somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

স্মৃতিচারণঃ আমি দেশ ছাড়তে চাইনি

২৫ শে আগস্ট, ২০২২ সকাল ৭:৪৬
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

২০১৩ সাল, দক্ষিণ কোরিয়া থেকে কম্পিউটার ইঞ্জিনিয়ারিং -এ ব্যাচেলর এবং মাস্টার্স শেষ করেছি মাত্র। মাস্টার্সে থাকা অবস্থায়ই কানাডার একটি বিশ্ববিদ্যালয়ে ফুল ফান্ডে পিএইচডিতে ভর্তি হলাম। আমি যখন মাস্টার্স শেষ সেমিস্টারে পড়ি তখন দেখলাম কোরিয়াতে স্যামসাং-এ লোক নিচ্ছে বাংলাদেশ ব্যাঞ্চের জন্য, ভাবলাম ইন্টার্ভিউটা দিয়ে দেই! গ্রাজুয়েশনের আগেই জানতে পারি স্যামসাং-এ চাকরিটাও হয়ে গেছে। সিনিয়র সফটওয়্যার ইঞ্জিনিয়ার পদে জয়েন করতে হবে দেশে, বেতন মোটামুটি খারাপ না! আমার অবস্থাটা তখন 'চাকরীটা আমি পেয়ে গেছি বেলা শুনছ, আর মাত্র কয়েকটা দিন ব্যাস', তবে আফসোস দেশে আমার কোন বেলা বোস নেই! যাইহোক আমি সিদ্ধান্ত নিলাম দেশে ফিরব, আসলে অনেক লম্বা সময় বিদেশ থাকব এমন কোন ইচ্ছাই ছিল না! আমি দেশে ফিরব শুনে আমার বাসায় সবাই বেশ মনক্ষুন্ন হল, তারা ভেবেছিল হয়ত ছেলে বিদেশ চাকরি-বাকরি করে বিদেশী দিনার দিয়ে পকেট ভারি করবে, দেশে ফিরছে কেন শুধু শুধু। তবে তাদের এই ভাবনাটাকে আমি খারাপ ভাবে দেখছি না!

দেশে ফিরে চাকরিতে জয়েন করলাম। আত্মীয়স্বজন থেকে শুরু করে পাড়া প্রতিবেশী যার সাথেই দেখা হয় সবাই আমাকে দেখে মুষড়ে পরে, এত ভাল সুযোগ থাকা অবস্থায়ও কেন দেশে ফিরলাম এই ভেবে তাদের রাতের ঘুম হারাম হয়ে যাবার অবস্থা! তবে আমার তাতে কোন ভ্রুক্ষেপ নেই। দেশে ফিরেই জানালাম বিয়ে শাদী করে ঘর-সংসার করতে চাই, অবশ্য আমি যখন কোরিয়াতে ব্যাচেলর চতুর্থ বর্ষে পড়ি তখনই বাসায় মাকে ফোনে জানিয়েছিলাম শুভ কর্মটি সম্পাদন করতে চাই।

দেশে ফিরার মাস দুয়েকের মধ্যেই শুভ কর্মটি সম্পাধান করে ফেলি! কোরিয়াতে থেকে দেশে একেবারে খালি হাতে ফিরি নাই, সরকারী স্কলারশীপের টাকা আর ল্যাবে কাজ করে যা পেতাম, সেখান থেকে ভালই জমিয়েছিলাম। ল্যাবে আমি মোটামুটি ভাল টাকাই পেতাম। অন্তত আমি বাংলাদেশে চাকরিতে যে বেতনে আসছি তার ডাবলের বেশী ল্যাব থেকেই পেতাম। আমাদের মধ্যবিত্ত সংসারে মাঝে মাঝে টাকা পাঠাতাম, অনেক সময় লাখ টাকার উপরেও পাঠাতাম একত্রে তখন। এখানে বলে রাখা প্রয়োজন, আমি করিয়াতে যেই ল্যাবে কাজ করতাম সেই প্রফেসরও আমাকে পিএইচডির অফার করেছিল। সেই প্রফেসর বাংলাদেশে আমাদের বাসায় এসে মাকে বলেছিল আপনার ছেলেকে আরো পাঁচ বছরের জন্য আমাকে দিন। ও বিয়ে করে বউ নিয়ে আসুক, আমি খরচ দিব আর মাসে মাসে আপনাদের আশি হাজার টাকা দিব সংসার পরিচালনার জন্য। সেই হিসেবে অর্থনৈতিকভাবে চিন্তা করলে দেশে আসা ছিল একেবারেই লস প্রজেক্ট, তবে কথায় আছে না দেশ প্রেম! আসলে দেশ প্রেমে উজ্জীবিত হয়েই দেশে ফিরেছিলাম!

