somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

টাইবেরিয়াস: অসুখী এক রোমান সম্রাট (দ্বিতীয় পর্ব)

৩১ শে জুলাই, ২০১২ দুপুর ১২:৪৩
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

রোমান সম্রাট টাইবেরিয়াস (খ্রিস্টপূর্ব৪২-৩৭খ্রিস্টাব্দ) রোমান সম্রাট টাইবেরিয়াস সম্বন্ধে আমি প্রথম পর্বে লিখেছি যে ইনি ছিলেন রোমান সাম্রাজ্যের দ্বিতীয় সম্রাট এবং ১৪ থেকে ৩৭ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত রোম শাসন করেন। টাইবেরিয়াস ছিলেন এমন একজন মানসিকভাবে বিপর্যস্ত মানুষ যাঁর রাজত্বের শুরুটা ভালোই হয়েছিল তবে শেষটা ভরে উঠেছিল তুমুল রক্তপাতে। ‘টাইবেরিয়াস’ শব্দটি লাতিন। এর অর্থ ‘টাইবার নদী থেকে জাত বা উদ্ভূত।’ তবে নদী একটি রোম্যান্টিক বিষয় হলেও সম্রাট টাইবেরিয়াস- এর জীবনটি মোটেও রোম্যান্টিক ছিল না। বরং সম্রাট টাইবেরিয়াস ছিলেন শীতল হৃদয়ের এক অসুখী মানুষ। সবসময় নিরাপত্তার অভাব বোধ করতেন। মাকেও যে খুব একটা শ্রদ্ধা করতেন তাও না। ক্ষমতা থেকে দূরে দু'বার আত্মনির্বাসনে গিয়েছিলেন। তবে এই মানসিক বিপর্যয়ের কারণ তার জীবনে রোমান সম্রাট অগাস্টাস- এর কিছু সিদ্ধান্ত। সমকালীন ঐতিহাসিকরাও তাঁর সম্বন্ধে ভালো কথা লিখে যাননি। সম্রাট টাইবেরিয়াস জনপ্রিয় ছিলেন না।সম্রাটের নির্বিকার আচরণ এবং দুনীর্তি প্রশ্নবিদ্ধ করেছিল। তবে আধুনিক ঐতিহাসিকরা মনে করেন যে রাষ্ট্রীয় ব্যয় সঙ্কোচের সিদ্ধান্তই ছিল সম্রাটের জনপ্রিয়তা হারানোর অন্যতম কারণ। আধুনিক ঐতিহাসিকরা সম্রাটের সমকালীন ঐতিহাসিকদের বয়ান প্রত্যাখান করেছেন। সম্রাট টাইবেরিয়াসের নিষ্ঠুরতা, ভন্ডামী, দ্বিমুখী নীতি অস্বীকার করেছেন এবং একজন বীর যোদ্ধা এবং সফল প্রশাসক হিসেবে সম্রাট টাইবেরিয়াসকে তুলে ধরেছেন যিনি রোমান সাম্রাজ্যের ঐক্য দীর্ঘকাল সমুন্নত রাখতে পেরেছিলেন।



