশনের মায়ের খালাতো ভাই) দেখে ফেলেছিলেন। তো, সেই লোকটা বাড়ি এসে রওশনের ‘নস্টামি’র কথা জানালে মোজাম্মেল ভাই সবার সামনেই রওশনকে বেল্ট দিয়ে নির্দয় ভাবে পেটাতে শুরু করে। মোজাম্মেল ভাই শুধু রওশনকে মারেনি-ভয়ঙ্কর এক প্রতিশোধও নিয়েছিল। ইন্টারমিডিয়েট পরীক্ষার আগে আগে হুট করে রওশনের বিয়ে ঠিক করে ফেলে। পাত্র-পিরোজপুরের এক তরুণ ব্যবসায়ীর; ভাবটা এমন, এখন থেকে রওশনের পড়ালেখার দায়িত্ব রওশনের স্বামীর- নষ্ট মেয়ের জন্য আমাদের অত দায় কীসের।
বিয়ের তারিখ ফেলেছিল রওশনের ইন্টারমিডিয়েট পরীক্ষার দিন ...
অবশ্য রওশনের জন্য বিয়েটা শাপে বর হয়েছিল।
রওশনের স্বামী জিল্লুর রহমান দাড়িঅলা, ফরসা, পাঞ্জাবি-পা’জামা পরা নামাজী মানুষ। বড় ভালো মানুষ। বিয়ের পর স্ত্রীর পিঠের দাগ দেখে কোনও ধরনের প্রশ্ন করেননি। কাটছাট করে রওশনই যা বলার বলেছিল। শুনে মানুষটা গম্ভীর হয়ে গিয়েছিলেন। জিল্লুর রহমান আই. এ পাস হলেও স্ত্রীকে এম.এ অবধি পড়ালেন । রওশনেরও জেদ ছিল পড়া শেষ করার। চাকরি অবশ্য রওশনকে করতে হয়নি । বিয়ের পর জিল্লুর রহমান নতুন বউকে আরামবাগে দু-রুমের ভাড়া বাড়িতে তুলেছিলেন। তার পর কী এক যাদুবলে জিল্লুর রহমানের গার্মেন্টস এক্সেসোরিসের ব্যবসা রমরমা হয়ে উঠেছিল। উত্তরায় চার কাঠা জমি কিনে দোতলা বাড়ি তৈরি করতে সময় লাগেনি । এর মধ্যে রওশনের এক ছেলেও হল। শুভ্র এবার প্রাইভেট ইউনিভারসিটি ভর্তি হল ... স্বামী-সন্তান নিয়ে রওশনের জীবন বেশ কেটে যাচ্ছে । কিন্তু যাকে নিয়ে এত ঘটনা সেই তাপস সাহা এখন কোথায়? ... মাঝে মাঝে তাপসের মুখটা খুব মনে পড়ে ... একবার ঝমঝম করে বৃষ্টি নেমেছিল ... কালো মেঘে ঢেকে গিয়েছিল ঢাকা শহরটা ... দু’জনেই এ্যালিফ্যান্ট রোডের ফুটপাতে হাঁটতে হাঁটতে ভিজল ... খুব ভিজল । সেদিনই কলেজ ফাঁকি দিয়ে বলাকা সিনেমাহলে ছবি দেখল ...
বাবার বাড়ির সঙ্গে সম্পর্ক আজও রেখেছে রওশন। ইচ্ছে করেই রেখেছে। জিল্লুর রহমান অবশ্য মনে করেন আত্বীয়স্বজনের সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্ন করা গুনাহ। কাজেই রওশনের বাবার বাড়ির লোকজন রওশনকে দূরে ছুড়ে ফেলে দিতে চেয়েও পারেনি। তাছাড়া রওশনের সুখ ও সাফল্য যদি তারা নাই দেখল তো এত অপমান এত লড়াই এত সংগ্রাম করে কি লাভ?
মোজাম্মেল ভাই এখন কানাডা থাকে। কুড়ি বছর ধরে ও দেশেই সেটল। মাঝেমধ্যে বাংলাদেশে আসে। রওশন তখন মোজাম্মেল ভাই কে ওর উত্তরার বাড়িতে দাওয়াত করে। মোজাম্মেল ভাই মনে হয় সেই মারের ব্যাপারটা ভুলে গেছে। (পুরুষের স্মরণশক্তি বড্ড গোলমেলে, এরা যে কি মনে রাখে আর কি মনে রাখে না ...) তবে মোজাম্মেল ভাইয়ের সামনে এলে আজও অস্বস্তি হয় রওশনের। পিঠের ওপর তেলাপোকার অস্বস্তিকর দৌড়াদৌড়ি টের পায় ... তখন বাথরুমে লুকিয়ে হু হু করে কাঁদতে হয়। তাপসের কাছে ক্ষমা চাইতে হয় ...
কানাডিয় এক মেয়েকে বিয়ে করেছে মোজাম্মেল ভাই । সে মেয়ের নাম ভিক্টোরিয়া। শ্বেতাঙ্গ, খ্রিস্টান। আশ্চর্য! বিয়ের সময় জাতপাত বড় হয়ে ওঠেনি বরং রওশনের মা-বাবা পুত্রবধূকে নিয়ে ভীষণ গর্ব করেন, ভিক্টোরিয়ার শ্বেতাঙ্গ আভিজাত্যের কাছে সব সময় নত হয়ে থাকে।রওশন শুনেছে ... ভিক্টোরিয়া ইসলাম ধর্ম গ্রহন করেনি, চার্চেও নাকি যায় । এসব দূস্তর ব্যাবধানও বড় হয়ে দাঁড়ায়নি। কেবল যত দোষ বাঙালি হিন্দু তাপস সাহার! শ্বশুর-শাশুড়িকে নিয়মিত টাকা পাঠায় ভিক্টোরিয়া, বছর কয়েক আগে হজ-এর টাকাও দিল। সে টাকায় হজও করল বুড়ো-বুড়ি ... তাছাড়া বেশ ক’বার কানাডা নিয়ে গেছে।
কাজেই, বুড়ো-বুড়ির চুপ করে থাকাই বুদ্ধিমানের কাজ!



