somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

গল্প: বিস্ফোরক

১৪ ই এপ্রিল, ২০১১ সন্ধ্যা ৭:৩৫
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

ভোর। কনকনে শীতের ভিতর প্ল্যাটফর্মের ওপর দাঁড়িয়ে ছিল নাজমা । আশেপাশে ডিজেলের গন্ধ মাখা মাঘ মাসের কুয়াশা ছড়ানো। নাজমার গায়ে একটা ময়লা চাদর, বেগুনি রঙের সালোয়ারটি নোংরা; পায়ের স্যান্ডেলটিও ছেঁড়া । ধুলিমাখা নোংরা খসখসে পায়ে দাঁত বসাচ্ছে নির্দয় শীত। যারা প্রতিদিন গ্রাম থেকে উৎখাত হয়ে শূন্য হাতে এ শহরে আসে -নাজমা তাদেরই একজন। মেয়েটির যে গ্রামে জন্ম হয়েছিল ঘটনার আবর্তে সে গ্রাম থেকে মেয়েটি উৎখাত হয়ে গেছে ... এখন অপরিচিত নির্দয় একটি শহরের রেলস্টেশনের প্ল্যাটফর্মের ওপর অসহায়ভাবে দাঁড়িয়ে আছে। ওর চৌদ্দ বছরের শরীরটি কনকনে শীতে কাঁপছে। তবে কাঁপুনির চেয়ে ক্ষুধার যন্ত্রণা বেশি । অনেক ক্ষণ হল খলিল ভাইয়ের দেখা নাই ... স্টেশনে অপেক্ষা করতে বলে খলিল ভাই কই যে গেল? নাজমা এদিক-ওদিক তাকায়। কে একজন এসে দাঁড়িয়েছে। বিশ/বাইশ বছরের একটি ছেলে। লম্বা। শ্যামলা। মাথায় টুপি, গালের ছোপ ছোপ দাড়ি। মোচ কামানো। গায়ে খয়েরি রঙের চাদর। নাজমা আতরের গন্ধ পায়।
ছেলেটি নরম গলায় জিগ্যেস করল, তুমি কি কাউরে খুঁজতেছ বইন?
ছেলেটা কেমন হজুর- হুজুর দেখতে। নাজমা সন্দেহ করে না। বরং ভরসা পায়। মাথা নেড়ে বলে, হ।
কারে?
খলিল বাই রে। বাসাবাড়িতে কাম দিব বইলা খলিল বাই আমারে ঢাকায় নিয়া আনছে।
খলিল কি তুমার আপন ভাই?
না, খলিল ভাই আমার আপন ভাই না। চিনপরিচয় আছে।
ও, বুঝছি। তোমার নাম কি বইন?
নাজমা ।
বুঝছি। শুন, বইন । আমার নাম হইল জয়নাল হোসেন, মাদ্রাসায় পড়ি। আমি একজন হুজুর রে চিনি, বড় ভালো মানুষ, আল্লাহতালার ওলি। হজুরের একজন খেদমদগার দরকার । তুমি কি আমার লগে যাইবা বইন? বেতন ভালো। মাসে বারো ’শ টা।
বারো ’শ টা শুনে নাজমা অবাক হয়ে গেল। পাঁচ টাকার জন্য রমিজ মামা ওকে পিছা দিয়ে মারছিল।
জয়নাল হাঁটতে হাঁটতে বলল, হজুরের বাড়ি তিনবেলা খাওয়া ফিরি। ফিরি মানে বুঝ? ফিরি মানে মাগনা।
নাজমা মাথা নাড়ে। জয়নালের পাশাপাশি হাঁটতে থাকে। ও ফিরি মানে বোঝে। নাজমার রমিজ মামার মুদীর দোকান আছে বটপাড়া গ্রামে। রমিজ মামা বাকি দিলেও কাউরে ফিরি কিছু দেয় না।
নাজমার পেটের ভিতর ক্ষুধাটা আবার বলক দেয় । ও এদিক-সেদিক তাকায়। খলিল ভাই তো এখনও আসল না, কখন আসে কে জানে। জয়নাল ভাই হজুর মানুষ-এরা খারাপ না, বইন বইলা ডাকল। নাজমা ক্ষীণ স্বরে বলল, চলেন।
