somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

গ্রিক মিথ: প্রক্রিস

১৩ ই জুলাই, ২০১১ দুপুর ১২:৪৫
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

মান্না দের একটি গান দিয়ে শুরু করছি:

সবাই তো সুখি হতে চায়,
তবু কেউ সুখি হয় কেউ হয় না।
জানি না বলে যা লোকে সত্যি কি না
কপালে সবার নাকি সুখ সয় না ...

আজ থেকে আড়াই হাজার বছর আগে প্রাচীন গ্রিসের সুন্দরী নারী প্রক্রিস সম্ভবত এমনটাই ভেবেছিল। নইলে প্রক্রিস কেন সুখি হল না ? এথেন্স নগরের উপকন্ঠে গভীর অরণ্যে ভিতরে একখানি মনোরম কাঠের কুটির। সে কুটিরেই স্বামী সিফালাস-এর সঙ্গে সুখে দিন কাটছিল তরুণি প্রক্রিস-এর । প্রক্রিস তাহলে সুখি হল না কেন? কেন তাদের মাঝখানে চলে এল উষাদেবী ইওস?




লিন্ডা শাটন-এর আঁকা সিফালাস এবং প্রক্রিস।

প্রক্রিস - এর স্বামী সিফালাস ছিল শিকার-পাগল মানুষ। রাতের বেলা গভীর অরণ্যে শিকার করতে যেত সিফালাস । কখনও রাতে অরণ্যময় ছড়িয়ে থাকে প্রগাঢ় জোছনা । নিজেকে আড়াল করবার জন্য সিফালাস ফিসফিস করে আকাশের মেঘ কে ডাকে: ‘এসো, নেফেলি, এসো।’ তারপর ভোর পর্যন্ত শিকার করত সিফালাস । ভোরের দেবী ইওস। তিনি গ্রিক জগতে ‘উষাদেবী ইওস’ নামে পরিচিত।
এক রাতে অরণ্যে শিকার করছিল সিফালাস। রাত গড়িয়ে ভোর হল । তখন সিফালাস-এর কাছে এল উষাদেবী ইওস। তার গভীর আবেগে বলল, সিফালাস আমি তোমাকে ভীষণ ভালোবাসি । এসো, আমাকে আদর কর।
সিফালাস বলল, নাঃ! তা সম্ভব নয়।
কেন? কেন সম্ভব নয়? উষাদেবী ইওস ফুঁসে ওঠে।
আমি প্রক্রিসকে ভালোবাসি। সিফালাস ক্রোধ চেপে বলল।
ও। উষাদেবী ইওস ঠোঁট বাঁকিয়ে হাসল। তারপর বলল, তুমি যে প্রক্রিসকে এত ভালোবাস। কিন্তু, প্রক্রিস কি তোমার প্রতি বিশ্বস্ত?
হ্যাঁ। বিশ্বস্ত। প্রক্রিস আমাকে গভীর ভাবে ভালোবাসে । চিৎকার করে বলল সিফালাস।
আচ্ছা, পরখ করেই দেখ না। দেখবে নারীর ভালোবাসা কত ঠুনকো। উষাদেবী ইওস বলল। ঠোঁটে ক্রর হাসি।
কথাটা শুনে সিফালাস- এর মন কেমন গাঢ় অস্বস্তিতে ছেয়ে যায়। উষাদেবী ইওস বলল তা কি সত্যি? আমার প্রতি প্রক্রিস-এর ভালোবাসা কি ঠুনকো? ভাবতে ভাবতে এথেন্স নগরে চলে এল সিলাফাস। তখনও ভাবছিল: আমি কি প্রক্রিসকে পরখ করে দেখব? উষাদেবী ইওস কে দেখিয়ে দেবে প্রক্রিস-এর সততা?
এইসব ভেবে ব্যবসায়ীর ছদ্মবেশ ধারণ করল সিফালাস । একটি ঝুলিতে সোনার অলঙ্কার ভরে নিল।
তারপর অরণ্যের কুটিরে এল।
প্রক্রিস দরজা খুলে অবাক। সুদর্শন এক তরুণ দাঁড়িয়ে আছে।
ছদ্মবেশী সিফালাস বলে, আমার নাম পোলাক্স। আমি থিবস নগর থেকে এসেছি। আমি সিফালাস-এর বন্ধু। সিফালাস কি ঘরে আছে?
না। আপনার বন্ধু এখনও শিকার করে ফেরেনি।
তাহলে আমি না হয় পরে আসি। ছদ্মবেশী সিফালাস বলল।
না, না। আসুন, আসুন । সিফালাস এখনি ফিরে আসবে। প্রক্রিস উচ্ছ্বসিত হয়ে বলে।
সামান্য বিষন্ন হল ছদ্মবেশী সিফালাস। সে কুটিরে ঢোকে। চারিপাশে তাকায়। আপন মনে হাসে। তারপর সুন্দর একটি আসনে বসে।