ফেব্রুয়ারির প্রথম সপ্তাহে কানাডা থেকে মোজাম্মেল ভাইয়ের মেয়ে লিজা এল বাংলাদেশে। ভাইবোনদের মধ্যে রওশনই ঢাকায় থাকে। টেলিফোনে মোজাম্মেল ভাই রওশনকে বলল: শোন রওশন, লিজা বাংলাদেশে দু’ সপ্তাহ থাকবে। ওকে যদ্দূর সম্ভব বাংলাদেশ ঘুরিয়ে দেখাস, বিশেষ করে সিলেটের চা বাগান, লালন এর মাজার, ... আর সম্ভব হলে কক্সবাজার।
রওশন রাজি হয়। সময় আছে যখন, গাড়িও আছে-অসুবিধে নেই। তা ছাড়া শুভ্রর এখন ছুটি।
লিজা একাই এসেছে। অনেক বছর আগে একবার এসেছিল। তখন ছোট ছিল। লিজা এখন সতেরো বছরের কিশোরী। ঈষৎ সোনালি চুল, নীলাভ চোখ। তবে মুখচোখে এশিয় স্নিগ্ধতা লেপ্টে আছে। বাবার ধাত পেয়েছে মেয়েটা। মোজাম্মেল ভাই লম্বা, সুদর্শন। তাপস সাহাও লম্বা আর ফরসা ছিল। ওই বয়েসে লম্বা আর ফরসা ছেলেদের ভালো লাগে। পরে অবশ্য বাস্তবতার চাপে দৃষ্টিভঙ্গি বদলে যায় ...
লিজা বাবার কাছে বাংলাদেশ সম্বন্ধে শুনেছে। বাংলাদেশ এখন আর বিশ্ববাসীর কাছে কেবলই দারিদ্রপীড়িত দেশ না, বরং ড. মোহাম্মদ ইউনূস, একুশে ফেব্রুয়ারি, ক্রিকেট এবং বাউল গানের জন্য বাংলাদেশ বিশ্ববাসীর কাছে আলোচিত দেশ।
রওশনের স্বামী জিল্লুর রহমান কয়েক বছর আগে তাবলীগ জামাত-এ যোগ দিয়েছেন। প্রায়ই সাথীদের নিয়ে বাংলাদেশের এখানে-ওখানে দ্বীন প্রচার করেন। এবারও টেকনাফ যাওয়ার কথা ছিল। বললেন, আমরা বাসেই টেকনাফ যাই। তোমরা গাড়ি নিয়া কুষ্টিয়া রওনা হইয়া যাও।
কথাটা শুনে খুশি হল রওশন । মানুষটা বরাবরই ভালো।
এরপর জিল্লুর রহমান একটা আলগা কথা বলে বসলেন। সরল মনে বললেন, গাজীউর রহমানের (শুভ্রর ভালো নাম) বিবাহ দিতে হয়। মোজাম্মেল ভাইয়ের মেয়েটা তো ভালই মনে হইল ... তুমি কি বল?
যাঃ, তাই হয় নাকি! রওশন কেঁপে উঠল। হাজার হলেও লিজার বাবাকে ঘৃনা করে রওশন। মোজাম্মেল ভাইয়ের ওপর আজও ক্ষোভ যায়নি। এখনও পিঠের ওপর বেল্টের দাগ আছে। দু-জনের মধ্যে যেন কোনও রকম নিবিড় সম্পর্ক গড়ে না ওঠে। ওদের ওপর সতর্ক চোখ রাখছে রওশন ।তবে লিজার সঙ্গে শুভ্রর বেশ জমে গেছে। ওরা ইন্টারনেট যুগের সন্তান বলেই হয়তো।
ভোর ভোর সময়ে কুষ্টিয়া রওনা হল ওরা। ড্রাইভার শরীফুল বেশ পুরনো। মধ্যবয়েসি আর বিশ্বস্ত। সারাটা পথ শুভ্র কানে হেডফোন গুঁজে সামনের সিটে বসে রইল। পিছনের সিটে রওশন আর লিজা বসেছে। ছোটখাটো বিষয় নিয়ে লিজার ভারি উচ্ছ্বাস। রওশন অবাক হয় না। লিজা এদেশে আগে এলেও তখন বয়স কম ছিল। রাস্তার পাশে গরু দেখলেও ভালো লাগে মেয়েটির। বাংলা বলার চেষ্টা করে। তবে আটকে যায়। তারপরও বলে ...
লালনের মাজারে পৌঁছল দুপুরের আগেই। শান্তি পেল রওশন। আগেও একবার এসেছিল। এসব ব্যাপারে শুভ্রর বাবা আবার উদার। লালনগীতি মন দিয়ে শোনে রওশন। বিশেষ করে লালনের এই গানটা ভালো লাগে-