জয়নাল হাসে। মনে মনে বলে আলহামদুল্লিাহ। কিছুটা দ্রুতপায়ে স্টেশনের গেটের দিকে যেতে থাকে। আশেপাশে একবার দেখে নেয়। নাজমা জয়নালের পাশাপাশি হাঁটতে থাকে।
স্টেশনের ঠিক উলটোপিঠে কতগুলি খাওয়ার হোটেল। এই ভোরে আলো জ্বলে ছিল। হোটেলের বাইরে বড় তাওয়ায় গরম-গরম পরটা ভাজছিল। হোটেলে ঢুকে ডিমের মামলেট, হালুয়া আর পরটার অর্ডার দেয় জয়নাল । নরম স্বরে নাজমাকে হাত ধুয়ে নিতে বলে। নাজমা হাত ধুয়ে আসে।
খেতে খেতে অবাক হয়ে যায় নাজমা। সব যেন স্বপ্নের মতো মনে হচ্ছে ওর ... নাজমার চৌদ্দ বছরের জীবনটিও সাদামাটা নয় বরং ঘটনাবহুল। সাত বছর বয়েসে নাজমার আব্বা নাজমার মারে তালাক দেয় । তারপর মায়ের হাত ধরে শিবপুর ছেড়ে বটপাড়া গ্রামে চলে আসে। বটপাড়া গ্রামে নাজমার নানাবাড়ি। নানাবাড়িতে কয়েক বছর খারাপ যায় নি। তারপর নাজমার রমিজ মামা বিয়ে করল। মামী মায়ের উপর অত্যাচার শুরু করল - মামাও নাজমার মাকে গালাগালি করত। এই দুঃখে নানা মরল। নাজমার তখন দশ বছর বয়েস। নানার দুঃখে মা মরল। নাজমার বয়েস তখন এগারো বছর । নাজমাকে নানী নাজমাকে আগলে রাখত। সেই নানী অসুখে পড়ল। খাওয়ার কষ্ট, পরার কষ্ট। মামীর চোটপাট। উঠতে বসতে মামী মারত, চুরির দোষ চাপত। খানকি, মাগী বলে গালাগালি করত। খলিল-পুবপাড়ার হাসনা আপার দুঃসর্ম্পকের খালাতো ভাই । ঢাকায় চাকরি করে । হাসনা আপা নানীর কাছে নাজমাকে ঢাকায় পাঠানো প্রস্তাব দেয়, নানী কখন চোখ বুজে - নানী রাজী হয় ... এখন ঢাকায় পৌঁছে খলিল ভাইয়ের দেখা নাই, অপরিচিত ছেলের সঙ্গে ‘হডোলো’ বসে হালুয়া - পরটা খাচ্ছে। ...এ স্বপ্ন নয়তো কি!
খাওয়ার পর জয়নাল একশ টাকার একটা নোট বের করে বিল মিটাল। তারপর ওরা হোটেল থেকে বেরিয়ে এল। কুয়াশা ফুঁড়ে হালকা রোদ উঠেছে। জয়নাল ধীরেসুস্থে হাঁটে। নাজমা তার পিছন পিছন হাঁটে । খিদে মিটেছে। ভালো লাগছে। চা ও খাইতে দিল । হডোলোর চায়ের এত স্বাদ কে জানত। জয়নাল ভাই মানুষটা ভালা। বইন বইলা ডাকছে। কথা বলার সময় চোখের দিকেও তাকায় না। এখনও আড়চোখে বুকের দিকে তাকিয়ে চাদরের নীচে বুক মাপে নি। জয়নাল ভাইয়ের স্বভাবচরিত্র ভালা।
গলিতে হালকা কুয়াশার ছড়িয়ে আছে। দু’পাশের বাড়িঘর নিথর হয়ে রয়েছে এই জানুয়ারি সকালে । একটি বাড়ির সামনে চলে এল জয়নাল । পুরনো বাড়ি, চারতলা; গেট-টেট নেই, সিঁড়ি নোংরা আর কেমন অন্ধকার-অন্ধকার।
সেই অন্ধকারে আতরের গন্ধ পেল নাজমা ...
এভাবে অপরিচিত একটি শহরে নতুন জীবন শুরু হয়েছিল ওর ...