রোমান সম্রাট টাইবেরিয়াস-এর সময়কার মানচিত্র


১৪ সালে রোমান সম্রাট অগাস্টাস সিজার মারা যান।এরপর তাঁর দত্তক পুত্র টাইবেরিয়াস সম্রাট হন। অগাস্টাস সিজার -এর মৃত্যু সংবাদ ছড়িয়ে পড়ার পর দানিয়ূব নদীর কাছে প্যাননোনিয়ায় এবং রাইন নদীর নিম্ন অববাহিকায় জার্মানিতে বিদ্রোহে উত্তাল হয়ে ওঠে। সম্রাট টাইবেরিয়াস বিদ্রোহ দমন করতে ছেলে ড্রুসাস দ্য ইয়াংঙ্গার এবং জারমানিকাস কে বিদ্রোহী অধূষ্যিত অঞ্চলে পাঠান । প্রথম পর্বে লিখেছিলাম -১৩ খ্রিস্টপূর্বে সম্রাট টাইবেরিয়াসের প্রথম পক্ষের স্ত্রী ভিপসানিয়া আগরিপিনার একটি ছেলে হয়েছিল। টাইবেরিয়াসের এই ছেলে ইতিহাসে ‘ড্রুসাস দ্য ইয়াংঙ্গার’ নামে পরিচিত। আর জারমানিকাস ছিলেন জুলিও-ক্লাউডিয়ান রাজবংশের একজন বিখ্যাত রোমান সেনাপতি এবং কুখ্যাত রোমান সম্রাট ক্যালিগুলার বাবা। সে যাই হোক। ড্রুসাস দ্য ইয়াংঙ্গার এবং সেনাপতি জারমানিকাস-এর সামরিক অভিযান সফল হয়। অবশ্য ১৯ সালে জারমানিকাস মারা যায়। ঘটনাটি ঘটেছিল সিরিয়ায়। সিরিয়ায় রোমান গর্ভনর ছিলেন পিসো। অনেকের ধারণা সম্রাটের আদেশেই পিসো জারমানিকাস কে বিষ খাইয়েছিল। কেননা জারমানিকাস কে সম্রাট টাইবেরিয়াস দত্তক নিয়েছিলেন। এখন জারমানিকাস-এর মৃত্যুতে প্রথম পক্ষের প্রাণপ্রিয় স্ত্রী ভিপসানিয়া আগরিপিনার ছেলে ড্রুসাস দ্য ইয়াংঙ্গার-এর সম্রাটের উত্তারাধিকারী হওয়ার আর কোনও বাধা রইল না। পিসোকে অবশ্য বিচারের মুখোমুখি দাঁড়াতে হয়েছিল। শেষ পর্যন্ত (সম্রাট টাইবেরিয়াস এর নির্দেশে) পিসোকে আত্মহত্যা করতে হয়েছিল। ওদিকে রোমে চলছিল ত্রাসের রাজত্ব। ইনফর্মারের কথায় সামান্য অপরাধে রোমান নাগরিকদের প্রান যাচ্ছিল, তাদের সম্পদ বাজেয়াপ্ত করা হচ্ছিল।



ড্রুসাস দ্য ইয়াংঙ্গার

মনে থাকার কথা -প্রথম পর্ব সমাপ্ত হয়েছিল এভাবে-সম্রাটের উপদেষ্টা ছিলেন এলিয়াস সেজানুস। ক্ষমতালোভী এবং অত্যন্ত নিষ্ঠুর মানুষ ছিলেন এলিয়াস সেজানুস । এর ষড়যন্ত্রের কথা আমরা দ্বিতীয় পর্বে আলোচনা করব।
টাইবেরিয়াস রোমের ক্ষমতা লাভের পর তার ঘনিষ্ট উপদেষ্টা এলিয়াস সেজানুস নানা রকম ষড়যন্ত্র করছিল। সে রাজকীয় দেহরক্ষীদের কবজা করে প্রাসাদ ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হয়। অথচ তার ওপর সম্রাটের ছিল অগাধ আস্থা।



ফ্রান্সের একটি মিউজিয়ামে অবস্থিত এই ছবিটিকে অনেকেই সম্রাট টাইবেরিয়াসের পুত্রবধূ স্ত্রী লিভিল্লার মনে করেন।