বিধাতা সংসারের রাজা
আমায় করে রাখলেন প্রজা।
কর না দিলে দেয় গো সাজা
কারও দোহাই মানে না ...

মাজার প্রাঙ্গনে বেশ ভিড়। বেশ ক’জন বিদেশিও চোখে পড়ল। লালন সম্বন্ধে দেশের বাইরেও দিনদিন আগ্রহ বাড়ছে। লালনের গানের অসাম্প্রদায়িক দিকটাই বড় হয়ে উঠছে। লিজার মা ভিক্টোরিয়া ইসলাম ধর্ম গ্রহন করেনি। চার্চে যায়। মোজাম্মেল ভাই আগে অন্যরকম ছিল, বিয়ের পর রিলিজিয়াস হয়ে উঠেছেন। কই, কুড়ি বছর ধরে তো ওদের ঘর করতে সমস্যা হয়নি। কিন্তু, পুরনো ঢাকার বাংলা বাজারের তাপস সাহা কি দোষ করল আজও রওশন বুঝতে পারে না ...
ভিড়ের মধ্যে মাঝবয়েসি সুদর্শন চেহারার এক ভদ্রলোককে দেখে চমকে উঠল রওশন।
অবিকল তাপস সাহার মতো দেখতে। ভদ্রলোকের পাশে সাদা রঙের সালোয়ার-কামিজ পরা শ্যামলা মতন ভারি মিষ্টি চেহারার চশমা পরা একজন কিশোরী। রওশনের বুক ধকধক করতে থাকে। হায়, আল্লা, এ বছর পর তাপস ফিরে এল জীবনে।
কৌশলে শ্যামলা মেয়েটির আলাপ করে রওশন।
জানা গেল ভদ্রলোকের নাম জয়ন্ত সেনগুপ্ত। পশ্চিমবঙ্গের হাওড়া জেলায় বাড়ি, রেলওয়েতে চাকরি করেন। একটাই মেয়ে -রমা সেনগুপ্ত। মায়ের কাছে মেয়েবেলায় লালনের গান শিখেছে রমা। মা নদীয়া জেলার মেয়ে, তিনি অবশ্য বেঁচে নেই। শাঁইজির আখড়াবাড়ি দর্শনের জন্য বাবার সঙ্গে বাংলাদেশে এসেছে রমা।
ওহ্ । বাংলাদেশে এল বলেই দেখা হল! ঈশ্বর কেন যে এমন খেলা খেলেন। মনে মনে কেঁদে ওঠে রওশন।
রওশনের অনুরোধে দু-লাইন লালনের গান শোনাল রমা ।

