somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

ধারাবাহিক সায়েন্স ফিকশান উপন্যাস: ডায়েরি (পর্ব এগারো এবং শেষ)

০২ রা জানুয়ারি, ২০২২ সকাল ৯:০০
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :


একুশ।
তিন মাস পর।

এই তিন মাসে পৃথিবী তার আগের জায়গায় ফিরে গিয়েছে। সমস্ত সিগন্যাল আবার আগের মত কাজ করা শুরু করে দিয়েছে, ইন্টারনেট, মোবাইল সব কিছুই ঠিক মত কাজ করছে। পৃথিবীটা আগের মতই আবার কর্ম চঞ্চল হয়ে উঠেছে। প্রায় সপ্তাহ খানেক ধরে সারা পৃথিবী অন্ধকারে নিমজ্জিত ছিল, পৃথিবীর সমস্ত দেশ একে অন্যের থেকে বিচ্ছিন্ন ছিল। পৃথিবীর মানুষ এই সাতদিনকে কালো দিন হিসেবে ঘোষণা করেছে। সংবাদ মাধ্যমগুলো সেই সাতদিনের ঘটনা নিয়ে মুখরোচকর ঘটনা ছেপে চলেছে সংবাদ পত্রিকা সংস্থাগুলো তাদের কাটতি বাড়ানোর জন্য।

পৃথিবীতে যে এলিয়েন আঘাত হেনেছিল এই সত্যটি সাধারণ মানুষ থেকে গোপন করা হয়েছে কারণ এতে সবার মাঝে এক ধরনের আতংক ছড়িয়ে পরতে পারে, শুধু সরকারের উচ্চপদস্থ গোয়েন্দা সংস্থার লোকেরা সত্যিটা জানে।

বদরুলের মাঝে ব্যাপক পরিবর্তন হয়েছে, সে পড়াশুনায় মনোযোগ দিয়েছে আজকাল। তাকে তার সাহসিকতার জন্য ফিউচার ইনকর্পোরেশনের পক্ষ থেকে পুরস্কৃত করা হয়েছে। সুমি, দিপু এবং টিটুনকে সরকারী স্কলারশিপের ব্যবস্থা করা হয়েছে। টিটুনরা আগে আমেরিকাতে থাকত, সেখানে পড়াশুনা করত, তাকে আবার সেখানে যাবার প্রস্তাব দেয়া হয়েছিল তবে সে বাংলাদেশেই থাকতে চায় আপাতত।

এখন সন্ধ্যা, বাহিরে প্রচুর বৃষ্টি হচ্ছে। টিটুন তাদের বাসার বারান্দায় দাঁড়িয়ে বৃষ্টি দেখছে। বৃষ্টির দিনে খিচুড়ি খেতে দারুণ লাগে টিটুনের, মা রান্না ঘরে খিচুড়ি রান্না করছে। থেমে থেমে মেঘের ঘর্ষণ, আকাশে বর্জ্রপাতের শব্দ কানে ভেসে আসছে, টিটুনের তিন বছর আগের কথা মনে পরে গেল, এই রকমই একটি দিনে আমেরিকার ফ্লোরিডাতে সে তার বাবাকে হারিয়েছিল। বাবার কথা মনে হতেই বুকের ভিতর থেকে একটি দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে আসে তার।

আজগর স্যারকে আর সেদিনের পরে দেখা যায়নি। স্যার হয়ত যেই সময় থেকে এসেছিল সেই সময়ে ফিরে গেছেন। যাবার আগে স্যারকে বিদায় বলা হয়নি ভাবে টিটুন। টিটুন হঠাত লক্ষ করে তার সামনেই একটি ঘূর্ণায়মান চক্রাকার বায়ু, ওয়ার্ম-হোলের মত দেখতে অনেকটা তার সামনে প্রকট হয়। সেই চক্রাকার বৃত্তের ভিতর থেকে বেরিয়ে আসে আজগর স্যার।

“কেমন আছিস টিটুন?” সামনে এসে জিজ্ঞেস করে স্যার।

টিটুন যেন চমকে উঠেছে, নিজেকে সামলে পাল্টা প্রশ্ন করে “স্যার আপনি?”

