somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

গল্প: খোঁজ

০৩ রা আগস্ট, ২০১১ বিকাল ৩:৩১
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

তুমি আমাদের অন্তরঙ্গ মিলনদৃশ্যের ছবি প্রকাশ করেছ, সে জন্য আমি অপমানিত বোধ করেছি ; তবে তার চেয়েও বেশি কষ্ট পেয়েছি তুমি আমাকে ভালোবাস না বলে। এই নির্মম সত্য উপলব্দি করে আমি পৃথিবী ছেড়ে চলে যাচ্ছি। ছোট চিরকুট। ছোট-ছোট অক্ষরে মেয়েলি হাতের বল পয়েন্টে লেখা। চিরকুট পড়ে রাশেদ খানিক ক্ষণ স্তব্দ হয়ে দাঁড়িয়ে রইল। ফাঁকা ঘরগুলি ঘুরে ঘুরে দেখছিল সে । একটু আগে চিরকুটটা মেঝেতে কুড়িয়ে পেয়েছে। আবছা কিছু মনে পড়ল যেন। পত্রিকায় পড়া কোনও মর্মান্তিক আত্মহত্যার রিপোর্ট। ওকে কেমন উদভ্রান্ত দেখায়।
কিছুদিন হল এই মফঃস্বল শহরে এসেছে রাশেদ। হেড অফিস থেকে পাঠিয়েছে। এই শহরে কোম্পানীর একটা ডিপো আছে। কিছুদিন ধরে হিসেবে গড়মিল হচ্ছিল। রাশেদকে ডিপোর ইনচার্জ করে পাঠিয়েছে। অফিসের কাছে বাড়ি ভাড়া নিতে হয়েছে। ফাঁকা বাড়িতে মালপত্র তোলার দিনই মেঝের ওপর চিরকুট কুড়িয়ে পেয়েছে। কে লিখেছে? যাকে উদ্দেশ্য করে লেখা সে চিরকুট পায়নি। নইলে চিরকুটটা ঘরের মেঝেতে পড়ে থাকবে কেন? বাতাসে উড়ে গিয়েছিল কি?
চিরকুট- এর লেখা কেমন বিষন্ন, কেমন দীর্ঘশ্বাসময়। রাশেদকে আচ্ছন্ন করে ফেলে। মেয়েটির মুখ কল্পনা করার চেষ্টা করে। অফিসের কাজে মন বসে না। অস্থির বিষন্ন মনে সন্ধ্যার পর রাস্তায় অনেক ক্ষণ হাঁটে। আজকাল মফঃস্বল শহরের মোড়ে-মোড়ে আধুনিক শপিং সেন্টার । শপিং সেন্টারে মোবাইল ফোনের শোরুম, কম্পিউটারের দোকান। সেসসব দোকানের কম্পিউটারের হার্ডডিক্সে থাকে থিজিপি কিংবা এমপি ফোর ফরম্যাটে নরনারীর মিলনের অন্তরঙ্গ দৃশ্য। পয়সা দিলেই রগরগে ক্লিপগুলি মোবাইলে ট্রান্সফার দেয়। ক্রেতা অধিকাংশই কিশোর-তরুণ। পরিচিত কারও স্ক্যান্ডাল হলে কথা নেই- সে ক্লিপ বিক্রি হয় বেশি দরে। স্ক্যান্ডাল জানাজানি হলে কেউ কেউ লজ্জ্বায় অপমানে মরেও যায়।
রাশেদ অস্থির হয়ে ওঠে ...
হাঁটতে-হাঁটতে ভাবে: কিছু কিছু লোক ভালোবাসা বোঝে না। কেবল শরীর বোঝে। মানুষের পক্ষে এতটা নগ্ন ... এতটা বন্য হয়ে থাকা কি করে সম্ভব?