শাঁই আমার কখন খেলে কোন্ খেলা
জীবের কি সাধ্যি আছে তাই বলা।

চমৎকার গলা রমার।
গানের কথা যদ্দূর সম্ভব ইংরেজিতে অনুবাদ করে লিজাকে বোঝাতে চেস্টা করল শুভ । লিজার ফর্সা মুখে সহসা মেঘ ঘনাল যেন। রওশন টের পেল মেয়েটা এই বয়েসেই কী এক কষ্ট লুকিয়ে রেখেছে। রওশনের জিজ্ঞেস করতে ইচ্ছে করে-তোমার বাবা কি তোমার মাকে মারে?
প্রশ্নটাটা আর করা হয় না।
ওরা যখন গড়াই নদী পেরিয়ে শিলাইদহের কুঠিবাড়ি পৌঁছল তখনও দুপুরের রোদ ঝলঝল করছিল।
রওশনের অনুরোধে মেয়েকে নিয়ে জয়ন্ত সেনগুপ্ত ওদের সঙ্গী হলেন।
এরই মধ্যে লিজা ও শুভ্রর সঙ্গে পরিচয় হয়ে গেছে ওদের।
ফেব্রুয়ারি মাসের সবে শুরু। ঝলমলে রোদময় দিন। বাতাসে শীতের কামড় টের পাওয়া যায় । লিজা উচ্ছ্বসিত। মুগ্ধ চোখে দেখছে সব। গ্রামীণ পরিবেশ আর নির্জনতা টানছে ওকে। বারবার বলল, স্বপ্নের চেয়েও এই দেশ সুন্দর ।
রমার মুখচোখেও মুগ্ধতা ঝরে ঝরে পড়ে। রবীন্দ্রনাথের গানও শিখেছে ও। শিলাইদহের কুঠিবাড়ি ওর কাছে তীর্থ।
দীর্ঘ গাছের ছায়ায় দীঘিসমেত কুঠিবাড়ি দেখে জয়ন্ত সেনগুপ্তও রীতিমতো উচ্ছ্বসিত। জয়ন্ত সেনগুপ্ত বেশ আলাপি লোক। কুষ্টিয়া থেকে ঢাকা যাবেন। এবার মেয়েকে নিয়ে একুশে ফেব্রুয়ারি ঢাকায় উদযাপন করবেন। বললেন, জীবনভর কেবল ভারতবর্ষেই ঘুরেছি- পাঞ্জাব, মানালি, বেঙালুরু। অথচ এদিকটায় কখনও আসা হয়নি। অথচ আমরা বাঙালি।
একবার সময় করে সিলেট যাবেন। রওশন বললেন।
সিলেট?
হ্যাঁ। সিলেট। খুব সুন্দর জায়গা ... গেলে ভালো লাগবে।
আচ্ছা, যাব।
শুভ্রর কানে হেডফোন। রওশন ছেলেকে ধমক দিকে কান থেকে হেডফোন খসাল। ধমকের সুরে বলল, কি সব গান শুনছিস! ভালো করে চেয়ে দেখ সব। রবীন্দ্রনাথের এই কুঠিবাড়িটায় আমরা স্বাধীন ভাবে ঘুরে বেড়াবার জন্য একাত্তরে কত মানুষ প্রাণ দিয়েছে জানিস!
শুভ্র মুখ কাঁচুমাচু করে।
কুঠিবাড়ির দোতলার বারান্দায় হাঁটতে হাঁটতে লিজা বলল, জান ফুপ্পি, এখন থেকে কানাডার টরেন্টোর এলিমেনটারি স্কুলে রবীন্দ্রনাথ পড়াবে।
তাই?
হ্যাঁ।
শুনে রওশনের ভালো লাগে। অথচ বাংলাদেশে একশ্রেণির সাম্প্রদায়িক লোক রবীন্দ্রনাথকে আজও কেবল হিন্দু জমিদারই মনে করে। পতিসরে রবীন্দ্রনাথের স্কুলবাড়িটা ভেঙে ফেলল! ... এসব কথা লিজাকে বলা যায় না। বলা যায় না ... আজ থেকে পঁচিশ বছর আগে কলেজে পড়ার সময় আমাকে তোমার বাবা নির্দয় ভাবে বেল্ট দিয়ে মেরেছিল।
রমা জিজ্ঞেস করল, ‘ফুপ্পি’ মানে কি মাসী?
রওশন হেসে বলল, ফপ্পি মানে হল পিসি। বাবার বোন। আসলে শব্দটা ফুপু। আদর করে এদেশে ফুপ্পি বলে।
ও।
রওশন জানে দু-বাংলার সমাজে একটা দূরত্ব তৈরি হয়ে গেছে। দূরত্ব কবে ঘুচবে কে জানে। তবে আশার কথা লালন আছেন, রবীন্দ্রনাথ আছেন। তখন জয়ন্ত সেনগুপ্ত বললেন: বরিশালে যাবেন। বরিশাল বাঙালির আরেক তীর্থ। ওখানে রুপসী বাংলার কবির জন্ম ...
লিজা বলল, জানেন আঙ্কেল, মিয়ানমারের নেত্রী অং সাং সুচি গৃহবন্দি থাকার সময় রবীন্দ্রনাথের কবিতা পড়ে সান্ত¦না পেতেন।
তাই নাকি! জয়ন্ত সেনগুপ্ত উচ্ছ্বসিত হয়ে ওঠে।
হ্যাঁ। আমি একটা ওয়েবসাইটে দেখেছি।
এই সময়ের মেয়ে লিজা। কত খবর রাখে ...
শেষ বিকেলের মনোরম আলোয় দীঘির পাড়ে বসে রবীন্দ্রসংগীত শোনাল রমা-