আমাদের বাসা ঢাকায়, আমাদের বাসার কয়েকটা ঘর বাড়া দেয়া আছে আর একটা পুরোনো বিল্ডিঙে আমরা নিজেরা থাকতাম। দেশে আমার জমানো টাকা আর ব্যাংক লোণ নিয়ে সেই বিল্ডিংটা পাঁচতলা ফাউন্ডেশন দিয়ে দোতালা করলাম! বিয়েও করলাম নিজের টাকা দিয়ে, সেই দিকে নিজের মনে একটি সুপ্ত অহংকার কাজ করত সবসময়!

চাকরি এবং সংসার ভালই চলছিল। তবে ২০১৩ সালে তখন দেশে তাণ্ডব চলছিল! প্রতিদিন বাস পুড়ানো, মিটিং মিছিল এগুলো যেন নৈমিত্তিক ঘটনার পরিণত হয়েছিল! আমার অফিস ছিল কাওরান বাজারে, জীবনের ঝুঁকি নিয়ে অফিস করতাম। বাসে সীট পাওয়া ছিল ভাগ্যের ব্যাপার, আর জ্যামের কথা নাইবা বললাম। অফিস শেষে বাসে ওঠার প্রতিযোগিতা করতে হত, বাসের ভিতর গাধাগাধি অবস্থা। একবার কেউ বাসে উঠে পরলে দেখতাম সেও নতুন কেউ যাতে উঠতে না পারে সেভাবে কন্টাকটারকে তাগাদা দিত! এত কিছুর পরও চাকরীটা চালিয়ে যাচ্ছিলাম। আসলে যেভাবেই হোক দেশেই থাকব এরকম চিন্তা নিয়েই দেশে ফেরা!

চাকরীর বছর খানেক পার করে দিলাম। স্যামসাং এ চাকরিটা দেশের সবার জন্যই আকর্ষণীয়, তাই বুয়েট, কুয়েট থেকে শুরু করে সব পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের মেধাবী ছাত্র-ছাত্রীরা এখানে প্রতিযোগিতা করে জয়েন করত। ২০১৪ সাল থেকেই স্যামসাং মোটামুটি অর্থনৈতিক ভাবে ধাক্কা খায়, তারা সিদ্ধান্ত নেয় প্রায় অর্ধেকের বেশী কর্মী ছাটাই করবে, স্যামসাং এ তখন প্রায় ৬০০ জনের মত কাজ করে! আমি খুব কাছ থেকে তখন দেখলাম দেশের মেধাবী সেই মুখগুলোর মলিন চেহারা। সবাই দু-চিন্তায়,কার কখন চাকরী যায় এই চিন্তায় সবাই অস্থির। এমনও হয়েছে অফিসে এসে শুনলাম ঘুব ঘনিষ্ঠ কারো চাকরি চলে গেছে, সবার ভিতরেই অস্থিরতা, কারণ চাকরী হারালে বাংলাদেশে নতুন একটি চাকরী যোগার করা খুব একটা সহজ নয়। তার-উপর স্যামসাং এর এই অবস্থা সারা দেশের আইটি সেক্টর ওয়াকিবহাল এবং তারা এর সুযোগ নিচ্ছিল। তারা সেই সুযোগে লোকবল নিতে আগে যেই টাকা অফার করত এখন অনেক কম করছে। আইটি মার্কেটে প্রবল অস্থিরতা বিরাজ করছিল। আমি না হয় নিজের বাসায় থেকে অফিস করি, আমার অনেক কলিগই ঢাকায় ভাড়া থেকে অফিস করে, তারা বলত বাসা ভাড়াই গুনতে হয় মাসে ত্রিশ হাজারের মত, হঠাত চাকরী হারালে বেকায়দায় পরতে হবে।