অদম্য এই আকর্ষন ...

আঙুর মদ নিয়ে আসে প্রক্রিস । মুখোমুখি একটা আসনে বসে। তারপর গল্প করতে থাকে । ছদ্মবেশি সিফালাস কৌশলে প্রক্রিস কে জানিয়ে দেয় যে সে খুব ধনী ব্যবসায়ী । এক ফাঁকে ঝুলি থেকে সোনার অলঙ্কার বার করে ছদ্মবেশি সিফালাস ।
এমন গয়না! এথেন্সের রানীরও নেই যে! প্রক্রিস অভিভূত হয়ে পড়ে।
এই গয়নাগুলি আমি তোমাকে উপহার দিলাম। ছদ্মবেশী সিফালাস উষ্ণস্বরে বলে।
অভিভূত প্রক্রিস- এর নিঃশ্বাস আটকে আসে।
গভীর অরণ্যের শূন্য কুটির ... ছদ্মবেশী সিফালাস গাঢ়স্বরে বলে: প্রক্রিস?
বলুন পোলাক্স।
তুমি খুব সুন্দল।
প্রক্রিস চুপ করে থাকে। কাঁপছে ...
এই হারটি কি আমি তোমার কন্ঠে পরিয়ে দিতে পারি ? ছদ্মবেশী সিফালাস বলল।
দিন না। কাঁপা কাঁপা কন্ঠে বলে প্রক্রিস। বলে উঠে দাঁড়ায়।
প্রক্রিস-এর পিছনে ছদ্মবেশী সিফালাস এসে দাঁড়াল ... তারপর সহসাই প্রক্রিস কে জড়িয়ে ধরে চুমু খেতে থাকে ... প্রক্রিস চোখ বন্ধ করে ... বাধা দেয় না ... প্রক্রিস সম্ভবত ভাবছিল ... থিবস নগরের ব্যবসায়ী পোলাক্স আমাকে ভালোবাসে ...নইলে আমাকে অত গয়না উপহার দেবে কেন ... আর আমাকে ভালোবাসে যখন ...তখন ...



প্রক্রিস-এর অসততায় সিফালাস এর হৃদয় ভেঙে গিয়েছিল ...

তারপর ছদ্মবেশ খুলে ফেলেছিল সিফালাস। আর্ত চিৎকার করে উঠেছিল প্রক্রিস। তারপর লজ্জ্বায় মুখ ঢেকেছিল। প্রক্রিস কে তীব্র ভাষায় তিরস্কার করেছিল সিফালাস । উষাদেবী ইওস কাছে মুখ দেখাবে কি করে ...এই ভেবে ... চুলে মুঠি ধরে প্রক্রিস কে কুটির থেকে বের করে দিয়েছিল। ছুটতে ছুটতে কাঁদছিল প্রক্রিস ।
প্রক্রিস ছদ্মবেশ ধারণ করে ক্রীট দ্বীপে চলে গিয়েছিল ...