ও বধূ কোন্ আলো লাগল চোখে ...
বুঝি দীপ্তিরূপে ছিলে সূর্যলোকে

শুভ্রর এবার আর গানের কথার ইংরেজি করে লিজাকে বোঝাতে পারল না।
লিজা ঘোষনা করল: আর ইংরেজি না! এখন থেকে ও ভালো করে বাংলা শিখবে।
সেই ভালো । মিষ্টি করে বলল রমা।
ভালো ইংরেজি জানে না রমা। অথচ লিজার সঙ্গে ভাব বিনিময়ে সমস্যা হচ্ছে না। মেয়েদের নিজস্ব একটা ভাষা আছে। সে ভাষায় কথাবার্তা চলছে। শ্যামলা হলেও দারুণ মিষ্টি দেখতে রমা। অবশ্য মেয়েটিকে ঘিরে কী এক করুণ বিষন্নতা জড়িয়ে আছে ।
বারবার আড়চোখে জয়ন্ত সেনগুপ্তকে দেখছিল রওশন। দেখতে দেখতে রক্তস্রোতে
কাঁপন টের পাচ্ছিল। জয়ন্ত সেনগুপ্ত অনেকটা তাপস সাহার মতো দেখতে। যতক্ষণ মানুষটাকে চোখের সামনে রাখা যায়, যত্নআত্তি করা যায়। শরীরজুড়ে গোপন পুলক । বড় ভালো লাগছিল রওশনের । আর এ পুলক কিছুতেই পাপ না ... রওশন জানে- জীবনের ভাঁজে ভাঁজে বিধাতা এভাবে লুকিয়ে রাখেন প্রেম । এবং সে প্রেম যথাসময়ে উদ্ভাসিত করেন। মান্না দে-র গাওয়া একটা গান মনে পড়ে গেল ...

এ কি অপূর্ব প্রেম দিলেন বিধাতা আমায় ...

