তখন আমি আন্ডার-গ্রাজুয়েট করছি। ধানমন্ডিতে একটি প্রাইভেট ইউনিভার্সিটি-তে কম্পিউটার ইঞ্জিনিয়ারিং -এ তৃতীয় বর্ষে পড়ি। প্রাইভেট ইউনিভার্সিটি-তে পড়ি ভেবে অনেকে ভাবতে পারেন আমরা মনে হয় মালধার পার্টি, আসলে ব্যাপারটা সেরকম নয়। তখন ছয় মাস পর পর সেমিস্টার ফি দিতাম ৪০ হাজার টাকা (এখন লাগে ৮৫ হাজার লাগে যতদূর জানি), এত মালপানি জোগাড় করা আমাদের পক্ষে সহজ ছিল না! তবে আমি ছোট থাকতেই আমার মার স্বপ্ন ছিল তিনি আমাকে ডাক্তার বানাবেন, ডাক্তাররা মালপানি ভালই কামায়, তাই সব মায়ের মত আমার মাও হয়ত চাইতেন আমিও যেন ভাল দিরহাম কামাই বড় হয়ে! তাই আমি ছোট থাকতেই আমার পড়াশুনার কথা চিন্তা করে একটি জমি কিনে রেখেছিলেন, উদ্দেশ্য ছিল আমি যখন বড় হব তখন এই জমি বিক্রি করে আমাকে তিনি রাশিয়া পাঠাবেন ডাক্তারি পড়তে। পাঠক ভাবতে পারেন, পৃথিবীতে এত দেশ থাকতে রাশিয়া কেন? রাশিয়া পাঠাতে চাওয়ার শানে-নযুল হল আমার এক মামা, আমার মামাও ডাক্তারি পড়তে রাশিয়া গিয়েছিলেন তখন তাই আমার মাও সেখান থেকেই অনুপ্রাণিত হয়েছিলেন।
যাইহোক, ছোট বেলা থেকেই আমি একটি কথা শুনেই বড় হয়েছি, পৃথিবীতে কেয়ামত হয়ে যাক আমাকে ডাক্তার হতেই হবে! মালপানি যা লাগবে সেটা নিয়ে আমাকে চিন্তা করতে হবে না! তবে আমি রেজাল্ট কি করি, না করি সেদিকে মা-বাবার কারো কোন খেয়াল ছিল না, এমনকি কি রেজাল্ট করলাম এগুলো জিজ্ঞেসও করতেন না, আমার প্রতি তাদের বিশ্বাস ছিল দেখার মতন! আমার আব্বার সাথে আমার যে ফ্রেন্ডলি সম্পর্ক ছিল ব্যাপারটা তেমন না, তবে তিনি আমাকে জীবন একটি চড়ও মারেন নি, ধমকতো দূর কি বাত! আব্বার সাথে একটি সূক্ষ্ণ দূরত্ব ছিল তবে শ্রদ্ধা ছিল অটুট, তেমন কথা হত না তবে তিনি যখন বাসায় আসতেন আমি তার পাশে গিয়ে মাথা নিচু করে বসে থাকতাম, টুকটাক কথা বলতাম, তার কথা শুনতাম, সত্য বলতে আব্বা বাসায় থাকলে আমার দারুণ লাগত, আমি সব কাজ ফেলে তার কথা শুনতাম। এমন ভদ্র, শান্ত শিষ্ট এবং সৎ মানুষ আমি জীবনে দেখিনি! পাঠক মাত্রই বুঝার কথা অনেক লাই পেয়েছি জীবনে। একটি উদাহারন দিচ্ছি, তখন ক্লাস টেইনে পড়ি, কয়েকজন বন্ধু মিলে এক চাচার কলা বাগান সাবাড় করলাম, সাথে বাগানের অনেক গাছ কেটে ফেলেছিলাম (এই ব্যার্থ মিশন নিয়ে একটি পোষ্ট দিয়েছিলাম ব্লগে, লিংক)। চুরি করে ধরা খেয়েছিলাম, বাসায় বিচার নিয়ে আসলেও আমাকে কিছুই বলেনি বাসা থেকে তবে এই অবাধ স্বাধীনতায় আমি কখনও বিগড়ে যাইনি! বোধহয় আমার আব্বার কিছু গুন জেনেটি-কালি পেয়েছিলাম! আসলে সেই বয়সটাই ছিল চুরি-চামারি করার হয়ত, বায়তুল মোকাররমের হুজুরকেও যদি জিজ্ঞেস করা হয়, হুজুর আপনি ছোট বেলায় এই ধরনের কোন আকাম করছিলেন নাকি? হুজুরও হয়ত বলবেন ইয়ে মানে আমিও ছোট বেলায় অমুকের গাছের লেবু চুরি করছিলাম (কায়দা করে নিজের অপরাধ হালকা করলাম আরকি!)।
