তখন আমি কোরিয়াতে আন্ডার-গ্রাজুয়েট করছি। আমাদের ইউনিভার্সিটিটা বিশাল বড় ছিল, অনেকগুলো ছাত্র হোস্টেল আছে, তার মাঝে কয়েকটি হোস্টেল ছিল শুধুমাত্র বিদেশি ছাত্রছাত্রীদের জন্য। বিদেশী ছাত্র-ছাত্রীদের জন্য আলাদা হোস্টেল বানানোর শানে-নযুল হল যাতে বিদেশিরা নিজের দেশের খানা-খাদ্য রান্না-বান্না করে গলধঃকরণ করতে পারে। তবে এটা নামে মাত্র বিদেশিদের হোস্টেল বলা চলে কামে আসলে সবার জন্যই উন্মুক্ত ছিল। আমি কোরিয়াতে ছিলাম প্রায় ৫ বছর, তার মাঝে প্রায় দুই বছর ছিলাম ইউনিভার্সিটির হোস্টেলে। আমার হোস্টেল লাইফের এক বছর ছিলাম কোরিয়ান রুমমেটের সাথে, ছয়মাস চাইনিজ কুড়ালের সাথে, ইয়ে মানে চাইনিজ আরকি আর বাকি ছয়মাস ছিলাম ভিয়েতনামিজ এক রুমমেটের সাথে। আকামটি যখন ঘটে তখন আমি ইউনিভার্সিটির হোস্টেলে থাকি, একদিন হোস্টেলের ম্যানেজমেন্ট কর্তৃপক্ষ আমাকে হঠাৎ ফোন দিল নিয়ম-শৃংখলা ভঙ্গের অভিযোগে। ফোন দিয়ে বলল আমি যেন অতিসত্বর অফিসে গিয়ে তাদের সাথে মোলাকাত করি। আমি বললাম আজ্ঞে আমার অপরাধ? বলল সরাসরি এলে বলবে তবে ব্যাপারটি গুরুতর! আমি মনে মনে বলি খাইছে আমারে, এবার বোধ হয় আমাকে নাস্তানাবুদ বানিয়ে ছাড়বে! আমি ছিলাম বাঘ, ফোনে কথা বলে ভয়ে হয়ে গেলাম ভেজা বিড়াল।
পুরো ব্যাপারটি বলছি তার আগে আমার হোস্টেলে লাইফ সম্মন্ধে কিছু বলে নেই। আমার ৫ বছরের কোরিয়ান জীবনের দু-বছর ইউনিভার্সিটি হোস্টেলে থাকা ছাড়াও বাকি তিন বছর কাটিয়েছিলাম বাঙ্গালীদের সাথে, এক সাথে ৪-৭ জন বাঙালী একসাথে বিভিন্ন সময়ে ভিন্ন ভিন্ন বাসায় ছিলাম। রান্না-বান্নাও করতাম একসাথে, আমার রান্নার হাতেখড়িও সেখানেই হয়। নিজেদের মধ্য থেকে একজন ম্যানেজার হতাম যে বাজার ঘাট এবং টাকা পয়সার হিসেব-নিকেশ রাখত। ইউনিভার্সিটিতে আমাদের বাঙালি কমিউনিটি ছিল প্রায় ১৫-২০ জনের মত, প্রায় প্রতি সপ্তাহে এক সাথে পার্টি করতাম, বিশাল খানা-দানার আয়োজন থাকত, এক সাথে রান্না-বান্না করে খেতাম। প্রতিদিন বিকেল বা উইকেন্ডে চলত আমাদের ফুটবল এবং ক্রিকেট খেলা, খেলা শেষে যে কোন এক বাঙালী ভাইয়ের বাসায় গিয়ে দানার দান খানা খাদ্য পেটে চালান করতাম। বাঙালি কমিউনিটিতে আমি আর একটি ছেলে আন্ডার-গ্রাজুয়েটে গিয়েছিলাম, আর বেশীর-ভাগ ছিল মাস্টার্স এবং পিএইচডির ছাত্রছাত্রী, তাই আমরা দুজনই ছিলাম সবচেয়ে জুনিয়র তখন।
প্রীতিলতার সামনে ক্রিকেট খেলা অবস্থায় তখনকার একটি ছবি আমার।