রাশেদ আগে তেমন সিগারেট খেত না। আজকাল দিনে অন্তত দু- প্যাকেট কিনতে হয়। আজকাল রাতে ওর তেমন ঘুম হয় না। বিছানায় শুয়ে থেকে ঘরের অন্ধকারে আগুনের লাল বিন্দুর দিকে চেয়ে থাকে । জ্বলন্ত লাল বৃত্তটা অন্ধকারে ঘোরায়। কে যেন ফিসফিস করে বলে, ... তুমি আমাদের অন্তরঙ্গ মিলনদৃশ্যের ছবি প্রকাশ করেছ, সে জন্য আমি অপমানিত বোধ করেছি ; তবে তার চেয়েও বেশি কষ্ট পেয়েছি তুমি আমাকে ভালোবাস না বলে। এই নির্মম সত্য উপলব্দি করে আমি পৃথিবী ছেড়ে চলে যাচ্ছি।
চিরকুটটা মানিব্যাগে রেখেছে রাশেদ। মোবাইলের আলোয় ওটা বের করে। বারবার পড়ে। তারপর গভীর ভাবনায় ডুবে যায়। কে কাকে ভালোবাসেনি? কে কাকে অগ্রাহ্য করেছিল? গভীর এক কৌতূহল ওকে গ্রাস করে।
রাশেদের মা ছেলের জন্য পাত্রী দেখে বেড়াচ্ছেন। ফোন করে খুঁটিনাটি তথ্য ছেলেকে জানায়। পাত্রীর নাম নওশীন। ইডেনে পড়ে। আজ আমি আর তানিয়া গিয়ে মেয়েকে দেখে এসেছি। তানিয়ার অবশ্য মেয়ের গায়ের রং পছন্দ হয়নি। কলাবাগানে মেয়ের বাড়ি। বাবা ইনকাম ট্যাক্সের উকিল। আমি ওনাকে বলেছি: বিয়ের পর আমরা মেয়েকে পড়াব ।
রাশেদ অবশ্য এসব কথায় আগের মতো রোমাঞ্চ বোধ করে না। ও মাকে বলে, এখন থাক মা। পরে। আমি একটু গুছিয়ে নিই।
বাড়িঅলা থাকে দোতলায় । নাম হাজী কাশেম আলী। লোকটা বেশ আন্তরিক। গলির মুখে একটা কনফেকশনারি আছে । ‘রত্না বেকারি’। হাজী সাহেব ও তার বড় ছেলে ফয়েজ বসে। ফয়েজ ছেলেটা রাশেদেরই সমান। দেখতে অবশ্য কেমন বয়স্ক লাগে। সব সময় লুঙ্গি-পাঞ্জাবি পড়ে। রাশেদকে দেখলে অদ্ভূত উচ্চারণে সালাম দেয়। হাজী সাহেবের বড় মেয়ে সালমার বিয়ে হয়েছে শিবপুর। ছোট মেয়ে রত্না। ক্লাস টেনে পড়ে। এসবই হাজী সাহেবের মুখে শুনেছে রাশেদ।
একদিন হাজী কাশেম আলী বললেন, আমার ছোট মেয়ে রত্নায়, বুঝলা বাবা। খালি ইংরেজিতে ফেইল করে । শুক্রবার সকালের দিকে আইসা আমার মেয়েটারে যদি একটু পড়াইতা।
রাশেদ রাজি হল। অফিস টাইমের পর সময় কাটানো সমস্যা। বিশেষ করে শুক্রবারে। তাছাড়া একা থাকলেই চিরকুটের লেখাটা কুঁড়ে কুঁড়ে খায়। রত্নাকে পড়াতে-পড়াতে শুক্রবার সকালটা বেশ কেটে যাবে। রাশেদ রত্নাকে ড্রইংরুমে বসে পড়ায়। তবে এটা ড্রইংরুম কিনা কে জানে। এক পাশে আস্ত একটা খাট ফেলা। এককোণে পুরনো মডেলের একটি প্যানাভিশন টেলিভিশন।