আমি নববিবাহিত, চাকরী হারানোটা ইজ্জতের শাওয়াল তার-উপর ব্যাংক লোণ আছে বাড়ির জন্য। চিন্তা করলাম কবে কি ঘটে এর চেয়ে ভাল অন্য একটি চাকরী জোগাড় করি। আমার রিসার্চে প্রোফাইল খুব একটা খারাপ না, অন্তত বাহিরে একটা কিছু চাইলেই করা যাবে! তারপরও দেশেই চেষ্টা চালিয়ে যেতে লাগলাম। প্রতিদিনই অফিস থেকে ফিরেই বিভিন্ন জায়গায় চাকরির আবেদন করতে লাগলাম। আমি প্রায় ৩০/৩৫ টার মত চাকরীতে ইন্টারভিউ দিয়েছিলাম, সেই হিসেবে দেশের চাকরীর বাজার, কর্পোরেট কালচার সম্পর্কে ভালই ধারনা আছে! আমার বিচিত্র অভিজ্ঞতা হয়েছে, তার কয়েকটা বলা যাক।

একটি কোরিয়ান মাল্টি-ন্যশনাল কোম্পানিতে ইন্টারভিউ দিতে গেলাম। টেকনিক্যাল পজিশন, সম্ভবত উত্তরা অফিস ছিল যতদূর মনে পরে। কোন রকম অফিস থেকে সময় ম্যানেজ করে গেলাম ইন্টারভিউ দিতে। দুপুরের রোধ এবং জ্যাম ঠেলে আশা নিয়ে ইন্টার্ভিউ দিতে গেলাম। আমাকে বলল লিখিত পরীক্ষা হবে, আমি সম্মতি-সরূপ মাথা ঝাঁকালাম। আমি ভাবছিলাম টেকনিক্যাল পজিশন তাই হয়ত টেকনিক্যাল বিষয়ে লিখিত পরীক্ষা হবে। অনেকক্ষণ বসিয়ে রেখে শেষে একটি খাতা আর একটি ডকুমেন্ট ধরিয়ে দিল আমাকে। ডকুমেন্ট খুলে দেখি কোরিয়ান লেখা, আমাকে এই কোরিয়ান লেখাগুলোকে ট্রান্সলেশন করতে হবে! আমি আকাশ থেকে পড়লাম, সফটওয়্যার ইঞ্জিনিয়ার পদের লিখিত পরীক্ষার জন্য কোরিয়ান ট্রান্সলেশন!! আমি হাসব নাকি কাধবো বুঝতে পারলাম না! আমার জায়গায় তখন চিত্র-নায়ক জসীম হলে ততক্ষণে নিশ্চয়ই ক্ষোভে সার্টিফিকেট ছিঁড়ে ফেলত, তবে ভাগ্য ভাল আমি নায়ক জসীম নই তাই রাগ সংবরণ করলাম।

আরেক জায়গায় গিয়েছি ইন্টার্ভিউ দিতে, সেটাও উত্তরা হবে মনে হয়। গিয়েছিলাম বিকেলে, অপেক্ষা করতে করতে সন্ধ্যা হয়ে গেল আর এদিকে আমি তখনো কিছুই খাইনি। ক্ষুধায় আমার পেট চো-চো করছে। অবশেষে দুজন এলো আমার ইন্টার্ভিউ নিতে, এসেই খুব ব্যস্ততা দেখাচ্ছে, তারা নাকি সেদিন রাতেই মালয়েশিয়া যাচ্ছে, আমার সাথে খশ গল্প শুরু করছে, দারুণ ব্যস্ততা যাচ্ছে। একজনের দেখলাম পেটটা সামনের দিকে সিজদা দিয়ে আছে, ভদ্রলোক মাল্টি ট্যালেন্টেট, কানাডার কোন কোন বিশ্ববিদ্যালয়ে নাকি পড়ান মুখ ফুলিয়ে বললেন, আমি নিজেকে অনেক কষ্টে সংবরণ করলাম।

