আমার যখন জন্ম হয়, আমার ভাইয়ার খুব মন খারাপ হয়েছিলো। আমি কেনো মেয়ে হলাম । তার তো একটা ভাইয়ের দরকার। বোন যে হলো, এখন তার সঙ্গে ফুটবল খেলবে কে? ক্রিকেট খেলবে কে? ঘুড়ি উড়াবে কে?
মন খারাপ হলেও ভাইয়া কিন্তু আমাকে ভীষণ আদর করতে শুরু করে। আমার বয়স তখনও ৪০ দিন হয় নাই। এর মধ্যে একদিন আম্মুর অগোচরে একটা চকলেট এনে আমার মুখে দিয়ে দেয়। ভাইয়ার বন্ধুদের ভাইবোনরা চকলেট খায়। তার বোন কেনো খাবে না। এই ছিলো যুক্তি। আম্মু তো ভয়ে অস্থির। কীভাবে বের করবে এই জিনিস। তারপর অনেক বুদ্ধি করে মুখ থেকে বের করা হলো। ধারণা করা হয়, এই কারণেই হয়তো বা চকলেট আমার এতো প্রিয়।
ঐসময়কারই আরেকটা ঘটনা। আম্মু ভাইয়ার পাহাড়ায় আমাকে রেখে রান্নায় ব্যস্ত। সবার ভাই বোন হামাগুড়ি দেয়,হাঁটে , দৌড়ায়। তার বোন কিনা বসতেই পারে না। চিন্তার ব্যাপার! ভাইয়া করলো কি, তার বোনের চারদিকে বালিশ দিয়ে ঘেরাও করে তাকে বসায় রাখলো। আম্মু এসে দেখে এই অবস্থা। তাড়াতাড়ি বালিশ সরায় আমাকে শোয়ায় দিলো। আমার বয়স তখন ৪০ দিনও হয় নাই। পরে নাকি আমি হাঁটতে পারা পর্যন্ত আম্মু অনেক টেনসনে ছিলো।
তখন আমার বয়স দুই আড়াই বছর।এটা আমাদের দুই ভাইবোনের হারায় যাওয়ার গল্প। ঈদের দিন। সকালবেলা আম্মু রান্না-বান্নায় ব্যস্ত। আমি কাঁদছিলাম। আম্মু আমাকে ভাইয়ার তত্ত্বাবধানে রেখে আমার জন্যে খাবার রেডি করতে গেছে। এর মধ্যে ভাইয়া কান্না থামানোর জন্যে আমাকে নিয়ে বাইরে দাঁড়ালো। হয়তো আমার কান্না থামছিলো। তাই দেখে আমাকে নিয়ে আরেকটু বাইরে গেলো। আরেকটু গেলো। যেতে যেতে, হাঁটতে হাঁটতে অ-নে-ক দূর। এমন সময় নামলো ঝুম বৃষ্টি। সেই বৃষ্টি থেকে বাঁচার জন্যে দুই জন মিলে একটা যায়গায় আশ্রয় নিলাম। সকাল গড়ায়ে দুপুর। দুপুর গড়ায়ে বিকাল। বৃষ্টি আর থামে না। এইদিকে আমাদের দুইজনকে খুঁজতে খুঁজতে সারা এলাকার মানুষ হয়রান। আম্মু বারবার জ্ঞান হারায়। একসঙ্গে দুই ছেলেমেয়ে হারায় গেলো? বৃষ্টি থামলে পরে আমাকে নিয়ে ভাইয়া বাসার দিকে রওনা দিলো। পথে পাশের বাসার এক নানার সঙ্গে দেখা। উনি আমাদেরকে নিয়ে রিকশা করে বাড়ি ফিরলেন।সেবার আমাদের দুইভাইবোনের জন্যে আমার বাবা-মা সারা এলাকার সবার ঈদ মাটি।