আমি যেই হোস্টেলটিতে ছিলাম সেটা ছেলেদের হোস্টেল। আমাদের সামনে আরও দুটি হোস্টেল ছিল, তার মাঝে একটি ছিল মেয়েদের হোস্টেল, আমরা বাঙ্গালিরা এটার নাম দিয়েছিলাম প্রীতিলতা। এই প্রীতিলতার সামনেই আমরা ক্রিকেট খেলতাম ধুমায়া, খেলা শেষে সন্ধ্যায় বাঙ্গালীদের বিশাল আড্ডা হত। আর ইউনিভার্সিটি হোস্টেলের বাইরে শেষের দিকে আমরা সাতজন বাঙালী একসাথে একটি বিশাল বাসায় থাকতাম। আমাদের ইউনিভার্সিটি এর পাশে একটি হাট বসত কাচা বাজারের, শনিবার হলে সবাই মিলে হাটে যেতাম বাজার করতে, সাঁরা সপ্তাহের মাছ-মাংস কিনে নিয়ে এসে প্রতিদিনের জন্য আলাদা আলাদা করে রেখে দিতাম ফ্রিজে, যাতে রান্না করতে সহজ হয়। দুপুরে সবাই যার যার ল্যাব থেকে এসে একসাথে খেতাম, খাবার পর একটু আড্ডা দিয়ে যে যার ল্যাবে আবার চলে যেতাম। সন্ধ্যায় ফিরে শুরু হত বিরাট আড্ডা, হলিউডের নতুন কোন সিনেমা এলে আমরা দলবেঁধে চলে যেতাম সিনেমা দেখতে। রাত বারটা বা একটায় হঠাৎ কারো পিজা বা ফ্রাইড চিকেন খেতে মনে চাইলে নেমে পরতাম নীচে। কোরিয়া অনেক জাঁকজমক একটি দেশ, পৃথিবীর এত দেশ, শহর ঘুরেছি একরকম জাঁকজমক দেশ বা শহর আমার তেমন চোখে পড়েনি, একমাত্র থাইল্যান্ডের ব্যাংকক ছাড়া।
ফুটবল খেলে মাঠ থেকে বের হচ্ছি। বাংলাদেশ VS কোরিয়ানদের ম্যাচ ছিল। খেলাটি ড্র হয়েছিল।
আমি কোরিয়াতে গিয়েছিলাম সরকারী স্কলারশিপে, পড়াশুনা ফ্রি, থাকা খাওয়ার টাকাও পেতাম সরকার থেকে। তাছাড়া ডিপার্টমেন্টের একজন প্রফেসরের ল্যাবে রিসার্চ এসিসট্যাঁন্ট হিসেবেও কাজ করতাম তখন। এই প্রফেসরের আন্ডারেই আরেক বাংলাদেশী ভাই পিএইচডি করছিলেন তখন। সেই ভাই এখন বাংলাদেশের একটি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়য়ে শিক্ষক হিসেবে আছেন, বাংলাদেশে গেলে তার সাথে সাক্ষাৎ হয় আমার। তিনিই আমাকে সেই প্রফেসরের সাথে মোলাকাত করিয়ে দিয়েছিলেন প্রথম। সরকারী স্কলারশিপের মালপানি ছাড়াও প্রফেসরও আমাকে মাস শেষে কিছু দিরহাম ধরিয়ে দিত হাতে, আহা বিন্দাস জীবন। যখন আন্ডার গ্রাজুয়েট শেষ করি তিনি আমাকে মাস্টার্সের জন্য স্কলারশিপ দিয়ে রেখে দেন। মাস্টার্স শেষ হলে তিনি আমাকে পিএইচডির অফার করেছিলেন, তবে তখন আমার কোরিয়াতে আর থাকতে ইচ্ছে করেনি, হোম সিকনেস বেড়ে গিয়েছিল, তাই ব্যাক-টু দ্যা প্যাভিলিয়নে ব্যাক করেছিলাম। কারন ব্যাখ্যা করেছিলাম এখানেঃ স্মৃতিচারণঃ আমি দেশ ছাড়তে চাইনি
যাইহোক, এবার বলা যাক আমাকে কেন হোস্টেল কর্তৃপক্ষ জরুরী তলব করেছিল। আমি সরাসরি হোস্টেল কর্তৃপক্ষের অফিসে গিয়ে দেখি এক ভদ্র মহিলা বসে আছেন, আমি তার সামনের চেয়ার টেনে বসতে বসতে নিজের পরিচয় দিলাম। বললাম "আজ্ঞে আমার অপরাধ কি?" ভদ্র মহিলা কম্পিউটারে কি যেন চেক করে মাথা উঁচিয়ে বললেন "তুমি আন্ডার-গ্রাজুয়েট পরছ, তাইনা?" আমি মাথা ঝাঁকিয়ে সম্মতি দিলাম। তুমি জানোনা আন্ডার-গ্রাজুয়েটের ছাত্রছাত্রীদের রাত ১০-টার মধ্যে হোস্টেলে ঢুকতে হয়? এর অন্যথায় হলে কঠিন শাস্তি!" বললেন তিনি। নিয়মটি আমি জানি, সর্বোচ্চ সম্ভবত চার বারের বেশী দেরি করে হোস্টেলে ঢুকলে কর্তৃপক্ষ পাকরাও করে। আমি কতবার যে দেরি করে হোস্টেলে ঢুকেছি তার কোন ইয়ত্তা নেই, রাত বারটার