বেলালউদ্দীন হুজুর বৃদ্ধ। ধবধবে ফরসা নূরানি চেহারা, লম্বা পাকা দাড়ি। শরীরটি শীর্ণ। মাথায় তালপাখার টুপি পরেন। তিন কামরায় ছোট ফ্ল্যাট। হুজুর একাই থাকেন । মাঝে-মাঝে জয়নাল আসে। তার মাদ্রাসা কাছেই; বাজার-সদাই সেই করে দিয়ে যায়। বাসমতী চাল, তেল- ঘি, মাছমাংস । বাজার করার টাকাপয়সা বেলালউদ্দীন হুজুরই দেন। বেলালউদ্দীন হুজুর এর ফ্ল্যাটে টিভি নেই, তবে ফ্রিজ আছে। নাজমাই রান্নাবান্না করে। গ্রামের মেয়ে। রান্নাবান্না নানীর কাছে শিখেছে। নাজমার কাজকামে সন্তুষ্ট বেলালউদ্দীন হুজুর; নাজমার একটি নতুন নাম দিয়েছেন: আসমা। ডাকেন অবশ্য ‘আছমা’ বলে।
চোখে কম দেখেন বৃদ্ধ । তাকে গোছল করিয়ে দিতে হয়। খালি গায়ে লুঙ্গি পরে গোছলখানায় পিঁড়ির ওপর বসে থাকেন বৃদ্ধ; নাজমা একটা লাল প্লাসটিকের মগে বুড়া হুজুরের টাক মাথায় অল্প অল্প করে কুসুম গরম পানি ঢালে। উহুহু উহুহু করে বৃদ্ধ কাঁপে। নাজমার হাসি পায়। নাজমার চৌদ্দ বছর জীবনে হাসির ঘটনা তেমন ঘটেনি। এত বছর পর ওর জীবনে হাসি ফিরে এসেছে। এখন ওর খাওন-দাওনের কষ্ট নাই। থাকার জন্য একটা ঘর ওকে ছেড়ে দেওয়া হয়েছে। তবে নাজমাকে পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ পড়তে হয়। নামাজ পড়তে নাজমার আপত্তি নাই, বরং ভালোই লাগে। জয়নাল ওর জন্য একটা বোরখাও কিনে দিয়েছে। মাঝেমাঝে নিচে যেতে হয় নাজমাকে। গলির মাথায় রউফের মুদী দোকান থেকে এটা-ওটা আনতে। তখন বোরখা পরে।
বুড়া হুজুরের ঘরে আতরের গন্ধ। নাজমার ভালো লাগে। দেওয়ালে একটা তরবারি। ওটা দেখলে নাজমার ভয় করে। বুড়া হুজুরের খাটের নীচে একটা কাঠের বাক্সে আছে। সে বাক্সে টাকার বান্ডিল। নাজমা উঁিক মেরে দেখেছে টাকা বের করে জয়নাল ভাইকে দিতে। বুড়া হুজুর এত টাকা পাইল কই? নাজমার মাথায় ধরে না। বুড়া হুজুর কি কাম করে নাজমার বোঝার কথা না। তবে বৃদ্ধের প্রতি গভীর ভালোবাসা বোধ করে। হজুরের কাছে মোবাইল আছে। মইধ্যে-মইধ্যে হজুরে কার লগে যেন কথা কয়। আরবি ভাষায় কথা বলে বুড়া হুজুর । ... পুবপাড়ার হাসনা আপার কাছে মোবাইল আছে। হাসনা আপার স্বামী মালয়েশিয়া থাকে। নাজমারে জড়ায়া কান্দে হাসনা আপা। হাসনা আপার লগে কথা বলতে ইচ্ছা করে। বুড়া হুজুর রে বলতে সাহস হয় না।
মাঝে-মাঝে বুড়া হুজুরের কাছে লোকজন আসে। হুজুরের কামরায় বসে ফিসফিস কথা বলে। বাইরের লোকজন আসলে হুজুরের ঘরে ঘরে নাজমা প্রবেশ নিষেধ।



