somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

জীবনবোধ

১৫ ই অক্টোবর, ২০১৬ রাত ২:৫৪
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

এক
দুপুরের খাঁ খাঁ রোদ , মাত্রই স্কুল ছুটি হলো । স্কুল থেকে নুহাস বাড়ি ফিরছে , বাড়ি ফেরার পথে পুকুরে ওর বয়সী ছেলেপিলেদের দাপাদাপি দেখে অবাক চোখে তাকিয়ে থাকে ।
-আহ , কতই না মজা করছে এরা । কিন্তু মা কেন যে সব সময় কলের পানিতেই গোসল করতে বলে। আচ্ছা, ওদের যদি গিয়ে বলি , আমাকে কি ওরা একটু নাইতে দেবে ? আচ্ছা মাছও তো ধরতে পারব বোধ হয় ,বইতে যেমনটি পড়েছি – আমাদের ছোট নদী চলে বাঁকে , বাঁকে ...... বৈশাখ মাসে তার হাটু জল থাকে
সকালে বিকালে কভু নাওয়া হলে পরে, ............ আঁচলে ছাকিয়া তারা ছোট মাছ ধরে //
কিন্তু নদী তো কখনোই দেখলাম না , পুকুর আর নদীতে তাহলে তফাৎটা কি ?
খানিক বাদেই পেছন থেকে নুহাস কে ডেকে উঠে সাব্বির ,
-নুহাস, দাঁড়িয়ে আছিস কেন ? দুপুরে কোচিং আছে তো । আজকে না আবার গ্রামার এক্সাম আছে- যাবি না ? চল।
-আরে দাঁড়া, এক্সাম তো প্রায়ই থাকে, কতই বা মার্কস পাই । আমার কখনোই হায়েস্ট মার্ক পাওয়া হয়ে উঠবে না ।
আচ্ছা সাব্বির , তুই কি কখনো নদী দেখেছিস ?
-হ্যাঁ, আমরা যখন ঈদে বাড়ি যাই লঞ্চেই যাই। তখন দেখি।
-অনেক সুন্দর, নারে ? বাঁকে বাঁকে বয়ে চলে । আমাদের বাড়িই তো এইখানে , আব্বুও কখনো তেমন কোথাও নিয়ে যায়নি।
- আচ্ছা চল এখন । কাল তো ফ্রাইডে , কম্পিউটারে “কল অব ডিউটি” খেলব । আব্বু কালই গেমস এর সিডি-টা এনে দিল ।

সূর্যের কিরণ সামান্য হেলে পড়ে প্রস্ফুটিত করে আছে চারদিক । রাস্তা ধরে বাড়ির পানে হাটতে হাটতে নুহাসের মনে উকি দিয়ে বেড়ায় খালি গায়ে পুকুরে লাফ দেয়ার স্বপ্ন – কি যেন চিন্তে করে জামার দুটো বোতামও খুলেছিল । কিন্তু স্বপ্ন যে স্বপ্নই থেকে গেল।

সন্ধ্যেয় নুহাসের হোম টিউটর রায়হান স্যার এলো । রায়হান স্যারকে নুহাসের খুব ভাল লাগে । তাঁর সহজ-সরল মন্ত্রমুগ্ধ কথা আর কোমল-কঠোর শাসন তাকে সত্যিই বিষ্মিত করে।
-আচ্ছা স্যার ? মানুষ মরে গেলে কি পঁচে যায় ?
-হুম , হঠাৎ এই প্রশ্ন ?
- না মানে আমরা মাটিকে এতো অবহেলা করি তো – তাই বুঝি মাটি আমাদের পঁচিয়ে দেয় ।
- না নুহাস । আসলে মাটিতে কিছু ব্যাকটেরিয়া থাকে , যা প্রাণীদেহ পঁচাতে সাহায্য করে।
- না স্যার । গায়ে সামান্য ধুলা লাগলে আম্মু যা বকা দেয়, মাটি তখন খুব কষ্ট পায় । আর তাই ব্যাকটেরিয়া ডেকে আমাদের পঁচিয়ে দেয় ।
- সত্যি বলতে কি নুহাস, আমরা সবাই মাটির মানুষ – আমাদের একদিন মাটিতেই মিশে যেতে হবে।
- তাহলে বিকালে কোচিং থেকে আসতে দেখলাম, ছেলেরা ধুলোবালি গায়ে ফুটবল খেলছে। এরাও তো মাটিতে মিশে আছে। এদের কি মাটি ব্যাকটেরিয়া দিয়ে আবার মিশিয়ে দেবে ?
............প্রশ্নটির উত্তর রায়হান দিতে পারে না। কেবল নিশ্চুপ হয়ে নিষ্পলক তাকিয়ে থাকে নুহাসের দিকে।

