মেইল করবার পর ওকে মেসেন্জারে এড করলাম। কৃষক দেশের বাইরে থাকে , তাই একটা সময় দিয়ে বলল এই সময় অনলাইনে এসো কথা হবে। আমি বেশ একটা উত্তেজনা অনুভব করছি ১৬ বছর পর কথা হবে, হোক না,মেসেন্জারে। ঠিক সময় মত সব কিছু গুছিয়ে পিসি ছেড়ে বসলাম। কত যে কথা। সব আমিই বলি। শুধু প্রশ্ন করি আর সে উত্তর দেয়। বিয়ে করেছে কিনা জানতে চাই, বাচ্চাদের কথা জানতে চাই। বউ বাচ্চার ছবিও দেখা হয়। ভারী মিষ্টি একটা বউ তার, (ইয়ে মানে আমার চেয়ে সুন্দরী না)।
একটা পর্বে ব্লগার বরুণাকে বলেছিলাম কৃষকের চুল সব কাশফুলের মত সাদা। ওটাও মেসেন্জারে জেনেছি। কৃষকের বর্তমান সময়ের ছবিও আমি দেখিনি।ওর সব ভাই, কাজিনদের খবর নিলাম। পিচ্চি পিচ্চি কাজিনগুলো সব নাকি এখন বিয়ে করে সংসার করছে!!!! সে ও আমার ভাই বোন এমনকি বাড়ীর পিচ্চিগুলার নাম ধরে ধরে খবর নিল। আমি অবাক হয়ে বলি, সবার নাম তোমার মনে আছে!
ফেসবুকের প্রোফাইলে তার যে জন্মতারিখ দেয়া আছে, সেটা নিয়ে জিজ্ঞেস করলাম, তোমার জন্মতো আগষ্ট না তাহলে আগষ্ট লিখেছ কেন? ওপাশ থেকে বলে...জাননা কেন?...আমি সত্যি জানিনাা...মানে ভুলে গেছি।
ক্যাম্পাসের একথা সেকথা বলছিল, অনেকদিন আগের ঘটনা আমি অনেক কিছু ভুলে গেছি....অবাক হই। বলি তোমার মনে আছে? সে বলে আমার সব মনে আছে কিষাণী, সব! কেন জানো? কারন আমাকে তুমি ছেড়ে গেছ আমি তো তোমাকে ছাড়িনি, তাই আমি কিছু ভুলিনি। কেমন লাগে!!!!!! মন খারাপ করে থাকি কিছুন তারপর বলি কৃষক গত ১৩ বছরে আমার জীবনে অনেক ঝড় বয়ে গেছে, ওসব স্মৃতি তাই আমার মনে নেই। তারপর ব্লগের লিংকগুলো দিল বলল পরে পড়বা, যাতে বোঝা যায় সে কিছু ভোলেনি।
আমার ফেলে আসা সংসার নিয়ে কথা হয়....কৃষক বলে মনে আছে আমি অভিশাপ দিয়েছিলাম..........ওর মনে হয়তো একটা কাঁটা খঁচখচ করে.... তাই আমি বলি তুমি এটা নিয়ে একদম গ্লানি বোধ করবে না। যা হবার ছিল তা হয়েছে...এখানে অভিশাপ এর কিছু নাই।
দুজন কথা বলছি, কৃষক একটু পর পর বলে কত বছর পর তোমার সাথে কথা তাইনা?
আমার মাথায় দুষ্ট বুদ্ধি চাপলো, আমি জিজ্ঞেস করলাম........আচ্ছা আজকে যদি তোমার সাথে আমার দেখা হত কোন কফিশপে বা অন্য কোথাও.....তোমার কি অনুভূতি হত? তোমার কি আমার হাতটা ধরতে ইচ্ছা করতো? আমাকে চুমু খেতে ইচ্ছা করতো?
ওপাশে খানিন নীরবতা। বেশ বেকায়দায় ফেলে দিলাম মনে হয়। আমি এপাশে হাসছি।
উত্তর এল...না, তারপর বলল মনে হয় না।
আমি বললাম এটাই স্বাভাবিক। ও বলল কেন?