“হুম, তোর কাছ থেকে বিদায় নেয়া হয়নি, মনে আছে?”

হুম সরূপ মাথা নাড়ে টিটুন।

“বললি না কেমন আছিস?” ফের প্রশ্ন আজগর স্যারের।

“ভাল আছি স্যার।“

“টিটুন আমি জানি তুই তোর বাবাকে অনেক মিস করিস। আমি তোর বাবাকে ফিরে পাবার ব্যবস্থা করে দেব।“ বলেই টিটুনের প্রতিক্রিয়া দেখার অপেক্ষায় থাকে আজগর স্যার।

চমকে উঠে টিটুন। সে কি বলবে ঠিক বুঝতে পারে না।

থেমে স্যার বলে “টাইমলাইন পরিবর্তন করা অনেক ঝুঁকিপূর্ণ কারণ ছোট কোন পরিবর্তনের জন্য ভবিষ্যতে এর অনেক বিরূপ প্রভাব পরতে পারে। আমাদের বিজ্ঞানীরা তাই অতীতের কোন ঘটনা পরিবর্তন বা হস্তক্ষেপ করতে নিষেধ করে, এটাকে সর্বোচ্চ সপ্তম মাত্রার অপরাধ হিসেবে দেখা হয়, এর শাস্তি ভয়াবহ।“

আবার বলে “তবে আমি আজ নিয়ম বহির্ভূত একটি কাজ করব তোর জন্য টিটুন।“ বলেই স্যার তাকায় টিটুনের দিকে।

আবার বলে “আমি টাইম পোর্টাল ওপেন করছি তোর জন্য বলেই হাতের ছোট মেশিনটিকে চাপ দেয় স্যার। সাথে সাথেই একটি চক্রাকার ওয়ার্ম-হোলের মত একটি চক্র তৈরি হয়। স্যার বলেন আমি টাইম পোর্টাল এমন ভাবে সেট করেছি যাতে তুই তিন বছর আগের তোদের আমেরিকার ফ্লোরিডার বাসায় পৌছাতে পারিস।“

টিটুন বিস্ময় নিয়ে স্যারের দিকে তাকিয়ে থাকে। প্রচণ্ড খুশী এবং উত্তেজনায় সে কাঁপছে।

বলেন চলেন স্যার “মনে রাখিস সেই চতুর্থ মাত্রিক প্রাণীটি তোর বাবাকে গ্রাস করার পূর্ব মুহূর্তে তুই পৌঁছে যাবি। তোর বাবাকে যদি বাচাতে পারিস তাহলে নতুন একটি রিয়েলিটি তৈরি হবে যেখানে তোর বাবাকে নিয়ে তুই আবার বেড়ে উঠবি। “

আবার বলে চলেন স্যার “আগেই বলেছি থার্মোডাইনামিক্সের প্রথম সূত্র অনুসারে, এই ইউনিভার্সের মোট এনার্জির পরিমাণ সমান, এটা কেউ বাড়াতে বা কমাতে পারবে না। আইনস্টাইনের এনার্জি-মাস সূত্র অনুসারে আবার বস্তু হল এনার্জিরই আরেকটি রূপ, মানুষের শরীরও এনার্জিই বলা যায়। মনে রাখিস তুই যেহেতু সময় পরিভ্রমণ করে অতীতে যাবি সেখানেও তোর আরেকজন প্রতিলিপি আছে, অর্থাৎ দুজন একই মানুষ অবস্থান করবি একই সময়ে। তোরা যেহেতু একই মানুষ তাই এই মহাবিশ্বের মোট এনার্জির পরিমাণ বেড়ে যাবে যেটা থার্মোডাইনামিক্সের প্রথম সূত্র লঙ্ঘন করে। তাই মহাবিশ্ব যখনই বুঝতে পারবে তোরা দুটি একই ভার্সনটা একই সময়ে আছিস তখন তোর বর্তমান ভার্সনকে ভাইরাস হিসেবে নিহ্নিত করবে এবং ডিলিট করে দিবে থার্মোডাইনামিক্সের প্রথম সূত্র বজায় রাখতে, মানে শূন্যে মিলিয়ে যাবি তুই। তাই সেখানে গিয়ে যা করার তাড়াতাড়ি করতে হবে, এই মহাবিশ্ব তোকে ভাইরাস হিসেবে চিহ্নিত করার আগেই। এখন যা টিটুন”