সম্রাট পুত্র ড্রুসাস দ্য ইয়াংঙ্গার এখন সেজানুস-এর পথের কাঁটা। যে করেই হোক তাকে সরাতে হবে। কীভাবে? পৃথিবীতে বিশ্বাস ভঙ্গকারীর সংখ্যাও বড় কম নয়। ড্রুসাস দ্য ইয়াংঙ্গার- এর স্ত্রী অর্থাৎ সম্রাট টাইবেরিয়াসের পুত্রবধূ লিভিল্লার সঙ্গে অতি কৌশলে সেজানুস অবৈধ সর্ম্পক গড়ে তুলে। তারপর লিভিল্লা কে সে প্রাসাদ ষড়যন্ত্রে জড়িয়ে ফেলে। এর পর যা হল-সেই মর্মান্তিক ঘটনাটি এই গ্রহের নাট্যমঞ্চে বারংবার অভিনীত হয়েছে এবং নাট্যকার শেক্সপিয়রকে আর্কষণ করেছে। সেজানুস-এর প্ররোচনায় বিষ খাইয়ে লিভিল্লা মেরে ফেলল তার ৩৬ বছর বয়েসের স্বামীকে । ড্রুসাস দ্য ইয়াংঙ্গার ২৩ সালে মারা যায়। সেজানুস জানে ছেলেকে হারিয়ে সম্রাট লাগামহীন হয়ে উঠবেন। তখন ক্ষমতা কেড়ে নিতে সুবিধেই হবে।
প্রাণপ্রিয় পুত্রের মর্মান্তিক পরিনতির কথা শুনে সম্রাট টাইবেরিয়াস অত্যন্ত মর্মাহত হলেন। তিনি নির্জন কোনও দ্বীপে আত্মনির্বাসনের সিদ্ধান্ত গ্রহন করলেন।

সম্রাট টাইবেরিয়াস এর আগেও ৩৬ বছর বয়েসে একবার স্বেচ্ছানির্বাসনে গিয়েছিলেন। সেই পটভূমি সর্ম্পকে একজন গবেষক লিখেছেন:He did more fighting in the army, and he won a bunch of battles. But he was very unhappy, and in 6 BC, when Tiberius was 36 years old, he quit all his army positions and everything else and announced that he was moving to the island of Rhodes (far away in the Aegean Sea) and would not participate in politics any more, ever.



ইটালির কাপ্রি দ্বীপ। নির্জন, সুন্দর সুদূর ...


সম্রাট টাইবেরিয়াস-এর নির্দেশে কাপ্রি দ্বীপের নানা স্থানে বেশ কয়েকটি ভিলা নির্মিত হয়েছিল। ২৭ সালে সম্রাট নির্বাসনে গেলেন। উঠলেন কাপ্রি দ্বীপের জোভিস ভিলায় । এবার অবশ্য তাঁর সঙ্গী হল বেশ কয়েকজন অন্তরঙ্গ সহচর। এদের একজন ছিলেন রোমান সেনাপতি জারমানিকাস এর পুত্র ক্যালিগুলা। কাপ্রি দ্বীপে কেউ অবতরণ করতে পারত না। অবশ্য উপদেষ্টা সেজানুস ছাড়া । স্থানীয় জেলেরা অসাবধান হয়ে আইন ভাঙলে তাকে কঠিন শাস্তি দেওয়া হত। প্রতিদিনই রোম থেকে কাপ্রি দ্বীপে রাজকীয় নথিপত্র আসত এবং সম্রাট কাগজপত্র দেখে যথাযথ নির্দেশ দিতেন বিশাল সাম্রাজ্যের কোথায় কী করতে হবে। উপদেষ্টা সেজানুস রোম শাসন করত।আসলে শাসনের নামে সেজানুস আসলে জুলুম নির্যাতন চালাত।



কাপ্রি দ্বীপে ভিলা অভ জুপিটার। ভিলাটি জোভিস ভিলা নামে পরিচিত। ২৭ সালে ভিলাটির নির্মান শেষ হয়েছিল।


