somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

সুলতানের কৃষক [২]

১০ ই আগস্ট, ২০০৭ দুপুর ২:১৬
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

সুলতানের চিত্রে কৃষকদের আমরা দলবদ্ধ দেখতে পাই। একসঙ্গে তারা জমি চাষে যায়, আবার ফিরে আসে। ফসল কাটে একসঙ্গে, যূথবদ্ধ হয়ে অবসর কাটায়। জীবন তাদের সমষ্টিগত। ঔপনিবেশিক পুঁজিতন্ত্রে কৃষকের মধ্যকার বিচ্ছিন্নতাবোধ এভাবে তিনি নিশ্চিহ্ন করতে চান। সুলতান সমবায়ে বিশ্বাসী ছিলেন। তিনি সমবায় পদ্ধতির পক্ষে ছিলেন। সমসাময়িক এনজিও ধারণার বিপরীতে আমাদের সমাজে চলে আসা সমবায় পদ্ধতি ছিল অধিকতর কৃষকবান্ধব। এ সমবায় চেতনার স্বরূপটি সুলতানের চিত্রকলায় আমরা লক্ষ্য করি। আগে কৃষকরা সমবায় প্রথার আওতায় একে অন্যের সহায়তায় লাগত। সুলতানের একটি ছবি আছে ‘গাঁতায় কৃষক’, ১৯৭৫ খ্রিস্টাব্দে আঁকা এ চিত্রে সুলতানের সমবায় ধারণার আগ্রহ প্রতিফলিত হয়েছে। একজন কৃষকের দুটো ক্ষেত আছে, সেটা সে একা পেরে উঠছে না; তখন সে তার অন্যান্য কৃষক বন্ধুকে নিয়ে একত্রে কাজ করে এবং পর্যায়ক্রমে তারা সবার কাজ করে। এভাবে সমবায় প্রথার উৎপত্তি। একে বলে গাঁতায় চাষ করা। ভুঁই নিড়ানো হোক, জমি চাষ বা ধান কাটা হোকÑ সব একসঙ্গে করা। এই প্রথাটা আদিম। অভিজ্ঞতা ও অনুশীলনে উত্তীর্ণ। সুলতান এ প্রথাটা পছন্দ করতেন। কেননা এর মাধ্যমে জীবনের সঙ্গে জীবনের যোগ বড় নিবিড়। তাই সুলতানের ছবিতে এত ফিগর এক সঙ্গে দেখা যায়।
সুলতান এভাবে কৃষকের মধ্যকার ঔপনিবেশিক পুঁজিতন্ত্রের বিচ্ছিন্নতাবোধ কাটিয়ে উঠতে চান এবং পদ্ধতিটা বেছে নেন নিজস্ব ইতিহাস থেকে। তাই সুলতানের চিত্রাবলির অতীতচারী মনোভঙ্গি, পেছনে ফিরে-যাওয়া প্রকাশ করে না, বরং ভবিষ্যতে এগিয়ে যাওয়ার শুদ্ধ পথ বাতলে দেয়। নিজস্ব প্রগতির অবয়বটি যেমন তুলে ধরে, তেমনি নিজস্ব অর্জনের নির্যাসটুকু।
সামন্ততান্ত্রিক সমাজব্যবস্থায় জমিদার ও কৃষকের পারস্পরিক শ্রেণীসম্পর্কের ইতিহাস শুধু প্রভুত্বের অধিকারী জমিদারই রচনা করে না, কৃষকও এই ইতিহাসের কর্তা। এখানে কৃষকেরও নিজস্ব একটি রাজনৈতিক পরিসর আছে, যা স্বতন্ত্র এবং সম্পূর্ণ স্বকীয়। এই স্বতন্ত্র রাজনৈতিক পরিসর নির্দিষ্ট হয়ে রয়েছে তার চেতনায়। সেখানে তার নির্দিষ্ট নৈতিক এবং রাজনৈতিক ধ্যান-ধারণা বিন্যস্ত হয়ে রয়েছে একান্তই স্বতন্ত্র এক কাঠামোর ভিতর। কৃষকচেতনার এ স্বকীয় রূপ নিজস্ব স্বাতন্ত্র্যেই বিবেচনা করতে হবে। এভাবে বিবেচনা না করলে কৃষকের দাসত্বের অবয়বটিই একমাত্র বিবেচ্য হিসেবে চিহ্নিত হবে। সুলতান কৃষকের স্বকীয় এ রূপটিকে চিহ্নিত করেছেন, উচ্চকিত করেছেন। ঔপনিবেশিক ব্যবস্থায় কৃষক যা বিস্মৃত হয়েছিল।
কৃষকের এ স্বকীয় রূপটি বজায় ছিল, কারণ প্রবলতম সামন্ততান্ত্রিক শাসনেও প্রভুত্ব সর্বগ্রাসী ছিল না। এমন যদি হতো, তাহলে সামাজিক উৎপাদক-গোষ্ঠী হিসেবে কৃষকের স্বতন্ত্র কোনো অস্তিত্বই থাকত না, পরিপূর্ণ দাসত্বের মধ্যে কৃষক সম্পূর্ণ বিলীন হয়ে যেত। বাস্তবে তা হয়নি, অতএব ধরে নিতে হবে যে প্রভুত্ব-দাসত্বের সম্পর্ক দুটি স্বতন্ত্র পরস্পর-বিরোধী শ্রেণীর মধ্যে একটা দ্বান্দ্বিক সম্পর্ক বজায় ছিল। এ সম্পর্কের একদিকে যেমন ছিল জমিদারের আধিপত্য বিস্তারের চেষ্টা, ঠিক তেমনি বিপরীতক্রমে ছিল কৃষকের প্রতিরোধ। আধিপত্য আর প্রতিরোধ, এই দুই দ্বান্দ্বিক সংঘাতের মধ্য দিয়েই সামন্ততন্ত্রের ইতিহাস এগিয়েছে।