“আপনাকে ধন্যবাদ স্যার।“ বলে টিটুন, আবেগে তার গলা কাঁপছে।

স্যার টিটুনের মাথায় হাত রাখে পরম মমতায়।

“স্যার আপনাকে কোন সমস্যার পরতে হবে না, এই যে আপনি আমাকে সাহায্য করলেন?“ ভেজা গলায় বলে টিটুন।

“হুম হয়তবা। তবে আমি সেটা নিয়ে ভাবছি না টিটুন। তুই ভাল থাকিস, আমাকে যেতে হবে এখন।“

“স্যার আপনার সাথে কি আবার আমার দেখা হবে?”

স্যার একটি দীর্ঘশ্বাস ছাড়ে। স্যারের চোখ আদ্র হয়ে উঠে।

বাইশ।
তিন বছর আগে।

আমেরিকার ফ্লোরিডায় টিটুনদের বাসা। টিটুন ক্লাস সিক্সে পড়ে, বাড়ির ড্রয়িং রুমে বসে হোম-ওয়ার্ক করছিল। তার বাবা বিজ্ঞানী সাফায়াত তাকে দেখিয়ে দিচ্ছিল পড়াশুনা। আজ টর্নেডো হবে, মোবাইলে একটার পর আরেকটা অটোমেটিক মেসেজ আসছে, বিজ্ঞানী সাফায়াত বিরক্তি নিয়ে ফোন চেক করে দেখলেন। টিটুনের মা সুপার মলে গেছে কেনাকাটা করতে, তিনি বেশ দুশ্চিন্তায় পরে গেলেন, কয়েকবার ফোন দিলেন টিটুনের মাকে কিন্তু ধরছে না।

“বাবা আমার পড়তে ইচ্ছে করছে না আজ” বলল তিন বছর আগের ভার্সনের টিটুন।

“কেন?হোম ওয়ার্কগুলো কাল জমা দিতে হবে। এখন করে নে।“ বললেন বাবা।

“কাল করি?” আবদারের সুরে বলে টিটুন।

“গতকালকেও-তো বললি একই কথা, আবার আজ বলছিস কাল?”

“চল আমরা ডাবা খেলি?“ বলে টিটুন।

“হুম, আগে হোমওয়ার্কগুলো শেষ কর, তারপর খেলব।“ বলেই থামলেন বাবা সাফায়াত।

এই ড্রয়িং রুমের পাশের রুমটাতে বিজ্ঞানী সাফায়াত একটি ছোটখাটো ল্যাবরেটরি বানিয়েছে, ল্যাবরেটরিটির মেঝে থেকে ভূমি পর্যন্ত কাচ দিয়ে বানানো একটি দেয়াল, সেখানে কাপড়ের পর্দা লাগানো, ল্যাবরেটরির ভিতর থেকে কাপড়ের পর্দা সরালেই এই ড্রয়িং রুমটা দেখা যায়। সাফায়াত সাহেব টেলি-পোর্টের মেশিনটি বানিয়েছেন, তবে এখনও সেটা পরীক্ষা করা হয়নি ভালমতো। মেশিনটা পরীক্ষা করা দরকার।

“টিটুন তুই হোম-ওয়ার্ক কর আমি একটু আসছি। আর পড়া ফাকি দিবি না, আমি কিন্তু ল্যাব থেকে তাকিয়ে দেখব ঠিকমত হোম-ওয়ার্ক করছিস কিনা? বলেই তিনি তার ড্রয়িং রুপের পাশের ল্যাবে চলে গেলেন।

