somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

শৈশবের রমজান মাস

১৪ ই এপ্রিল, ২০২১ দুপুর ২:৩০
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

মানুষের জীবনে একটা সময় আসে যখন পুরোনো স্মৃতির অ্যালবামের পাতা উল্টাতে বড় ভালো লাগে। ইংরেজিতে এটাকে বোধহয় নস্টালজিয়া বলে।

কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের একটি গান আছে- “পুরানো সেই দিনের কথা ভুলবি কি রে হায়…”

এটি একটি নস্টালজিক গান। নস্টালজিয়ার স্মৃতি বিজড়িত এই গান বা এই ধরনের গান বিশ্বের বিভিন্ন ভাষায় হয়তো রয়েছে।

“পুরানো সেই দিনের কথা ভুলবি কি রে হায়। ও সেই চোখে দেখা, প্রাণের কথা, সে কি ভোলা যায়।“

কেউ কি বলতে পারবে যখন এই গানটি বাজে একটা বারের জন্যে হলেও অতীত তাকে স্পর্শ করে না।

রোজার মাস এলেই আমার বুকের ভিতর উথালপাথাল করে, মনে পড়ে যায় আমাদের সেই শৈশবের রোজার সময়ের কথা।

রোজার মাসকে বলা হয় সংযমের মাস। আমাদের শৈশবে আমরা অতটা সংযমের অর্থও বুঝতাম না। আমাদের কাছে রোজা ছিল, সারাদিন না খেয়ে থেকে রোজা রাখা আর ইফতারের সময় মজার মজার খাবার খাওয়া। রোজার মাসটা ছিল আমাদের আনন্দের মাস।

রোজার সময় দাদার অভ্যাস ছিল ইফতারে তার সব সন্তান ও নাতী নাতিনদের নিয়ে একসাথে, পাটি বিছিয়ে ইফতার করবেন। দাদী ছিলেন মূল কর্তা। তিনি থালায় ইফতার সাজিয়ে রাখতেন । দাদা ডাকতেন, “এই কই তোরা ইফতারের সময় হয়ে এলো। রোজা ভাঙ্গার আগে ইফতার সামনে নিয়ে বসে থাকতে হয়”।

আমরা ছুটে এসে একেকটা প্লেটের সামনে বসে পড়তাম। নিজের প্লেটে চোখ বুলিয়েই ট্যারেট্যারে অন্য প্লেটের দিকে তাকাতাম- আমার প্লেটে সব পেয়েছি তো। অন্য কোনো প্লেটে দাদী ভুল করে বেশি দেয়নি তো। দাদার প্লেটে সব সময়ই দাদী কিংবা মা একটু বেশি দিতেন। তাতে আমরা যারা ছোট ছিলাম দাদার প্লেটে বেশি দেখলে আনন্দই হতো, কারণ দাদা আস্তে আস্তে তাঁর আশেপাশে যারা বসতো এটা ওটা তাদের পাতেই তুলে দিতেন। অবশ্য আমিই বেশিরভাগ সময় দাদার পাশে বসতাম। এখনকার সন্তানেরা, কিংবা আমরা বাবা না হওয়া পর্যন্ত কখনও বুঝবো না- বাবা মা বা দাদা দাদী যখন তাদের প্লেট থেকে কিছু তুলে দেন বুকের ভিতরের আনন্দের কাঁপুনিটা কেমন।

সবার সামনে প্লেটে সাজানো ইফতার। দাদার সামনে একটা হাফ প্লেটে থাকতো খোসা ছাড়ানো পানিতে ভেজানো ছোলার ডাল, মিহি করে কাটা আদার কুচি, পাশে এক বা দুই টুকরো কাগজি লেবু।

