এখন 'ফাংবিয়ান মিয়ান' পুরোটাই খেতে পারি
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
Tweet
স্কলারশীপ স্টুডেন্ট ছিলাম বলে প্রথমে বেইজিং আসতে হল অফিসিয়ালি রেজিস্ট্রেশনের জন্য যদিওবা আমার গন্তব্য বেইজিং নয়; শিয়ান(xi'an) নামের অন্য একটি ঐতিহাসিক শহর। রাতে বেইজিং পৌঁছার পর বেইজিং ল্যাংগুয়েজ এন্ড কালচারাল ইয়ুনিভার্সিটির একটি বাস এসে আমাদের নিয়ে গেল। রাত ১২টা; আমিতো খিদায় মরি মরি অবস্থা; স্কলারশিপের ভাতার কিছু অংশ যখনি পেলাম কয়েকজন মিলে পেটের দানাপানি যোগানের জন্য দিলাম ছুট। রাত অনেক তাই ভারসিটির ক্যান্টিন বন্ধ অগত্যা বাইরে খুঁজতে লাগলাম, কিছুদুর হাটতেই পেলাম Mcdonalds এর ২৪ ঘণ্টা সার্ভিসের দোকান। ওইটাই প্রথম Mcdonalds দর্শন ও ভক্ষন।
পরেরদিন বেইজিং থেকে শিয়ানে যেতে ১২ ঘন্টার ট্রেন জার্নি তাই খাবার কিনতে গেলাম কিন্তু ফ্রুটস আর ব্রেড ছাড়া আর কিছুই আমার খাবারোপযোগি পেলামনা। ট্রেনে উঠে দেখলাম আমার কেবিন সিটের দাবিদার অন্য আরেক চীনা সুন্দরি। মনে মনে ভাবলাম আল্লাহ এত তাড়াতাড়ি পরিক্ষা নেয়া শুরু করল কেন? তো সুন্দরি আমি বিদেশি বলে আমার হয়ে কমপ্লেন করল আর সাথে সাথে অন্য কেবিনে সিটের ব্যবস্থা হয়ে গেল। কিন্তু ঐ সুন্দরিরে মিস করলাম বলে আফসোস লাগল। সন্ধ্যা ৬টা বাজতেই সবাই ডিনার আয়োজন শুরু করল। আমি বাংগালতো খাই রাতের ৯/১০টায়। আমার কেবিনের বাকি ৩জনের ২ জন স্বামী-স্ত্রী। আকারে ইংগিতে বলল ১০টা বাজে লাইটস অফ, তাড়াতাড়ি খাওয়া শুরু কর। তো আমি যখন ব্যাগ থেকে ব্রেড আর জ়েলীর বোতল বের করছি চাইনিজরা দেখি সবাই গোল গোল বক্স বের করতে লাগল। পরে জানলাম এটার নাম 'ফাংবিয়ান মিয়ান' বা ইন্সট্যান্ট নুডলস। সবাই দেখলাম গরম পানির জন্য ছুটছে বগির একমাথায়। তারপর বক্সের মধ্যে শুধু গরম পানি ঢালল আর ২ মিনিট অপেক্ষা করে খাওয়া শুরু করে দিল। চাইনিজদের নুডলস খাওয়াও একটা আর্ট। নুডলসের এক মাথা মুখে ঢুকিয়ে দেয় দে একটান আর সুর সুর করে কিছু ঢুকে যায় মুখের ভিতর। যদি এক্সপার্ট না হন তাহলে ঝোল, নুডলস সব গায়ে এসে পড়বে।
আমার কেবিনের ভদ্রলোক ও ভদ্রমহিলা তাদের দুর্বোধ্য ইরেজির সব ঢেলে দিয়ে আমার সাথে কমিউনিকেট করার চেষ্টা করতে শুরু করল। আমি দেখলাম ইংরেজি বাক্য পুরাটা না বলে যদি শুধু কিওয়ার্ড গুলো বলি তাহলে তারা বুঝে। তো শুধু কি কিওয়ার্ড দিয়ে চালাইতে শুরু করলাম। যা বলল তা হলো " ফাংবিয়ান মিয়ান খুবি সুস্বাদু তুমি ১টা চেখে দেখ"। আমি না বলাতে আরো চেপে ধরল। তারা আমার জন্য ১টা বক্স বের করল; দেখলাম বক্সের উপরে মাংসের ছবি দেখা যায়। জিজ্ঞেস করলাম কিন্তু বুঝলনা। এইরে! এখন কেমনে জিজ্ঞেস করি এটা গরু না শুকর। কোন