তিনি তার মেশিনটি বের করে সব কিছু একবার পরখ করে নিলেন। আজ প্রায় দীর্ঘ চার বছর যাবত এই যন্ত্রটি বানিয়েছেন বিজ্ঞানী সাফায়াত। এটা শুধু তার গবেষণাই নয় তার স্বপ্নও বটে, আজ তিনি এই স্বপ্নের প্রায় দার গোরায় পৌঁছে গেছেন। তার গবেষণা যদি সফল হয় তাহলে সারা পৃথিবীতে হইচই পরে যাবে, বিজ্ঞানের বড় একটি অগ্রগতি হবে, কোয়ান্টাম টেলি-পোর্টের মাধম্যে সময় পরিভ্রমণকে মানুষ এত দিন মানুষ অলীক স্বপ্ন ভাবত সেটা বাস্তবে পরিণত হবে ভাবতেই তিনি উত্তেজনায় ঘামছেন।

হঠাত তার এই ছোট্ট ল্যাবরেটরিতে কিছু একটি শব্দ পেলেন। কেপে উঠল ল্যাবরেটরিটি, চোখ ঘুরিয়ে দেখতেই চমকে উঠলেন তিনি। একটি বৃত্তাকার কালো ঘূর্নয়মান ওয়ার্ম-হোলের মত কিছু একটা ঘূর্নয়নমান বায়ু, সেখান থেকে বেরিয়ে আসছে একটি ছেলে। দৃশ্যটি দেখতেই কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে পরলেন বিজ্ঞানী সাফায়াত।

বিজ্ঞানী সাফায়াত বসে তার যন্ত্র নিয়ে কাজ করছিলেন, সেখান থেকে দাঁড়িয়ে গেলেন, তিনি তাকিয়ে আছেন ছেলেটার দিকে। টিটুনের চোখ ঠেলে পানি বেড়িয়ে আসল। কোন কিছু না ভেবেই জরিয়ে ধরল বিজ্ঞানী সাফায়াতকে “বাবা আমি” কথাটা শেষ পারল না টিটুন।

টিটুনের বাবা বিজ্ঞানী সাফায়াত ঠায় দাঁড়িয়ে আছেন তখন। তিনি কি স্বপ্ন দেখছেন নাকি বাস্তবে ঘটছে ব্যাপারটা ঠিক বুঝতে পারলেন না। ধাতস্থ হতে সময় নিলেন কিছুক্ষণ তারপর ছেলেটির মাথায় হাত রেখে বুঝতে পারলেন তিনি স্বপ্ন দেখছে না তিনি। ছেলেটিকে চেনা চেনা লাগছে।

পুনরায় বলল টিটুন “বাবা আমাকে চিনতে পারছ না আমি? ”

বলার আগেই বাবা সাফায়াত মুখে কথা কেড়ে নিয়ে বললেন “তুমি মানে তুই আমাদের টিটুন। থেমে বললেন কত বড় হয়ে গেছিস। তিনি একবার জানালা দিয়ে তিন বছর আগের টিটুনের দিকে তাকালেন, শুকনা পাতলা, আর এই টিটুন কিছুটা স্বাস্থ্যবান গায়ের রঙ যদিও কিছুটা ময়লা হয়েছে।

“বাবা তুমি আমাকে চিনলে কি করে?”

হাসলেন বাবা সাফায়াত সাহেব।

পুনরায় টিটুন বলে “আমিতো ভুলেই গিয়েছিলাম, তুমি-তো সাধারণ মানুষ নও।“ গলাটা ভারি হয়ে আসে টিটুনের।

“কোন সময় থেকে এসেছিস? আমার এই টেলি-পোর্টাল নিশ্চয়ই কাজ করেছে? কেমন আছিস তোরা? আমি এখন কি করছি?” একেই পর কে প্রশ্ন করে যাচ্ছে বাবা সাফায়াত।