আগে খুব কমই হোস্টেলে ঢুকতাম রাতে! ভদ্র-মহিলা ক্ষেপে ছিল, মোটামুটি ভাল একটি সাজা দেবার জন্য মনে মনে প্রস্তুতিও নিচ্ছেন মনে হল। আমি আত্মপক্ষ সমর্থন করে বললাম আমি একটি ল্যাবে কাজ করি, সেখানে কাজ করতে করতে বাসায় ফিরতে দেরি হয়ে যায়। এখানে বলে নেই, করিয়াতে ল্যাবগুলোতে সকাল থেকে রাত ১২ টা/ ১ টা পর্যন্ত ছাত্রছাত্রীরা কাজ করে। আমিও প্রতিদিন সকালে গিয়ে রাত ১২তার পর বাসায় ফিরতাম। ল্যাবগুলোতে যে শুধু কাজই হয় তা না, সেখানে আড্ডা দেয়া, একসাথে ল্যাব-মেটরা মিলে পিজা, চিকেন ফ্রাই পার্টি সবই করতাম, তাছাড়া মাঝখানে বেরিয়ে বাঙ্গালীদের সাথে আড্ডা খেলাধুলা সবই চলত। সে এক অন্য জীবন ছিল! যাইহোক, ভদ্র মহিলা আমাকে প্রফেসরকে দিয়ে একটি ইমেইল করতে বললেন, আর আমাকে একটি লঘু-শাস্তি দিলেন। শনিবার আমাকে ক্যাম্পাসে পরে থাকা কাগজ, ময়লা ইত্যাদি পরিষ্কার করতে বললেন কয়েক ঘণ্টা শাস্তিস্বরূপ।
যাইহোক লেখাটি শেষ করা যাক, আমার কোরিয়া লাইফের সেই দুরন্ত দিনগুলো এখনো মনে পরে, বিশেষ করে বাঙ্গালীদের সাথে একসাথে খেলাধুলা, খানা-দানা, উইকেন্ড এর বাঙালী পার্টি, ঈদের সকালে একসাথে নামাজ পরে সুবিদামত সময়ে পার্টি। আহারে কোথায় হারিয়ে গেল আমার ঘিয়ে বাজা দিনগুলো! যখন এই লেখাটা লেখছি তখন আমার মনে পরছে মান্নাদের সেই বিখ্যাত গানটি "কফি হাউসে সেই আড্ডাটা আজ আর নেই, আজ আর নেই!" আমাদের আড্ডার নিয়মিত সদস্যরা এখন ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশ আর শহরে। দু-তিনজন আছে বাংলাদেশের পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়য়ের শিক্ষক হিসেবে, কয়েকজন ডাক্তার আছে যারা দেশেই প্যাকটিস করছে, কয়েকজন এখনো কোরিয়াতে, একজন অস্ট্রেলিয়া আর আমরা প্রায় চারজন আমেরিকার বিভিন্ন রাজ্য এবং শহরে আছি। কোরিয়া ছেড়ে বাংলাদেশে ফিরলাম, তারপর বিয়ে করে দোকলা হয়ে গেলাম ডেনমার্কে পিইএইচডি করতে। পিএইচডির ফাস্ট ইয়ারেই বাচ্চা-কাচ্চা উৎপাদন করলাম, ইয়ে মানে আমার ছেলের জন্ম হল আরকি! সেখানেও একটি ছোটখাটো কমিউনিটি জমিয়ে ফেলেছিলাম, তারাও এখন আমেরিকা-কানাডায় আছে, যোগাযোগ হয় নিয়মিত। তারপর এলাম আমেরিকায় এলাবামাতে, এলাবামাতে যখন ছিলাম, সেখানে আমাদের কমিউনিটি অনেক বড় ছিল, আমরা কয়েকটি ফ্যামিলি কয়দিন পরপরই পার্টি করতাম। যখনই মনে হত উইকেন্ডে কোন পার্কে বা বনজঙ্গলে গিয়ে গাছের কাঠ বাঁ লাকড়ি পুড়িয়ে দিয়ে মাংস/ পোলাও/ভাত ইত্যাদি রান্না করে খেতাম। আর ফুটবলও খেলতাম অনেক, তারপরও আমার কোরিয়ার লাইফের সেই সময়টা সত্যিই মিস করি। কোরিয়া নিয়ে আমার অনেক কিছুই লেখার আছে, আসতে আসতে শেয়ার দিব।
কোরিয়া নিয়ে লেখাঃ
কোরিয়ার স্মৃতিচারণঃ আমার কোরিয়া যাওয়ার প্রারম্ভিক ইতিহাস
সর্বশেষ এডিট : ১৮ ই নভেম্বর, ২০২৩ সকাল ৮:৩৩