বললাম তুমি এখন একজনের স্বামী, একটা মানুষ দুজনকে একসাথে ভালোবাসতে পারে না, তাই তোমার আমার হাত ধরতে ইচ্ছা করবে না।
আমি বলি আমারউপর তোমার অনেক রাগ? বলে ....আগে ছিল, এখন নাই। ...এখন নাই কেন?....নাই কেমন করে যেন রাগ চলে গেছে। বলি.... কেন এখন আমি একা এজন্য এত মায়া?....বলে না না তা হবে কেন....এটার সাথে ওটার কোন সম্পর্ক নাই। রাগ আরো আগেই চলে গেছে।
থেকে থেকে কৃষক বলে....জীবনটা এমন নাও হতে পারতো।আবার হয়তো খানিক পর বলে সব দোষই তো ছিল আমার, আর সুস্থ হতেও অনেক সময় লেগেছিল প্রায় ৩ বছর, তুমি আর কি করবা। আবার বলে তুমি তো আমাকে ছেড়ে চলে গেলা, একবার সুযোগ ও দিলা না।
আমি বলি তুমি আমার কাছে কেন সত্য বলতা না, আমার চেয়ে আপন ক্যাম্পাসে তোমার আর কে ছিল? ও বলে তোমাকে হারানোর ভয়ে বলতাম না। তুমি বলেছিলা ওটা খেলে যেন তোমার কাছে আর না আসি। অথচ না খেয়ে তো পারতাম না। আমি বলি এটা আমাকে কেন বল নাই, কেন বন্ধুর মত অকপট হওনি কৃষক? তোমার অনেক ভার আমি কাঁধে তুলে নিয়েছিলাম, এটুকু নির্ভর কেন আমার উপর করনি? কৃষক বলল....তুমি তো বন্ধু হতে চাওনি কিষাণী....তুমি সাধারন কোন নারীর মত বলেছিলা... ওটা খেলে যেন তোমার কাছে আর না আসি!!!!!!! হা কপাল, আমি যা বললাম তাই তোমার কাছে বড় হল। কখন তোমার বন্ধু আমি ছিলাম না, আর আমি তো নারীই, অতি সাধারন বাঙ্গালী নারী............আমার কাছে আর কি অসাধারনত্ব তুমি চেযেছিলে আমি জানিনা।
আরেক বার বলি সুস্থ যখন হলে তুমি তো জানতে আমি কোথায় আছি, তখন কেন এলেনা আমার সামনে? পাল্টা প্রশ্ন করলো ..আসলে কি হত? আমাকে গ্রহন করতা?...থমকে যাই আমি....একটু ভাবি...তারপর বলি...আমি জানিনা তখন গ্রহন করতাম কিনা, তবে জানতাম তো ভালো আছো...এখন এই যে স্বাভাবিক হয়ে কথা বলছি সেটা সেই অতটা বছর আগেই বলতাম.... আর যদি তখনো বিয়ে না হয়ে থাকতো, হয়তো বিয়েও করতাম..........আবেগ জড়িয়ে ধরে আমাদের ...বলি, ভালোবেসেছিলাম তোমাকে কৃষক... অনেক অনেক ভালোবেসেছিলাম....তুমি জানো সেটা। তারপর আবার স্বভাবিক হয়ে বলি....থাক, হয়তো বা যদি নিয়ে কথা বলে কি হবে। এখনকার কথা বল...। বলি বাদ দাও...সাথে সাথে উত্তর আসে বাদ দিলাম।
আবার বলি, তোমার সাথে সারারাত আমার পূর্ণিমা দেখার কথা ছিল, ..বলল মনে আছে, আমি কিছুই ভুলি নাই। আমি বললাম আজো আমার পূর্ণিমা দেখা হয়ে ওঠেনি....বুঝতে পারি ওপাশে মন খারপ হল। বলি ..জানো বিয়ের পর স্বামীকে বলেছিলাম আমার এই শখটার কথা...শুনে আমার দিকে এমন করে তাকিয়েছিল...আমি বুঝে গেছিলাম এ জাতীয় কথা এখন আর বলা চলবেনা। আবার ওর মন খারাপ হল বুঝতে পারি... আবার টপিক চেইন্জ। এই কথাটা বলার সময়ও আমার চোখ ভরে এসেছিল।