কয়েক সপ্তাহ পরের কথা।
শুক্রবার। সকাল বেলা জয়নাল ভাই এসে বাজার করে দিল। মাস শেষ না- হলেও বুড়া হুজুর বেতন দিয়েছেন। বারোটা চকচকে একশ টাকার নোট। টাকা হাতে নিতে নাজমার বুকটা হিম হয়ে এসেছিল। আজ সকালে টাকাটা জয়নাল ভাইকে দিয়েছে নানীর কাছে পাঠাতে । গ্রামের বিস্তারিত ঠিকানাও দিয়েছে। জয়নাল ভাই টাকা পাঠিয়ে দিবে বলল।
আজ মুগের ডাল দিয়ে রুই মাছের মাথা রেঁধেছিল নাজমা। বেলালউদ্দীন হুজুর জুম্মার নামাজ পড়ে এসে খেতে বসলেন। রুই মাছের মাথা দিয়ে মুগের ডাল খেতে ভালোবাসেন বেলালউদ্দীন হুজুর । নাজমার রান্নাও ভালো। এই বয়েসে মাশাল্লা খেতেও পারেন।
খাওয়ার পর বিছানায় আধশোওয়া হলেন বৃদ্ধ । নাজমা এঁটো বাসনকোসন ধুয়ে ঘরে এল। এই সময়ে বুড়া হুজুরের পা টিপতে হয়। নাজমা ঋণ শোধ করার সুযোগ পায়। বুড়া হুজুর থাকতে দিসেন, খাইতে দিছেন, তার জন্য কষ্ট করতে ভালো লাগে নাজমার ... কৃতজ্ঞতায় ওর কান্নাও পায়।
এই সময়ে কিছু অন্তরঙ্গ কথাও হয়। বেলালউদ্দীন হজুর নাজমাকে এক যুদ্ধের কথা বলেন । দ্বীন আর বে-দ্বীনের মধ্যে চলছে সে যুদ্ধ। বালিশের তলা থেকে একটা ম্যাপ বের করে নাজমাকে দেখান। ম্যাপটা আফগাস্তিানের। বিশ বৎসর আগে বুড়া হুজুরে নাকি সে দেশে ছিলেন, ট্রেনিং নিসিলেন; বুড়া হুজুর বলেন, আফগাস্তিান একদিন হবে দুনিয়ার হেডকোয়ার্টার ...নাজমা এসব কথা বোঝে না, তবে বিশ্বাস করে। বুড়া হুজুর এই বয়েসে মিছা কথা কইতে যাব কোন দুঃখে ...
আজ বুড়া হজুর বড় আশ্চর্য কথা বললেন, জয়নালে তোরে শাদী করবার চায় রে আছমা।
এই কথায় নাজমা শরম পায়। ওর হাত হুজুরের উরুর ওপর থমকে যায়। কাল রাতে অদ্ভূত এক স্বপ্ন দেখেছে জয়নাল ভাইকে নিয়ে। এখন সেই অদ্ভূত স্বপ্নের কথা মনে পড়ে গেল।
বেলালউদ্দীন হুজুর বললেন, জয়নালে পিরোজপুরের পোলা, ভালাই পোলাটা, সংসারে মা আর বোন আছে। বাপ নাই, বাপ মইরা গেছে। অভারে সংসার, জমি বন্দক দিয়া মাদ্রাসায় পড়তে আসছে। বল সোবানাল্লা।
সোবানাল্লা। নাজমা অস্ফুট স্বরে বলে।
হ। চাইর-পাঁচ বছর আগে তোর বিয়ার বয়স হইছে । আমি তরে জয়নালের লগে বিয়া দিমু। বোঝছোস?
নাজমা আর কি বলবে। ওর শরীর শিরশির করে। চৌদ্দ বছরের কিশোরী শরীর। একা থাকলে জয়নাল ভাইরে নিয়া ভাবে। সেই কথা আল্লাহ ছাড়া কেউ জানে না।
হঠাৎ বেলালউদ্দীন হজুর পা সরিয়ে বললেন, শুন, আছমা। তর আর পা টিইপা কাম নাই। এখন তুই রান্নাঘর থেকে ছালার ব্যাগ আন।
ছালার ব্যাগ? নাজমা অবাক হলেও উঠে রান্নাঘরে যায়। বাজারের ব্যাগটা ভাঁত করে নিয়ে আসে। বুড়া হুজুর বিছানায় পা ঝুলিয়ে বসেছেন। হাতে খবরের কাগজে মোড়ানো একটি ছোট বাক্স। তারপর বললেন, রউফের মুদি দোকান আছে না?
হ। আছে।
সেই দোকানে পাশে গলি আছে না একডা?
হ। আছে।
সেই গলি দিয়া ঢুকলে হাতের ডাইনে সাদা রং করা একখান চারতলা বাড়ি দেখছস?
হ। দেখছি।
অখন তুই সেই বাড়ির সামনে যাবি। গেইটে বুড়া মতন দারোয়ানে আটকাইেেল কবি আমি হাজী তাইফুর হুজুরের গ্রামের বাড়ি থেইকা আসছি। তারপরে সোজা চারতলায় উঠবি। যে দরজা খুলব। তারে এই ছালার ব্যাগ দিবি। তর কুনও সমস্যা নাই। আমি মুবাইলে সব বইলা রাখছি।
আইচ্ছা। নাজমা মাথা নাড়ল।
বেলালউদ্দীন হজুর বাক্সটা দোওয়া পড়তে পড়তে বাজারের ব্যাগের ভিতরে ভরলেন। তারপর বললেন, যা বোরখা পইরা আয়।
নাজমা ওর ঘরে ঢুকে বোরখা পরে আসে।