যাদের কনফেকশনারির ব্যবসা আছে, তাদের শুক্র-শনি নেই। শুক্রবার বাড়ি ফাঁকাই থাকে। সেই সুযোগটাই রত্না নেয়। বেশ সাজগোজ করে আসে। মেয়েটার কত যে সালোয়ার-কামিজ! একেবারেই পড়তে চায় না। খালি এটা-ওটা জিগ্যেস করে। বারবার ওড়না ঠিক করে। চোখে চোখ রেখে বলে, স্যার আপনি তো ঢাকায় থাকেন। আপনি কি শ্রাবন্তীর (চিত্রনায়িকা) বাড়ি চিনেন? রাশেদ এড়িয়ে যায়। দীর্ঘশ্বাস ফেলে ভাবে- আগের চেয়ে আজকাল মেয়েদের সঙ্গে সম্পর্ক করা বেশ সহজ। কেন? মিডিয়া? আকাশসংস্কৃতি?
যে মেয়েটি মরে গেছে, সেও কি এমন সহজ হয়ে উঠেছিল তার হত্যাকারীর কাছে? কে মেয়েটির হত্যাকারী?
রত্নার ভাবিও ঘন ঘন ড্রইংরুওম আসে। নাম নাসরীন। ছোট একটি দুধের বাচ্চাও আছে। শ্যামলা হলেও বেশ সুন্দরী। নাসরীন আবার শাড়ি পরে আসে। ড্রইংরুমে এলে পারফিউমের গন্ধ ছড়ায়। হাতে কখনও ট্রে; ট্রেতে চা-নাশতা । খাটের ওপর বসে এটা-ওটা প্রশ্ন করে। বাঁকা কথা বলে। বোঝা গেল বাঁকা কথা বলে বেশ সুখ পায় মেয়েটি। একদিন আপেল কেটে এনে বলে, ভালো কইরা খান। আপনি তো দিন দিন শুখায় যাইতেছেন মাষ্টার সাব। রাশেদ আর কি বলবে? রত্নার সঙ্গে ওর ভাবির সূক্ষ্ম রেষারেষি টের পায় রাশেদ। নাসরীন ড্রইংরুমে এলে কেমন গুটিয়ে যায় রত্নার। ফর্সা মুখটা গম্ভীর হয়ে ওঠে। যেন নিজের ভুবন অন্য কেউ দখল করে নিয়েছে। রাশেদের এসব ভালো লাগে না। ওর হৃদয়ে চিরকুটের কটা লাইন শলাকার মতো গেঁথে আছে। সেখান থেকে রক্ত ঝরে।
নাসরীন একদিন বাচ্চাকে নিয়ে বাপের বাড়ি গেল। রত্নাকে কয়েকটি কথা জিগ্যেস করার ফুসরত পায় রাশেদ। সেদিন রত্নার নিজেই চা বানিয়ে এনেছিল। চায়ে চুমুক দিয়ে রাশেদ জিগ্যেস করে, একতলায় আগে কারা থাকত?
রিতাদিরা। কথাটা বলার পর রত্নারর মুখে ভাব কেমন বদলে যায়। ভীষণ গম্ভীর হয়ে যায় মেয়েটি। যেন ভয় পেয়েছে।
খারাপ কিছু ঘটেছিল? মানে-
হ্যাঁ। নিউজটা আপনি পত্রিকায় পড়ছেন স্যার?
কি হয়েছিল বল তো?
রিতাদি আত্মহত্যা করছিল।
ওহ্ ।
বসাক আঙ্কেল রিতাদিরে খুব ভালোবাসত।
বসাক আঙ্কেল কে?
বসাক আঙ্কেল হইল রিতাদির আব্বা। রিতাদি আত্মহত্যা করার পর বসাক আঙ্কেলরা চইলা যায়। কালিতলায় নিজেদের বাড়ি করছে। সেখানে। বলতে বলতে রত্নার চোখে পানি চলে আসে। ওড়নায় মুখ ঢেকে মুখ নীচু করে বসে। রাশেদ চুপ করে থাকে। জানালার ওপাশে নাড়কেল গাছ। নাড়কেল পাতায় রোদ। দিনটা এখন রোদে ঝলমল করলেও আজ ভোররাতে খুব বৃষ্টি পড়ছিল। মফঃস্বল শহরটা তার রোদ-মেঘ নিয়ে আগের মতোই আছে। কেবল একজনই নেই!