আরেকটা ইন্টারভিউ এর কথা মনে পরছে সেটা ছিল শুক্রাবাদে মনে হয়। গিয়ে দেখি অনেককে বসিয়ে রেখেছে। কিছুক্ষণ পরপর একজন করে ভিতরে ডাকে, আমার ডাক পরল, আমি ভিতরে গেলাম। ইন্টারভিউ শেষে আমাকে জানাল এটা নাকি পার্মানেন্ট পজিশন না,চুক্তি ভিত্তিতে তাদের সাথে কাজ করতে হবে, অথচ চাকরির সার্কুলারে এগুলো লেখা ছিল না। দেশের কর্পোরেট কালচার যে এখনো প্রফেশনালিজম শিখে নাই, এখনো নাবালক অবস্থায়ই আছে সেটা টের পেলাম। আমি বিভিন্ন ধরনের বিব্রতর অবস্থায় পরেছি ইন্টারভিউ দিতে গিয়ে, আমার মনে হয় প্রার্থীদের তারা মানুষ মনে করে না!

যাইহোক অনেক খুঁজাখুঁজির পর একটি কোম্পানিতে চাকরী হল, সিনিয়র সফটওয়্যার ইঞ্জিনিয়ার হিসেবে, একটি ছোট এন্ড্রয়েড টিমের হেড হিসেবে। স্যামসাং-এ প্রায় দুই বছর চাকরি করার পর চাকরিটা ছেড়ে নতুন চাকরিটাতে জয়েন করি। আসলে স্যামসাং-এর চাকরিটা করতে পারতাম তবে কোম্পানির অবস্থায় ভরসা করতে পারছিলাম না, কখন কি হয় এই ভেবে। যাইহোক নতুন কোম্পানিতে আমার রিপোর্টিং ম্যানেজার ছিল কোম্পানির সিইও। সপ্তাহে ছয়দিন অফিস, সকাল নয়টা থেকে পাঁচটা পর্যন্ত। তবে মালিক পক্ষ চায় রাত পর্যন্ত যেন কাজ করি, বিভিন্নভাবে বলেছেও আমাকে!

নতুন কোম্পানিতে একটি কাজ দিয়ে কিছুক্ষণ পরপর সেটার আপডেট চায়। যারা সফটওয়্যার ফিল্ড-এ আছে তারা জানে এখানে প্রতিদিন আপডেটের কিছু থাকে না আসলে, মাঝে মাঝে ছোট একটি সমস্যার সমাধান করতে কয়েকদিন লেগে যায় আবার কোন সময় দেখা গেল কঠিন সমস্যাও সহজেই সমাধান হয়ে যাচ্ছে! প্রতিদিন রাত হয়ে যেতে বাসায় ফিরতে, রাস্তায় জ্যাম, বাসে অতিরিক্ত মানুষ, গরমে সিদ্ধ হয়ে বাসায় ফিরতাম। লম্বা সময় বিদেশ থেকে দেশে এসে এই ব্যাপারগুলো আমার মানিয়ে নিতে বেগ পেতে হচ্ছিল, তার উপর অফিস পলিটিক্স এর সাথে আমি অভ্যস্ত না। আসলে স্যামসাং- এ যেই টাকা বেতন পেতাম তার চেয়ে আরো একটু কম বেতনেই এখানে জয়েন করছিলাম। আসলে বললাম না দেশ ছাড়ার কোন ইচ্ছেই আমার ছিল না, দেশ প্রেম বলে একটা কিছু আছে সেটা হাড়ে হাড়ে বুঝছিলাম।

স্যামসাং একটি ইন্টারন্যাশনাল কোম্পানি, তাই এর কালচার দারুণ ছিল। তবে লোকাল কোম্পানিতে কাজ করে বুঝতে পারলাম কত আটায় কত রুটি হয়! আমার ব্যক্তিগতভাবে মতামত আমাদের দেশের বেশির ভাগ কোম্পানির মালিক কর্মীদের চাকর ভাবে! নতুন চাকরীর কয়েক মাস না যেতেই চেষ্টা করলাম আবার নতুন চাকরী খুঁজতে। আসলে এভাবে কাজ করা যায় না! জীবনটা যেন অতিষ্ঠ হয়ে উঠছে, একে-তো বাসা থেকে অফিস যাতায়াতে প্রতিদিন ঘণ্টার পর ঘণ্টা জ্যামে বসে থাকতে হয় তার উপর অফিসে কাজ করে মজা পাচ্ছিলাম না। আমার বউ আমাকে প্রায় তাড়া দিত বিদেশ যেতে, তবে আমি তারপরও লেগে ছিলাম। ওই যে দেশ প্রেম!