দুই
ইদানিং পড়ালেখায় আর মন বসে না রাইসার। মনের মধ্যে কি যেন এক পরিবর্তন সে অনুভব করতে পারে, কিন্তু কাউকে খুলে বলতে পারে না। বাড়িতে যে সে বড্ড একা। ছোটবেলায় মায়ের মৃত্যুর পর সৎ মা যে তাকে বলতে গেলে একেবারেই কাছে টেনে নেয়নি । আর তাই সন্ধ্যে হলেই পছন্দের টিভি সিরিয়ালগুলোই তার নিত্য দিনের সঙ্গী ।
হঠাৎ রাইসার ফোন বেজে উঠল , তার সহপাঠী কনিকা ।
-হ্যালো , রাইসা ।
-হুম, ভালো আছিস ?
-হুম , কি করিস রে ?
- এইতো, সিরিয়াল দেখি। “বোঝেনা সে বোঝেনা” ।
- দোস্ত , আর বলিস না । আজকে অরণ্য কে যা হ্যান্ডসাম লাগছে না মাইরি ।
- তোর ভাষার কি ছিরি রে এসব ?
-আর বলিস না , দিন দিন ওদের মতো হয়ে যাচ্ছি ।
- আচ্ছা শোন , কাল তোর সাথে কথা আছে ।

হঠাৎ মায়ের চিৎকার ......... হারাদিন কি গুজুর গুজুর , ফুসুর ? তোর বাপে কি এড়ে চর পোয়া লাই গেইয়ে নে ?
তরাতড়ি আই নি চুলেত ভাত বোয়া । ভাত বোয়াই নি সবজি গিন কুডি ল । আই নাটক গো চাই লই ।
-জি আম্মু ।
অসহায় দৃষ্টিতে কিছুক্ষণ টিভির দিকে তাকিয়ে থেকে একখানা দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেলে উঠে যায় রাইসা।
পরদিন সকালে............
-কনিকা, বেশ কদিন ধরে আমার না কেমন অস্বস্তি লাগছে। ঠিকমত খাওয়া দাওয়া হয় না, ঘুম হয়। নিজেকে কেমন যেন অচেনা লাগে ।
-আরে বুঝিস না। এই বয়স এ ও রকম হয়। কেন তোর আম্মু তোরে কিছু বলে নাই ?
-না রে, সেইদিন পেটব্যাথা করছিল // বলল – ফকির বাবার কাছ থেকে পানি পড়া আনি খা।
-আচ্ছা, তুই তো আমাদের শারিরীক শিক্ষা আপার কাছ থেকে পরামর্শ নিতে পারি। জানিস না ? কিশোরী স্বাস্থ্য উন্নয়নের লক্ষ্যে স্কুলভিত্তিক কার্যক্রম এ আপা সংযুক্ত আছে ।
-ও......... তাই নাকি ? আচ্ছা। ভালই হলো তাহলে বল ।

হঠাৎ শিক্ষক এসে পড়ায় ক্লাসে শুনশান নীরবতা নেমে আসে। রফিক স্যার অন্যান্য দিনের মতোই নাম ডাকা শেষে মার্কার নিয়ে উঠে দাঁড়ালেন। হঠাৎ কি মনে করে বলে উঠলেন –
-আচ্ছা আমরা তো সব সময়ই বই এর পড়া পড়ি, আজ একটু জীবনবোধ নিয়ে আলোচনা করি ।
গতানুগতিক বোর্ডের লেখা তোলা থেকে ছুটি পেয়ে শিক্ষার্থীরা যেন হাঁফ ছেড়ে বাচল। ছাত্রছাত্রীদের নিজেদের মধ্যে কথা বলতে দেখে স্যার বললেন,
-আচ্ছা, তোমরা কি লেখাপড়ার প্রকৃত উদ্দেশ্য জান ? কেনই বা আমরা বিদ্যালয়ে আসি ? পড়াশুনা করি কি শুধু একটু ভালভাবে বেঁচে থাকার জন্যে ? নাকি প্রকৃত মানুষ হবার জন্যে ?