রত্না ওড়নায় চোখ মুছে নেয়। নাক টানে। তারপর বলে, রিতাদির ছবি দেখবেন স্যার?
আছে?
সোফার ওপর থেকে মোবাইল তুলে নেয় রত্নার। কমদামী একটা ম্যাক্সিমাস সেট। মেনু থেকে মালটিমিডিয়া বার ইমেজ ভিউয়ার-এ ঢুকে স্ক্রল করে রত্না। তারপর বলে, এই যে স্যার, দেখেন ।
মেয়েটাকে শ্যামলাই মনে হল। চেহারা তেমন আহামরি না। কপালে লাল রঙের বড় টিপ। রাশেদ দীর্ঘশ্বাস ফেলল। প্রেমিককে বিশ্বাস করে ঠকল। মৃত্যুর সময় কষ্ট হচ্ছিল ...।
যে ছেলেটির সঙ্গে তোমার রিতাদির সম্পর্ক ছিল সেই ছেলেটির নাম জান? কথাটা রত্নাকে জিগ্যেস না-করে পারল না রাশেদ।
রত্না মাথা নাড়ে। বলল, পরাগ ভাই। ফয়েজ ভাইয়ের ফ্রেন্ড। আরও বলল, পুলিশ পরাগ ভাইরে খুঁজতেছে।
রাশেদ নিজের ভিতরে অস্থিরতা টের পায়। মফঃস্বল শহরটি ছোট। একে অন্যকে চেনে।
রত্না বলল, জানেন স্যার। রিতাদি না অনেক বই পড়ত। আমারেও বই পড়তে বলত। আমার না বই পড়তে একদম ভালো লাগে না। রিতাদি কবিতাও লিখত। আমারে পইড়া শুনাইত। রিতাদির কবিতার আমার ভালো লাগত।
চায়ের কাপ টেবিলের ওপর রেখে রাশেদ প্রায় ছুটে ঘর ছেড়ে বেড়িয়ে আসে।
তারপর প্রতিটি মুহূর্ত কেমন বিষময় হয়ে ওঠে।
মা ফোন করে। মোবাইল অফ করে দেয় রাশেদ। ঘন ঘন সিগারেট টানে। অন্ধকার ঘরে। ঘুমহীন চোখে কিছু প্রশ্ন ঘুরে ফিরে আসে। পরাগ নামের পলাতক ছেলেটি রিতাকে ভালোবাসে নি? কেন? রিতা দেখতে সাদামাটা হলেও ফিগারটি আকর্ষনীয় ছিল কি? ওই টানটান শরীরের টানেই কি পরাগ ছলচাতুরি করেছিল? হয়তো। হয়তো না তাই। কিন্তু, ঘনিষ্ট মিলনদৃশ্যের ছবি কেন প্রকাশ করতে গেল পরাগ? রিতা কি টের পেয়েছিল যে পরাগ ওর ছবি তুলছিল? রিতার সম্মতি থাকার কথা তো নয়। আর থাকলেও ...রিতা হয়তো পরাগকে গভীরভাবে বিশ্বাস করত। কিন্তু ... কিন্তু গোপন ভিডিও ক্লিপ ওভাবে ছড়িয়ে না দিলে কি এমন হত? পৃথিবীতে প্রতি মুহূর্তে কত শত একান্ত মিলন ঘটছে, সেসব প্রকাশের কি প্রয়োজন? রিতাকে পরাগ হালকাভাবে নিয়েছিল কি ? কেন? পরাগ কি ভালোবাসতে জানে না? সব জানাজানি হলে লজ্জ্বায় কুঁকড়ে গিয়েছিল রিতা? বাবার কাছে, মায়ের কাছে, পরিবারের কাছে, সমাজের কাছে লজ্জ্বায় মিশে গিয়েছিল? আত্মহত্যা ছাড়া আর কোনও পথ ছিল না? রিতা কীভাবে আত্মহত্যা করেছিল? গলায় ফাঁস দিয়ে? খুব কষ্ট হচ্ছিল তখন ? আর সইতে হয়েছিল পৃথিবী থেকে চিরতরে চলে যাওয়ার দুঃখ ? আর শারীরিক যন্ত্রণা?