ফাল্গুন মাসের মিষ্টি রোদে ডুবে আছে গলিটা । নাজমা হাঁটতে থাকে। বেশ ভারি ব্যাগ। বাক্সে কি আছে কে জানে। দিনটা শুক্রবার বলে গলিটা ফাঁকা । মাঝে-মাঝে একটা-দুটে রিকশা যাচ্ছে ...স্টেশন কাছেই। ট্রেনের হুইশেল শুনতে পেল নাজমা। ট্রেনে চেপে এ শহরে একদিন এসেছিল । আল্লায় ইচ্ছায় স্টেশনে জয়নাল ভাইরে সঙ্গে দেখা হইছিল। জয়নাল ভাইয়ের কথা মনে পড়তেই লজ্জ্বা পেল নাজমা। কাল রাত্রের স্বপ্নে জয়নাল ভাই ওকে কোলে নিয়ে আদর করেছিল ... শিবপুর গ্রামে মিদ্দাবাড়ির পিছনে খালপাড়ের ঝোপের ভিতর... ছোট থাকতে আব্বার সঙ্গে মিদ্দাবাড়ির পিছনে খালপাড়ে মাছ ধরতে যেত ... মিদ্দা বাড়ির মোমেনা চাচী আসত। আব্বায় ছিপ নাজমার হাতে ধরায় দিয়া ঝোপের আড়ালে যাইত। মোমেনা চাচীরে কোলে নিত আব্বা মোমেনা চাচীর সঙ্গে জড়াড়ড়ি করত, ...পরে শুনেছিল নাজমা ... মোমেনা চাচীর জন্য বাবা মারে তালাক দিসে ... স্বপ্নে ঝোপের মধ্যে বইসা ছিল নাজমা ... জয়নাল আইসা নাজমারে কোলে নিল। কি ফুরফুর আতরের গন্ধ ... জয়নাল ভাইয়ের গালে চুমা খাইতেই ওর স্তন দুটো শক্ত হয়ে উঠল ... নাজমার দাড়ি ভালো লাগে না, ... বলে ... আপনে দাড়ি কামাইয়া ফেলেন। জয়নাল ভাই হা হা কইরা হাসল ...তখন ঘুম ভাঙল ...ফজরের আজান দিল ... উঠে বাথরুমে গিয়ে গোছল করল ... গা তখনও শিরশির করছিল ...
বুড়া হুজুরে কইল জয়নাল ভাইয়ের বাড়ি পিরোজপুর। পিরোজপুর কোথায়? নাজমা পিরোজপুর যাবে না। বুড়া হুজুররে ছাইড়া নাজমা কোথাও যাবে না। বুড়া হুজুর দেখতে নাজমার নানার মতো । নাজমার নানায় বাঁইচা থাকতে নাজমারে বহুত আদর করত। বর্ষাকালে নৌকায় তুইলা ঝিলে নিয়া যাইত । নাজমার তখন নয়-দশ বছরবয়েস। ঝিলের পানি তে ডুব দিয়া শাপলাশালুক কড়াইত নাজমা। নানা বৈঠা বাইত। মেঘলা আকাশ ... ঝিরঝির বৃষ্টি। শাপলাশালুক তুলে নৌকায় রাখত নাজমা। একদিন ... নানা নৌকার মধ্যে হাত-পা ছাইড়া দিল। নাজমার কি চিৎকার ... বৈঠা নানার হাত থেকে খইসা পানিতে পড়ছে। নৌকা থেকে পানিতে ডুব দিয়ে বৈঠা খুঁইজা আবার নৌকায় উঠে বাইতে থাকে নাজমা। নৌকায় উপর নানার মরা লাশ। নৌকা ঘাটে লাগতে না লাগতে নাজমার সে কি চিৎকার ... রমিজ মামা মুদী দোকান থেকে দৌড়ে আসছিল ...
বুড়া হুজুরে নানার মতন দেখতে । আল্লা নানারে আবার ফিরায়ে দিসে। না, জয়নাল ভাইয়ের সঙ্গে বিয়া হইলেও নাজমা পিরোজপুর যাবে না।