কাপ্রি দ্বীপে নির্বাসনকালে রোম থেকে সম্রাটের মা লিভিয়া ডুসিল্লার মৃত্যু সংবাদ এল।অথচ ক্যাপ্রি থেকে রোমে গিয়ে মায়ের শেষকৃত্যে যোগ দেননি সম্রাট টাইবেরিয়াস। এর কি কারণ হতে পারে? অভিমান? প্রথম পর্বে আমি লিখেছি: সম্রাটের যখন ৩ বছর বয়স তখনই তার মা-বাবার বিবাহবিচ্ছেদ ঘটেছিল। মা লিভিয়া ডুসিল্লা বিয়ে করেন অগাস্টাস সিজার কে। অগাস্টাস সিজার অনিচ্ছা সত্ত্বেও টাইবেরিয়াসকে দত্তক নিতে হয়েছিল। এই সৎপিতা অগাস্টাস সিজারই টাইবেরিয়াস -এর জীবন ধ্বংস করে দিয়েছেন! অগাস্টাস সিজার-এর নির্দেশে প্রাণপ্রিয় স্ত্রী ভিপসানিয়া আগরিপিনাকে হারাতে হয়েছে। অগাস্টাস সিজার ৩০ বছর বয়েসি টাইবেরিয়াস কে ভিপসানিয়া আগরিপিনাকে তালাক দিতে নির্দেশে দিলেন! কেন? সম্রাটের কন্যা জুলিয়া বিধবা হয়েছে। সম্রাট টাইবেরিয়াসকে নির্দেশ দিলেন জুলিয়াকে বিয়ে করতে । আসলে সম্রাট অগাস্টাস জোর করেছিলেন। টাইবেরিয়াস কী আর করেন। জীবন বিষিয়ে উঠল।
এখন ছেলে ড্রুসাস দ্য ইয়াংগারও মারা গেল ...



যিশু খ্রিস্ট। ইনি মধ্যপ্রাচ্যের প্রাচীন পয়গম্বরদের বাণীর সারকথা উপস্থাপিত করতে চেয়েছিলে নির্দয় রোমান শাসকদের সামনে; পবিত্র ঈশ্বরের নামে রোধ করতে চেয়েছিলেন দূষিত রোমান রাষ্ট্রযন্ত্র সচল রাখার জন্য মধ্যপ্রাচ্যের শ্রমজীবি মানুষের অর্থহীন আত্মদান ...

আমরা যখন এক অসুখী রোমান সম্রাটের বিমর্ষ জীবনালেখ্য পাঠ করছি সেসময় রোমান সাম্রাজ্যের দূর প্রান্তে এক অসামান্য ঘটনা ঘটছিল। ঘটনাটি রোমানদের শাসনকেন্দ্র থেকে দেখলে বিচ্ছিন্ন ঘটনা কিংবা তুচ্ছ বিদ্রোহ অথবা ক্ষুদ্র এক মরমি সম্প্রদায়ের নিছক ধর্মীয় আন্দোলন বলেই মনে হতে পারে। সেসব তুচ্ছ বিষয় সামাল দিতেই ২৬ খ্রিস্টাব্দে সম্রাট টাইবেরিয়াস তো পন্টিয়াস পিলাতকে জুদাহর গর্ভনর নিযুক্ত করলেন। হ্যাঁ, আন্দোলন দমন করা হয়েছিল বৈ কী এবং অপরাধীকেও (!) ক্রশবিদ্ধও করা হয়েছিল। ইতিহাসও সেকথা লিখে রেখেছে বৈকী। লিখেছে- Pontius Pilate was the Roman governor of Judaea from 26 CE to 36 CE; in this capacity, he was responsible for the execution of Jesus of Nazareth. পরবর্তীকালে অবশ্য ইতিহাসের রায় এই দাঁড়াল যে যাকে ক্রশবিদ্ধ করে হত্যা করা হল কালক্রমে তিনিই হলেন রোমানবিশ্বের সবচে বড় সম্মানিত সম্রাট! যে সম্রাটের অস্তিত্বের জ্যোতি ২০০০ বছর পর আজও এতটুকু ম্লান হয়নি।