টিটুন এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে তার বাবার দিকে, আহারে কতদিন দেখা হয়নি বাবার সাথে। তার বাবার গলার স্বর, গায়ের ঘ্রাণ, তার চেহারা কত দিন দেখেনি টিটুন। এই তিনটা বছর কত ভেবেছে যদি বাবা থাকতো কত কিছু করত এক সাথে, কত জায়গা ঘুরার কথা ছিল, এক সাথে গল্প করতো ভাবতেই আবেগে চোখ ভেঙ্গে পানি আসে টিটুনের। পৃথিবীর এই সময়টাকে যদি চিরদিন ধরে রাখা যেত ভাবে টিটুন। এত দিন পর বাবাকে দেখার এই অনুভূতি ব্যাখ্যা করার মত শব্দ হয়ত এই পৃথিবীতে তৈরি হয়নি ভাবে সে।

স্মৃতির অতলে হাড়িয়ে যায় টিটুন। তখন পঞ্চম শ্রেণীতে পড়ত, সেবার টিটুনদের স্কুলে ছোটদের বিজ্ঞান মেলায় আয়োজন করে, টিটুনের বিজ্ঞান প্রজেক্টটি প্রতিযোগিতায় প্রথম হয়। ছেলের থেকে বাবারই যেন খুশী হয় বেশী, টিটুনকে ষ্টেজে যখন পুরস্কৃত করা হল তখন বাবা সাফায়ত দৌড়ে গিয়ে তাকে কোলে তুলে নিলেন, বাবার চোখে সেই প্রথম অশ্রু দেখে টিটুন, সেটা আনন্দের অশ্রু। তার ছোট সাফল্যে বাবার কত যে আনন্দ, কত উত্তেজনা দেখেছিল সেদিন টিটুন। এরকম কত রকম স্মৃতি আছে ভুলতে পারে না টিটুন।

“কি করে চুপ আছিস কেন?” ফের জিজ্ঞেস করে বাবা সাফায়াত।

বাবার প্রশ্নের চিন্তায় ছেদ পরে টিটুনদের। “বলছি বাবা, তার আগে তোমাকে তোমার এই এক্সপেরিমেন্ট বন্ধ করতে হবে কারণ” বলেই চুপ হয়ে যায় টিটুন।

কিছুক্ষণ থেমে থাকে কিন্তু বলতে পারে না, যে আজকেই সে তার বাবাকে হারিয়েছিল তিন বছর আগে।

“কি ব্যাপার? কেন?” ফের প্রশ্ন করে বাবা সাফায়াত।

একটি দীর্ঘশ্বাস ছাড়ে টিটুন।

“সব কিছু ঠিক আছে টিটূন?”

“না ঠিক নেই বাবা, কিছুই ঠিক নেই। ভিতর থেকে ঠেলে কান্না চলে আসতে নেয় টিটুনের। ধাতস্থ হতে কিছুটা সময় নেয় তারপর বলে তোমাকে এই এক্সপেরিমেন্ট বন্ধ করতে হবে।“

ফের জিজ্ঞেস করে বাবা “কেন?”

টিটুন একটু দীর্ঘশ্বাস ছাড়ে তারপর বলে তার বাবা যেই মুহুত্যে এক্সপেরিমেন্টটি করবে সেই মুহুত্যে স্পেস-টাইমে কম্পন হয়ে ছিদ্র হয়ে যাবে এবং তখনই সেই সুযোগে চথুর্ত মাত্রিক প্রাণীটি উদয় হয়ে তার বাবাকে ছিনিয়ে নিবে, তাই বাচতে হলে এই এক্সপেরিমেন্টটি বন্ধ করতে হবে। সব কিছু খুলে বলে তার বাবাকে। এই তিন বছরে কত কিছু ঘটে গেছে, তার মার সংগ্রাম, প্রতিকুল পরিবেশে বাংলাদেশে গিয়ে থাকা, সেখানে সেই চতুর্থ মাত্রিক প্রাণীর সাথে লড়াই করে টিকে থাকার গল্প, কোন কিছুই বাদ দেয় না টিটুন।

সাফায়াত সাহেব হু হা বলে সব কিছুই শুনছিল। টিটুনের বলা শেষ হলে বাবা সাফায়াত বললেন “আমি তোর জন্য গর্বিত টিটুন।“ পরম মমতায় টিটুনের মাথায় হাত রাখেন তিনি।