তাই অবশ্যম্ভাবী বিবর্তনের ধারায়, সংগ্রামের পথ ধরে পরবর্তীকালে সংখ্যাগরিষ্ঠ কৃষকের স্বরাজ প্রতিষ্ঠার একটি স্বাভাবিক সম্ভাবনা ছিল। কিন্তু ইতিহাসের অকস্মাৎ পালাবদল ঘটল। শাসনদ- দখল করল বেনিয়া ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শক্তি, উপনিবেশবাদ ও সাম্রাজ্যবাদের ছায়ায় লালিত পুঁজিবাদ কৃষকের অগ্রঅভিযান রুদ্ধ করল। তাকে বিভক্ত করল, বিখ-িত করল। নিস্তেজ করতে সক্রিয় হলো দ্রোহী যূথবদ্ধতা। কৃষক ভুলে গেল নিজেকেই, বিস্তৃত হলো আপন স্বরূপ। বিস্তৃত হয়ে পুঁজিবাদের দাসে পরিণত হলো, সেখানে সে শেকড়চ্যুত, বিচ্ছিন্ন। পণ্য উৎপাদনের প্রান্তিক একক।
তবু সুলতান ছিলেন আশাবাদী। এ আশার স্থিতি পেয়েছিলেন বাঙালির নৃতত্ত্ব, ইতিহাস ও সংস্কৃতির গভীর পাঠের মাধ্যমে। তিনি ইতিহাস পরম্পরায় কৃষকের দ্রোহী সত্তাকে উসকে দিতে চেয়েছিলেন। তার কাছে কৃষক কখনো পারিপার্শ্বিক রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক অবস্থায় বশীভূত অসহায় জড়পদার্থ নয়। ঐতিহাসিক প্রক্রিয়ার মধ্যে কৃষক শ্রম নিয়োগ করে সামাজিক উৎপাদনে অংশ নেয়। সবসময়ই কৃষকের মধ্যে প্রতিরোধের স্বভাব ছিল। কৃষকও ঐতিহাসিক কর্তার ভূমিকা পালন করেছে। প্রভুত্ব আর দাসত্ব, আধিপত্য আর প্রতিরোধÑ এ দুই বিপরীত ক্রিয়ার দ্বান্দ্বিক ঐক্যের মাধ্যমে সামন্ততন্ত্রের ইতিহাস সম্পন্ন হয়েছে। ঔপনিবেশিক তন্ত্রে কৃষকের সে তেজ কমেছে, হয়েছে নিস্পৃহ, তবে কৃষক দমে যায়নি। যদিও পুঁজিবাদের অনিবার্য নিয়মে হারিয়েছে তার দলবদ্ধতা, যূথবদ্ধ চরিত্র। পুঁজিবাদের এ কৌশলে কৃষকবিপ্লব সহজসাধ্য নয়, সুলতান তা ভালোভাবেই উপলব্ধি করেছেন। তাই সুলতান হয়েছেন অতীতচারী, কৃষকের আন্তর-শক্তির সুলুকসন্ধানী।
সুলতানের একটি অসাধারণ ছবির কথা আমরা জানতে পারি। আমরা অনেকেই ছবিটি দেখিনি, কোথায় আছে তাও জানি না। ছবিটির চিত্রভাষ্য এ রকম : ‘বিশাল একটি বটবৃক্ষ। সেই বৃক্ষের অসংখ্য ঝুরি নেমে এসেছে। ঝুরিগুলো বৃক্ষের বিশাল ডালপালা থেকে নেমে মাটির রস শোষণ করছে। আর প্রতিটি ঝুরির মধ্যে একটি করে মানুষের মাথা দেখা যাচ্ছে। অর্থাৎ বিশাল বৃক্ষ তার অসংখ্য ঝুরির সাহায্যে অসংখ্য মানুষের রক্তমাংস সবই শোষণ করে দাঁড়িয়ে আছে।’ এই শোষক বটবৃক্ষে তিনি সাম্রাজ্যবাদকে প্রতিকায়িত করেছেন। তিনি যে সাম্রাজ্যবাদী শোষক ধনিক শ্রেণীর প্রতি প্রচ- সচেতন ছিলেন তারই বহিঃপ্রকাশ এ ছবি। এ ছবির মধ্যেই মূর্তমান সুলতানের রাজনৈতিক বিশ্বাস ও প্রজ্ঞা। সুলতান কিন্তু রাজনৈতিকভাবে সচেতন ছিলেন।
রাজনীতির মূল বিষয়গুলো তিনি জানতেন।
তিনি জানতেন কেউই কৃষকের পক্ষে নেই। রাষ্ট্র সবসময় ধনিকের পক্ষে। আর কৃষক-মজুর যুগ যুগ ধরে বঞ্চিত হচ্ছেন, তাদের বঞ্চনার কোনো শেষ নেই। সেই অনাদিকাল থেকে তারা শুধু ঠকেই চলেছেন।
ঐতিহাসিক পরম্পরায় কর্তারূপে কৃষকের বিতর্কিত অবস্থিতি থাকলেও, স্থিতি ছিল না কখনো। দ্বন্দ্বমুখরতা আর অন্তহীন সংগ্রামের মধ্যেই কৃষকের বেড়ে ওঠা। সুলতান এ বেড়ে ওঠার প্রক্রিয়াটিকে মহিমান্বিত করেছেন। কৃষকের দ্রোহকে তিনি শৈল্পিক ভাষা দিয়েছেন। কৃষকের উচ্চতা তিনি আকাশে ঠেকিয়েছেন। পুঁজিবাদের বিচ্ছিন্নতার বিপরীতে কৃষককে করেছেন যূথবদ্ধ। এভাবে আড়মোড়া ভেঙে কৃষকের উত্থান তিনি প্রত্যাশা করেছেন, চেয়েছেন নতুন দিনের নির্মাণ। এ নির্মাণের প্রতিপক্ষ সাম্রাজ্যবাদ। এক্ষেত্রে সুলতান আবার প্রিয় কবি ইকবালের পঙ্ক্তি উচ্চারণ করেন : বুর্জোয়াদের এমন একটা সময় আসবে তখন তার চিহ্ন দেখামাত্র ধ্বংস করে দিও
১টি মন্তব্য ০টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