লুসিয়াস এইলিয়াস সেজানুস। তবে সেজানুস নামেই পরিচিত। উচ্চাকাঙ্খী রোমান সৈন্য, সম্রাট টাইবেরিয়াসের বন্ধু এবং উপদেষ্টা। সেজানুস Praetorian guard -এর কর্মকর্তা ছিলেন।ধীরে ধীরে এদের ওপর প্রভাব খাটিয়ে উপরে উঠে এসেছে।

শোকার্ত সম্রাট তলে তলে তাঁর ছেলে ড্রুসাস দ্য ইয়াংঙ্গার - এর মৃত্যুর তদন্ত করছিলেন। তিনি প্রকৃত ঘটনা জানতে পারলেন। তার কারণ-... সেজানুসের স্ত্রী আপিকাটা স্বামীর অনৈক কর্মকান্ডে মর্মাহত হয়ে আত্মহত্যা করে। আত্মহত্যার আগে আপিকাটা চিঠি লিখে সম্রাট টাইবেরিয়াসকে সব জানিয়ে দেয়। ওদিকে বিধবা লিভিল্লাকে বিয়ে করার অনুমতি চেয়েছিল সেজানুস। সম্রাট অবশ্য তাকে সে অনুমতি দেননি। ড্রুসাস দ্য ইয়াংঙ্গার- এর পেয়ালাবাহক লাইগডাস এবং লিভিল্লার চিকিৎসক ইউদেমুসকে বন্দি করে রিমান্ডে নেওয়া হল। অমানুষিক নির্যাতনের পর আপিকাটার বক্তব্যের সত্যতা প্রমাণিত হল। সম্রাট লিভিল্লাকে তার মা আনটোনিয়া মাইনর এর হাতে তুলে দিলেন। আনটোনিয়া মাইনর মেয়েকে একটি ঘরে আটকে রাখে। লিভিল্লা অনাহারে মারা যায়। সম্রাট বুঝতে পারলেন তাঁর জীবনও নিরাপদ নয়। ক্রমশ এই মর্মে রোমান সিনেটে একটি চিঠি লিখে জানালেন যে এলিয়াস সেজানুস একজন বিশ্বাসঘাতক। সেজানুস কে অবিলম্বে বন্দি করে কারাগারে প্রেরণ করা হল। ৩১ খ্রিস্টাব্দে তার ফাঁসী কার্যকর হয়। রোমের জনগন প্রচন্ড ক্ষোভে সেজানুস- এর মৃতদেহটি টাইবার নদীতে ছুড়ে ফেলেছিল।



সঙ্গত কারণেই সম্রাট টাইবেরিয়াসের প্রথম স্ত্রী ভিপসানিয়া আগরিপিনা আজও ইউরোপীয় লেখকদের লেখার প্রেরণা যোগায়। সম্রাটের শেষ জীবনে উন্মাদনার যে চিহ্ন পাই সে উন্মাদনার সূত্রপাত হয়েছিল প্রাণপ্রিয় স্ত্রী ভিপসানিয়া আগরিপিনাকে হারিয়ে। নইলে শেষ জীবনে সম্রাট হত্যালীলায় মেতে উঠবেন কেন?


সম্রাট সেজানুস- এর বিশ্বাসঘাতকতার পর দিনদিন কেমন প্যারানয়েড (সন্দেহপ্রবণ) হয়ে উঠতে থাকেন। আর নিরাপত্তার অভাব বোধ করেন। এই অস্বস্তিকর অনুভূতি তাঁর আগেও ছিল। সত্যিই সম্রাটের শেষ জীবনে তাঁর আচার আচারণে আমরা উন্মাদনার চিহ্ন পাই নইলে তিনি দুই সন্তানসহ তাঁর বোনের মেয়ে আগ্রিপিনাকে হত্যার নির্দেশ দেবেন কেন? সম্রাট সিনেটের ওপর নির্দয় ভাবে শাসন করতে লাগলেন। ছেলেকে গভীর ভাবে ভালোবাসতেন টাইবেরিয়াস। সে সম্বন্ধে ইউরোপীয় এতিহাসিক লিখেছেন: After the death of his son Drusus, the quality of Tiberius' rule declined and ended in a terror. In 26, he exiled himself from Rome...



