সন্ত্রাসী কার্যক্রমে অর্থায়ন তদন্তে বাংলাদেশ ব্যাংকের ক্ষমতা বাড়ছে। সন্ত্রাসবিরোধী (সংশোধন) বিল, ২০১২ এর মাধ্যমে এই উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। গত মঙ্গলবার বিলটি সংসদে উত্থাপন করেন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী সাহারা খাতুন। বিলটি পাস হলে সন্ত্রাসী কর্মকান্ডে অর্থায়নের সাথে জড়িত সন্দেহে যেকোনো লেনদেন বিশ্লেষণসহ তা সর্বোচ্চ ছয় মাস পর্যন্ত স্থগিত করার ক্ষমতা পাবে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। এছাড়া কেন্দ্রীয় ব্যাংক বাংলাদেশ ফাইন্যান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্ট ইউনিটের চাহিদা অনুয়ায়ী বা কোনো কোনো ক্ষেত্রে স্বপ্রণোদিত হয়ে সন্ত্রাসী অর্থায়ন কর্মকান্ড সংক্রান্ত তথ্য অন্য দেশের ফাইন্যান্সিয়াল ইনটেলিজেন্ট ইউনিটকে সরবরাহ করতে পারবে। তাই সন্ত্রাসবিরোধী আইন, ২০০৯ এর সংশোধনের জন্য এ বিলটি উত্থাপন করা হয়েছে। মন্ত্রী বলেন, সন্ত্রাসী কার্যক্রমের ধরন ও প্রকৃতি পরিবর্তনের কারণে বিশেষ করে সন্ত্রাসী কার্যক্রমে অর্থ যোগানের অপরাধসংক্রান্তে বর্তমান সন্ত্রাসবিরোধী আইনে সুস্পষ্ট বর্ণনা না থাকায় অপরাধ নিরসনে যথেষ্ট নয়।
সময়ের সঙ্গে আইনের সংশোধন হবে, এটা স্বাভাবিক। বরং না হওয়াই বেমানান। তাই উদ্যোগটি নিঃসন্দেহে সময়োপযোগী এবং আর্থিক সন্ত্রাস রোধে সংশ্লিষ্টদের সচেতনতাই প্রকাশ করে। আর বিষয়টিও স্পর্শকাতর। সম্প্রতি লক্ষ্য করা যাচ্ছে স্পর্শকাতর বিষয় নিয়ে সরকার নড়াচড়া করতে স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করছেন। ফলে স্বাভাবিক অনেক কিছু অস্বাভাবিক হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে। সিদ্ধান্ত সমূহ বুমেরাং হয়ে প্রত্যাঘাত করছে। অর্থ ও পুঁজিবাজার নিয়ে ইতিমধ্যে সরকার ও কেন্দ্রীয় ব্যাংকের বেশ কিছু উদ্যোগ বিফলে গেছে। সিদ্ধান্তগুলো সব যে মন্দ ছিল তা নয়, বরং সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নের সময়টি ছিল প্রতিকূল।
বাংলাদেশের অর্থ ও পুঁজিবাজার চাপের মধ্যে আছে। অস্থিরতা ও আস্থাহীনতা উভয় ক্ষেত্রে বিশৃঙ্খলা তৈরি করেছে। চলছে বিশ্বাসের সংকট। তাই এসব ক্ষেত্রে সিদ্ধান্ত নেওয়ার আগে স্পর্শকাতর অর্থনীতির কথা ভাবতে হবে। যেকোনো কিছুই এখানে সন্দেহের কারণ হয়, ফলে লজ্জাবতী বৃক্ষের মতো অর্থনীতি নুইয়ে পড়ে। প্রস্তাবিত আইনটির প্রতিক্রিয়ায় এমন কিছু হবে না তার নিশ্চয়তা কোথায়? সম্প্রতি আইএমএফ-এর ঋণপ্রাপ্তির নিশ্চিত করতে আর্থিক খাতে যেসব সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে, আখেরে তা অর্থনীতিবান্ধব হয়নি। তাই নতুন আইনটি মনের দোলাচলা থেকেই যায়।