জিব দিয়ে ঠোট ভিজিয়ে বললেন “জীবনের অনেক প্রতিকুল পরিবেশ পেরিয়ে আজ এখানে এসেছিস তুই। মানুষ সব চেয়ে ভাল করে যখন সে প্রতিকুল পরিবেশে বড় হয়, যখন খুব প্রেশারে থাকে তখন তার ভিতরের আসল প্রতিভাটা প্রকাশ পায়, সে আরো বড় হয়ে উঠে, ম্যাচিউর হয়।“

থেমে আবার বলে টিটুনের বাবা সাফায়াত “তুই আজ অনেক বড় হয়ে-গেছিস বাবা। আমি যদি আজ এক্সপেরিমেন্টটা না করি তাহলে আজ তুই যেই জায়গায় আছিস সেখানে থাকবি না, টাইম লাইন পরিবর্তন হবে, হয়ত আমাদের অন্য একটি অল্টারনেটিভ রিয়েলিটি তৈরি।“ বলেই টিটুনের প্রতিক্রিয়া দেখার জন্য থামেন বাবা সাফায়াত।

একটু থেমে, নিজেকে প্রস্তুত করে বললেন “আমি মৃত্যুকে ফাকি দিতে চাই না টিটুন।“

চমকে উঠল টিটুন “কি বললে বাবা?”

“হ্যাঁ। আমার ভাগ্যে যা আছে তাই হোক। আমি চাই তুই তর বর্তমান রিয়েলিটিতে বেড়ে উঠ। মানব জাতির বৃহত্তর স্বার্থের জন্যও হলেও আমাকে আজ এই পরিক্ষাটি করতে হবে, নয়ত ভবিষ্যতের পৃথিবী এর ফল ভোগ করবে, আমি স্বার্থপরের মত নিজের কথা চিন্তা করতে পারি না। পৃথিবীতে সবাই একটি নিদিষ্ট সময়ের জন্য আসে বাবা, যখন সেই সময় শেষ হয় তখন তাকে চলে যেতে হয়, তাছাড়া প্রকৃতি হয়ত চায় না আমি আর এই পৃথিবীতে থাকি।” কথাগুলো বলতে কষ্ট হচ্ছিল বাবা সাফায়াতের।

“এটা কি বলছ বাবা?”গলাটা ভিতর থেকে চেপে আসে টিটুনের।

নিজেকে সামলে বাবা সাফায়াত আবার বলে “হুম। আমি আমার ভাগ্যকে মেনে নিব বাবা।“

পুনরায় বলেন “মনে রাখিস ‘দেয়ার ইজ নো রিয়েল ডেথ, সত্যিকারের মৃত্যু বলে কিছু নেই। জীবনের চলার পথের প্রতিটি মুহুত্যে ভিন্ন ভিন্ন মাত্রা নিয়ে হাজির হয়, সেগুলোকে স্বাগত জানাতে, উপভোগ করতে হয়। আর তোর মা একা হয়ে যাবে তার খেয়াল রাখিস।”

টিটুন কান্না চেপে রাখতে পারে না। অনেক বুঝিয়ে বিজ্ঞানী সাফায়াত টিটুনকে শান্ত করে। টিটুন ল্যাবরেটরির পাশের বারান্দায় গিয়ে দাঁড়ায়। বারান্দার দেয়ালে পিঠ ঘেঁষে দাঁড়িয়ে থাকে, তার বুকের ভিতরটা চুরমার হয়ে যাচ্ছে।

বিজ্ঞানী সাফায়াত ড্রয়িংরুমে যায়, তার হাতে সময় নেই। তিনি তিন বছর আগের টিটুনের মাথায় হাত রাখে পরম মমতায়। তারপর নিজের ডায়েরিটা টিটুনের স্কুল ব্যাগে ঢুকিয়ে দিয়ে বলে “বাবা ডায়েরিটা দেখে রাখিস। তিন বছর পর এই দিনে আবার দেখে হবে” বলেই টিটুনের কপালে একটি চুমু একে দেয়। তার চোখ দুটি ঝাপসা হয়ে উঠে।

