আমি অনেক শখ করে নেপাল থেকে একটা রাধা-কৃষ্ণের যুগল পুতুল এনেছিলাম। বালক কৃষ্ণ, হাতে মুরারী, আশ্চর্য পোজে বাঁশিটি ধরে আছে বাজানোর ভঙ্গীতে। শ্রী রাধাও আশ্চর্য সুন্দর এক বালিকা। আমি নিধার্মিক মানুষ, কেনার সময় স্ত্রীও সাথে ছিল, আপত্তি করেনি। যদিও সে রিচুয়ালিস্ট, জীবন গেলেও নামাজ কামাই যাবে না।
এ পুতুলটি তো আমি পূজার জন্য কিনিনি! শিল্প-সাহিত্য ভালোবাসি, রাধা-কৃষ্ণকে আমি প্রেরণাদায়ী মিথ মনে করি। ভারতীয় মিথ, গ্রীকদের যেমন আছে মিথের বিরাট ঐতিহ্য।
মিথ সত্য নয় যুক্তিবাদী মানুষই জানেন। কিন্তু মানব কল্পনার এই আশ্চর্য মিথ-সম্পদের আছে বিশাল ক্ষমতা। তা আমাদের ভাবনাকে রাঙিয়ে যায়, চিন্তাকে পরিপুষ্ট করে, শিল্প-সাহিত্য এমনকি জীবনে সংকটে সংগ্রামে প্রেরণা যোগায়। তাই তো বলা হয়, মিথ নিয়ে আমাদের চলে না বটে, কিন্তু মিথ ছাড়াও চলে না।
তো সাহিত্য কিত্তন বিচ্ছেদি গানের ভক্ত—এগুলোর উৎস রাধা-কৃষ্ণ। মথুরার এই মিথের নায়ক-নায়িকাকে বাদ দিলে, বাংলাসাহিত্যই হাঁটু ভেঙে পড়ে। কোথায় পাবো আমর চন্ডিদাস বিদ্যাপতি রবীন্দ্রনাথ? এই আমি যে অখ্যাত ভূইয়া সফিকুল ইসলাম, আমার লেখাও একটা কিত্তন আছে, যা শুনলে রসিক মাত্রই কান খাঁড়া করবেন। আমার কাছে রাধাকৃষ্ণ হচ্ছে চিরন্তন প্রেমের অবোধ প্রেরণা।বিশ্ব-নিখিলের প্রকৃতি-পুরুষের প্রতীক।
পুতুলটি আমার বাসায় শোকেচে রেখেছিলাম, স্ত্রী আপত্তি করেনি কখনো। সে নামাজ পড়ত ভিন্ন রূমে, তার নামাজেও বাধা হয়ে দাঁড়ায়নি।
কিন্তু একদিন দেখি রাধা-কৃষ্ণ নেই।
কই গেল?
স্ত্রীর জবাব, ফেলে দিয়েছি।
কেন? এত দিন পরে !
জবাব মিলল, খালা এসেছিলেন, তিনি বলেছেন, নামাজের স্থানে তো নয়ই, ঘরে মুরতি থাকলেও রহমতের ফেরেশতা ঘরে আসবে না। তাই ফেলে দিয়েছি।
কী বলব, মনে মনে ভীষণ রাগ হল। আমার শিক্ষক বাবা এমন মন-কষ্টকর অপরাধে তাঁর স্ত্রীকে কিছু উত্তম মধ্যম দিতে কার্পণ্য করতেন না। কিন্তু আমি বাবার মতো রাগী মানুষ হলেও আমার স্ত্রীকে মারি না। আমার বাবা ছিলেন প্রবলভাবে ধার্মিক মানুষ, তাহাজ্জুতও পড়তেন। আমাকে নিধার্মিক দেখে অনেকেই আফসোস করে, বলে, এমন বাবার ছেলে, তবু নামাজটাও পড়ে না।
আমার স্ত্রীর ওই খালা তার পাতানো খালা। ভদ্রমহিলা বেসম্ভব নামাজি, ঘরের মধ্যেও পর্দা করেন বৃদ্ধ বয়সে। (কিন্তু উনার একমাত্র ছেলে, আমার ছোটো ভাইয়ের বিশ্বাসের সুযোগ নিয়ে প্রায় কোটি খানেক টাকা মেরে পালিয়ে বিদেশে চলে গেছে, খালা তাতে বোধ হয় খুশি)। দুজনেই ধার্মিক বলে অনেক ভাব পরষ্পরে।
২.
‘আজ অভাজন ইতি’ ছদ্মনামের এক ফেস-ফ্রেন্ডের পোস্টে বোরাকের একটা সুন্দর ছবি দেখলাম। ঘোড়ার পিঠে ডানা, ঘোড়াটির মুখ আবার অনিন্দ রূপসি এক নারীর। মাথায় কালো কোঁকড়ানো চুল। বেহেশতের হুরদের চুলের যেমন বর্ণনা, ঠিক তেমনই। এমন ঘোড়া দেখলে কাম রিপু দমন করে রাখা মুশকিল অনেকেরই।
খালাদের বাসায় একবার গেলাম। মাঝে মাঝে বুড়ি দাওয়াত দিয়ে ঢাকাইয়া পাকে, বিচিত্র আইটেম খাওয়াতেন। স্ত্রীর সাথে আমি দু-এক বার গিয়েছি।
দেখি এমনই একটা বোরাকের ছবি ঝুলছে খালার মেয়ের পড়ার রূমে। বোরাকের গলায় আরবি হরফে কারুকার্যময় একটা ওড়নাও।
খালাকে বললাম, আপনার বুদ্ধিতে আমার স্ত্রী রাধা-কৃষ্ণের পুতুলটি ফেলে দিল, ফেরেশতা ঢুকবে না বলে, তো আপনার বাসায় বোরাক রাখেছেন কেন খালা?
খালার জবাব, তুমি কিসের সাথে কি মিলাও বাবা? কোথায় বোরাক, আর কোথায় রাধা-কৃষ্ণ!
যাক, সে অনেক কথা, বলতে গেলে লেখা বাড়বে। বোরাকের ছবি আঁকাও মুসলমানের পাপের নয়, ঘরে রাখাও পাপের নয়। শুধু এটুকু বলেই ইতি।
২৫.০৮.২০২২
সর্বশেষ এডিট : ২৭ শে আগস্ট, ২০২২ বিকাল ৩:২০

অনুগ্রহ করে অপেক্ষা করুন। ছবি আটো ইন্সার্ট হবে।