ভূমধ্যসাগরে ক্রীট দ্বীপের অবস্থান।

ক্রীট দ্বীপের রাজার নাম মাইনস। বৃদ্ধ। রানির নাম প্যাসিফি। তারা তরুণি প্রক্রিসকে আশ্রয় দিল । প্রক্রিস সুন্দরী। রানী প্যাসিফি বৃদ্ধা। তিনি প্রক্রিসকে চোখে চোখে রাখেন। রাজা মাইনস বৃদ্ধ হয়েছেন। বৃদ্ধ বয়েসে সুন্দরী তরুণির প্রতি প্রবল আকর্ষন বোধ করাই স্বাভাবিক।
যা হোক। অরণ্যদেবী আর্টেমিস মাইনস কে দৈব কুকুর ও দৈব বর্শা দান করেছিলেন। রাজা মাইনস জিনিস দুটি কিছুটা উদ্দেশ্যপ্রনোদিত ভাবে প্রক্রিস কে দেখালেন। প্রক্রিস জিনিস দুটি পছন্দ করে ।
রাজ মাইনস সুযোগ নিতে ছাড়লেন না। বললেন, প্রক্রিস আমি তোমাকে দৈব কুকুর ও দৈব বর্শা উপহার দিতে পারি। যদি -
প্রক্রিস মধুর হেসে বলল, যদি ?
যদি-তুমি আমায় নিভৃতে সঙ্গ দাও।
সুখের সংসার ভেঙে যাওয়ায় সম্ভবত হতাশায় ভুগছিল প্রক্রিস । সে রাজার সঙ্গে নিভৃতে মিলিত হতে রাজি হল।
রানি প্যাসিফি তার অনুগত চরের মুখে সবই শুনলেন। রানীর অনুগত সশস্ত্র দাস ছিল । তাদের নিয়ে প্রক্রিসের কাছে গেলেন। বললেন, প্রক্রিস!
বলুন।
ব্যাভিচারী! তুই আজই ক্রীট দ্বীপ ছেড়ে চলে যা! নয়তো মৃত্যু কে বেছে নে ...
প্রক্রিস দৈব কুকুর ও দৈব বর্শা নিয়ে এথেন্স ফিরে আসে।
তারপর সেই অরণ্যের কুটিরে যায়। সিফালাস কুটিরে বসে মদ খাচ্ছিল। চোখ লাল। মুখে খোঁচা খোঁচা দাড়ি। প্রক্রিস দেখে চেঁচিয়ে উঠতে যাবে তখনই দৈব কুকুর ও দৈব বর্শা চোখে পড়ল। শান্ত হল সে।
বলল, আমি তোমাকে এই দৈব কুকুর ও দৈব বর্শা দিতে পারি যদি তুমি সব ভুলে যাও।
প্রক্রিসশূন্য দিনগুলি অসহ্য ঠেকছিল। তা ছাড়া শিকার করতে ভালোবাসে সিফালাস । দৈব কুকুর ও দৈব বর্শা পেলে ভালো হয়।
এইসব ভেবে প্রক্রিসকে নতুন করে বরণ করে নেয় সিফালাস ।



অরণ্যদেবী আর্টেমিস। দৈব কুকুর ও দৈব বর্শার বিনিময়ে প্রক্রিস ব্যাভিচার করেছে বলে ইনি প্রক্রিসের উপর ভয়ানক ক্ষেপে উঠেছিলেন । প্রক্রিসকে ধ্বংস করে দেবেন বলে প্রক্রিস- এর মনে সিফালাস-এর প্রতি সন্দেহের বীজ বুনে দিয়ে ছিলেন দেবী আর্টেমিস ...

দিন যায় ...
প্রক্রিস এর মন অস্থির হয়ে ওঠে। তার বারবার মনে হতে লাগল সিফালাস কি কাউকে ভালোবাসে? সিফালাস কি কেবল আমাতেই সন্তুষ্ট? এই ভাবনা তাকে আচ্ছন্ন করে ফেলে। দৈব কুকুর ও দৈব বর্শা রাত্রে গভীর অরণ্যে শিকার করতে যায় সিফালাস ।
এক রাতে প্রক্রিস তাকে অনুসরণ করে।
সে রাতে অরণ্যময় ছড়িয়েছিল প্রগাঢ় জোছনা ।
নিজেকে আড়াল করবার জন্য সিফালাস ফিসফিস করে আকাশের মেঘ কে ডাকে: ‘এসো, নেফেলি, এসো।’
নেফেলি? কে নেফেলি?
আড়ালে থাকা প্রক্রিস চমকে ওঠে । ওর সন্দেহ ঘনীভূত হয়ে ওঠে। ও অভূতপূর্ব দৃশ্য দেখার আশায় সিফালাস এর আরও কাছে যেতে থাকে।
অরণ্যের মাটিতে পড়ে থাকা শুকনো পাতার উপর মশমশ শব্দ হয়।
শ্বাপদ!
দৈব বর্শাটি তাক করে সিফালাস । তারপর আবছা অবয়বের দিকে ছুড়ে মারে সে দৈব বর্শা।
কে যেন আর্তনাদ করে ওঠে ...নারীকন্ঠ ...
সিফালাস ছুটে যায় ... প্রগাঢ় জোছনায় দেখল মাটিয়ে লুটিয়ে আছে প্রক্রিস । বুকে বিদ্ধ দৈব বর্শা।
হায় প্রক্রিস!
সিফালাস আর্তনাদ করে ওঠে ...



