জনাব সালাউদ্দিন,
আপনাকে অভিনন্দন!
টানা চতুর্থবারের মতো বাংলাদেশ ফুটবল ফেডারেশনের সভাপতি নির্বাচিত হয়েছেন, আমি আনন্দিত।
আপনার সাথে, আপনার দলের সাথে আমার সম্পর্ক সেই ক্লাস ওয়ান থেকে। যদিও স্টেডিয়ামে গিয়ে প্রথম খেলা দেখি ১৯৭৭ সালে। আপনি খেলেছিলেন সেদিন। প্রতিপক্ষ মোহামেডান। বড় ভাইয়ের সাথে গিয়েছিলাম খেলা দেখতে। শুনেছিলাম লায়নেল পিরিচ ও মহেন্দ্র পালাকে শ্রিলঙ্কা থেকে নিয়ে এসেছে আবাহনী, জিততেই হবে। খুব উত্তেজনার ম্যাচ।
স্টেডিয়ামের বাইরে কি বিশাল লাইন! বাপ রে বাপ! ব্ল্যাকারদের কাছ থেকে টিকিট কিনে লাইনে দাড়াই, এর মধ্যেই পুলিশের অতর্কিত লাঠির বাড়ি। শক্ত করে হাত ধরে আগলে রাখেন ভাইয়া। কিন্তু এই লাঠির কারণ জানিনা। হতে পারে আবাহনী বনাম মোহামেডান, এই নাম দুটোইতো একটা বড় কারণ।
আপনার শেষ খেলাটিও দেখেছিলাম। আপনাকে ফুলের মালা দিয়ে বিদায় জানানো হয়েছিল। আপনি চিরকালের প্রতিদ্বন্দ্বী মোহামেডানের হয়ে খেলেছিলেন সেদিন। ওই দিনটিতে খুবই মন খারাপ ছিল কারণ ততদিনে আমি জেনে গিয়েছিলাম যে আমাদের একজন হিরো আছেন এবং তাঁর নাম সালাউদ্দিন, আজকের পর যার খেলা আর দেখতে পাব না।
তেরো বছর আগে ২০০৬ সালে যখন আপনি প্রথমবারের মতো বাফুফের সভাপতি নির্বাচিত হন আমি উদ্বেল হয়েছিলাম আনন্দে। দৃশ্যটা এখনো ঝকঝক করে। খবরটা পড়ে আমি সেদিন আমার ছোট্ট বড় মেয়েটিকে জড়িয়ে ধরে অনেক আবেগ নিয়ে স্বগতোক্তি করেছিলাম, 'এবার যদি বাংলাদেশের কিছু হয়'। মেয়েটি উদ্বিগ্ন চোখে জিজ্ঞেস করেছিল, 'বাংলাদেশের কি হয়েছে আব্বা? তুমি কি বাংলাদেশে যেতে চাও?'
কিন্তু অভাগা যেদিকে চায়, সাগর শুকায়ে যায়।
২০০৬ সালে নির্বাচনে জিতলেন। ৪ বছর পর যা পারেননি তা করবেন বলে আরও ৪ বছর নিলেন। এরপর ৮ বছরে যা পারেননি তা করে দেখাবেন বলে আরও ৪ বছর আদায় করে নিলেন। এই ১২ বছরে যা পারলেন না, আগামী ৪ বছরে তাই করবেন বলে ২০২০ এ নির্বাচিত হয়ে গেলেন। যে কাজ ১২ বছরে শুরু বা সমাপ্ত, কিছুই করতে পারেননি তা মাত্র ৪ বছরে কী যাদুতে সম্ভব করবেন?
একটু বলুননা, পিলে চমকানো এক কোটি টাকার সুপার কাপ দেশের ফুটবলের উন্নয়নে কী অবদান রেখেছে? কোটি টাকা খরচ করে আর্জেন্টিনা-নাইজেরিয়াকে এনে কোথাও কি এতোটুকুও জোয়ার আনতে পেরেছেন?
আপনি সেই চার বছরে চমকে দিয়েছিলেন আশা আর আইডিয়া দিয়ে, কিন্তু চার বছর, আট বছর, বারো বছরেও পায়ের নিচের মাটিটুকুও শক্ত করতে পারেনি আমাদের জাতীয় দল। আরো কতকিছুই বললেন। ২০২২ সালে বাংলাদেশ বিশ্বকাপে খেলবে বলেছিলেন, ফলাফল? এশিয়ার মধেই আমরা এখন সম্ভবত ৪৩/৪৪ নাম্বার ভালো দল।
আপনার এই এক যুগে নতুন কতজন মানসম্পন্ন খেলোয়াড় তৈরি হয়েছে? পাইপলাইনের কি অবস্থা? সারাদেশে কি ফুটবল ছড়িয়েছে? নিয়মিত খেলা হচ্ছে কি? পেশাদার ফুটবলের চর্চা কি হচ্ছে? ক্লাবের কাছে নতজানুভাব কি কমেছে? দলবদলে অনিয়ম বিদায় হয়েছে? লিগ পেছানো বন্ধ হয়েছে? অ্যাকাডেমি তৈরি হয়েছে? চলছে? পাতানো খেলারই বা কি হিল্লে হলো?
একটু জোয়ারই তো চেয়েছিলাম, প্লাবনতো চাইনি কেউ।
আপনি কি ততখানিই ব্যার্থ সংগঠক এবং প্রশাসক নন, যতখানি খেলোয়াড় হিসেবে সফল ছিলেন?
ক্লাস ওয়ানের যে ছেলেটি বাড়ি থেকে দেড় কিলোমিটার হেঁটে একা আবাহনী মাঠে আপনাদের খেলা দেখতে এবং নিজে খেলতে চলে যেতো প্রতিদিন বিকেলে, সেই ছেলেটির এসব কথার কোন মূল্য আপনার কাছে না থাকলেও তার আবেগের মূল্যটা অন্তত থাকা উচিত।
ফুটবল ছিল একটা উন্মাদনা, একটা ধর্ম, একটা পরিচয়। আজকে বাংলাদেশের ফুটবলের খোঁজ রাখে কয়জন?
আপনি এখনো আমার হিরো। কিন্তু বাফুফের সভাপতি হিসেবে এটাই যেনো আপনার শেষ টার্ম হয়।
ধন্যবাদ।
ভালো থাকবেন।
আমি
(বাংলাদেশের ফুটবলের দৈন্যদশায় মানসিকভাবে গুরুতর আহত একজন ফুটবল প্রেমী)
২০২০
সংশোধনীঃঃ
স্মৃতনির্ভর এই লেখাটতে একটি তথ্যগত ভুল আছে। সালাউদ্দিন শেষ ম্যাচে মোহামেডানের হয়ে খেলেননি। আমার মনে হচ্ছিলো তিনি কিছুক্ষণের জন্য দল বদলেছিলেন ভালবাসার প্রকাশের জন্য।