প্রথম আলোর জ্যেষ্ঠ সহসম্পাদক সারফুদ্দিন আহমেদ আজ প্রথম আলোতে নাতিদীর্ঘ কলাম লিখেছেন। দুঃখকে মজা বানিয়ে লেখা সেই কলামে জনগণের মনের কথা খুব সুন্দরভাবে উঠে এসেছে। যারা কষ্ট করে পড়তে চাননা, তাদের জন্য কিছু চুম্বক অংশ কোট করা হলঃ
১। একসময় ঢাকা শহরে মিটারে সিএনজি চলত বলে কোনো কোনো ঐতিহাসিক গবেষণায় অথেনটিক তথ্য পাওয়া যাবে। তবে আজকালকার দিনে মিটারটা সুন্দর করে চালানো থাকলেও কোনো চালকই যে মিটারে যান না, সেটা আমরা জানি।
২। ইনসাফ কি আছে এই দুইন্ন্যায়? এই যে গরমেন্ট ফট কইর্যা ৬৫ ট্যাকার ত্যাল ৮০ টাকায় নিয়া ঠ্যাকাইলো, এইডা ইনসাফ? কথা নাই বার্তা নাই, বাসমালিকরা বাস বন্ধ কইর্যা দিলো, এইডা ইনসাফ? আমার গাড়ি চলে সিএনজিতে, ডিজেলে না, তারপরও মালিকও জমার টাকা তিন শ বাড়ায়ে দিছে, এইডা ইনসাফ?
৩। হাজার হাজার মানুষ রাস্তায় দাঁড়িয়ে। কেউ কেউ রাস্তাতেই বসে পড়েছেন। তাঁদের চেহারা দেখে মনে হলো, তাঁদের কারও বিরুদ্ধে কোনো অভিযোগ নেই। যেন তাঁরা গার্জিয়ান ছাড়া নৈরাজ্যকর এক ‘নেই রাজ্যের’ বাসিন্দা। এটাই কপালে লেখা ছিল, তাই সবাই মেনে নিয়েছে।
৪। মাসখানেক আগে থেকেই চালের আর সয়াবিনের দাম বাড়ার কথা মুখে আনা আর চুন খেয়ে মুখ পোড়ানো সমান কথা হয়ে দাঁড়িয়েছে। ‘নাবালেগ’ অবস্থায় খেত থেকে তুলে বাজারে আনা পানসে মরিচেরও দস্তুরমতো ‘ঝাল’ বেড়েছে। পেঁয়াজের ঝাঁজো নাক জ্বালা করে। ঝিঙে, উচ্ছে, বেগুন, টমেটো ছুঁলেই হাত পুড়ছে। ছেঁকা দিচ্ছে আলুও। লাউ বা ফুলকপি ঝলসে দিচ্ছে হাত। এই হাঁসফাঁস দশার মধ্যে জ্বালানি তেলের দাম বাড়ল। এই শাকসবজি আসে ট্রাকে। ডিজেলের দাম বাড়ায় ট্রাকভাড়া যেভাবে বাড়বে এবং পটোলের দাম যেখানে গিয়ে ঠেকবে, তাতে পটোল খাওয়ার বদলে তুলতে হবে।
৫। আর এখন সেই আন্তর্জাতিক বাজারের কথা বলে তারা দাম বাড়িয়ে দিল। মানে তৈলাক্ত বাঁশ বেয়ে যে বানর বাঁশের আগায় উঠে বসেছে, বিপিসি জনগণের তেল বের করে হলেও সেই বানরকে আর নামতে দেবে না।
৬। মন্ত্রণালয় বলেছে, আন্তর্জাতিক বাজারে তেলের দাম বাড়ায় বিপিসির লোকসান হচ্ছে। বিপিসি প্রায় ৩৩ হাজার ৭৩৫ কোটি টাকার বিভিন্ন উন্নয়ন প্রকল্প নিয়েছে। লোকসান হতে থাকলে এই প্রকল্পগুলো চালানো কঠিন হবে। পাবলিক জানে, উন্নয়ন ও দুর্নীতি এই দেশে মাসতুতো ভাই। মানুষ বাঁচুক আর মরুক এই দুই ভাইকে বাঁচিয়ে রাখতেই হবে।
৭। আমরা তেলের দাম বাড়ায় যাতে বেশি টেনশন না করি, সে জন্য বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ মন্ত্রণালয় বলেছে, আন্তর্জাতিক বাজারে তেলের দাম কমে গেলেই সরকার আবার তেলের দাম কমানোর উদ্যোগ নেবে। অর্থাৎ যে কাজ তারা অতীতে করতে পারত কিন্তু করেনি, সেই কাজ তারা ভবিষ্যতে করবে—এই কথা জনগণকে বিশ্বাস করতে বলেছে।
৮। তিনি বলেছেন, ডিজেলের দাম বাড়ার অজুহাতে অন্য পণ্যের দাম বাড়ানোর সুযোগ নেই। ওদিকে গণপরিবহনমালিকেরা সরকারি নীতিনির্ধারকদের অফিস ঘরকে জাতীয় মামাবাড়ি মনে করে সেখানে ঝুড়িভরা আবদার ফেলছেন। তাঁদের আবদার আগেও বিফলে যায়নি, এবারও যাবে বলে মনে না।
৯। লাগামছাড়া দাম বাড়াকে একধরনের পরোক্ষ কর বলা যেতে পারে। এই কর ‘রিগ্রেসিভ’ চরিত্রের। মানে যাঁর আয় যত কম, তাঁর ওপর করের বোঝা তত বেশি পড়ে।
১০। যেহেতু সবার ওপরে রাজনীতি সত্য, যেহেতু তেলের মূল্যবৃদ্ধিলব্ধ টাকাগুলো উন্নয়ন প্রকল্পের হাত ঘুরে সংখ্যায় নগণ্য অথচ অতি শক্তিশালী মধ্যস্বত্বভোগী শ্রেণির পকেটে পৌঁছাবে, সেহেতু অর্থনীতি এখানে ব্যাকরণমাফিক চলবে না। সাধারণ মানুষের পাশে থাকার কথা মেঠো বক্তৃতায় যত জোরের সঙ্গে উচ্চারিত হয়, কার্যক্ষেত্রে ছবিটি যে চিরকালই বিপ্রতীপ, তা অর্থনীতির কঠিন আলোচনা না বোঝা পাবলিকও ভালো করে জানে।
কলামের শিরোনাম দেয়া হয়েছে 'পাবলিকের পেটে ত্যালত্যালা লাথি'
সর্বশেষ এডিট : ০৭ ই নভেম্বর, ২০২১ দুপুর ১২:১১