আমি আমার ভাইয়ার ভাই হই নাই তাতে কি? ভাইয়ার সঙ্গে কিন্তু ঘুরাঘুরি, ফুটবল, ক্রিকেট, র্যাকেট, ক্যারম সবই খেলা হইছে। নতুন কোন ইলেক্ট্রনিকস আনলেই সেটা কীভাবে বানানো হইছে, তা দেখার জন্যে ভাইয়ার হাত নিশপিশ করতো। গাড়ি,রোবট, ঘড়ি, রেডিও, ক্যাসেট প্লেয়ার এমন কোনো জিনিস নাই যে ভাইয়ার হাতে খোলা হয় নাই। আর সেইসব কাজের প্রত্যক্ষ সহযোগিতায় থাকতাম আমি। এটা দে। ওটা রাখ। যত্ন করে রাখবি, যেন না হারায়। এইটাইপের দায়িত্ব পালন করতাম। তবে মজার ব্যাপার হলো, প্রত্যেকবারই যন্ত্রপাতি জোড়া লাগানোর পরই দেখা যাইতো দুয়েকটা -পার্টস কেনো যেন বেশি । ওগুলো ছাড়াই চমৎকার কাজ করছে৷
সব কাজের হেল্পার আমি হলেও একটা ব্যাপারে ভাইয়ার সহযোগি ছিলাম না। ভাইয়া প্রচুর তিন গোয়েন্দা, নভেল পড়তো। বই তো আর একসঙ্গে পড়া যায় না। সম্ভবত এই কারণে আমি ঐসময় চুপি চুপি আম্মুর কাছে গিয়ে বলে দিতাম। আম্মু বকা ঝকা করতো। ভাইয়া কতরকম কায়দা করে যে লুকায় লুকায় পড়তো। মাঝে মাঝে খাটের নিচে গিয়েও পড়তো। আম্মু খুব রাগ করতো। এইজন্যে কত বই যে আম্মু ছিড়ে ফেলছে ! আমি তখন ক্লাস ফাইভে পড়ি। একদিন ভাইয়া আমাকে তিন গোয়েন্দার একটা বই দিলো। "জিনার সেই দ্বীপ"। বললো পড়ে দেখ, কত্ত ভালো লাগে। সত্যিই ...আমি মুগ্ধ হয়ে গেলাম। এতো সুন্দর! এত্ত ভালো লাগার !! এতোদিন আমি পড়তাম রূপকথা, আরব্য রজনী, শিয়াল পন্দিত টাইপের বইগুলো। এই বইটা পড়ে যেন আমি বড় হয়ে গেলাম। ঐসব বাচ্চা গল্প আর ভালো লাগে না। একটার পর একটা তিন গোয়েন্দা শেষ করতে লাগলাম। ভাইয়ার নামে নালিশ করা বন্ধ। পড়ার ফাঁকে ফাঁকে আমিও এখন এইসব পড়ি। তারপর তো ধীরে ধীরে হুমায়ুন, জাফর ইকবাল, সমরেশ, সুনীল,বিভূতিভূষন, অনুবাদ। আরও কত কত। নেশার মতো একটা ব্যপার! প্রথমে ভাইয়াই কিনতো বই।তারপর আমিও শুরু করি। নিউ ইয়ার। বই কিনে নিয়ে আসি। পয়লা বৈশাখ,পয়লা ফাল্গুন, পরীক্ষায় ফার্স্ট হওয়া, বার্থডে, বইমেলা। কোনো একটা উপলক্ষ্য পেলেই হলো। বই কেনা। পড়া।
তবে এইটা ঠিক ভাইয়া আমার ছোটো বোনের রেজল্টের জন্যে বই গিফট করতে পারলেও আমার জন্যে খুব বেশি রেজাল্ট বিষয়ক গিফট দিতে পারে নাই। কারন আমি অতো ভালো রেজাল্ট করতে পারি নাই। আমার রেজাল্ট বেশির ভাগ সময়ই তাদেরকে হতাশ করে দেয়। আমার জীবনের প্রত্যেকটা গুরুত্বপূর্ণ স্টেপে আমি শুধু হত্যাশা আর ব্যার্থতাই গিফট করি সবাইকে। তারপর আবার নতুন করে উৎসাহ, নতুন করে শুরু করা। তারপর আবার ব্যর্থতা। আমার ছোটোবেলা থেকেই আমার ভাইয়া, আমার বাবা মা, এমনকি ছোটো বোনটাও আমার প্রতি অসম্ভব কেয়ারিং ছিলো।