এক শুক্রবার। সকালে রত্নাকে পড়াতে এসেছে। পড়ানোর এক ফাঁকে রত্নাকে জিগ্যেস করল রাশেদ, সেদিন তোমার বসাক আঙ্কেল কোথায় থাকে বললে?
কালিতলা। আলীয়া মাদ্রাসা আছে না?
হ্যাঁ।
তার বাম পাশের গলিতে।
দুপুরের পর হালকা মেঘ করে এল। ভারী বৃষ্টির অবশ্য সম্ভবনা নেই। রাশেদের অস্থির লাগছিল। অফিস থেকে ছুটি নিয়ে বাড়ি যাবার কথা ভাবছিল। মার মুখ দেখলে হয়তো অস্থিরতা কমবে। বাড়ি গেলে মা অবশ্য বিয়ের জন্য ধরে বসবে। এখুনি বিয়ে সম্ভব না। নওশীন মেয়েটি সুখি হবে না। চিরকুটটা পড়ার পর থেকেই রাশেদের শরীর কাঠ হয়ে আছে। যৌনাকাঙ্খা টের পায় না।
কালিতলায় আলীয়া মাদ্রাসার বাঁ পাশের গলিটি বেশ সরু। বাঁ পাশে সরকারি পাট গুদাম। আস্তর ওঠা দেয়ালে চটকদার সব রাজনৈতিক শ্লোগান লেখা। রাজনৈতিক নেতাদের ছবি সম্বলিত পোস্টার সাঁটা। এদিকে রাস্তার অবস্থা বেহাল। রাস্তায় কাঁচা ইট ফেলা। এখানে-ওখানে পানি জমে আছে। পাট গুদামের পর খানিকটা জায়গা ফাঁকা। সেখানে রেইনট্রি আর ইপিল ইপিল গাছ। কালো পানির কচুরি পানা ভর্তি একটা পুকুর। ডান দিকে মাদ্রাসার পিছনেও মাঠ, সে মাঠে সার সার ইটের পাঁজা। তারপর নারকেল গাছের সারি । রেললাইন। মেঘলা দিনের আলোয় কেমন অপার্থিব হয়ে আছে সব।
পুকুর ছাড়িয়ে আরও কিছুদূর হাঁটল রাশেদ। সিগারেট টানছিল। এখন ছুড়ে ফেলল। বাঁ পাশে আস্তরহীন দেয়াল। মাঝখানে একটা কালো রঙের লোহার গেট। গেটের ওপর ছোট কালো সাইনবোর্ডে ‘সুবোধ বসাক’ লেখা। এটাই কি রিতাদের বাড়ি? রত্না বলেছিল: রিতাদি আত্মহত্যা করার পর বসাক আঙ্কেলরা নিজেদের বাড়িতে চইলা যায়।
রাশেদ গেট ঠেলে । ক্যাঁচ ক্যাঁচ করে শব্দ হয়। ভিতরে ঢুকতেই বেলি ফুলের তীব্র গন্ধ পায় ও। কতক্ষণ স্তব্দ হয়ে দাঁড়িয়ে থাকে। ভিতরে টিনশেডের একতলা বাড়ি। অল্প একটু বারান্দা। দেয়ালে আস্তর হয়নি। ইট বেরিয়ে আছে। দরজা জানালার রং সবুজ।
রাশেদ পায়ে পায়ে এগিয়ে যায়।
বারান্দায় একটি মেয়ে দাঁড়িয়ে। সাদা রঙের সুতির শাড়ি পরা। বয়স আঠারো-উনিশ। শ্যামলা। তবে রূপ যেন উথলে পড়েছে। মেয়েটির এক হাতে একটি গোটানো ছাতা। অন্য হাতে একটা টিফিন ক্যারিয়ার। মেয়েটিকে কেমন চেনা চেনা মনে হল। রিতা? তা কি করে হয়? রিতার কি যমজ বোন আছে? রত্না বলেনি তো ।
এটা তো সুবোধ বাবুর বাড়ি?
হ্যাঁ।
তিনি আছেন?
না। বাবা হাসপাতালে।
ওহ্ । সরি।
আপনি? কন্ঠস্বরটা ভারি মিষ্টি।
