বয়সটা তখন কোন তরুণীর প্রেমে পাগল হবার, এই বয়সে কোন রমণীর প্রেমে যে না পরেছে, দৃষ্টি নিবদ্ধ না হয়েছে কারো চোখে, প্রেম নামক অনুভূতির সাথে যার পরিচয় না হয়েছে সে কখনোই বুঝবে না প্রেমের কি সেই দুর্নিবার টান, প্রেমের মাদকতা কাকে বলে। কেউ কেউ বলে মানুষের জীবনে নাকি সত্যকারের প্রেম আসে এই কিশোর বয়সেই, পরিণত বয়সের প্রেমগুলোকে প্রেম না বলে বড়জোর সমঝোতা বলা যেতে পারে, দুটি পরিপূর্ণ মানুষ সমঝোতা করে মায়ার বন্ধনে আবদ্ধ হওয়া যাকে বলে।
সেই সময় আমার এক বন্ধু পাশের এলাকার এক মেয়ের প্রেমে মশগুল। ওকে প্রায় দেখতাম ওই মেয়ের বাসার সামনে ঘুরঘুর করতে। দেখা গেল মেয়েটি অন্য কোন জায়গায় বেড়াতে গিয়েছে বা বাসায় নেই তারপরও আমার বন্ধুটি তীর্থের কাকের-মত সেই মেয়েটির বাড়ির দিকে তাকিয়ে থাকত। আমি একদিন জিজ্ঞেস করলাম মেয়েটি-তো বাড়িতে নেই তাহলে এখানে ঘুরঘুর করছিস কেন? ও আমাকে বলল এটা তুই বুঝবি না, ও বাড়িতে না থাক, ওদের বিল্ডিং, ওদের পরিবারের মানুষ এমনকি ওদের বাসার ছাদের শুকা দেয়া কাপড়চোপড়ও দেখতে ভাল লাগে। কিশোর বয়সের প্রেম মনে হয় এমনই!
আরেকদিন ভ্যালেন্টাইন-ডে, আমার বন্ধু মেয়েটিকে ফুল উপহার দিবে বলে ঠিক করল। তবে কিনে না বরং এক বাড়ির ছাদে ফুল বাগান আছে, সেই ছাদ থেকে চুরি করে ফুল উপহার দিবে বলে মনঃস্থির করল। এটা ছিল একটি কঠিন মিশন কারণ সেই বাড়িতে বড় বড় কুকুর ছিল। আমরা দুজন খুব সকালবেলা ফজরের নামাজ পরে সেই দোতলা বাড়িতে গেলাম ফুল চুরি করতে। আমি বাইরে পাহারা দিচ্ছিলাম আর আমার বন্ধুটি ঝুঁকি নিয়ে অনেক কষ্ট করে ফুল চুরি করে আনল, তারপর মেয়েটি স্কুলে যাবার পথে ফুলটি দিয়েছিল। যাইহোক মেয়েটি শেষ পর্যন্ত আমার বন্ধুর কচি মনে দাগা দিয়ে অন্য-কারো ঘরনি হয়েছিল!