মানচিত্রে লাল চিহ্নিত স্থানটির নাম মাইসেনাম। এটি ছিল ইটালির একটি প্রাচীন রোমান নৌবন্দর। সম্রাট টাইবেরিয়াস ওই নৌবন্দরেই মারা যান।


অবশেষে ২৩ বছর রাজ্য শাসন করে ১৬ মার্চ ৩৭ খ্রিস্টাব্দে ৭৮ বছর বয়েসে বন্দর নগরী মাইসেনাম-এ শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করলেন এক অসুখী রোমান সম্রাট। মাইসেনাম সেকালে রোমানদের সবচে বড় নৌঘাটি ছিল। হয়তো অ-জনপ্রিয় সম্রাট শেষ জীবনে একটা নিরাপদ আশ্রয় খুঁজছিলেন। রোমান ঐতিহাসিক টাসিটাস লিখেছেন: ...upon the news of his death the crowd rejoiced, only to become suddenly silent upon hearing that he had recovered, and rejoiced again at the news that Caligula and Macro had smothered him.



ফরাসী চিত্রকর জা পল লরেন্সের (১৮৩৮-১৯২১) ‘দ্যা ডেথ অভ টাইবেরিয়াস’। ছবিতে মৃত্যুর কাছে সম্রাটের অসহায়ত্ব ফুটে উঠেছে।


আমি আগেই বলেছি যে রোমান সেনাপতি জারমানিকাস এর ছেলে ক্যালিগুলা কাপ্রি দ্বীপে ছিলেন। সম্রাটের অন্তিম মুহূর্তে ক্যালিগুলা মাইসেনাম- এও ছিলেন। সম্রাটের বেশুমার গুম-খুনের কারণে রোমে যে অরাজক অবস্থা সৃষ্টি হয়েছিল তাতে রাজকীয় প্রাকটোরিয়ান গার্ডদের মধ্যেও তীব্র অসন্তোষ ও ক্ষোভ সৃষ্টি হয়েছিল। প্রাকটোরিয়ান গার্ডদের প্রধান ম্যাকরো এই পরিস্থিতি সামাল দেওয়ার জন্য ক্যালিগুলার শরনাপন্ন হয়েছিল। ক্যালিগুলা ছিলেন জুলিও ক্লাউনিয়ান রাজবংশের একজন সদস্য। তদুপরি জনপ্রিয় রোমান সেনাপতি জারমানিকাস- এর ছেলে এবং সম্রাটের একজন ঘনিষ্ট আত্মীয়। সে রোমান সাম্রাজ্যের বৈধ উত্তরাধিকারী না হলেও প্রাকটোরিয়ান গার্ডদের সহায়তায় তার ক্ষমতা গ্রহন করতে সমস্যা হয়নি। উন্মাদ সম্রাট ক্যালিগুলার কুখ্যাত কীর্তিগুলি ইতিহাসে কালো অক্ষরে লেখা রয়েছে। সে খুব কাছ থেকে দেখেছিল এক বৃদ্ধ সম্রাট উন্মাদনার স্বরূপ। ক্যালিগুলা তারই উত্তরাধিকার টেনেছিলেন বিকৃত যৌনতা যুক্ত করে।



রোম শহরে এই প্রাসাদেই সম্রাট টাইবেরিয়াস থাকতেন। পরবর্তীকালে সম্রাট ক্যালিগুলাও বাস করতেন এই প্রাসাদে। প্রাসাদটির অবস্থান পালাটাইন পাহাড়ের উত্তরপশ্চিমে। রোম শহরে যে সাতটি অনুচ্চ পাহাড় রয়েছে পালাটাইন পাহাড়ের অবস্থান তার কেন্দ্রে।