দাদা নিজেই মাঝে মাঝে এই ভেজা ছোলা, আদা কুচির সাথে লেবুর রস চিপে চামচ দিয়ে আলতো নেড়ে মেশাতেন। মিশিয়ে নিজের প্লেটে নিয়ে আমাদের প্লেটেও অল্প দিতেন আর বলতেন “ইফতারের খাবার মুখে দেওয়ার আগে সরবত খেয়েই আগে এইটা খাবে। চিবিয়ে চিবিয়ে খাবে। তাহলে ইফতারের খাবার ভালোভাবে হজম হবে”।

জিনিসটা খেতে আমাদের খুব একটা ভালো লাগতো না। খেতে চাইতাম না। কাচা ডালের গন্ধ। তাছাড়া মন পড়ে থাকতো গরম পেঁয়াজু, ছোলা আর পেঁয়াজ দিয়ে ভাজার প্রতি। এখন বুঝতে পারি ওই ছোলা, আদা আর লেবু হজমের জন্যে কতটা উপকারী ছিল।

সারাদিন পানি না খাওয়া, খাবার না খাওয়া মুখের ভিতরটা শুষ্ক, শুন্য পাকস্থলি। আমরা জানতাম রোজার সময় থুথুও গেলা যায় না। আবার সঙ্গী-সাথী অন্যদের, আমি যে রোজা আছি তা জানানোর জন্যে কাউকে সামনে পেলেই বেশি বেশি থুথু ফেলতাম। যার ফলে দিনের শেষে মুখের ভিতরটা একেবারেই শুকিয়ে থাকতো, ঢোক গিলতেও কষ্ট হতো।

মুখের ভিতরে আনাচে কানাচে, জিহ্বায়, মুখের তালুতে ছোট ছোট গ্রন্থিগুলি যা লালা নিঃসরণ করে ওগুলোও নির্জীব হয়ে থাকতো। লেবুর রস মুখে যাওয়ার সাথে সাথে মুখের ছোট ছোট লালা গ্রন্থিগুলোকে সক্রিয়, জীবন্ত করে তুলতো।

আমরা ছোটরা সব রোজা রাখতে পারতাম না। মা বলতেন, দাদি বলতেন, “যখন বড় হবে তখন সব রোজা রেখো সোনামনিরা। তোমরা যে কয়টা রাখছো তাতেই আল্লাহ মহাখুশি হবেন"। আবার রোজার রেখে যখন কাহিল হয়ে যেতাম দাদী কিংবা মা তারা বলতেন দুপুরে খেলে অর্ধেক রোজা হবে, তাহলে আজ অর্ধেক আর আগামীকাল অর্ধেক করলে একটা রোজা হয়ে যাবে। আমরা ছোটরা একেকটা রোজা শেষ করতাম আর হাতের কড়ে গুনতাম আমার কয়টা রোজা হলো।

আমার সবচেয়ে বড় প্রতিযোগী ছিল আমার থেকে ২২ দিনের ছোটো এক বোন। ওর চেয়ে একটা হলেও বেশি রোজা আমাকে করতে হবে, তাই ক্ষনেক্ষনে তাকে জিজ্ঞেস করতাম রোজা ভেঙ্গেছিস কিনা। আবার সঙ্গী-সাথিদের, পাড়ার সমবয়সীদের জিজ্ঞাসা করতাম তারা কয়টা রেখেছে। ওরা আবার আমার থেকে বেশি রোজা রাখলো না-তো। বেশি রাখলে খারাপ লাগতো নিজের।

ইফতার শেষে মাঝে মাঝে তরমুজ, বাঙ্গী, পেপে খাওয়া হতো। তখন আমাদের গ্রামে ফ্রিজ ছিল কিনা জানিনা, আমাদের ছিল না। দাদা বাগান থেকে পেপে, বাঙ্গী আনতেন কিংবা মাঝেসাজে বাবা বাজার থেকে আস্ত তরমুজ কিনে আনতেন। সেই তরমুজ বা পেপে সারাদিন রেখে দেওয়া হতো মাটির তৈরি বড় বড় নাইন্দে। টিউবওয়েল এর বরফ শীতল পানিতে ভরা “নাইন্দে” রাখার কারণে তরমুজ, পেপে বা বাঙ্গী ঠাণ্ডা থাকতো।