যেকোনো আইনের বাস্তবায়নে প্রায়োগিক দিকটি গুরুত্বপূর্ণ। এক্ষেত্রে প্রশ্ন আসে, আইনটি কে প্রয়োগ করবে? প্রস্তাবিত আইনটি যেহেতু আর্থিক সন্ত্রাস রোধে প্রণীত, তাই বিষয়টি আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর আওতায় থাকাই শ্রেয়। কিন্তু দেখা যাচ্ছে, এক্ষেত্রে কেন্দ্রীয় ব্যাংককে জড়িয়ে ফেলা হয়েছে। এটা কি কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কাজ? কেন্দ্রীয় ব্যাংককে বলা হয়, ব্যাংকসমূহের ব্যাংক। তার এর রয়েছে বিশাল পেশাদার ক্ষেত্র, সেটাই সূচারুরূপে সম্পন্ন করাই এখন সময়ে দাবি। পুলিশিংয়ে কেন্দ্রীয় ব্যাংককে মানায় না। এতে আদতে মূল কাজই ব্যহত হবে। অন্যদিকে আইন প্রয়োগকারী সংস্থা কর্তৃক ব্যাংকের দলিল বা নথিতে অবাধ প্রবেশাধিকার আমানতকারীদের শঙ্কার কারণ হতে পারে। কারণ অনেকেই ব্যাংকিং গোপনীয়তায় স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করে আসছে। এক্ষেত্রে যদি আমানতকারীরা ব্যাংকের প্রতি বিরূপ হয়ে পড়ে তবে তারুল্য সংকট বেড়েই চলবে।
এই আইন কার্যকর হওয়ার পর ব্যাংকের আমানত সঞ্চয়নে ধস নামবে কীনা তা ভেবে দেখা যেতে পারে। অনেক অর্থনীতিবিদরা বলছেন বাংলাদেশের অপ্রদর্শিত ও আয়কর বহির্ভূত অর্থের পরিমান প্রায় বাংলাদেশের জিডিপি’র সমান। যদি তাই হয়, নয়া আইনে ওসব টাকা ব্যাংকমুখী না-হওয়ার শঙ্কা থেকে যায়। এতে করে একদিকে যেমন মূল্যস্ফীািত বেড়েই চলবে, অন্যদিকে ব্যাংকগুলো তারল্য হারাবে। তাই নতুন আইন যাতে ব্যাংকিং খাতে ভীতি ছড়াতে না পারেÑ সেদিকে লক্ষ্য রাখতে হবে। আর্থিক মন্দা সত্ত্বেও, এখনো ব্যাংকগুলো মন্দের ভালো অবস্থায় আছে। কেন্দ্রীয় ব্যাংক এমনিতেই ব্যাংকগুলোর ওপর নানা বিধি ও নজরদারি করে চলছে, এখন যদি নতুন উপদ্রব শুরু হয়Ñ তাহলে ব্যাংকগুলোর ভিত নড়বড়ে হয়ে যেতে পারে। পরিস্থিতি ভয়াবহ হলে বেইল আউটের সম্ভাবনাও উড়িয়ে দেয়া যায় না। সরকার কি তেমন পরিস্থিতি মোকাবেলায় এখন প্রস্তুত?
বাংলাদেশের বিদ্যমান আর্থনীতিক পরিস্থিতিতে যেকোনো সিদ্ধান্তই দূরদর্শিতার সঙ্গে নিতে হবে। আর্থিক খাতে সন্ত্রাস কিছুতেই সমর্থনযোগ্য নয়। তবে আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীকেই করতে হবে সন্ত্রাস দমনের কাজটি। বাংলাদেশের আর্থনীতিক মেরুদন্ড শক্ত করতে কেন্দ্রীয় ব্যাংককে বিপুল ক্ষমতা দেয়া আছে, ব্যাংকের সেদিকেই মনোযোগী হওয়া সময়ের প্রয়োজন। আর বাংলাদেশের আইন বাংলাদেশের প্রেক্ষিতে হওয়াই জরুরি। বিষয়টি সংশ্লিষ্টরা বিবেচনা করবেন।

অনুগ্রহ করে অপেক্ষা করুন। ছবি আটো ইন্সার্ট হবে।