আমারদের প্রথম সন্তান হবে, বউ আমাকে বুঝালো বিদেশে বাচ্চা উৎপাদনের ফজিলত অনেক বেশী। বিদেশে বাচ্চা উৎপাদন করতে পারলে তার ভবিষ্যৎ ফকফকা হবে। আমিও ততদিনে বুঝে গেলাম দেশে আসলে আমার দেবার মত কিছু নেই। অনেকেই দেশে চায়ের দোকানে বসে ঝড় তুলে আর বলে মেধাবীরা দেশ থেকে চলে যাচ্ছে, এতে বহুত ক্ষতি হয়ে যাচ্ছে, আমি সেটা মনে করি না। আমি নিজেকে মেধাবী হিসেবে দাবি করছি না। আমার মতে মেধাবীরা দেশ থেকে গেলে হয়ত পরোক্ষভাবে দেশের লাভ! দেশে থাকলে যেই চাকরিটা করতাম, বিদেশে যাবার ফলে আমার জায়গায় অন্য কেউ সেই চাকরীটা করছে হয়তবা। তাছাড়া আমাদের আইটি সেক্টরে যেই লেভেলে কাজ হয় সেটা আসলে বলা যায় শিশু লেভেলের কাজ। এই কাজ করার জন্য বিদেশ থেকে বড় বড় ডিগ্রিধারীর দরকার নেই! বরং বাহিরে যেতে পারলে নিজেই দক্ষতা ভালভাবে কাজে লাগানো যায়!

চিন্তা করলাম বিদেশেই চলে যাই, আমার আর দেশকে দেবার মত কিছু নেই। আমেরিকার প্রেসিডেন্ট কে হল? চায়না কি পরবর্তী সুপার পাওয়ার হবে? অথবা আফগানিস্তানের ভবিষ্যৎ কি? এইগুলো নিয়ে চিন্তা করার চেয়ে ভাবলাম নিজের পরিবার নিয়ে ভাবি। অবশেষে কয়েক মাসের মধ্যেই ডেনমার্কে পিএইচডি যোগাড় করে ফেললাম। ২০১৫ সালের মাঝামাঝি বউসহ চলে গেলাম ডেনমার্কে।

কোরিয়া থেকে দেশে ফিরে গিয়েছিলাম এই নিয়ে আমার কখনো দুংখ বোধ ছিল না এবং এখনো নাই কারণে কথায় আছে খারাপ সময় মানুষকে অনেক কিছু শিখায়! প্রায় আড়াই বছরে দেশে থেকে আমি দেশের কর্পোরেট কালচার, মানুষ, পরিবার পরিজন সবাইকে আরো ভালভাবে চিনতে পেরেছিলাম। বিয়ের পর আসলে সম্পর্কের সূত্রগুলোর পরিবর্তন হয়, পারিবারিক প্রত্যাশা, দায়িত্বের চাপ হঠাত এসে যেন ধাক্কা খেয়েছিল আমার উপর। আমি নিজের দুর্বলতা এবং শক্তিগুলোকে তখন উপলব্ধি করতে পেরেছিলাম। তাই সেই অভিজ্ঞতাটা বড্ড দরকার ছিল আমার।

ডেনমার্কে পিএইচডিকে চাকরি হিসেবে চিন্তা করে অর্থাৎ একজন ছেলে মাস্টার্স শেষ করে ইন্ডাস্ট্রিতে যেই বেতন পায় পিএইচডিতে তারা সেই বেতন পায়। তার-উপর আমার দুই বছরের উপরে চাকরির অভিজ্ঞতা তাই বেতনও ভালই পেতাম! কোরিয়াতে থাকাকালীন আমি আসলে সেভিং এ জোর দেই নাই, সেটা আমার মাথায়ই ছিল না তবে ডেনমার্কে সেই ভুল কম করার চেষ্টা করেছিলাম। মাসে ভাল টাকা সেইভ করতে পারতাম, ব্যাংক লোণও শোধ করে ফেলেছিলাম। ডেনমার্ক থেকে পিএইচডি শেষ করলাম ২০১৯ সালের নবেম্বরে, পিএইচডি ডিগ্রি এবং মোটামুটি ভাল অংকের টাকা নিয়ে দেশে ফিরলাম। আমি বিজনেস পারিনা,তাই জমানো টাকা দিয়ে একটি জায়গা কিনে রাখলাম।