ইফতার শেষ করে, নামাজ পড়ে এসে মা কিংবা দাদী বারান্দায় বসে বটি দিয়ে তরমুজ কাটতেন, আমরা সবাই ঘরে দাদাকে ঘিরে বসে থাকতাম। তরমুজের প্রথম ফালি দাদাকে দিয়ে দাদী দিতেন তার সন্তান, তারপর আমাদের।

আহারে। কি যে মজা লাগতো খেতে। ঠাণ্ডা তরমুজ লাল অংশে সামনের সারির দাত দিয়ে কামড় দেয়ার সাথে সাথে মুখ মিষ্টি রসে ভরে যেত। তরমুজের ফালির উপরের লাল অংশ খাওয়া হয়ে গেলে নিচের সাদা অংশে দাদী লবন ছিটিয়ে দিতেন আর বলতেন “খাও সোনা মানিকরা, কামড়িয়ে কামড়িয়ে খাও, এগুলো তে অনেক পুষ্টি আছে”।

মাঝেসাজে আখ পাওয়া যেত, দাদা, বাবা কিংবা বড়চাচা মাঠ থেকে আনতেন। মাঝে মাঝে আমরাও আনতাম। আখ খেতে হয় শব্দ করে, পরিবেশ পারিপার্শ্বিকতা ভুলে।

আখ খাওয়ার সময় মুখের হা বড় করতে হয়। আখের আগা মাড়ির দাঁত দিয়ে চেপে কামড়ে ধরে হাতের হ্যাচকা টানে আখ ছিলতে হয়। হ্যাচকা টানে পর পর শব্দে উপরের ছাল (ছোকলা) উঠে আসে। এভাবে কয়েক টানে চারিদিকে সুন্দরভাবে ছেলার পর আখের মিষ্টি নরম, রসালো অংশ বেরিয়ে পড়ে। ব্যস, এখন আখের ছেলা অংশের বেশ খানিকটা মুখে দিয়ে আবারো মাড়ির দাঁত দিয়ে কামড়। মুখের ভিতর আখের নরম একটা মিস্টি রসালো টুকরো। মাড়ির দাত দিয়ে চিবানোর সময় মিষ্টি রসে মুখ ভরে যায়, আবেশে চোখও বুজে আসতে চায়। মুখের দুইপাশ দিয়ে মুখের ভিতর থেকে রস বেরিয়ে আসতে চায়, আসেও কিছুটা। ইফতারের পর, বাসার উঠোনে বেঞ্চ পেতে কখনো ঘরের দুয়ারে পাটি বিছিয়ে বসে পাল্লা দিয়ে আখ খাওয়ার আনন্দ, তৃপ্তি আর কি কখনও আসবে আমাদের জীবনে?

রোজার সময় সেহেরিতে উঠে খাওয়াও ছিল বিশাল আনন্দের ব্যাপার। আমরা জানতাম সেহেরিতে খেতেই হবে। ঘুম ঘুম চোখে বিছানা থেকে উঠে আসতাম। সেহেরিতে মা রান্না করতেন। বেশির ভাগ ভর্তা আইটেম থাকতো দুই বা ততোধিক। সিদ্ধ ডিমভর্তা, ডাল ভর্তা, আলু ভর্তা, করলা ভর্তা, ওল কচু ভর্তা, আর মাঝেমধ্যে পুকুরের মাছ। গরমভাতের গন্ধ, সেই সাথে ডাল ভর্তা, ডিমভর্তার গন্ধ সেহেরির পরিবেশটা কেমন যেন পবিত্র করে রাখত।