তাদের সাথে চার বছর আগে নতুন করে যোগ হলো আমার চমৎকার ভাবিটা। আমার আনন্দে আমার চেয়েও ত্যাদের বেশি আনন্দিত হওয়া, আমার দূঃখে আরও বেশি দুঃখ পাওয়া এই ব্যাপারগুলো আমি খুব ভাবি। এতোটা ভালোবাসা কি সবাই পায়? অন্তত আমি আরেকটু কম পেলেই বা কি হত? শুধু মাত্র এই কারণেই আমার কষ্টগুলোকে আমি খুব বেশি ফীল করি না। আমার জন্যে টেনশন করার লোক তো আছেই। আমার আর চিন্তা কি? খাই দাই, হাসি, খেলি। এইতো।
এইবার ভাইয়ার কিছু সুন্দর আর ভালো গুনের কথা বলি। ভাইয়া খুব সুন্দর রবীন্দ্র সঙ্গীত গাইতে পারে। রবীন্দ্র সঙ্গীতের মধ্যে আবার সবচে ভালো গায় "কতবার ভেবেছিনু আপনা ভুলিয়া" গানটা । তারপর ভাইয়া টিচার হিসাবে অসম্ভব ভালো। প্রচণ্ড হাসি খুশি। সবার চোখে পড়ার মতো একটা গুন হলো তার অট্টহাসি। হা হা করে যে হাসে, পাশের বাড়ির মানুষও বুঝতে পারে তৌফিক হাসতেছে । মন ভালো করে দিতে পারে। গিটার বাজাইতে পারে (একসময় পারতো।এখন পারে কিনা জানি না)।যা টার্গেট করে সেটা সফল করার জন্যে প্রাণপন খাটে। আরও যেন কি কি । মনে পড়ছে না। আর... আমি তার ভীষন আদরের। আমি কোনো প্রব্লেমে পড়লে ভাইয়া যদি আমার সঙ্গে কথা বলে, তখনই মনে হয় আমার প্রব্লেম সলভড। আর আনন্দের কথা ভাইয়ার সংগে শেয়ার না করা পর্যন্ত মনে হয় আনন্দটা ঠিক পরিপূর্ণ হচ্ছে না।
ভাইয়া এখন আমাদের কাছ থেকে অনেক দূরে। কিন্তু তারপরও দূরে না। ফোন ফেসবুক ইমেইলের বদৌলতে মনে হয় পাশেই আছে। মনে চাইলে একটু ছোঁয়া যায় না,এই যা!
আর খারাপ গুন হলো, অল্পতেই অনেক বেশি কষ্ট পায়। আর আমাদের নিয়ে অনেক অনেক বেশি ভাবে। আরেকটু কম ভাবলে খারাপ হতো না।
আজকে আমার এই অসাধারণ ভাইয়াটার জন্মদিন। আমাদের ফ্যামিলির প্রত্যেক্টা জন্মদিনে আমরা রাত বারোটা এক মিনিটে কেক কাটি। উইশ করি। ভাইয়া কাছে নাই তো কি হইছে। আমরা কেক খাবো না? অবশ্যই খাবো।
আমি তোমাদের আনন্দের কারণ হইতে পারি না। তারপরও তোমার জন্যে, তোমাদের জন্যে আমার সবসময়ের চাওয়া, প্রত্যেকটা ক্ষণ, প্রত্যেকটা মুহুর্ত তোমাদের চিরসুন্দর হোক। সাফল্য, সুখ , ভালোবাসা চারদিক থেকে ঘিরে রাখুক তোমাদের!
শুভ জন্মদিন ভাইয়া!!!...