তিনবছর আগের টিটুন তাকিয়ে আছে বাবার দিকে সে ঠিক বুঝতে পারছে না আর কিছুক্ষণ পরেই সে তার জীবনের অন্যতম সম্পদ তার বাবাকে চিরদিনের জন্য হাড়িয়ে ফেলতে যাচ্ছে।

বিজ্ঞানী সাফায়াত তার ল্যাবরেটরিতে ফিরে গিয়ে নিজের বানানো টাইম মেশিনটি চালু করে। ঘর ঘর শব্দ করে চালু হয়ে যায় মেশিনটি। তিনি অপেক্ষা করতে থাকেন অসীম দুরুত্বে মিলিয়ে যাবার জন্য, নতুন একটি যাত্রার জন্য। একটি সিগারেট ধরালেন, তারপর গোল করে ধোয়া উপরের দিকে ছাড়লেন। একটু পরই নিয়ম মেনে সেই চথুর্ত মাত্রিক প্রাণীটি উদয় হল, প্রচণ্ড আক্রোশে হা করে বিজ্ঞানী সাফায়াতের দিকে তাকালো। প্রাণীটির প্রচণ্ড আকর্ষণে সাফায়াত সাহেবের শরীরের সমস্ত কণাগুলো আসতে আসতে বাতাসে মিলিয়ে যেতে থাকে, তিন বছর আগেই টিটুন ড্রয়িং রুম থেকে তাকিয়ে আছে বাবার দিকে। তিন বছর পরের টিটুন তখন বারান্দায়, তার ভিতরের সব কিছুই যেন ভেঙ্গে চুরে চুরমার হয়ে যাচ্ছে, এই দৃশ্য দ্বিতীয়বার দেখার শক্তি তার নেই, সে চোখ ভুজে একরাশ কষ্ট বুকে নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে তার বাবা মিলিয়ে যাবার আগ পর্যন্ত।

পরিশেষ।
বর্তমান।

সন্ধ্যায় বাতাস বইছে। মা খিচুড়ি চরিয়েছে চুলোয়। টিটুনের ভিতর দিয়ে অনেক ঝড় বয়ে যাচ্ছে। সে নিজেকে সামলে রান্না ঘরে গেল। মার কাধে পিছন থেকে আলতো করে হাত রাখল, তারপর জরিয়ে ধরল।

“কি হয়েছে?” জিজ্ঞেস করল মা।

“কিছু না মা।“ টিটুনের চোখে পানি।

“আমাকে মাফ করে দিও মা।“

মা রাবেয়া খিচুরিতে পানি দিয়ে নাড়া দিচ্ছিল, কাজ বন্ধ রেখে টিটুনের দিকে তাকিয়ে বললেন “কেন?”

“আমি তোমাকে তোমাকে অনেক যন্ত্রণা দিয়েছি।“ দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলল টিটুন।

রাবেয়া ছেলের চোখ মুছে দিলেন। পরম মমতায় হাত রাখলেন ছেলের মাথায়।

টিটুন আর তার মার একসাথে খিচুরি খেয়ে বারান্দার গিয়ে বসল। মা-ছেলে আকাশের দিকে তাকিয়ে আছে, ততক্ষণে আকাশে বৃষ্টি সরে গিয়ে সেখানে চাঁদ উকি দিয়েছে, তারাগুলো ঝলমল করছে। টিটুন মায়ের কাঁধে মাথা রেখে আকাশের তারার দিকে তাকিয়ে থাকে। টিটুনের বাবার শেষ কথাটা মনে পরল ‘দেয়ার ইজ নো রিয়েল ডেথ, সত্যিকারে মৃত্যু বলে কিছু নেই। জীবনের চলার পথের প্রতিটি মুহূর্তে ভিন্ন ভিন্ন মাত্রা নিয়ে হাজির হয়, সেগুলোকে স্বাগত জানাতে, উপভোগ করতে হয়।‘
(শেষ)