জিজ্ঞেস করেছিলাম ক্যাস্পাস ছেড়ে চলে গেলে কেন? পড়াটা শেষ করলে না। আমার ওপর জেদ করেও তো পড়াটা শেষ করতে পারতা। ও বলল... সবাই বলেছিল প্রাইভেট ভার্সিটিতে পড়তে....আমি পড়িনি। কেন?...আমার একটা রাগ হয়েছিল...সাফল্যের প্রতি কোন মোহ ছিল না।.....আবার একসময় বলল..আমার মনে হত পাপ করেছি কিষাণী, আমার শাস্তি হওয়া দরকার,তাই ভাল কোন সাবজেক্ট নিয়ে পড়িনি,এখন যে কষ্টটা করবো তাই হবে পাপের শাস্তি। আমি শুনে আঁতকে উঠি...এসব কি বল, পাপ কেন হবে,তুমি ভুল করেছিলে,ভুল আর পাপ এক কথা হল? যে ভুল করেছিলা তার জন্য এমনি কত কষ্ট পেয়েছ, ডিগ্রি হল না, আমিও চলে গেলাম,আর কত শাস্তি হবে তোমার। আমার বুক ভেঙ্গে যায়। এই ছেলেটা এত আত্মনীপীড়ণ করতে পারে!!!!!! অসহ্য!!! তারপর বলি...তাতে কি, এখন তোমার সোনার সংসার, এখন তো ভাল আছ। বলে হ্যাঁ, এখন ভালো আছি।
আবার বলল....শেষ যেদিন তোমার পথ আগলে দাঁিড়য়েছিলাম, তোমার চোখে আমার জন্য কোন ভালবাসা দেখতে পাইনি কিষাণী, শুধু ঘৃনা ছিল, তাই আর তোমাকে খুঁিজনি। আমি বলি আমি তোমাকে ঘৃণা করবো? তোমাকে? আমি তোমাকে ভালবাসতাম!!!!! ছায়ার মত তোমার পাশে ছিলাম। বলল আমার তখন এমনই মনে হয়েছে, এবং সেটা ভুল ছিল না।
আবার বলছে ....কতদিন পর কথা বলছি, একদম সিনেমার মত!!!! আমি বললাম, না না মৈত্রয়ী দেবীর "ন হণ্যতে" র মত। অনেক অনেক বছর আমরা পুরোনো দিনের কথা ভাবছি!!! কৃষক যখন বলে আমার শুধু একটা কথাই মনে হয়, এমন তো না ও হতে পারতো, তখন খুব খারাপ লাগে কিষাণী, মানতে পারি না। কিংবা যখন বলে...তুমি সেজেগুজে ঘুরে বেড়াতা, আমাকে দেখানোর জন্য, চারদিকে তোমার স্মৃতি, আমি আর থাকতেই পারলাম না ওখানে। তখন আমি পিসির সামনে বসে ঝরঝর করে কাঁদি তারপরও বলি বাহ, তোমার একারই শুধু কষ্ট হত, আমার হয়নি, আমি কেমন করে ছিলাম???? ও বলে আমি পারিনা কিষাণী, তুমি ছেড়ে গেছ আমি তো যাইনি, তোমার বলয় ছেড়ে বের হতে আমার অনেক সময় লেগেছিল।
তখন আমি আবার দুষ্টুমি জুড়ি, বিয়ে কিভাবে হল, প্রেম করে? বলে ন্যাড়া একবার বেলতলায় যায়, আমি গেছি দুবার। শুনে হাসতে হাসতে আমি খুন। বলি যাই বল তোমার নারী ভাগ্য ভাল...সুন্দরী মেয়েরা তোমার প্রেমে পড়ে!! ও বলে ওরে কি বলে রে!!!