উপায় না পেয়ে যেই এঁকে দেখালাম একটা গরু ও আরেকটা শুকর তারা হাসতে শুরু করল আর বলল নিশ্চিত থাকো এটা গরুর মাংস, চাইনিজ লেখায় 'গরুর মাংস' দেখাতে লাগল যেন আমি চাইনিজ লেখা বুঝি। তা আমি সানন্দে বললাম ওকে। তারপর তারা আমার জন্য ফাংবিয়ান মিয়ান বানাতে শুরু করে দিল। চাইনিজার কি শীত কি গরম সবসময় গরম পানি আর চা পান করে, তাই গরম পানি তাদের সবসময়ই চাই। প্রতিটি কেবিনে গরম পানির ফ্লাস্ক দেয়া থাকে এবং গরম পানির বয়লার ও থাকে বগির এক কোনায়। তো ২ মিনিট অপেক্ষার পর আমি বক্সটি হাতে নিলাম। তারা বুঝল আমি চপ স্টিক ব্যবহার জানিনা তাই একটি প্লাস্টিকের কাঁটা চামচ দিল। আমিতো মুখে দিয়েই ঝান্ডুদার রসগোল্লার মত আক্কেলগুড়ুম তবে স্বাদে নয় বিস্বাদে। বাংলাদেশে থাকতে মায়ের হাতের নুডলস কি যে মজা লাগত কিন্তু চীন দেশের সুস্বাদু নুডলসের যদি এই অবস্থা হয় তাহলে আমারে বাকি সময়টা এই জায়গায় যে কিভাবে কাটবে তাই ভেবেই মুষঢ়ে পড়লাম। চোখের সামনে ভাসতে লাগল মুস্তাকিম, হাজীর বিরিয়ানি, চট্রগ্রামের দারুল কাবাব। সেই নুডলস ২/৩ চামচ খেয়ে আর খেতে পারিনি। তবে এখন ক্ষুদা লাগলে ব্যস্ত সময়ে মাঝে মাঝে ১ট বক্স শেষ করে আবার আরেকটা শুরু করি, পুরোপুরি অভ্যস্ত হয়ে গেছি। একটা কথা বলি, আমাদের দেশে চাইনিজ রেস্টুরেন্ট এর যে ব্যবসা হয় তার কিন্তু পুরাটাই ভুয়া। মানুষ চাইনিজ খবার বলে যা খাচ্ছে তা মোটেও চাইনিজ খাবার নয়। পুরাটাই ধোঁকা।
চাইনিজদের হোটেলে কিন্তু অর্ডার দেওয়ার পর খাবার রান্না করা হয়। আমাদের হোটেলের মত না, যে হোটেলে যাওয়ার পর আপনি যা রান্না করা আছে তার থেকে একটা বেছে নিবেন। তাই রেস্টুরেন্টে আপনাকে ওয়েট করতে হবে মিনিমাম ২০মিনিট থেকে আধা ঘন্টা। যেহেতু সদ্য রান্না করা গরম গরম খাবার তাই বাসি খাবার এবং ফুড পয়জনিং এর সম্ভাবনা থাকেনা। আমি আসার পার প্রথম যে সমস্যাগুলোর মধ্যে পড়ি তার একটা হল শুকরের মাংস আর চপস্টিক ব্যবহার। প্রথম প্রথম কত জামা যে নষ্ট করছি ঐ চপ স্টিক ব্যবহার করতে গিয়ে।চাইনিজরা মাংস বলতে শুকরের মাংসই বুঝায়। সব ভালখাবার গুলো শুকরের মাংস দিয়ে তৈরি। শুকর এদের কাছে খুবি আদরনীয় এবং ভাগ্যের প্রতীকও। আরেকটা সমস্যা ছিলো এরা বাংলাদেশের রেস্টুরেন্টের মতো ঢুকার সাথে মামুদের মত একজগ পানি আর গ্লাস এনে দেয়না; দেয় হচ্ছে গরম চা তাও আবার দুধ চিনি চা না। চাইনিজরা পানির বদলে যে কোন কিছুর সাথে গরম চা খায়। আমি বাংগালতো খাওয়ার সময় সবসময় নরমাল পানি খুজি তাই প্রথম কমাস মিনারেল বোতলের পিছনেই শধু টাকা ঢেলেছি। এখন পুরাদস্তুর চা তে অভ্যস্ত।