যাইহোক বউ আমার হতাশ হল। কারণ সে আশায় ছিল ডেনমার্কে বাচ্চা উৎপাদন করলে হয়ত বাচ্চা ডেনিশ নাগরিকত্ব পাবে। তবে আমার ছেলে পেল না, তবে এতে আমার চেহারার কোন দোষ নাই! আমার চেহারা খারাপ এর জন্য যে নাগরিকত্ব পেল না ব্যাপারটা এমন না। ডেনমার্কে জন্মসূত্রে নাগরিকত্ব দেয়া হয় না! আসলে পিএইচডির প্রথম বর্ষে থাকতেই আমাদের ছেলের জন্ম হয়। আমার বউকে হতাশ দেখে বললাম নো চিন্তা ডু ফুর্তি, আমার ছেলের ব্যবস্থা একটি আমি করবই! আমি ডেনমার্ক থেকে পিএইচডি করে দেশে ফিরলাম ২০১৯ এর নবেম্বরে, তখনো নতুন কোন চাকরির ব্যবস্থা হয়নি!

পিএইচডি করা মানে দেশে আমি ওভার-কোয়ালিফাইড, ইন্ডাস্ট্রির দরজা আমার জন্য বন্ধ! আমার একমাত্র পথ হচ্ছে ইউনিভার্সিটি। তবে দেখলাম সরকারী বিশ্ববিদ্যালয়ে আমার চাকরি হবে না কারণ আমি সেকেন্ড ক্লাস নাগরিক। আর সেকেন্ড ক্লাস নাগরিকের সরকারী বিশ্ববিদ্যালয়ে চাকরী হয় না! সেকেন্ড ক্লাস নাগরিক মানে আমি ব্যাচেলর করেছি কোরিয়া থেকে, বাংলাদেশের সরকারী বিশ্ববিদ্যালয়ে অলিখিত নিয়ম হচ্ছে কেউ বাংলাদেশ সরকারী বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ডিগ্রি না নিলে সরকারী বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক হতে পারবে না যদিও আমি এই দেশের নাগরিক! তারা দরকার পরে ব্যাচেলর ডিগ্রি-ওয়ালা কাউকে শিক্ষক বানাবে তারপরও এর বাইরে যাবে না! পিএইচডি ডিগ্রি এই দেশে কোন মূল্য নাই! তবে দেশে আমি মানান সই নই সেটা আগেই বুঝতে পেরেছিলাম।

ডেনমার্ক থেকে দেশে আসার সপ্তাহ-খানেক পরে আমেরিকার একটি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পোষ্ট-ডোকরাল রিসার্চার পজিশোনে ডাক পেলাম। ২০২০ সালে চলে এলাম আমেরিকায় আর এ বছর আমার পরিবারসহ গ্রিন কার্ড পেলাম। তাই আমি বলব আমি দেশে ফিরার চেষ্টা করেছি, আমি আয়েশী জীবন এবং পশ্চিমাদের নরম বিছানায় আর কোল বালিশে শুয়ে থাকার লোভে বাহিরে আসি নাই, আমি দেশে ফিরতে চেয়েছিলাম এবং চেষ্টা করেছিলাম। আমি আনন্দিত আমি দেশে গিয়েছিলাম। যাইহোক আমি এখন অনুধাবন করতে পারি যারা দেশে বেসরকারী চাকরীজিবী তাদের অবস্থা কেমন। তারাই আসলে সত্যকারে যোদ্ধা, তারাই দেশকে এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছি আর আমরা যাদের সুযোগ আগ আছে তারা চলে আসছি মানে পালিয়ে আসছি! তাই আমার টুপি খোলা শ্রদ্ধা সেই সত্যিকারে যোদ্ধাদের প্রতি!