ইংরেজ চিত্রকর উইলিয়াম টার্নার-এর আঁকা সিফালাস এবং প্রক্রিস।

ছবি: ইন্টারনেট।

তথ্যসূত্র:

Click This Link
http://www.maicar.com/GML/Procris2.html
Click This Link
Click This Link
http://en.wikipedia.org/wiki/Cephalus
১৭টি মন্তব্য ১৬টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

ছিঁচকাঁদুনে ছেলে আর চোখ মোছানো মেয়ে...

লিখেছেন খায়রুল আহসান, ১৮ ই এপ্রিল, ২০২৪ সকাল ১১:০৯

ছিঁচকাঁদুনে ছেলে আর চোখ মোছানো মেয়ে,
পড়তো তারা প্লে গ্রুপে এক প্রিপারেটরি স্কুলে।
রোজ সকালে মা তাদের বিছানা থেকে তুলে,
টেনে টুনে রেডি করাতেন মহা হুলস্থূলে।

মেয়ের মুখে থাকতো হাসি, ছেলের চোখে... ...বাকিটুকু পড়ুন

অহমিকা পাগলা

লিখেছেন আলমগীর সরকার লিটন, ১৮ ই এপ্রিল, ২০২৪ সকাল ১১:১৪


এক আবেগ অনুভূতি আর
উপলব্ধির গন্ধ নিলো না
কি পাষাণ ধর্মলয় মানুষ;
আশপাশ কবর দেখে না
কি মাটির প্রণয় ভাবে না-
এই হলো বাস্তবতা আর
আবেগ, তাই না শুধু বাতাস
গায়ে লাগে না, মন জুড়ায় না;
বলো... ...বাকিটুকু পড়ুন

হার জিত চ্যাপ্টার ৩০

লিখেছেন স্প্যানকড, ১৮ ই এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ১:৩৩




তোমার হুটহাট
চলে আসার অপেক্ষায় থাকি
কি যে এক ছটফটানি
তোমার ফিরে আসা
যেন প্রিয় কারো সনে
কোথাও ঘুরতে যাবার মতো আনন্দ
বারবার ঘড়ি দেখা
বারবার অস্থির হতে হতে
ঘুম ছুটে... ...বাকিটুকু পড়ুন

জীবনাস্ত

লিখেছেন মায়াস্পর্শ, ১৮ ই এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ১:৪৪



ভোরবেলা তুমি নিশ্চুপ হয়ে গেলে একদম,
তোমার বাম হাত আমার গলায় পেঁচিয়ে নেই,
ভাবলাম,তুমি অতিনিদ্রায় আচ্ছন্ন ,
কিন্তু এমন তো কখনো হয়নি
তুমি বরফ জমা নিথর হয়ে আছ ,
আমি... ...বাকিটুকু পড়ুন

যে দেশে সকাল শুরু হয় দুর্ঘটনার খবর দেখে

লিখেছেন এম ডি মুসা, ১৮ ই এপ্রিল, ২০২৪ রাত ৮:১১

প্রতি মিনিটে দুর্ঘটনার খবর দেখে অভ্যস্ত। প্রতিনিয়ত বন্যা জলোচ্ছ্বাস আসে না, প্রতিনিয়ত দুর্ঘটনার খবর আসে। আগে খুব ভোরে হকার এসে বাসায় পত্রিকা দিয়ে যেত। বর্তমানেও প্রচলিত আছে তবে... ...বাকিটুকু পড়ুন

×