সম্রাটের সমকালীন ঐতিহাসিকদের বয়ান অনুযায়ী সম্রাট টাইবেরিয়াস ছিলেন অত্যন্ত নিষ্ঠুর স্বৈরাচারী। যাঁর রক্ততৃষ্ণা ছিল প্রবল। আধুনিক ঐতিহাসিকরা সম্রাটের সমকালীন ঐতিহাসিকদের বয়ান প্রত্যাখান করে লিখেছেন: সম্রাট ধনীদের ওপরই কেবল অত্যাচার নির্যাতন করেছিলেন। কেননা এই শ্রেণিটি ক্ষমতার লোভে প্রাসাদ ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হত। রাজ্যের অধিকাংশ মানুষই ছিল নিরাপদ। এ প্রসঙ্গে একজন আধুনিক ইউরোপীয়ান ঐতিহাসিক লিখেছেন:Tiberius' later reign was described as a bloodbath and a reign of terror byTacitus, relatively few lost there lives in comparison to the repeated disorders of the late Republic. তদুপরি সম্রাট টাইবেরিয়াস অর্থনৈতিক দিক থেকে রোমান সাম্রাজ্যকে এক প্রাচুর্যময় অবস্থানেই রেখে গিয়েছিলেন।



সম্রাট টাইবেরিয়াসের এই দিনারিউস (রৌপ্য মুদ্রা) পাওয়া গিয়েছে ভারতবর্ষে। তুরস্ক ও পারস্যের ভিতর দিয়ে উত্তরভারতের সঙ্গে রোমের স্থলবানিজ্য চলত । আর দক্ষিণ ভারতের সঙ্গে নৌবানিজ্যের মাধ্যম ছিল লোহিত সাগর।


সম্রাট টাইবেরিয়াস আমলে কয়েকটি উল্লেখযোগ্য ঘটনা হল: ফিলিস্তিনের জুদাহ প্রদেশে গর্ভনর হিসেবে পন্টিয়াস পিলাত-এর নিয়োগ । এবং পন্টিয়াস পিলাত কর্তৃক যিশু খ্রিস্টের ক্রশবিদ্ধের ঘটনা। ঐতিহাসিকগণ যিশু খ্রিস্টের ক্রশবিদ্ধের বছর ৩৩ খ্রিস্টাব্দ বলে নির্ধারণ করেছেন। তার মানে এরপর সম্রাট টাইবেরিয়াস আর চার বছর বেঁচে ছিলেন! সম্রাট টাইবেরিয়াস আমলেই বিখ্যাত রোমান কবি ওভিদ লিখেছিলেন লেটারস ফ্রম পনটাস। আমরা রোমান ভূগোলবিদ স্ট্র্যাবোর নাম শুনেছি। তাঁর বিখ্যাত জিওগ্রাফি গ্রন্থটি তাঁর সময়ই সময়েই লেখা হয়েছিল।



রোমের এই সমাধিসৌধ (অগাস্টাস মওসোলিয়াম)অসুখী সম্রাটের শেষ আশ্রয়স্থল ...




কাসট্রা প্রেটোরিয়া। রাজকীয় রক্ষীদের ব্যারাক। সম্রাট টাইবেরিয়াসের সময়ে নিমির্ত হয়েছিল।


অগাস্টাস সিজার ৪৫ বছর শাসন করেন। তাঁর আমলে রোমান সাম্রাজ্যে সুখশান্তি বিরাজ করে। একে বলে ‘প্যাক্স রোমান’ বা রোমান শান্তি। অগাস্টাস সিজার Praetorian Guard প্রতিষ্ঠা করেন। এই রক্ষীরা ছিল সম্রাটের দেহরক্ষী।



লেপসিস মাগনায় অবস্থিত আর্চ অভ টাইবেরিয়াস। লেপসিস মাগনা- খটোমটো এই শব্দবন্ধের মানে লিবিয়া।