রউফের মুদী দোকানের পাশে গলি। হাতের ডাইনে সাদা রং করা চারতলা বাড়ি। কালো লোহার গেট। একজন বুড়া টুলে বসে কান চুলকাচ্ছিল। দারোয়ান মনে হয়। নাজমাকে দেখেই বুড়া কান চুলকানি বাদ দিয়ে চেঁচিয়ে উঠল, এই ছেমড়ি! কই যাইবি তুই ?
নাজমা বলল, তাইফুর হুজুরের কাছে যামু। হুজুরের গ্রামের থনে আসছি।
হ। বুঝছি। যা। হুজুরে চারতলায় থাকেন।
হ, জানি। মায়ে কইয়া দিসে। বুদ্ধি করে বলে নাজমা। তারপর সিঁড়ি দিয়ে উঠতে থাকে।
কলিং বেল চাপার পর পায়জামা আর গেঞ্জি পরা একটি ছেলে দরজা খুলে দিল । ছেলেটি জয়নাল ভাইয়ের বয়েসি - তবে ফরসা। জয়নাল শামলা। শামলাই ভালো। ফরসা দিয়া আমার কাম কি।
ছালাম। নাজমা সালাম দেয়।
ওলাইকুম। তুমার নাম কি আছমা?
হ।
তুমারে কি আলাম্মা বেলালউদ্দীন হুজুরে পাঠাইছেন বইন?
হ। বুড়া হুজুরে আমার নানা লাগে।
ও আইচ্ছা। আমার নাম জিল্লুর। হাজী তাইফুর হুজুরে আমার আব্বা লাগেন। হুজুরে তুমার কথা বইলা আমারে মুবাইল করছিল। আস, তুমি ভিতরে আস বইন।
নাজমা ভিতরে ঢোকে। ঘরের পরদা ফেলা। টিউব লাইট জ্বলেছিল। জিল্লুর দরজা বন্ধ করে। বলে, দাও বোন, ব্যাগটা আমারে দাও।
নাজমা জিল্লুরকে ছালার ব্যাগ দেয়। জিল্লুর সাবধানে নেয়। তাকে উত্তেজিত দেখাচ্ছিল। চাপা স্বরে বলে ‘তুমি বস বইন, আমি অখনই আসতেছি।’ বলে বাক্সটা নিয়ে পাশে ঘরে যায়।
চারিপাশে চোখ বোলায় নাজমা। ঘরে তিনটা নীল রঙের প্লাস্টিকের চেয়ার । সিমেন্টের মেঝেতে কাগজের টুকরা ছড়ানো । সাদা রং করা দেওয়াল। এক কোণে কয়েক কার্টন বাক্স । সারা ঘরে মৃদু কেরোসিনের গন্ধ ছড়ানো । পাশের ঘরে যাওয়ার দরজাটা খোলা। নাজমা উঁিক দিয়ে দেখল পাশের ঘরে টিউব লাইট জ্বলে আছে। খাট-পালঙ্ক কিছু নেই। একটা বড় টেবিল। টেবিলে অনেক তার, যন্ত্রপাতি, আর বই। টেবিলের কাছে কয়েক জন অল্পবয়েসি ছেলে দাঁড়িয়ে। মুখে দাড়ি, মাথায় টুপি। ওদের পাশে দাঁড়িয়ে আছে জিল্লুর। ব্যাগ থেকে সেই খবরের কাগজে মোড়ানো ছোট বাক্স বার করেছে। কি যেন বলাবলি করছে ওর। ‘ডেটেনেটোর’ শব্দটি নাজমার কানে আসল ... নাজমার ইংরেজি শব্দটি বোঝার কথা নয়। কারা এরা? এর কি বুইরা নানার পরিচিত? এইখানে কি করে ...বাক্সের মইধ্যে কি আছে? হাজী তাইফুর হুজুরে কই?
এসব প্রশ্ন মাথায় নিয়ে চেয়ারে বসল নাজমা ।
একটু পর জিল্লুর এল ঘরে, হাতে একটা গ্লাস।
ঠিক তখনই পাশের ঘরটা বিস্ফোরনে প্রচন্ড শব্দে কেঁপে উঠল ...