রওশন ভাবল: কাল আমরা সিলেট যাচ্ছি। ওদের কি যেতে বলব? তবে তার আগে শুভ্রর বাবার সঙ্গে একবার কথা বলা দরকার। রওশন টেকনাফে ফোন করল। সব শুনে জিল্লুর রহমান উত্তেজিত। বিদেশি মেহমান! ভালো করে আপ্যায়ন কইর। রওশন হাসল। মনে মনে বলল, জয়ন্ত সেনগুপ্তরা বিদেশি মেহমান না, বাঙালি। জিল্লুর রহমান এর সবই ভালো, তবে মানুষটা পাকিস্তানি ক্রিকেট দলের ঘোর সার্পোটর ...
জয়ন্ত সেনগুপ্ত কে রওশন বলল, কাল আমরা সিলেট যাচ্ছি। আপনারাও আমাদের সঙ্গে চলুন না। ওখান থেকে আমরা কক্সবাজারও যাব। ওই বিখ্যাত শহরটা আপনাদেরও দেখা হয়ে যাবে।
জয়ন্ত সেনগুপ্ত হাসিমুখে নিমন্ত্রন গ্রহন করলেন। ভাবনা কি- ছাব্বিশ ফেব্রুয়ারি অবধি ভিসার মেয়াদ আছে যখন।
বিষন্ন রমাকেও যেন খানিকটা উজ্জ্বল মনে হল।
গড়াই নদীর পারে একটা রেস্টহাউজে দুটো রুম বুক করা ছিল । রেস্টহাউজটি নতুন হয়েছে। ছিমছাম। দোতলা। আধুনিক সব সব ব্যবস্থাই আছে। গিজার-হিটার-টিভি। রাত্রে খাওয়ার পর ওর রুমে চলে যায় শুভ্র । সঙ্গে জয়ন্ত সেনগুপ্ত। দুজনেই ক্রিকেট পাগল এবং শচীন টেন্ডুলকারের ভক্ত। দু’জনই ২০১১ বিশ্বকাপ নিয়ে মেতে উঠেছে। এবার কোন্ দল চ্যাম্পিয়ন হবে সে বিষয়ে চলছে চুলচেরা বিশ্লেষন । জয়ন্ত সেনগুপ্ত তানিম ইকবাল এর ফ্যান। ওদিকে অলক কাপালির কে মিস করছে শুভ্র ... জয়ন্ত সেনগুপ্ত অলক কাপালিকে বিলক্ষণ চেনেন- ২০০৮ এর আই সি এ-এ অলকের দূর্দান্ত পারফর্মেন্স মনে আছে। জয়ন্ত সেনগুপ্ত ভীষণ উদার মানুষ। তিনি চান পাকিস্তানি প্লেয়াররাও যেন আই সি এ-এ খেলে ...
ফেব্রুয়ারির শুরুতে কুষ্টিয়ায় শীত তীব্র। যত রাত বাড়ছে শীত তত বাড়ছে। শীতের কাপড় এনেছিল রওশন। রমাকে একটা চাদর দিল । রমার সঙ্গে অল্প অল্প করে কথা হচ্ছিল রওশনের।
আর রমাও যেন কী বলতে চায় ...
ধীরে ধীরে বিষন্ন মেয়েটির সব কথা জানা গেল।
বছর দুয়েক আগে এক মুসলমান ছেলের সঙ্গে বিয়ে হয়েছিল রমার। কলেজে পরার সময় রমাই নাসিরকে আগ বাড়িয়ে অফার করেছিল। ওই বয়েসটায় আবেগই ক্ষুরধার হয়ে থাকে-জাতপাত বড় হয়ে দাঁড়ায় না। নাসিরদের বাড়ি ছিল হাওড়া রেলস্টেশনের কাছেই । রমার বাবা জয়ন্ত সেনগুপ্ত উদার মানুষ, আত্মীয়স্বজনের মধ্যে গুঞ্জন উঠলেও মেয়েকে ভালোবাসেন বলেই বিয়েটা মেনে নিয়েছিলেন। বিয়ের তিনমাস পর যৌতুকের জন্য নির্যাতন শুরু হয়। নাসির কুয়েত যাবে, সে জন্য লাখ টাকা চাই। জয়ন্ত সেনগুপ্ত রেলের চাকরি, ক’টাকাই-বা মাইনে পান । তাছাড়া মানুষটি উদার বলেই বড় সৎ । বাবাকে বিপদে ফেলবে না বলে রমা মুখ বুজে টর্চার সহ্য করত। শ্বশুরবাড়ির লোকেরা মুখ বেধে ছ্যাঁক দিত রমার উরুতে। নাসির আর নাসিরের বুড়ো বাপ ওর হাত-পা চেপে ধরত। বছরখানেক সহ্য করেছে রমা। পরে সহ্যের সীমা ছাড়িয়ে গেলে গোপনের বাবাকে সব জানিয়েছে। রমার মা মেয়ের কথা শুনে স্ট্রোক করে মারা যান। জয়ন্ত সেনগুপ্ত পুলিশ নিয়ে গিয়ে মেয়েকে বন্দিদশা থেকে উদ্ধার করেন, ... তারপর রমার শ্বশুরবাড়ি লোকজনের বিরুদ্ধে মামলা ঠুকেছেন। নাসিরের সঙ্গে বিবাহ বিচ্ছেদ হয়ে গেছে রমার। এখন গান নিয়ে ডুবে আছে রমা। বাংলাদেশে এসেছে শান্তির জন্য ... শাঁইজির আখরাবাড়িতে এসে শান্তি জুটেছে ...
