“না, কবির ভাই এভাবে তো একটা দেশ চলতে পারে না” এই বলে শুরু হয় আমাদের দেশ উদ্ধার। উদ্ধারকর্মী আমরা চার রুমমেট। উদ্ধার কাজ শুরু হয় এফ.এইচ. হলের ১০১২ নাম্বার রুম থেকে! কোনদিন আমি কোনদিন প্লাবন শুরু করি এই মহান ব্রত! বলছিলাম আমার হল লাইফের কথা। আগে এই মহান উদ্ধার কর্মীদের সাথে একটু পরিচয় করিয়ে দেই। মাথাভর্তি ঝাকড়া চুলের হালকা পাতলা ছোটখাট মানুষটা জিওলজির কবির ভাই, কথা বলেন খুব আস্তে চোখেও দেখেন খুব কম। আমার পাশের লম্বা এবং সবচে’ উৎসাহী ছেলেটা সাইকোলজির প্লাবন। আর মুখোমুখি বসে আছে ম্যাথে’র ইকবাল। পেপার পড়তে পড়তে কোনদিন দেশ উদ্ধার শুরু হয় রাত ১২ টায় চলে ৩ টা অবধি। জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণ থেকে শুরু করে ক্ষমতার বিকেন্দ্রীকরণ কি পরামর্শ আসে না সেই আলোচনা থেকে। আমাদের বাকি দুই জুনিয়র রুমমেট বসে বসে দেখে আমাদের কর্মকান্ড।
হল লাইফের কথা লিখতে বসে ভাবলাম সবাই তো হল লাইফের হাজারো কষ্টের কথা জানেই আজ নাহয় মজার গল্প গুলোই বলি। একটু পিছনে ফিরে যাই। প্রথম যেদিন হলে এ্যালটমেন্ট পেলাম, রসিকে নিয়ে ভয়ে ভয়ে গেলাম ১০১২ নাম্বার রুমে। রাত তখন ৮ তার মত বাজে। রুমে ঢুকে দেখি সব লাইট নিভানো শুধু দুই কোনায় টেবিল ল্যাম্প দিয়ে দুই জ্ঞানতাপস(!) (শামিম ভাই ও ফুয়াদ ভাই) গভীর মনোযোগ দিয়ে পড়ছেন। আমরা দু’জন তো গেলাম ভড়কে। আমি তো মনে মনে ভাবছি কোন আঁতেলদের রুমে এসে পরলাম। অবশ্য কিছুদিনের মধ্যেই জানা গেল এই দুই জ্ঞানতাপসই টেনেটুনে পাশ করেন! শামিম ভাইয়ের আরও কিছু প্রতিভা জানা গেল কিছুদিনের মাঝেই। উনি যতক্ষন জেগে থাকেন তার পুরোটাই উনি টেবিলে বসে থাকেন কিন্তু ওনার হবি হলো আড়ি পেতে অন্যদের টেলিফোনে কথোপকথন শোনা! এবং এই ভদ্রলোক আবার দাঁত কেলিয়ে বলতেন “আরে প্লাবন তুমি কালকে ফোনে বন্যার সাথে ঝগড়া করছো তাই না, হে হে...”। প্রথম যেদিন হলে উঠলাম সেদিন আমার কম্পিউটার দেখে আঁতকে উঠে বললেন “এইটা কি?”। আমিতো অবাক। ভুল করে কম্পিউটারের বদলে অ্যাটম বোমা নিয়ে আসলাম নাকি। মিনমিন করে বললাম “ভাইয়া প্রোগ্রামিং শেখায় তো তাই কম্পিউটার লাগে।” কিছুদিনের মাঝেই দেখা গেল আমার কম্পিউটার ওনার হিন্দী সিনেমা দেখার খুব ভালো একটা যন্ত্র হয়ে গেছে!