প্রকৌশলী এবং অসততা

লিখেছেন ফাহমিদা বারী, ০৫ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ রাত ১১:৫৭


যখন নব্বইয়ের দশকে ইঞ্জিনিয়ারিং পড়ার সিদ্ধান্ত নিলাম এবং পছন্দ করলাম পুরকৌশল, তখন পরিচিত অপরিচিত অনেকেই অনেকরকম জ্ঞান দিলেন। জানেন তো, বাঙালির ইঞ্জিনিয়ারিং এবং ডাক্তারিতে পিএইচডি করা আছে। জেনারেল পিএইচডি। সবাই... ...বাকিটুকু পড়ুন

ইউনুসের উচিৎ ভারতকে আক্রমন করা , বিডিআর হত্যাকান্ডের জন্য

লিখেছেন এ আর ১৫, ০৬ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ দুপুর ১২:৩৭


ইউনুসের উচিৎ ভারতকে আক্রমন করা , বিডিআর হত্যাকান্ডের জন্য

পহেল গাঁয়ে পাকিস্থানি মদদে হত্যাকান্ডের জন্য ভারত পাকিস্থানে আক্রমন করে গুড়িয়ে দেয় , আফগানিস্থান তেহেরিক তালেবানদের মদদ দেওয়ার জন্য, পাকিস্থান... ...বাকিটুকু পড়ুন

আমি ভারতকে যাহা দিয়াছি, ভারত উহা সারা জীবন মনে রাখিবে… :) =p~

লিখেছেন নতুন নকিব, ০৬ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ দুপুর ১:১৫

আমি ভারতকে যাহা দিয়াছি, ভারত উহা সারা জীবন মনে রাখিবে… :) =p~

ছবি, এআই জেনারেটেড।

ইহা আর মানিয়া নেওয়া যাইতেছে না। একের পর এক মামলায় তাহাকে সাজা দেওয়া... ...বাকিটুকু পড়ুন

এমন রাজনীতি কে কবে দেখেছে?

লিখেছেন অনিকেত বৈরাগী তূর্য্য , ০৬ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ সন্ধ্যা ৭:২০


জেনজিরা আওয়ামী লীগের ১৬ বছরের শাসনামল দেখেছে। মোটামুটি বীতশ্রদ্ধ তারা। হওয়াটাও স্বাভাবিক। এক দল আর কত? টানা ১৬ বছর এক জিনিস দেখতে কার ভালো লাগে? ভালো জিনিসও একসময় বিরক্ত... ...বাকিটুকু পড়ুন

মুক্তিযুদ্ধের কবিতাঃ আমি বীরাঙ্গনা বলছি

লিখেছেন ইসিয়াক, ০৬ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ রাত ৮:১৫


এখনো রক্তের দাগ লেগে আছে আমার অত্যাচারিত সারা শরীরে।
এখনো চামড়া পোড়া কটু গন্ধের ক্ষতে মাছিরা বসে মাঝে মাঝে।

এখনো চামড়ার বেল্টের বিভৎস কারুকাজ খচিত দাগ
আমার তীব্র কষ্টের দিনগুলোর কথা... ...বাকিটুকু পড়ুন

×