আজ এই পর্যন্তই। জগতের সকল প্রানী সুখী হোক!

আমার স্মৃতিচারণমূলক পোষ্টসমূহঃ
স্মৃতিচারণঃ আমি একটি এপোলজি নোট লিখতে চাই
সদ্য ফেলে আসা কিছু অম্ল-মধুর অভিজ্ঞতা
যেমন চলছে জীবন
কাজী সাহেব সমাচার
আমার প্রথম মোছ বিসর্জনের গল্প
আমার স্বদেশ প্রত্যাবর্তন, অতঃপর...
গুরু সেই নার্সারী থেকে শুরু
একটি অদ্ভুদ গাছের গল্প
চুরি বিদ্যা
খেয়ে যায় মোছওয়ালা নাম পরে দাড়িওয়ালার
বন্ধু এবং বন্ধুত্ব


সর্বশেষ এডিট : ২৬ শে আগস্ট, ২০২২ ভোর ৫:৫১
২৫টি মন্তব্য ২৫টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

আপনি কি পথখাবার খান? তাহলে এই লেখাটি আপনার জন্য

লিখেছেন মিশু মিলন, ২২ শে এপ্রিল, ২০২৪ রাত ১০:৩৪

আগে যখন মাঝে মাঝে বিকেল-সন্ধ্যায় বন্ধুদের সঙ্গে আড্ডা দিতাম, তখন খাবার নিয়ে আমার জন্য ওরা বেশ বিড়ম্বনায় পড়ত। আমি পথখাবার খাই না। ফলে সোরওয়ার্দী উদ্যানে আড্ডা দিতে দিতে ক্ষিধে পেলে... ...বাকিটুকু পড়ুন

কষ্ট থেকে আত্মরক্ষা করতে চাই

লিখেছেন মহাজাগতিক চিন্তা, ২৩ শে এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ১২:৩৯



দেহটা মনের সাথে দৌড়ে পারে না
মন উড়ে চলে যায় বহু দূর স্থানে
ক্লান্ত দেহ পড়ে থাকে বিশ্রামে
একরাশ হতাশায় মন দেহে ফিরে।

সময়ের চাকা ঘুরতে থাকে অবিরত
কি অর্জন হলো হিসাব... ...বাকিটুকু পড়ুন

রম্য : মদ্যপান !

লিখেছেন গেছো দাদা, ২৩ শে এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ১২:৫৩

প্রখ্যাত শায়র মীর্জা গালিব একদিন তাঁর বোতল নিয়ে মসজিদে বসে মদ্যপান করছিলেন। বেশ মৌতাতে রয়েছেন তিনি। এদিকে মুসল্লিদের নজরে পড়েছে এই ঘটনা। তখন মুসল্লীরা রে রে করে এসে তাকে... ...বাকিটুকু পড়ুন

= নিরস জীবনের প্রতিচ্ছবি=

লিখেছেন কাজী ফাতেমা ছবি, ২৩ শে এপ্রিল, ২০২৪ বিকাল ৪:৪১



এখন সময় নেই আর ভালোবাসার
ব্যস্ততার ঘাড়ে পা ঝুলিয়ে নিথর বসেছি,
চাইলেও ফেরত আসা যাবে না এখানে
সময় অল্প, গুছাতে হবে জমে যাওয়া কাজ।

বাতাসে সময় কুঁড়িয়েছি মুঠো ভরে
অবসরের বুকে শুয়ে বসে... ...বাকিটুকু পড়ুন

Instrumentation & Control (INC) সাবজেক্ট বাংলাদেশে নেই

লিখেছেন মায়াস্পর্শ, ২৩ শে এপ্রিল, ২০২৪ বিকাল ৪:৫৫




শিক্ষা ব্যবস্থার মান যে বাংলাদেশে এক্কেবারেই খারাপ তা বলার কোনো সুযোগ নেই। সারাদিন শিক্ষার মান নিয়ে চেঁচামেচি করলেও বাংলাদেশের শিক্ষার্থীরাই বিশ্বের অনেক উন্নত দেশে সার্ভিস দিয়ে... ...বাকিটুকু পড়ুন

×