আমাকে আপনি চিনবেন না। আমি রত্নাদের বাড়িতে ভাড়া থাকি।
মেয়েটি অদ্ভূত দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে। অদ্ভূতভাবে হাসল মনে হল। বলল, আমার নাম মিতা। আমরা আগে ওই বাড়িতে থাকতাম।
মিতা? তার মানে রিতার যমজ বোন? আশ্চর্য কথাটা রত্না বলেনি কেন? কি অদ্ভূত মেয়ে?
রাশেদ বলল, সে কথা রত্না আমায় বলেছে। বলে মানিব্যাগ থেকে চিরকুট বার করে। আমি এটা দিতে এসেছি। বলে হাত বাড়ায়।
মেয়েটি টিফিন ক্যারিয়ার নীচে রাখে। তারপর হাত বাড়ায়। রাশেদের হাত থেকে চিরকুট নেয়। হাতটা কাঁপছিল।
আচ্ছা আমি যাই। বলে ঘুরে দাঁড়ায় রাশেদ। মেয়েটি এখন কেঁদে উঠবে। রাশেদের ভালো লাগবে না। গেটের বাইরে এসে দ্রুত পায়ে হাঁটতে থাকে রাশেদ। মিতাকে চিরকুটটা দেওয়া কি ঠিক হল? ওদের তো মর্মান্তিক ব্যাপারটা ভুলে যেতে চাওয়াই স্বাভাবিক। রাশেদের করার কিছু ছিল না। চিরকুটা মানসিক যন্ত্রণার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছিল। এখন অনেক হালকা লাগছে।
ঝিরঝির বৃষ্টি পড়ছিল। হাঁটতে-হাঁটতে রাশেদ ভিজে যেতে থাকে। চশমায় বিন্দু বিন্দু পানি জমেছে । এসব অবশ্য সে খেয়াল করে না। কেমন এক ঘোরের মধ্যে হাঁটতে থাকে। মেঘলা বিষন্ন বাতাসে বেলি ফুলের ঘন গন্ধ ছড়িয়ে আছে। দূরে একটা ট্রেন আসছে। তার হুইশিলের আওয়াজ ভেসে আছে।
গলির ঠিক উলটো দিকে একটা চায়ের স্টল। ভিতরে ঢুকল রাশেদ। বৃষ্টিও পড়ছে বেশ। সেই সঙ্গে চায়ের তেষ্টা পেয়েছে। এক কাপ চায়ের অর্ডার দিয়ে সিগারেট ধরিয়ে বসল বেঞ্চের ওপর। ওপরে নীল রঙের প্লাষ্টিক। তার ওপর বৃষ্টির শব্দ। কী কারণে যেন মাথার ভিতরে বেলি ফুলের গন্ধ তীব্র হয়ে ওঠে।
চা খেতে খেতে দূর থেকে মিতাকে দেখতে পেল রাশেদ। এক হাতে কালো ছাতা মেলে ধরেছে। অন্য হাতে টিফিন ক্যারিয়ার। একমনে হেঁটে যাচ্ছে। হাসপাতালে সম্ভবত?
পরের শুক্রবার। রত্নাকে পড়াচ্ছিল রাশেদ। এক ফাঁকে বলল, তোমার রিতাদির যে এক যমজ বোন আছে, সে কথা আগে আমাকে বলনি কেন?
রত্না মুখ তুলে তাকায়। ফর্সা মুখে গভীর বিস্ময়ের চিহ্ন । চাপা স্বরে বলল, রিতাদির তো কোনও যমজ বোন নাই স্যার।
রাশেদ চমকে ওঠে।
সেই রাতেই স্বপ্ন দেখে রাশেদ।
হালকা কুয়াশার ওপারে কে যেন বলে, আপনি কিন্তু আমাকে ঠিকই দেখেছিলেন।
কেন দেখা দিলে? রাশেদের ভিতর থেকে কে যেন শুধায়।
আমাকে খুঁজেছেন বলে। পৃথিবীতে কত মানুষই তো মরে যায়। কেউ তো অমন করে খোঁজে না ...