এবার মূল প্রসঙ্গে আসা যাক, সেই সময়ে একটি দুর্ঘটনা ঘটে গেল আমার সাথে। একদিন একটি মেয়েকে দেখলাম দাঁড়িয়ে আছে আমাদের বাড়ির মেইন রাস্তায়, কারো জন্য অপেক্ষা করছে হয়ত, স্কুল পড়ুয়া মেয়ে আরকি! তখন সন্ধ্যা প্রায় আটটার-মত বাজে, তার উপর লোড শেডিং চলছিল। চাদের আলো প্রতিফলিত হয়ে আছে মেয়েটির উপর! আমি হা করে তাকিয়ে আছি, ভাবলাম কাছে গিয়ে টাংকি মাড়ি মানে একটু ভাব জমাই আরকি! আমি কিছুটা অন্তর্মুখী, মেয়ে মানুষের সামনে গিয়ে কথা বলা আমার ডিকশনারিতে নেই! তবে মেয়েটির সাথে কথা বলার লোভও সামলাতে পারছিলাম না! এখানে একটি কথা বলে নেই, মেয়েটি আমাকে চিনে না তবে মেয়েটিকে আমি আগে থাকতেই চিনতাম, সেটা কিভাবে একটু পরে বলছি। মেয়েটির মামাতো ভাই আবার আমারই বাল্য বন্ধু। বুকে হিম্মতের অভাবে কথা বলতে পারছি না তাই আমার বন্ধুকে ফোনে জরুরি তলব করলাম অতিসত্বর যেন আমার সাথে দেখা করে।
যথা সময়ে আমার বন্ধুটি আসল, আমি তাকে মেয়েটিকে দূর থেকে দেখিয়ে মোলাকাত করিয়ে দিতে বললাম। আমার বন্ধুটি আমাকে পরিচয় করিয়ে দিল। আমি টাংকি মাড়ার চেষ্টা করলাম, মতলব একটু খাজুরে আলাপ যদি করা যায় আরকি, তবে বিশেষ সুবিধা করতে পারলাম, মেয়েটি আমার প্রতিটি কথাই প্রবল বিরক্ত নিয়ে উত্তর দিচ্ছিল, আমি হতাশ হলাম!
এবার মেয়েটিকে কিভাবে চিনতাম সেটা বলে নেই, আমাদের বাসা ঢাকার কেরানীগঞ্জে, মেয়েটির দাদার বাড়ি আমাদের এলাকাতেই ছিল তবে ওর দাদার মালপানি হবার পর মূল ঢাকায় গিয়ে বাড়িঘর করেছে, ওখানেই থাকেই ওরা, এখানে আসে আত্মীয়স্বজনের বাসায়, সেই হিসেবে চিনি আরকি তবে কখনো কথা হয়নি, তার উপর অনেক বছর দেখলাম!
যাইহোক তারপর কেটে গেল অনেকটা বছর, সেই স্মৃতি অনেকটা ধূসর হয়ে এসেছে! প্রায় ছয় বছর পরে দেখা সেই মেয়েটির সাথে, আমার সামনেই বসে আছে, এর মাঝে আর দেখা হয়নি আমাদের। তবে চিনতে বেগ পেতে হল না আমার, আমি ঘোলাটে হওয়া স্মৃতির পাতায় শান দিলাম, আসতে আসতে ঝকঝকে হয়ে উঠতে লাগল সবকিছু। মেয়েটি তাকিয়ে আছে আমার দিকে, আমার চোখ দুটো পুরনো দিনের মত স্থির হল তাঁর উপর। আবার সেই পুরনো স্মৃতি জেগে উঠল, আমি ফিরে গেলাম আমার ফেলে আশা সেই সোনালী সময়ে, মনের ভিতর বেড়ে উঠা অনুভূতিটা বেশ পুরনো। এই ক-বছরে মেয়েটি ডাঙ্গর-ডোঙ্গর হয়েছে বেশ, স্কুলের গণ্ডি পেরিয়ে আজ পরিণত। মেয়েটি আমার মুখোমুখি বসা, আড় চোখে দেখছিল আমাকে। ভালভাবে পরখ করতে চাইছে, চোখে চোখ পড়াতে তাঁর দৃষ্টি আরও বেশী প্রখর হয়ে উঠল।