চাইনিজদের খাওয়ার রীতি নীতিও ভিন্ন। দুপুরের ও রাতের খাবারটকে তারা বেশ গুরুত্বর সাথে নেয়। আমরা সাধারনত হোটেলে বা রেস্টুরেন্টে গেলে যতজন মানুষ ততটা ভাত তরকারির অর্ডার দেই যেমনঃ দুইটা ডাল, দুই হাফ গরুর মাংস এবং দুইটা ভাত। চাইনিজরা কিন্তু অর্ডার করে গ্রুপের জন্য; গ্রুপ বড় হলে অর্ডার বেশি। ধরুন ৫টা ডিশ অর্ডার দিল ৩ জনের জন্য, আরেকজন ও এসে পরে যোগ দিতে পারে শুধু প্রয়োজন এক জোড়া চপ স্টিক। সবাই চপ স্টিক দিয়ে একই তরকারির প্লেট থেকে খাবার তুলে তুলে খাবে। প্রথম প্রথম খারাপ লাগতে পারে এটা দেখে; আমারো লাগতো। আরেকজন চপস্টিক মুখে ঢুকাচ্ছে আবার ওই বাটিতে চপ স্টিক দিয়ে খাবারও নাড়ছে যেখান থেকে কিনা আমাকেও চপ স্টিক দিয়ে খাবার তুলে নিতে হবে। চাইনিজদের খাবারের টেবিল সাধারনত গোল হয় এবং টেবিলের উপর একটা ঘূর্নায়মান টেবিলের সাইজের একটা মোটা কাঁচ বসানো থাকে এর ফলে আপনাকে উঠে হাত বাড়াতে হবেনা খাবার ধরার জন্য; কাঁচ ঘোরান ১টা ১টা খাবারের প্লেট আপনার সামনে আসবে আর আরেকজনের কাছে যাওয়ার আগেই চপ স্টিক দিয়ে তুলতে থাকুন। আমরা বাংগালীরা ভাত খাই প্লেইটে আর এরা ভাত খায় একটা ছোট বাটির মধ্যে; প্রথমে তরকারি তুলে নেয় মুখে তারপর ১ চিমটি ভাত চপ স্টিক দিয়ে তুলে মুখে পুরে। শুরুতে তারা ঠান্ডা তরকারি খায় তারপর গরম তরকারি। ঠান্ডা তরকারি মানে চুলায় তৈরি না, হাতে তৈরি।
চাইনিজরা খাবারের সময় কিছু রেওয়াজ মেনে চলে যেমন ভাতের বাটিতে আপনি চপ স্টিক পুতে রাখতে পারবেননা; আমরা যেমন ভাতের বাউলে ভাতের চামচ ঢুকিয়ে রাখি। এর কারণ তারা মৃত আত্মাকে খাওয়ার দেয়ার সময় ভাতের বাটিতে চপ স্টিক পুতে রাখে। চায়ের কেতলির মুখ কারো দিকে ফিরিয়ে না রেখে যেদিকে মানুষ নাই সেদিকে ফিরিয়ে রাখতে হয়। খাওয়ার তৈরি হচ্ছে ইত্যবসরে চপ স্টিক দিয়ে বাটিতে কিংবা অন্য কোথাও বাড়ি মেরে শব্দ করা যাবেনা। এতে বাবুর্চির অপমান হয়।
চাইনিজরা প্রচুর হোয়াইট ওয়াইন গিলতে পারে। এদের হোয়াইট ওয়াইনে এলকোহলের মাত্রা থাকে অস্বাভাবিক; নুন্যতম ৫০% সাথে মারাত্মক দুর্গন্ধ। আপনি যদি ৫ থেকে ৭ পেগ একনাগাড়ে খান তাহলে নিশ্চিত আহ্নিক গতি-বার্ষিক গতি সব চোখের সামনে প্র্যাক্টিকেলি দেখতে পারবেন! চাইনিজরা যখন ড্রিংক করে তখন আমি অনেককে দেখেছি ড্রিংকের মাঝ পথে টয়লেটে গিয়ে গলায় আংগুল ঢুকিয়ে বমি করে মুখ ধুয়ে ফিরে এসে আবার পুরোদ্যমে শুরু করতে। চাইনিজরা চায় অতিথি পান করে মাতাল হোক; অতিথি মাতাল এর মানে আপ্যায়নে তিনি সন্তুষ্ট। আপনি যদি আপনার বসকে সন্তুষ্ট করতে চান তাহলে ১ পেগ হোয়াইট ওয়াইন নেন, বসের চেয়ারের কাছে যান তারপর 'গান বেই' [চিয়ার্স] করেন। গানবেই করার সময় আপনার গব্লেট বসের গব্লেটকে ছুঁতে হবে এমনভাবে যেন আপ্নারটার মাথা বসেরটার তলানিতে স্পর্শ করে। অর্থাত