আমি তখন নাইনে পড়ি, আমার বন্ধুদের অনেকেই আর্টস এবং কমার্স নিচ্ছে ধুমায়া কিন্তু কেউ ভয়ে সায়েন্স নিচ্ছে না। আমিও বন্ধুদের দেখাদেখি কমার্স বা আর্টস নিব বলে ঠিক করলাম, এতে আমার মা চটলেন, তিনি জানিয়ে দিলেন, হয় আমি সায়েন্স নিব নয়ত আমার লেখা পড়া বন্ধ, তিনি এই একটি ব্যাপারে আমাকে কখনও ছাড় দিতেন না! অনেক জোরাজুড়ি করলাম এমনকি পড়ালেখা ছেড়ে দেবার হুশিয়ারি দিলাম কিন্তু পেরে উঠলাম না, অগত্যা আমার সায়েন্স-ই নিতে হল, তবে সায়েন্স নেয়াটা ছিল আমার জীবনের সবচেয়ে ভাল সিদ্ধান্ত, এর জন্য আমি আমার মার প্রতি সব সময়ই কৃতজ্ঞ কারণ তিনি সেই সময়ে আমাকে জোড় না করলে আজকে হয়ত আমি এই জায়গায় থাকতে পারতাম না! আমি যে সায়েন্স নিয়ে অনেক কিছু করে উলটাইয়া ফেলেছি জীবনে ব্যাপারটা এমন না, তবে আমি আমার বর্তমান অবস্থান নিয়ে তৃপ্ত!
আমি ইন্টারমিডিয়েট পাশ করলাম বিজ্ঞান বিভাগ থেকেই। তবে ডাক্তারি পড়ার প্রতি কোন আগ্রহ পেলাম না, আমি সিদ্ধান্ত নিলাম ইঞ্জিনিয়ারিং পড়ব। ইঞ্জিনিয়ারিং এর প্রতি ভাল লাগার বীচ বপন করেছিল আমার এক প্রাইভেট স্যার, স্যার আমাকে ক্লাস নাইন এবং টেইনে বিজ্ঞান পড়াতেন এবং ইঞ্জিনিয়ারিং পড়তে বেশ উৎসাহিত করতেন। আমি স্কুলে মাঝারী মানের ছাত্র ছিলাম তবে স্যারের দৃষ্টিতে আমি ছিলাম সেরা ছাত্র। আমার প্রতি তার এই বিশ্বাসের কারণ কি ছিল আমার জানা নাই। স্যার প্রায় দুই বছর আমাকে পড়িয়েছিলেন এবং তিনি যতটুকু আমাকে পড়িয়েছেন তার থেকে বেশি সব সময় অনুপ্রাণিত করতেন, তার দৃষ্টিতে আমি বড় হলে কিছু একটা হবই! স্যার আমাকে কতটা স্নেহ করতেন তার একটি উদাহারন দিচ্ছি। স্যার কয়েক এলাকায় ঘুরে ঘুরে ছাত্র-ছাত্রী পড়াতেন, স্যার নিজেও তখন অনার্সে পড়ছিলেন। একদিন স্যারের এক ছাত্রীর সাথে আমার মোলাকাত হল, মেয়েটিও আমার মত ক্লাস টেইনে পড়ত তবে অন্য একটি স্কুলে। মেয়েটি যেই এলাকায় থাকে সেখানে আমি প্রায় ক্রিকেট খেলতে যাই, একদিন মাঠে ক্রিকেট খেলছি হঠাৎ একটি মেয়ে আমাকে ডাক দিল, আমি আসলে মেয়েটিকে চিনতাম না তবে মেয়েটি কিভাবে জেনে জেনেছিল আমি সেই স্যারের ছাত্র। আমি মেয়েটির কাছে গেলে মেয়েটি আমাকে বলল আজ তোমাকে দেখলাম প্রথম (একই ক্লাসে ছিলাম তাই তুমি করেই বলেছিল প্রথম দেখায়), তোমার প্রশংসা স্যার প্রায় প্রতিদিনই করে, তাই তোমাকে দেখার অনেক ইচ্ছে ছিল। মেয়েটির সাথে পরে আমার ভাল বন্ধুত্ব হয়ে গিয়েছিল, বিকেলে সেই এলাকায় ক্রিকেট খেলতে গেলে প্রায় কথা হত!