আমার বন্ধু পাশে বসা, তার কনুই দিয়ে আমাকে তৃতীয় বারের মতন খোঁচা দিয়ে ফিসফিসিয়ে বলল ভালভাবে দেখে-নে। এই বাড়ির অন্যান্য সদস্যরাও বিভিন্ন জায়গা থেকে উঁকিঝুঁকি মেরে আমাকে দেখছে পাকা জহুরীর-মতন, নতুন কোন জায়গায় সবসময় অস্বস্তি লাগে আমার, এবারো তাঁর ব্যতিক্রম নয়। পাশ থেকে আরো মুরুব্বি গোছের মানুষজন ছিল, আমার দিকে তাকিয়ে একজন বলল যা জিজ্ঞেস করার জিজ্ঞেস করো, এখন আর সেই আগের যুগ নেই, পাত্রীকে কোন প্রশ্ন করার থাকলে কর, চাইলে অন্য ঘরে গিয়ে দুজন আলাদা কথাও বলতে পার।
যাইহোক, তারপরও কেটে গেল আরও অনেকটা বছর। সুখ এবং দুখের স্মৃতিগুলো মনের ভিতর হানা দেয় বার বার, নস্টালজিক করে তোলে। আমি স্মৃতি কাতর মানুষ, মাঝে মাঝে পুরনো স্মৃতিতে ডুব দেই, স্মৃতিগুলো আমার চিন্তাগুলোকে এলোমেলো করে দেয়, তারপরও আমি পুরনো স্মৃতি হাতরাই। স্মৃতি নিয়ে রুদ্র মুহাম্মদ শহীদুল্লাহ এর বানীর সাথে আমার মিল আছে, স্মৃতি নিয়ে তিনি বলেছেন “স্মৃতিগুলো ডাস্টবিনের জঞ্জাল আর আমিই অনুসন্ধান-রত আজীবন ডাস্টবিনের ব্যর্থ কাক”। অনেকে বলে অতীত স্মৃতি নাকি কথা বলে। এই নিয়ে হুমায়ূন আহমেদের একটি উক্তি আছে, যেমন "মানুষের সমগ্র অতীত তার চেহারায় লেখা থাকে। যারা সেই লেখা পড়তে পারে তারা মানুষকে দেখেই হুড়হুড় করে অতীত বলে দিতে পারে।" যাইহোক পুরনো স্মৃতি অনেক কপচালাম, এবার স্মৃতি নিয়ে কচলাকচলি বন্ধ করি বাংলা প্রবাদ দিয়ে “যা গেছে বয়ে, কী হবে কয়ে ”।
এই পর্যন্ত এসে একটি টুইস্ট দেই, সেই মেয়েটিই আজ আমার বউ, আমার ছেলের মা সে। এখনো মাঝেমাঝে আমার সেই ব্যর্থ টাংকি বা ফাও আলাপ মারার কথা মনে করিয়ে দিয়ে খোঁচা মারে। সবচেয়ে কষ্টের বিষয় আমার সেই টাংকি মাড়ার ঘটনাটি তার হুবহু মনে আছে! আমি যতই বলি আমি একজন শরিফ এবং ইমানদার, আমার-মত দরবেশ দ্বিতীয়টি নেই, ততই সে বলে তুমি যে কি জিনিষ আমি ভাল করেই জানি! তোমার মত...যাক আর বললাম না! জীবনে বড় ধরণের কালার খেয়ে খেলাম, প্রেস্টিজ পাংচার আমার!
প্রিয় ব্লগারদের আমি একটি ছবক দিয়ে এই লেখার ইতি টানি, বিশেষ করে বিরহী কবিরা সাবধান, সুন্দরি মেয়ে দেখলে যতই মনের ভিতর কবিতা উঁকিঝুঁকি মারুক, মনের ভুলেও কবিতা শুনাবেন না কোন রমণীকে। এবার কথামত প্রিয় ব্লগারদের প্রতি আমার তিনটি অমূল্য উপদেশ, প্রথমত টাংকি মাড়িয়েন না, দ্বিতীয় টাংকি মাড়িয়েন না এবং তৃতীয় উপদেশও টাংকি মাড়িয়েন না। কে জানে তাহলে আমার মত খোটা খেতে হতে পারে জীবনভর!
বিঃদ্রঃ এই লেখাটি অনেক আগে একবার দিয়ে আবার ড্রাফট করে নিয়েছিলাম, কিছুটা সম্পাদনা এবং পরিমার্জন করে পেশ করলাম আজ, সব কিছু দিতে গেলে নিজের ইজ্জতের ফালুদা হয়ে যাবে আর কি!
আমাদের বিয়ের কাজী নিয়ে একটি বহুল পঠিত করুণ কাহিনী আছে। সেটাও ব্লগাদের জন্য ছবকমূলক লেখা, ব্লগারদের অনেক কিছু শেখার আছে লেখাটি থেকে! এই লেখার সাথে প্রাসঙ্গিক বিদায় দিলাম (কাজী সাহেব সমাচার)।
সর্বশেষ এডিট : ১৮ ই জুন, ২০২৩ দুপুর ১:০৭