আগের পর্বঃ ধারাবাহিক সায়েন্স ফিকশান উপন্যাস: ডায়েরি (পর্ব দশ)

বিঃ দ্রঃ পড়ে যান আপাতত মন্তব্য করার দরকার নেই খুব প্রয়োজন না হলে। সময়-মত উত্তর দিতে পারব না, ব্যাস্ত আছি। জানুয়ারী ১০, ২০২২।


সর্বশেষ এডিট : ০৬ ই জুন, ২০২৩ দুপুর ১:০৯
৭টি মন্তব্য ৭টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

বাংলাদেশে কোন প্রজন্ম সবচেয়ে দুর্নীতিগ্রস্ত? ১৯৭১ থেকে একটি সংক্ষিপ্ত ভাবনা

লিখেছেন মুনতাসির, ১৪ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ সকাল ৮:৪৩

বাংলাদেশে দুর্নীতির প্রশ্নটি প্রায়ই ব্যক্তি বা দলের দিকে ছুড়ে দেওয়া হয়। কিন্তু একটু গভীরে গেলে দেখা যায়, এটি অনেক বেশি প্রজন্মভিত্তিক রাজনৈতিক - অর্থনৈতিক বাস্তবতার সঙ্গে যুক্ত। ১৯৭১ এর পর... ...বাকিটুকু পড়ুন

চাঁদগাজীর মত শিম্পাঞ্জিদের পোস্টে আটকে থাকবেন নাকি মাথাটা খাটাবেন?

লিখেছেন শ্রাবণধারা, ১৪ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ দুপুর ১২:৫৭



আমাদের ব্রেইন বা মস্তিষ্ক কিভাবে কাজ করে লেখাটি সে বিষয়ে। এখানে এক শিম্পাঞ্জির কথা উদাহরণ হিসেবে টেনেছি মাত্র।

ধরুন ব্লগে ঢুকে আপনি দেখলেন, আপনার পোস্টে মন্তব্যকারীর নামের মধ্যে "জেন একাত্তর" ওরফে... ...বাকিটুকু পড়ুন

ধর্মীয় উগ্রবাদ ও জঙ্গী সৃষ্টি দিল্লী থেকে।

লিখেছেন সৈয়দ মশিউর রহমান, ১৪ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ বিকাল ৩:১৫


((গত ১১ ডিসেম্বর ধর্মীয় উগ্রবাদ ও জঙ্গী সৃষ্টির ইতিবৃত্ত ১ শিরোনামে একটা পোস্ট দিয়েছিলাম। সেটা নাকি ব্লগ রুলসের ধারা ৩ঘ. violation হয়েছে। ধারা ৩ঘ. এ বলা আছে "যেকোন ধরণের... ...বাকিটুকু পড়ুন

আমাদের হাদিকে গুলি করা, আর আওয়ামী শুয়োরদের উল্লাস। আমাদের ভুল কোথায়?

লিখেছেন তানভির জুমার, ১৪ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ রাত ৯:৫৩



৩০ জনের একটা হিটলিস্ট দেখলাম। সেখানে আমার ও আমার স্নেহের-পরিচিত অনেকের নাম আছে। খুব বিশ্বাস করেছি তা না, আবার খুব অবিশ্বাস করারও সুযোগ নাই। এটাই আমার প্রথম... ...বাকিটুকু পড়ুন

এ যুগের বুদ্ধিজীবীরা !

লিখেছেন সৈয়দ কুতুব, ১৫ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ রাত ১:৪০


ডিসেম্বর মাসের চৌদ্দ তারিখ বাংলাদেশে বুদ্ধিজীবী দিবস পালন করা হয়। পাকিস্তান মিলিটারী ও তাদের সহযোগীরা মিলে ঘর থেকে ডেকে নিয়ে হত্যা করেন লেখক, ডাক্তার, চিকিৎসক সহ নানান পেশার বাংলাদেশপন্থী বুদ্ধিজীবীদের!... ...বাকিটুকু পড়ুন

×