টাইবেরিয়াস এর এই মার্বেল পাথরের নির্মিত ভাস্কর্যটি ক্যাপ্রি দ্বীপে পাওয়া গিয়েছে।


প্রথম পর্বের লিঙ্ক
Click This Link

ছবি। ইন্টারনেট।

তথ্যসূত্র:

http://www.nndb.com/people/932/000087671/
Click This Link
Click This Link
Click This Link
Click This Link
Click This Link
Click This Link
http://en.wikipedia.org/wiki/Germanicus
Click This Link
Click This Link
Click This Link
Click This Link
সর্বশেষ এডিট : ৩১ শে জুলাই, ২০১২ বিকাল ৫:৪৯
৯টি মন্তব্য ৯টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

জাম গাছ (জামুন কা পেড়)

লিখেছেন সায়েমুজজ্জামান, ০৭ ই মে, ২০২৪ সকাল ৯:০৩

মূল: কৃষণ চন্দর
অনুবাদ: কাজী সায়েমুজ্জামান

গত রাতে ভয়াবহ ঝড় হয়েছে। সেই ঝড়ে সচিবালয়ের লনে একটি জাম গাছ পড়ে গেছে। সকালে মালী দেখলো এক লোক গাছের নিচে চাপা পড়ে আছে।

... ...বাকিটুকু পড়ুন

অনির্বাণ শিখা

লিখেছেন নীলসাধু, ০৭ ই মে, ২০২৪ দুপুর ১:৩১



রাত ন’টার মত বাজে। আমি কি যেন লিখছি হঠাৎ আমার মেজো মেয়ে ছুটতে ছুটতে এসে বলল, বাবা একজন খুব বিখ্যাত মানুষ তোমাকে টেলিফোন করেছেন।

আমি দেখলাম আমার মেয়ের মুখ উত্তেজনায়... ...বাকিটুকু পড়ুন

=ইয়াম্মি খুব টেস্ট=

লিখেছেন কাজী ফাতেমা ছবি, ০৭ ই মে, ২০২৪ বিকাল ৪:১৪



©কাজী ফাতেমা ছবি
সবুজ আমের কুচি কুচি
কাঁচা লংকা সাথে
ঝালে ঝুলে, সাথে চিনি
কচলে নরম হাতে....

মিষ্টি ঝালের সংমিশ্রনে
ভর্তা কি কয় তারে!
খেলে পরে একবার, খেতে
ইচ্ছে বারে বারে।

ভর্তার আস্বাদ লাগলো জিভে
ইয়াম্মি খুব টেস্ট
গ্রীষ্মের... ...বাকিটুকু পড়ুন

শিরোনামহীন দুটি গল্প

লিখেছেন সাহাদাত উদরাজী, ০৭ ই মে, ২০২৪ বিকাল ৫:৫৫

গল্প ১।
এখন আর দুপুরে দামী হোটেলে খাই না, দাম এবং খাদ্যমানের জন্য। মোটামুটি এক/দেড়শ টাকা প্লাস বয়দের কিছু টিপস (এটা আমার জন্য ফিক্সড হয়েছে ১০টাকা, ঈদ চাদে বেশি হয়,... ...বাকিটুকু পড়ুন

এশিয়ান র‍্যাংকিং এ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অবস্থান !!

লিখেছেন ঢাবিয়ান, ০৭ ই মে, ২০২৪ রাত ৮:২০

যুক্তরাজ্যভিত্তিক শিক্ষা সাময়িকী 'টাইমস হায়ার এডুকেশন' ২০২৪ সালে এশিয়ার সেরা বিশ্ববিদ্যালয়ের তালিকা প্রকাশ করেছে। এশিয়ার সেরা ৩০০ তালিকায় নেই দেশের কোনো বিশ্ববিদ্যালয়।তালিকায় ভারতের ৪০, পাকিস্তানের ১২টি, মালয়েশিয়ার ১১টি বিশ্ববিদ্যালয়... ...বাকিটুকু পড়ুন

×