বিস্ফোরন পর নিরাপত্তা কর্মকর্তারা ঘটনাস্থলে পৌঁছেছিল।
ধ্বংসস্তূপের ভিতর বোরখা জড়ানো একটি কিশোরীর দলাপাকানো শরীর দেখে নিরাপত্তা কর্মকর্তারা বিস্মিত হয়ে গিয়েছিল ...

সর্বশেষ এডিট : ১৭ ই এপ্রিল, ২০১১ দুপুর ২:৫৬
২৪টি মন্তব্য ২৩টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

জীবন চলবেই ... কারো জন্য থেমে থাকবে না

লিখেছেন অপু তানভীর, ০২ রা মে, ২০২৪ সকাল ১০:০৪



নাইমদের বাসার ঠিক সামনেই ছিল দোকানটা । দোকানের মাথার উপরে একটা সাইনবোর্ডে লেখা থাকতও ওয়ান টু নাইন্টি নাইন সপ ! তবে মূলত সেটা ছিল একটা ডিপার্টমেন্টাল স্টোর। প্রায়ই... ...বাকিটুকু পড়ুন

যুক্তরাষ্ট্রে বিশ্ববিদ্যালয়ে ফিলিস্তিনের পক্ষে বিক্ষোভ ঠেকাতে পুলিশি নির্মমতা

লিখেছেন এমজেডএফ, ০২ রা মে, ২০২৪ দুপুর ১:১১



সমগ্র যুক্তরাষ্ট্র জুড়ে ফিলিস্তিনের পক্ষে বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাসগুলোতে বিক্ষোভের ঝড় বইছে। যুক্তরাষ্ট্রের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে ফিলিস্তিনের পক্ষে বিক্ষোভ কর্মসূচী অব্যাহত রয়েছে। একাধিক বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন বিক্ষোভ দমনের প্রচেষ্টা চালালেও তেমন সফল... ...বাকিটুকু পড়ুন

ছাঁদ কুঠরির কাব্যঃ ০১

লিখেছেন রানার ব্লগ, ০২ রা মে, ২০২৪ রাত ৯:৫৫



নতুন নতুন শহরে এলে মনে হয় প্রতি টি ছেলেরি এক টা প্রেম করতে ইচ্ছে হয় । এর পেছনের কারন যা আমার মনে হয় তা হলো, বাড়িতে মা, বোনের আদরে... ...বাকিটুকু পড়ুন

হিটস্ট্রোক - লক্ষণ ও তাৎক্ষণিক করণীয়

লিখেছেন ঢাকার লোক, ০২ রা মে, ২০২৪ রাত ১০:০৭

সাধারণত গরমে পরিশ্রম করার ফলে হিটস্ট্রোক হতে পারে। এতে দেহের তাপমাত্রা অতি দ্রুত বেড়ে ১০৪ ডিগ্রী ফারেনহাইট বা তারও বেশি হয়ে যেতে পারে।

হিটস্ট্রোক জরুরি চিকিৎসা প্রয়োজন। চিকিৎসা... ...বাকিটুকু পড়ুন

আল্লাহকে অবিশ্বাস করার সংগত কোন কারণ নাই

লিখেছেন মহাজাগতিক চিন্তা, ০২ রা মে, ২০২৪ রাত ১০:৪৩



সব কিছু এমনি এমনি হতে পারলে আল্লাহ এমনি এমনি হতে সমস্যা নাই। বীগ ব্যাং এ সব কিছু হতে পারলে আল্লাহও হতে পারেন। সব কিছুর প্রথম ঈশ্বর কণা হতে পারলে আল্লাহও... ...বাকিটুকু পড়ুন

×