যাইহোক ইন্টারমিডিয়েটের পর আমাকে বাসা থেকে প্রবল চাপ প্রয়োগ করা হল যাতে ডাক্তারি পড়ি তবে এবার আর পেরে উঠল না। আমি ভর্তি হলাম কম্পিউটার ইঞ্জিনিয়ারিং এ। আমি কম্পিউটার ইঞ্জিনিয়ারিং এ পড়ে বেশ মজা পেয়ে গেলাম, বেশ মনোযোগ সহকারে পড়তাম, এলাকায় আড্ডা একেবারেই বন্ধ, আমার জীবন শুধু ইউনিভার্সিটি কেন্দ্রিক ছিল তখন। পড়াশুনার পাশাপাশি ইউনিভার্সিটি-তে হার্ডওয়ার এন্ড সফটওয়্যার ক্লাব, এবং পোগ্রামিং ক্লাবে জয়েন করলাম। আমাদের এক শিক্ষক ছিলেন ইউনিভার্সিটিতে, নাম ড. ফয়েজ খান। আমার জীবনে যে কয়জন ভাল শিক্ষকের সান্নিধ্য পেয়েছি স্যার ছিলেন তাদের অন্যতম। স্যার আমাদের ডিপার্টমেন্টের প্রধান ছিলেন তখন । স্যার এক সময় বুয়েটের শিক্ষক ছিলেন, পরবর্তীতে মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন জায়গায় প্রায় বিশ বছর উচ্চ পদে চাকরি করে দেশে ফিরে আবার শিক্ষকতায় যোগ দিয়েছিলেন (স্যার এখন বর্তমানে একটি প্রাইভেট ইউনিভার্সিটির ভাইস চ্যান্সেলর হিসেবে কর্মরত আছেন)। ড. ফয়েজ খান স্যার আমাদের বেসিক ইলেক্টিক্যাল এন্ড ইলেকট্রনিক্স পড়াতেন, তিনি এত সুন্দর করে পড়াতেন, আমি জীবনে অনেক শিক্ষকের সান্নিধ্য পেয়েছি তবে তার মত করে এত কঠিন বিষয় সহজে কেউ পড়ায়নি, স্যারের পড়ানোটা এখনো আমার মাথায় গেঁথে আছে।
আমি যখন ইউনিভার্সিটি-তে তৃতীয় বর্ষে পড়ি তখন আমাদের ডিপার্টমেন্টে সফটওয়্যার এন্ড হার্ডওয়ার ফেয়ার হল, আমি স্যারের আন্ডারে একটি প্রজেক্ট করি তখন, ইলেক্ট্রিক্যাল একটি মেশিন বানিয়েছিলাম, সেখানে বিচারক হয়ে এসেছিলেন অনেক গণ্যমান্য ব্যক্তি তার মধ্যে বুয়েটের কায়কোবাদ স্যারও ছিলেন। প্রতিযোগিতায় আমার প্রজেক্ট প্রথম পুরস্কার পায়, আমার নাম তখন প্রথম আলো পত্রিকায় এসেছিল, সেই ক্ষুদ্র অর্জন তখন আমার কাছে পৃথিবীর সেরা অর্জন ছিল, ইউনিভার্সিটিতে পোগ্রামিং কনটেস্টেও দু-বার টানা চ্যাম্পিয়ন এবং একবার দ্বিতীয় হয়েছিলাম, ভিসির থেকে পুরস্কার পেয়েছিলাম তখন, সবকিছু মিলিয়ে স্যার আমাকে বেশ স্নেহ করতেন। একদিন স্যার আমাকে ডেকে বললেন তোমাদের ব্যাচের ফাস্ট এবং সেকেন্ড বয়ের সিভি দাও, আমি তোমাদের হয়ে একটি স্কলারশিপের জন্য আবেদন করতে চাই, আমি ছিলাম ফাস্ট বয়, আমি আর আমার এক বন্ধু আমাদের সিভি দিয়েছিলাম। তখন জানতাম না স্যার কোথায় পাঠাবেন, অনেকদিন পর একটি ইমেইল পেলাম কোরিয়ান এম্বাসী থেকে, তারা আরও ডকুমেন্ট চায় আমাদের দুজনের থেকে। মোটামুটি লোভনীয় স্কলারশিপ, কোরিয়াতে আন্ডার গ্রাজুয়েটের সুযোগ, পড়ালেখা