রওশন দীর্ঘশ্বাস ফেলে। লিজার দিকে তাকায়। লিজা বিছানার ওপর বসে। ওর হাতে একটি ইংরেজি পত্রিকা। মন দিয়ে পড়ছে। কারা যেন ফেলে গেছে পত্রিকাটি। রওশনের কপালে ভাঁজ পরেছে ... রমা যা বলল তেমনটা বাংলাদেশেও ঘটে ... আচ্ছা মোজাম্মেল ভাই কি মেয়েকে বাংলাদেশের অন্ধকার দিকগুলো সম্পর্কে বলে? ক’দিন আগে শরিয়তপুরে একটা কিশোরীকে দোররা মেরে মেরে হত্যা করল পশুরা ... এসব কথা?
... ২৫ বছর আগে লিজার বাবা হাতে দোররা তুলে নিয়েছিল ...
কি পড়ে লিজা বলে ওঠে, ওহ্ ! কি ভয়ঙ্কর ...
কি হল? দেখি- বলে রওশন হাত বাড়ায়।
লিজা পত্রিকা দেয়। বলে, এই যে এখানে ...
রওশন পড়তে থাকে ...Dhaka, Feb 7 ... The body of a teenaged girl who was raped and whipped more than 100 times following a fatwa by a Muslim cleric last month is to be exhumed, the Dhaka High Court ordered Monday.The court ordered a fresh probe after a police inquest and autopsy discounted any marks on the body of Hena, 14, contradicting media reports and eyewitness accounts which suggested rape and whipping.
পড়া শেষ হলে রওশন দীর্ঘশ্বাস ফেলে। ক্ষোভের সুরে বলে, এ আর কি। বাংলাদেশের সব মেয়ের জন্যেই একটা করে চাবুক রাখা আছে।
মানে? লিজা চমকে ওঠে।
পঁচিশ বছরের পুরনো পিঠের দাগটা এখনও দগদগ করে, তেমন চিহ্ন নেই ...তবে যন্ত্রণার অনুভূতি আছে। রওশন ঘুরে পিঠের কাপড় সরিয়ে বলে, এই দ্যাখো।
৪২ বছরের ফরসা পেলব পিঠ, বেল্টের ক্ষতচিহ্ন আজ আর নেই, তবে মেয়ে বলেই লিজা বোঝে একদিন এ পিঠেও চাবুকের দাঁত বসেছিল। লিজা চমকে ওঠে।
রমাও।
ফিসফিস করে জিজ্ঞেস করে লিজা, কে করেছে?
তোমার বাবা।
লিজা পাথরের মতো জমে যায়। কিছুক্ষণ মাথা নীচু করে থাকে। তারপর পরে ফিসফিস করে বলে, বাবা আমাকেও মারে।
তোমাকে মারে মানে! রমা আর্ত চিৎকার করে ওঠে।
আমার নিকোলাসকে ভালো লাগে। লিজা বলল।
কে নিকোলাস ? রমা জিজ্ঞেস করে। ওর নিঃশ্বাস ঘন হয়ে ওঠে।
লিজা বলল, নিকোলাস আমার ক্লাসমেট। গত বছর আমার জন্মদিনে নিমন্ত্রণ করেছিলাম। বাবা তখন নিকোলাসের কথা জানতে পারে। বাবা নিকোলাসকে পছন্দ করে না। ওর সঙ্গে মিশতে মানা করল। আমি শুনি নি। আমি কেন শুনব! বাবা আমাকে বেল্ট দিয়ে মারল ...
রওশন দীর্ঘনিশ্বাস ফেলে। ‘অনার কিলিং’ সম্বন্ধে জানে রওশন। কয়েকদিন আগে ইটাতলিতে এক মুসলিম পরিবারের ‘পশ্চিমা হওয়ার অপরাধে মেয়েকে মেরে ফেলল বাবা ...
লিজা ওর টিশার্ট খুলে ওর পিঠের দাগ দেখায়। রমাও সালোয়ার গুটিয়ে ওর উরু দাগ দেখায়। তারপর কাঁদে, ফিসফিস করে বন্দিজীবনের কথা বলে ...ভবিষ্যতের মুক্তির কথা বলে ...
ইংরেজি পত্রিকার পৃষ্ঠা থেকে আরও একজন যেন উঠে আসে ফেব্রুয়ারির এই ঠান্ডা ঘরে ...যেন সেও তার দোররা-পিষ্ট শরীরের ক্ষত ও যন্ত্রণা এদের দেখাতে চায় ...কি যেন বলতে চায় ...