শিক্ষার্থীরা নিশ্চুপ , তাদের মধ্যে ভাবোদয় হয়েছে । শিক্ষক প্রত্যেকের কাছ থেকে তাদের মতামতটুকু জানতে চাইলেন।
এরপর শেষে পরবর্তী ক্লাসের জন্য একখানা ছোট কাজ দিলেন।
-ধর তোমাদের একটি খালি কাচের জার দেয়া হলো । আর দেয়া হলো কিছু নুড়ি,পাথর আর বালি । কিভাবে জারটি পরিপূর্ণ করে ভর্তি করতে পারবে যাতে কোন উপাদান অবশিষ্ট না থাকে ? আমাদের জীবনটা যদি এই কাচের জার হয় তবে এই নুড়ি, বালি আর পাথরগুলো জীবনের অবিচ্ছেদ্য অংশ। এই কাজটা ভালোভাবে করতে পারলে জীবনবোধ নিয়ে তোমাদের ধারণা আরও স্পষ্ট হবে।

সেদিনের মতো ক্লাস শেষ। শিক্ষার্থীরা প্রত্যেকেই যে যার মত ভাবনায় লেগে পড়ল, আর রাইসা নুড়ি , বালিআর পাথর জোগাড় করতে বাইরে গেল । রাস্তার পাশের ঐ নির্মাণাধীন ভবনের পাশে বেশ কিছু নুড়ি,বালি আর পাথরের স্তূপ ছিল। রাইসা আনমনে নুড়ি কুড়াচ্ছিল । আচমকা.........
-দোস্ত,পাখি টা না সেইরম। দেখ দেখ বাসা বানাইবো বইলা নুড়ি কুড়াচ্ছে। ল চল ।
- তেরি ফটো কো সিনে সে ইয়ার , চুপ কালে ছাইয়া......
-ফেবিকল সে.........
-ঐ মাইয়া, নুড়ি লাগব নি নুড়ি ? আহো, আমার কাছে নুড়ি আছে, চুনি আছে , মুক্তা আছে। আরে যাও কই ?
-দোস্ত, ডরাইছে । ল , পিছু লই ।
-আরে যাও কই ?

রাইসা প্রাণপণে ছুটে নিরাপদ আশ্রয়ে চলে গেল। যেতে যেতে গায়ে পড়ল বখাটেদের ছুড়ে দেয়া বেশ কিছু নুড়ি পাথর।
বাসায় এসে রাইসা অঝোরে কাঁদতে লাগল। তাঁর মনে হাজারো প্রশ্নের ভীড়- এই কি তবে কাঁচের জারে বন্দী জীবন ? এই কি আমাদের সমাজ ?

তিন
পাঁচটি বছর কেটে গেছে। নুহাস-সাব্বির-রাইসা-কনিকা প্রত্যেকেই এখন সদ্য উচ্চ মাধ্যমিকের গণ্ডী পেরোনো চার তরুণ-তরুণী। একটি বিবাহের অনুষ্টানে তাদের দেখা.........কনিকা প্রথমেই শুরু করে,
-সাব্বির, কি ভাবছিস রে ? আমাদের রেজাল্ট তো তেমন ভাল হলো না ।
-আব্বু বলল, বিদেশ পাঠিয়ে দেবে। সে লক্ষ্যেই প্রস্তুতি নিচ্ছিলাম। কিন্তু হঠাৎ আব্বু হার্ট এটাক করে বসল;
-কি বলিস ? তাহলে তো আঙ্কেল এর পাশে থাকাটাই বেস্ট হবে।
এরই মধ্যেই ভাবুক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকা নুহাসের দিকে প্রশ্ন ছুড়ে দেয় কনিকা।
-কিরে, তোর কি চিন্তা ভাবনা ? আর কত বাধ্য ছেলে হয়ে থাকবি ? এখন অন্তত কিছু একটা তো ডিসিশন নিজে নে-
-কেমনে নেই ? আব্বা বলে রাখছে ডিফেন্স এ জব পাইতেই হবে,পরিবারের হাল ধরা লাগবে।
-তো এটেন্ড কর।
-কিন্তু আমি তো স্বপ্ন দেখতাম শৃঙ্খলহীন মুক্ত-স্বাধীন জীবনের। আর এ লক্ষ্যেই মনের কোণে লালন করে এসেছি ভার্সিটি তে পড়ার স্বপ্ন। মনে আছে তোদের, স্যারের সেই নুড়ি,বালি,পাথর আর খালি জার ? এখনো পরিপূর্ণ করতে পারলাম না রে ।

