লেখকের দৌড় কতদূর? মুক্তচিন্তার সীমা কতটুকু? কোনো সুনির্দিষ্ট সংজ্ঞা নেই। আইনি বিবেচনায়ও কোনো স্থির সংজ্ঞা নেই। অবশ্য বিধি-নিষেধ কিছু রয়েছে। তাই এ নিয়ে যত মামলা হয়েছে সেগুলোর রায়ের ব্যাপারে বিচারকের বিবেকের ওপর অধিক নির্ভর করতে হয়েছে। আমরা বিখ্যাত লেডি চ্যাটার্লিজ লাভার, ফ্যানি হিল কিংবা টপিক অব ক্যানসারের মামলার কথা জানি। এগুলো মূলত ছিল শ্লীল-অশ্লীলতার প্রশ্নে। প্রথম মামলাটি চিন্তার ক্ষেত্রে যেমন বড় ধাক্কা দেয়, তেমনি নতুন ভাবনার পথ খুলে দেয়। যুগে যুগে মুক্তচিন্তা নিয়ে ঝামেলা হয়েছে অথচ কোনো যুগই সেই অর্থে মুক্তচিন্তার পরিসর মেপে দেয়নি।
দেশ-বিদেশে লেখা নিয়ে প্রচুর মামলা হয়েছে দেওয়ানি ও ফৌজদারি বিধিতে। কপিরাইট, পাইরেট, রাষ্ট্রদ্রোহিতা, অশ্লীলতা, উত্তেজক লেখা নিয়ে ভূরি ভূরি মামলার নজির রয়েছে। সব মামলা যেমন উদ্দেশ্যপ্রণোদিত ছিল না, তেমনি সব লেখাও উদ্দেশ্যপ্রণোদিত নয়। আমাদের দেশে ছাপাখানার শ্রীবৃদ্ধি ঘটে ব্রিটিশ জমানায়। প্রথমে যন্ত্রটি এসেছিল পর্তুগিজ মিশনারিদের হাত ধরে। উদ্দেশ্য দেশীয় ভাষায় পুস্তক রচনা করে খ্রিস্টধর্মের বাণী প্রচার। কালক্রমে ছাপাযন্ত্রটি ভারতীয় উপমহাদেশে চিন্তা ও মননে বিপুল পরিবর্তন বয়ে আনে। অগুনতি সংবাদপত্র, ম্যাগাজিন, সাহিত্য পত্রিকা প্রকাশিত হতে থাকে। সৃজনচর্চার ব্যাপ্তি বাড়ে। তবে নন্দনচর্চার পাশাপাশি নিন্দাচর্চার কমতি ছিল না। উনিশ শতকে ‘রুচিবিকার’ নামে এক কবিতা নিয়ে হয় মামলা। তখন সনাতনপন্থী আর ব্রাহ্মসমাজ ছিল যথাক্রমে অনাধুনিক ও আধুনিকতার প্রতীক। ব্রাহ্মসমাজে কুসুম কুমারীর জনপ্রিয়তা ছিল। তার মেলামেশা ছিল অবাধ। জনশ্রæতি ছিল উপেন্দ্রলাল মজুমদারের সঙ্গে মেয়েটির প্রণয় ছিল। হেরম্বচন্দ্র মিত্রের সঙ্গে বিবাহের পরও পূর্বসম্পর্ক অটুট রয়েছেÑ এটা ছিল সনাতনী হিন্দুদের মুখরোচক আলোচনার বিষয়। ঠিক এমনি সময় হিতবাদী পত্রিকায় ১৮৯৬ সালের ২৪ জুলাই ‘রুচিবিকার’ প্রকাশিত হয়Ñ
শুনিবে না শুনিবে না মধুপ ঝঙ্কার/কুসুুমে কুরুচি মাখাÑ/ভ্রমরে লুকায়ে রাখা... কুসুমের কোমলতা মাধুরী অপার/ কিন্তু তার পবিত্রতা/ শুধু কল্পনার কথা...।
ব্রাহ্মসমাজ পত্রিকার কর্ণধার বাবু কালীপ্রসন্ন কাব্যবিশারদের বিরুদ্ধে মানহানিকর মামলা ঠুকে দেয়। ইংরেজ বিচারকের বোধগম্যতার জন্য কবিতাটি ইংরেজিতে অনুবাদ করা হয়। ভাবার্থ বের করার জন্য ডাকা হয় শ্রেষ্ঠ কবি, সাহিত্যিক, সাংবাদিকদের। অতঃপর জুরিগণের সর্বসম্মত রায়ে আসামি কালীপ্রসন্ন নয় মাসের কারাদÐে দÐিত হন। মামলার পুরো কাহিনীটি জেনে আমার মনে হয়েছে, রায়টি যথার্থ। কেননা লেখাটি ছিল সম্পূর্ণ উদ্দেশ্যপ্রণোদিত। এবারের একটি জাতীয় দৈনিকের নববর্ষ সংখ্যায় হাসনাত আবদুল হাই লিখেছিলেন ‘টিভি ক্যামেরার সামনে মেয়েটি’। গল্পটি নিয়ে মামলা হয়নি; কিন্তু হামলে পড়েছিল অনেকে। এটিকে জনজাগরণ ও নারীর মর্যাদাহানিকর বিবেচনা করা হয়েছে। প্রতিবাদ যে প্রবল ছিল সেটি ওই পত্রিকা ও লেখকের ক্ষমা প্রার্থনার মধ্যেই প্রমাণ। পাশাপাশি মুক্তচিন্তা ও লেখকের স্বাধীনতার প্রশ্নটিও উচ্চকিত হয়। নিজস্ব বোধতাড়িত রেখা যদি কোনো ব্যক্তি কিংবা গোষ্ঠীর বিরুদ্ধে যায়, সেটি কি নিছক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত হিসেবে দেখলেই চলবে?
কয়েক বছর আগে একজন আমলা (সচিব) একটি কবিতা লিখে ওএসডি হন। পরবর্তী হেনস্তার কথা আমরা জানি না। হুমায়ূন আহমেদের উপন্যাস ‘দেয়াল’ প্রকাশের আগে আদালত কর্তৃক সংশোধনের নির্দেশপ্রাপ্ত হয়। এ ছাড়া বিভিন্ন সময় টকশো ও কলাম লেখার কারণে অনেককেই আদালতের কাঠগড়ায় দাঁড়াতে হয়েছে। এগুলো তো ইঙ্গিত। আল মাহমুদ যখন লেসবিয়ানদের নিয়ে ‘পুরুষসুন্দর’ লেখেন তখন আমার সেটি অশ্লীল মনে হয়েছিল। কিন্তু একসময় আবিষ্কার করলাম সমাজের অতলে চলছে সম্পর্কের ক্ষয়। এ সমাজে সমকামিতার সংখ্যা নেহাত কম নয়। আশপাশেই আছে। তাদের নিয়ে আমি লিখলাম ‘চন্দ্রবালক’ উপন্যাস। লেখাটি উদার মননের কয়েকজন সম্পাদক লুফে নিলেন; কিন্তু ছাপাতে পারলেন না। কারণ সময়টা নাকি খারাপ! আমরা কবে সেই সমাজ পাব যেখানে যুক্তিটাই বড়, বাস্তবতাই সত্য।
ফকরুল চৌধুরী
১৮/০৪/১৩

অনুগ্রহ করে অপেক্ষা করুন। ছবি আটো ইন্সার্ট হবে।