আমার বেডমেট (৩ ফুট বাই ৭ ফুট বেডে দু’জন থাকতে হতো) ছিল ইকবাল।দেখা গেলো সেও খুব টেবিল অন্তঃপ্রান। পেপার পড়ে টেবিলে বসে, গল্পের বই পড়ে টেবিলে বসে এমনকি হেডফোনে গানও শোনে টেবিলে বসে বসে! আমি ওকে ঠাট্টা করে বলতাম “ইকবাল তুমি সব কিছুর সাথে যদি টেবিলে ঘুমিয়েও নিতে তাহলেও তো আমি একটু আরাম করে ঘুমাতে পারতাম। ”
উল্টোদিকের বেডে ছিলো প্লাবন। দিব্যি হাসিখুশি ছেলে কিন্তু কেন জানি গার্লফ্রেন্ডের সাথে ঝগড়া লেগেই থাকতো। আর সে কি ঝগড়া। ঝগড়ার এক পর্যায়ে আছাড় মেরে মোবাইল ভেঙ্গে ফেলতো। আমার সামনেই এক বছরে তিনটা মোবাইল ভেংগে ফেললো। আমি আর কবির ভাই অনেক বুঝিয়েও ওর এই অভ্যাস পাল্টাতে পারলাম না। আমরা ওকে খেপাতাম “তুই না সাইকোলজির ছাত্র, তোর তো নিজের উপরই কন্ট্রোল নাই, তুই কিভাবে অন্যদের সাইকোথেরাপী দিবি?”। কিন্তু অদ্ভূত হলেও সত্যি ও সাইকোথেরাপী দিতো খুব ভালো। মাঝেই মাঝেই দেখতাম ওর এক বন্ধু জামালপুর থেকে আসতো সাইকোথেরাপী নিতে। ও বলতো যে কোন সমস্যায় প্লাবনের সাইকোথেরাপী নাকি খুব কাজে দেয় ওর। কিন্তু প্লাবনের নিজের থেরাপী ওর উপরেই কেন কাজ করতো না কে জানে। ওর আরেকটা মজার ব্যাপার ছিলো ও রুমমেটদের কেনা খাবার (বিস্কুট,আপেল...) দিব্যি নিজের মনে করে খেতে থাকতো!
কিছুদিন পরে ফুয়াদ ভাই রুম পালটে চলে গেলে আমরা রুমমেট হিসেবে পেলাম জুলজি’র ফারহানকে। ছেলেটা নিজের মতো থাকতো। কিন্তু দেখা গেল ও চলন-বলনে খুব কুল হলেও কেন জানি সব সময় ওর খুব হট লাগে। মাঘ মাসের শীতেও ওর ফ্যান ছাড়া লাগতো! তখন ওর বেডমেট ছিলাম আমি, আর ছোটবেলা থেকেই আমার শীত লাগে বেশি, ফলাফল আমার অবস্থা দফারফা। ফারহান খুব সেজেগুজে থাকতে পছন্দ করতো।প্রতিদিন খুব সকালে উঠে ও ক্লিন শেভ করে পারফিউম দিয়ে ক্লাসে যেতো। আমি প্রতিদিন ঘুম থেকে উঠতাম ওর পারফিউমের গন্ধে।
আর ছিলেন আমাদের সবার কবির ভাই। আমাদের সবাইকে উনি দেখে শুনে রাখতেন। আমাদের সবার যত সমস্যা, ক্ষোভ, হতাশা আমরা সব গিয়ে কবির ভাইয়ের সাথে শেয়ার করতাম। ওনার মত ধীর স্থীর মানুষ আমি আর পাইনি। এমনকি শামিম ভাই এক রাতে কথা কাটাকাটির এক পর্যায়ে ওনার চোখে ঘুষি মেরে বসলেও ওনাকে আমি উত্তেজিত হতে দেখিনি। ওই ঘটনায় অবশ্য শামিম ভাইকে আমরা রুম থেকে বের করে দিয়েছিলাম। আর তো ছিলো ওনার নেতৃত্বে আমাদের দেশ উদ্ধার প্রকল্প। কবির ভাইয়েরও পড়াশোনা বাদে সব কিছুতে ব্যাপক উৎসাহ।স্কাউটিং, বিতর্ক, সাংবাদিকতা কি করেন নি উনি। ওনার মাথায় সব সময়ই বিভিন্ন ব্যবসা কিলবিল করতো আর উনি আমাকে আর প্লাবনকে টানাটানি করতেন শেয়ারে ব্যবসা করার জন্য।
সময়ের পরিক্রমায় তাদের কেউই আজ আর ১০১২ তে নেই শুধু আমিই রয়ে গেছি। আজও মিস করি তাদের। মাঝে মাঝে হাপিয়ে উঠি এই হল লাইফে। তবুও সান্ত্বনা, আসছে গরমকাল আবার জমবে আড্ডা পুকুরপাড়ে!!

অনুগ্রহ করে অপেক্ষা করুন। ছবি আটো ইন্সার্ট হবে।