ফ্রি তার উপর মাসে মাসে প্রায় ৬০ হাজার টাকা দিবে থাকা খাওয়ার জন্য, কোরিয়াতে তখন মাসে ৩০-৪০ হাজার টাকাই এনাফ থাকা খাওয়ার জন্য (আমি যেই শহরে ছিলাম)। স্কলারশিপটা যখন প্রায় কনফার্ম হল, তখন আমার বন্ধু বেকে বসল, ও বলল দোস্ত আমি এক মার এক ছেলে, আমি আসলে দেশ ছেড়ে যেতে চাইনা তবে তোর যেতে যদি কোন সাহায্য লাগে আমি তোকে সব রকমের সাহায্য করব, ও আমাকে কাগজ পত্রে ভাল সহযোগিতা করেছিল। কোরিয়াকে ভাল লাগার আরেকটি কারন ছিল আমাদের ইউনিভার্সিটির এক সিনিয়র ভাই, তিনি একটি রোবট বানিয়েছিল সেই রোবট দক্ষিন এশিয়ার ভিতর দ্বিতীয় হয়েছিল বোদ হয়, বাংলাদেশের টিভি পত্রিকায় আলোড়ন করেছিল ব্যাপারটা তখন, সেই ভাই-ও কোরিয়াতে গিয়েছিল পড়াশুনা করতে তাই একটি ফেসিনেশন ছিল কোরিয়ার প্রতি আগে থাকতেই। এভাবে পারি দিলাম কোরিয়াতে।
আমরা কয়েকজন কোরিয়া ফেরত ছাত্রছাত্রী। বাংলাদেশে কোরিয়ান এম্বাসির আয়োজনে গেট-টুগেদার পার্টিতে, সাথে কোরিয়ান রাষ্টদুত। বাম দিক থেকে কোরিয়ানের পাশে আমি।
কোরিয়াকে আমি আমার দ্বিতীয় দেশ হিসেবেই মানি, এখনো সে সম্পর্ক অটুট আছে, আমরা যারা কোরিয়ান সরকারী স্কলারশিপ স্টুডেন্ট ছিলাম বা এখনো যারা আছে, কোরিয়ান এম্বাসি এখনও আমাদের সাথে যোগাযোগ ধরে রেখেছে, এই সম্পর্ক আজীবন থাকবে। আমাদের হোয়াটস-আপ গ্রুপ আছে, এম্বাসীও আছে সেখানে, আমাদের সাথে রেগুলার যোগাযোগ রাখে এবং ঢাকায় বিভিন্ন পোগ্রাম করে আমাদের নিয়ে প্রতি বছর। কয়েক বছর আগে ঢাকায় ছিলাম তখন এম্বাসী থেকে দাওয়াত দিয়েছিল, উপরের ছবিতে রাষ্টদুতের সাথে আমরা কয়েকজন গুলশানের একটি রেস্টুরেন্টে (এখন মনে হয় অন্য কেউ এম্বাসেডর, পরিবারসহ দাওয়াত ছিল, সবাই গিয়েছিলাম)। রিসেন্টলিও একটি গেট-টু-গেদার করেছিল এম্বাসী থেকে তবে বাইরে থাকি বলে যেতে পারিনি তবে ভিডিও বার্তা দিয়েছিলাম আমরা যারা যারা যেতে পারিনি। কোরিয়া আমার কাছে শুধু একটি দেশ নয়, একটি আবেগের নাম, জীবনের সব চেয়ে ভাল সময় কেটেছে সেখানে।
আমার স্মৃতিচারণমূলক পোষ্টসমূহঃ
স্মৃতিচারণঃ আমি দেশ ছাড়তে চাইনি
স্মৃতিচারণঃ আমি একটি এপোলজি নোট লিখতে চাই
বিজ্ঞান নিয়ে কচলাকচলি করতে হবে
যেমন চলছে জীবন
সদ্য ফেলে আসা কিছু অম্ল-মধুর অভিজ্ঞতা
বন্ধু এবং বন্ধুত্ব
আমার প্রবাস থেকে স্বদেশ ভ্রমণ
অলৌকিকের লৌকিক ব্যাখ্যা
কাজী সাহেব সমাচার
আমার প্রথম মোছ বিসর্জনের গল্প
আমার স্বদেশ প্রত্যাবর্তন, অতঃপর...
গুরু সেই নার্সারী থেকে শুরু
একটি অদ্ভুদ গাছের গল্প
চুরি বিদ্যা
খেয়ে যায় মোছওয়ালা নাম পরে দাড়িওয়ালার