উৎসর্গ:

হেনা ... এক স্ফুলিঙ্গের নাম
পৃথিবীর সব ফতোয়াবাজদের
যে পুড়িয়ে ছারখার করে দেবে...

ইংরেজি পত্রিকার তথ্যসূত্র:

Click This Link
সর্বশেষ এডিট : ২৬ শে ফেব্রুয়ারি, ২০১১ বিকাল ৩:০১
১১টি মন্তব্য ১১টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

আমার মায়ের চৌহদ্দি

লিখেছেন শাওন আহমাদ, ১২ ই মে, ২০২৪ দুপুর ১:৩৫



আমার মা ভীষণ রকমের বকবকিয়ে ছিলেন। কারণে-অকারণে অনেক কথা বলতেন। যেন মন খুলে কথা বলতে পারলেই তিনি প্রাণে বাঁচতেন। অবশ্য কথা বলার জন্য যুতসই কারণও ছিল ঢের। কে খায়নি,... ...বাকিটুকু পড়ুন

ছেলেবেলার অকৃত্রিম বন্ধু

লিখেছেন ঢাবিয়ান, ১২ ই মে, ২০২৪ সন্ধ্যা ৭:০৯

খুব ছোটবেলার এক বন্ধুর গল্প বলি আজ। শৈশবে তার সাথে আছে দুর্দান্ত সব স্মৃতি। বন্ধু খুবই ডানপিটে ধরনের ছিল। মফস্বল শহরে থাকতো। বাবার চাকুরির সুবাদে সেই শহরে ছিলাম... ...বাকিটুকু পড়ুন

আমাদের দেশ ও জাতি সম্পর্কে আমাদের ১ জন ব্যুরোক্রেটের ধারণা!

লিখেছেন সোনাগাজী, ১২ ই মে, ২০২৪ সন্ধ্যা ৭:১৭



নীচে, আমাদের দেশ ও জাতি সম্পর্কে আমাদের ১ জন ব্যুরোক্রেটের ধারণাকে ( পেশগত দক্ষতা ও আভিজ্ঞতার সারমর্ম ) আমি হুবহু তুলে দিচ্ছি। পড়ে ইহার উপর মন্তব্য... ...বাকিটুকু পড়ুন

মোজো ইদানীং কম পাওয়া যাচ্ছে কেন?

লিখেছেন ...নিপুণ কথন..., ১২ ই মে, ২০২৪ রাত ৯:৩৭


শুনলাম বাজারে নাকি বয়কটিদের প্রিয় মোজোর সাপ্লাই কমে গেছে! কিন্তু কেন? যে হারে আল্লামা পিনাকী ভাট ভাঁওতাবাজিদেরকে টাকা দিয়ে 'কোকের বিকল্প'-এর নামে 'অখাদ্য' খাওয়ানো হচ্ছিলো, আর কোককেই বয়কটের ডাক... ...বাকিটুকু পড়ুন

জমিদার বাড়ি দর্শন : ০০৮ : পাকুটিয়া জমিদার বাড়ি

লিখেছেন মরুভূমির জলদস্যু, ১২ ই মে, ২০২৪ রাত ১০:২৪


পাকুটিয়া জমিদার বাড়ি

বিশেষ ঘোষণা : এই পোস্টে ৪৪টি ছবি সংযুক্ত হয়েছে যার অল্প কিছু ছবি আমার বন্ধু ইশ্রাফীল তুলেছে, বাকিগুলি আমার তোলা। ৪৪টি ছবির সাইজ ছোট করে ১৮ মেগাবাইটে... ...বাকিটুকু পড়ুন

×