বসেরটা উপরে আপ্নারটা নিচে। তারপর পুরা পেগ গলার মধ্য ঢেলে দেন বসের আগে এবং গবলেট উল্টিয়ে দেখান যে তার মধ্যে কিছুই অবশিষ্ট নাই; আপনার বস খুশি হয়ে যাবে। আর যদি বস হোন তাহলে কিন্তু সর্বনাশ কারন সবাই একের পর এক আসবে আপনার সাথে গাম বেই করতে। চাইনিজ বসরা তাই প্রচুর হোয়াইট ওয়াইন গিলতে পারে। বস যদি মাতাল হয় আরো ভাল আপনি আপনার আবদার আদায় করে নিতে পারবেন। দেখছেন বস মাতাল হওয়ার পথে ব্যস শুরু করুন আপনার কথা, দুঃখের কথা। চাইনিজদের বড় বড় বিজনেস ডিল, ডিসিশন কিন্তু খাওয়ারের টেবিলেই হয়ে থাকে। তাই খাওয়ারের টেবিল তাদের জন্য খুবি গুরুত্বপুর্ন।
অনেক কিছুই এখনও জানার বাকি। আমি এখনো সার্ভাইব্যাল ফর দ্যা ফিটেস্ট এর জন্য লড়াই করে যাচ্ছি।
এখানে একটি চীনা ই-ম্যাগাজিনের লিংক দিলাম। আপনাদের ভাল লাগলে আরো দেব।
[তিব্বত নিয়ে আরেকটি চীনা ই-ম্যাগাজিনের লিংক এখানে দিলাম উপযুক্ততার বিচারে।
লেখাটি একই সাথে 'আমার ব্লগ ' এ ও প্রকাশিত।
১৬টি মন্তব্য ১৬টি উত্তর
আলোচিত ব্লগ
খুলনায় বসবাসরত কোন ব্লগার আছেন?
খুলনা প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় তথা কুয়েট-এ অধ্যয়নরত কিংবা ঐ এলাকায় বসবাসরত কোন ব্লগার কি সামুতে আছেন? একটি দরিদ্র পরিবারকে সহযোগীতার জন্য মূলত কিছু তথ্য প্রয়োজন।
পরিবারটির কর্তা ব্যক্তি পেশায় একজন ভ্যান চালক... ...বাকিটুকু পড়ুন
একমাত্র আল্লাহর ইবাদত হবে আল্লাহ, রাসূল (সা.) ও আমিরের ইতায়াতে ওলামা তরিকায়
সূরাঃ ১ ফাতিহা, ৪ নং আয়াতের অনুবাদ-
৪। আমরা আপনার ইবাদত করি এবং আপনার কাছে সাহায্য চাই।
সূরাঃ ৪ নিসার ৫৯ নং আয়াতের অনুবাদ-
৫৯। হে মুমিনগণ! যদি... ...বাকিটুকু পড়ুন
শাহ সাহেবের ডায়রি ।। মুক্তিযোদ্ধা
মুক্তিযুদ্ধের সঠিক তালিকা প্রণয়ন ও ভুয়া মুক্তিযোদ্ধা প্রসঙ্গে মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রী আ ক ম মোজাম্মেল হক বলেছেন, ‘দেশের প্রতিটি উপজেলা পর্যায়ে মুক্তিযোদ্ধা যাচাই বাছাই কমিটি রয়েছে। তারা স্থানীয়ভাবে যাচাই... ...বাকিটুকু পড়ুন
ভারতীয় রাজাকাররা বাংলাদেশর উৎসব গুলোকে সনাতানাইজেশনের চেষ্টা করছে কেন?
সম্প্রতি প্রতিবছর ঈদ, ১লা বৈশাখ, স্বাধীনতা দিবস, বিজয় দিবস, শহীদ দিবস এলে জঙ্গি রাজাকাররা হাউকাউ করে কেন? শিরোনামে মোহাম্মদ গোফরানের একটি লেখা চোখে পড়েছে, যে পোস্টে তিনি... ...বাকিটুকু পড়ুন
ঘুষের ধর্ম নাই
শহীদুল ইসলাম প্রামানিক
মুসলমানে শুকর খায় না
হিন্দু খায় না গাই
সবাই মিলেই সুদ, ঘুষ খায়
সেথায় বিভেদ নাই।
হিন্দু বলে জয় শ্র্রীরাম
মুসলিম আল্লাহ রসুল
হারাম খেয়েই ধর্ম করে
অন্যের ধরে ভুল।
পানি বললে জাত থাকে না
ঘুষ... ...বাকিটুকু পড়ুন