এরপর যেদিন কথা হল জিজ্ঞেস করলাম আমার সাথে কথা বলে তোমার কেমন লাগলো? উত্তর টা না দিয়ে পাল্টা প্রশ্ন করলো তোমার কেমন লাগলো।...বেশ চালাক হয়ে গেছে কৃষক, ঘুরিয়ে কথা বলতে শিখেছে। আমি বললাম কখনো খুব ভালো লেগেছে, কখনো আমি বুকের মধ্যে কষ্টের তীব্র ব্যথা টের পেয়েছি, কখনো ঝরঝর করে কেঁদেছি ........এমনি অনুভূতি ছিল আমার। এবার বলল... আমাদের সব কিছু তো একই রকম ছিল....এখন তো আলাদা অনুভূতি হবার কোন কারন নাই!!!!!!! ফাঁকিবাজ, এখানেও ফাকি দিল।
এরপর ব্লগে লেখা এই পর্বের লেখা গুলো পড়লাম, পড়তে পড়তে আবার স্মৃতির মাঝে হারিয়ে গেলাম....কৃষক আমাকে নিক আর পাসওয়ার্ড দিয়ে দিল বলল তুমি ও লেখ। সে থেকে কিষাণীর আগমন। কিছুদিন পর আমি বলতাম এ কিসের মধ্যে ফেলে দিলা.... এ পর্ব আমি কেমন করে শেষ করবো?....সে বলতো কৃষকের ব্লগ আমি তোমাকে দিয়া দিলাম, তুমি যেভাবে খুশি শেষ কর। কিছুদিন লেখার পর আর এগুতে পারিনা। তারপর লেখা বন্ধ ছিল। মনে হল শেষ করি, সবাই ভাবে আমরা সত্যিকার কৃষক-কিষাণী....এ খেলা সাঙ্গ করি। ঝড় তোলা সেই দিনগুলির মুখোমুখি হওয়া যে এখনো কত কঠিন!.........কতবার লিখতে লিখতে চোখ ঝাপসা হয়েছে.....।
এখনো আমাদের মেসেন্জারে কথা হয়..... হয়তো দেশে ফিরলে সময় সুযোগ হলে দেখা হবে....না হলেও তি নেই। সেই দিনগুলি মনের মাঝে আছে সেই ভালো..... । কৃষকের বাকী জীবনটা সুখে কাটুক...।
আমাদের দুজনের মধ্যে এখন যে সম্পর্ক....এটা না প্রেম...... না ভালোবাসা,.... এটা একটা মায়া। তবে বন্ধুত্ব হয়তো আছে। একটা গান শুনেছিলাম উড়ে যায় বকপক্ষী; পড়ে থাকে মায়া.........এমন কিছু একটা। তাই ভালোবাসা, কামনা সব ধুয়ে গেছে, রয়ে গেছে মায়া। সময় এক অদ্ভুদ জিনিস...অনেক কঠিন ব্যাপারকে সহজ করে দেয়। সব কথা অবলীলায় তার সাথে এখন শেয়ার করি।কৃষক কোন ইন্টারফেয়ার করে না, চুপচাপ নিরবে,অনেকটা নিরাসক্ত হয়ে শোনে। কখনো উপদেশ দেয়। মতের মিল না হলে আমি যখন তর্ক করি, যুক্তি দেখাই, তখন বলে তোমাকে তো কিছু বলে লাভ নাই, সব কিছুর মধ্যে একটা যুক্তি দাঁড় করিয়ে দিবা, তোমাকে তো আমি চিনি!!! এই মায়ময় সম্পর্কটা হয়তো থাকবে.......দ্বি পাকি আগ্রহের উপর ভিত্তি করে। ভাল আছে, সুখে আছে, এটা জানাতেই সুখ, পরম শান্তি।
এই সিনেমার আরো নাটকীয় কোন মোড় হতে পারে ------আগামী ২০ বছর পর কৃষকের ছেলে আমার মেয়ের পেছনে ঘুরঘুর করছে, পটিয়ে ফেলেছে, তখন আমি ওর ছেলের ঠ্যাং ভেঙ্গে দিব বলে হুমকি দিচ্ছি। আর কৃষকের বউ বলছে...এই মেয়েটার মা আমার স্বামীর মাথা খেয়েছে আর মেয়েটাও হয়েছে তেমনি, এখন আমার সোনার ছেলেটার মাথা খাচ্ছে!!!!!!!!!! হাহাহাহা।
সমাপ্তি
সর্বশেষ এডিট : ২৯ শে জুলাই, ২০০৯ রাত ১:৫৭

অনুগ্রহ করে অপেক্ষা করুন। ছবি আটো ইন্সার্ট হবে।