সর্বশেষ এডিট : ০৩ রা আগস্ট, ২০১১ সন্ধ্যা ৬:৩৬
৩০টি মন্তব্য ৩০টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

ছি , অবৈধ দখলদার॥ আজকের প্রতিটি অন‍্যায়ের বিচার হবে একদিন।

লিখেছেন ক্লোন রাফা, ০৪ ঠা ডিসেম্বর, ২০২৫ দুপুর ১২:১০



ধিক ‼️বর্তমান অবৈধভাবে দখলদার বর্তমান নরাধমদের। মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে স্বাধীন বাংলাদেশে । বীর মুক্তিযোদ্ধাদের ক্ষমা চাইতে হলো ! রাজাকার তাজুলের অবৈধ আদালতে। এর চাইতে অবমাননা আর কিছুই হোতে পারেনা।... ...বাকিটুকু পড়ুন

আম্লিগকে স্থায়ীভাবে নিষিদ্ধে আর কোন বাধা নেই

লিখেছেন সৈয়দ মশিউর রহমান, ০৪ ঠা ডিসেম্বর, ২০২৫ দুপুর ১২:২২


মঈন উদ্দিন ফখর উদ্দিনের ওয়ান-ইলেভেনে সরকারের ২০০৮ সালের ডিসেম্বরে ভারতের সহায়তায় পাতানো নির্বাচনে হাসিনা ক্ষমতায় বসে। এরপরই পরিকল্পিত উপায়ে মাত্র দুই মাসের মধ্যে দেশপ্রেমিক সেনা অফিসারদের পর্যায়ক্রমে বিডিআরে পদায়ন... ...বাকিটুকু পড়ুন

আওয়ামী লীগের পাশাপাশি জামায়াতে ইসলামীকেও নিষিদ্ধ করা যেতে পারে ।

লিখেছেন সৈয়দ কুতুব, ০৫ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ রাত ১২:৪৫


বাংলাদেশে আসলে দুইটা পক্ষের লোকজনই মূলত রাজনীতিটা নিয়ন্ত্রণ করে। একটা হলো স্বাধীনতার পক্ষের শক্তি এবং অন্যটি হলো স্বাধীনতার বিপক্ষ শক্তি। এর মাঝে আধা পক্ষ-বিপক্ষ শক্তি হিসেবে একটা রাজনৈতিক দল... ...বাকিটুকু পড়ুন

J K and Our liberation war১৯৭১

লিখেছেন ক্লোন রাফা, ০৫ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ সকাল ৯:০৯



জ্যাঁ ক্যুয়ে ছিলেন একজন ফরাসি মানবতাবাদী যিনি ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সময় পাকিস্তান ইন্টারন্যাশনাল এয়ারলাইন্সের একটি বিমান হাইজ্যাক করেছিলেন। তিনি ৩ ডিসেম্বর, ১৯৭১ তারিখে প্যারিসের অরলি... ...বাকিটুকু পড়ুন

এবার ইউনুসের ২১শে অগাষ্ঠ ২০০৪ এর গ্রেনেড হামলার তদন্ত করা উচিৎ

লিখেছেন এ আর ১৫, ০৫ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ সকাল ৯:৪০



এবার ইউনুসের ২১শে অগাষ্ঠ ২০০৪ এর গ্রেনেড হামলার তদন্ত করা উচিৎ


২০০৪ সালের ২১ শে অগাষ্ঠে গ্রেনেড হামলার কারন হিসাবে বলা হয়েছিল , হাসিনা নাকি ভ্যানেটি ব্যাগে... ...বাকিটুকু পড়ুন

×