-আচ্ছা কনিকা, তোর কি ভাবনা-চিন্তা । বন্ধু নুহাস কথা বলতে বলতে ভাবুক হয়ে পড়ায় পরিস্থিতির সামাল দিতে প্রশ্ন করে বসে সাব্বির।
-আমার ইচ্ছে ছিল ইঞ্জিনিয়ারিং পড়ার, কিন্তু বাবার ইচ্ছে মেয়েকে ডাক্তার বানাবে।

রাইসা প্রথম থেকেই নীরব । তাঁর জীবন নামক কাঁচের জারটার ঢাকনা যে এঁটে গেছে ........

----------------------------------------- ০ ---------------------------------------


মোঃ এহসান সানি
তড়িত ও ইলেকট্রনিক প্রকৌশল
প্রিমিয়ার বিশ্ববিদ্যালয়।
সর্বশেষ এডিট : ১৫ ই অক্টোবর, ২০১৬ রাত ২:৫৫
০টি মন্তব্য ০টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

যে ভ্রমণটি ইতিহাস হয়ে আছে

লিখেছেন কাছের-মানুষ, ১৮ ই মে, ২০২৪ রাত ১:০৮

ঘটনাটি বেশ পুরনো। কোরিয়া থেকে পড়াশুনা শেষ করে দেশে ফিরেছি খুব বেশী দিন হয়নি! আমি অবিবাহিত থেকে উজ্জীবিত (বিবাহিত) হয়েছি সবে, দেশে থিতু হবার চেষ্টা করছি। হঠাৎ মুঠোফোনটা বেশ কিছুক্ষণ... ...বাকিটুকু পড়ুন

আবারও রাফসান দা ছোট ভাই প্রসঙ্গ।

লিখেছেন মঞ্জুর চৌধুরী, ১৮ ই মে, ২০২৪ ভোর ৬:২৬

আবারও রাফসান দা ছোট ভাই প্রসঙ্গ।
প্রথমত বলে দেই, না আমি তার ভক্ত, না ফলোয়ার, না মুরিদ, না হেটার। দেশি ফুড রিভিউয়ারদের ঘোড়ার আন্ডা রিভিউ দেখতে ভাল লাগেনা। তারপরে যখন... ...বাকিটুকু পড়ুন

মসজিদ না কী মার্কেট!

লিখেছেন সায়েমুজজ্জামান, ১৮ ই মে, ২০২৪ সকাল ১০:৩৯

চলুন প্রথমেই মেশকাত শরীফের একটা হাদীস শুনি৷

আবু উমামাহ্ (রাঃ) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, ইহুদীদের একজন বুদ্ধিজীবী রাসুল দ. -কে জিজ্ঞেস করলেন, কোন জায়গা সবচেয়ে উত্তম? রাসুল দ. নীরব রইলেন। বললেন,... ...বাকিটুকু পড়ুন

আকুতি

লিখেছেন অধীতি, ১৮ ই মে, ২০২৪ বিকাল ৪:৩০

দেবোলীনা!
হাত রাখো হাতে।
আঙ্গুলে আঙ্গুল ছুঁয়ে বিষাদ নেমে আসুক।
ঝড়াপাতার গন্ধে বসন্ত পাখি ডেকে উঠুক।
বিকেলের কমলা রঙের রোদ তুলে নাও আঁচল জুড়ে।
সন্ধেবেলা শুকতারার সাথে কথা বলো,
অকৃত্রিম আলোয় মেশাও দেহ,
উষ্ণতা ছড়াও কোমল শরীরে,
বহুদিন... ...বাকিটুকু পড়ুন

স্প্রিং মোল্লার কোরআন পাঠ : সূরা নং - ২ : আল-বাকারা : আয়াত নং - ১

লিখেছেন মরুভূমির জলদস্যু, ১৮ ই মে, ২০২৪ রাত ১০:১৬

বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহিম
আল্লাহর নামের সাথে যিনি একমাত্র দাতা একমাত্র দয়ালু

২-১ : আলিফ-লাম-মীম


আল-বাকারা (গাভী) সূরাটি কোরআনের দ্বিতীয় এবং বৃহত্তম সূরা। সূরাটি শুরু হয়েছে আলিফ, লাম, মীম হরফ তিনটি দিয়ে।
... ...বাকিটুকু পড়ুন

×