সেহেরির প্রধান আইটেমই থাকতো দুধভাত। দাদা দাদি ও বাবা-মা সহ আমাদের সবার দুধ-ভাত ছিল একটা প্রিয় খাবার। বিশেষ করে দুধ-কলা। যখন কলা থাকতো না তখন খেতাম দুধের সাথে খেজুরের পাটালি গুড়।

প্রথমে ভর্তা বা ছোট মাছের চচ্চড়ি দিয়ে অল্প একটু ভাত খাওয়ার পর মা বা দাদী সবার থালায় দুধ আর ভাত দিতেন। দাদী বাক্স থেকে কলা বের করে ছিলে ছিলে সবার থালায় দিতেন। আমি আবার বলতাম মাখিয়ে দাও। দাদি কলা ছিলে দুধ ভাতের সাথে মাখিয়ে দিতেন। খাওয়ার শেষের দিক থালায় কিছু কলা মিশানো দুধ রয়ে যেত। দাদা বলতেন, দুধগুলো চেটে খাও, চেটে খাওয়া সুন্নত। আমরাও খেতাম।

আমার এক চাচির একটা কাপড় সেলাই এর সিঙ্গার মেশিন ছিল। সারা বছরই মেশিনে কিছু না কিছু সেলাই করতেন। মেশিনটিও ভীষণ ব্যস্ত হয়ে উঠতো ঈদের আগে। চাচির পায়ে বিরামহীন মেশিনটি ঘুরে চলতো, খটাখট, খটাখট, খটখটখট….। পাড়ার সবাই কে কি বানাচ্ছে তার একটা আইডিয়া পেতাম। ১০-১৫ দিন আগে থেকেই বাড়ীতে ঈদ ঈদ আমেজ চলে আসতো।

রোজা যে কয়টাই রাখি, প্রথম রোজা, সাতাশের রোজা আর শেষ রোজা রাখতেই হবে। দাদী আর মা বলতেন “তোমরা ছোটরা প্রথম আর শেষ রোজা রাখলেই হবে”।

শেষ রোজার দিন সকাল থেকেই বুকের ভিতর খুশির কাঁপুনি। রাত পেরোলেই ঈদ। আবার বুকের ভিতর সংশয়, অনিশ্চয়তা। যদি পরের দিন ঈদ না হয়। সন্ধ্যা বেলা যদি ঈদের চাঁদ না ওঠে। ভিতরে এক রকমের ছটফটানি। এই ছটফটানি নিয়েই জুতো জোড়া নিজ হাতে কালি করতাম। বার পালিশ করতাম। বাবা কয়লার আগুনের ইস্তিরি দিয়ে ইস্তিরি করে রাখতেন বাবা দাদাদের পাঞ্জাবি।

শেষ রোজার দিন দুপুরের পর থেকেই অস্থিরতা আরও বেড়ে যেত। বার বার পশ্চিম আকাশে চোখ চলে যেত। সূর্য পশ্চিম আকাশে ঢলে পড়ার আগেই কলোনির উন্মুক্ত জায়গায় মানুষ জমতে শুরু করতো, কেউবা রাস্তায় কেউবা একতালা বাড়ির ছাদে। কিংবা মসজিদ প্রাঙ্গণে।

বড়রা ধীর স্থির, একেক জায়গায় জটলা পাকিয়ে গল্প করতো। যত টেনশন যেন আমাদের, ছোটদের। একবার বাসার বাইরে, একবার ভিতরে, বার বার উকি দিয়ে দেখতাম বাবা আসছেন কিনা। সবাই যদি চাঁদ দেখে ফেলে, আমি যদি দেখতে না পাই। কিংবা আমার সমবয়সীরা যদি চাঁদ দেখতে পায়, অথচ আমি যদি দেখতে না পাই। টেনশনে বুক ধড়ফড় করতো।

সূর্য পশ্চিম আকাশে ডুবে গেছে। গাঢ় কমলা রঙের আভা পশ্চিম আকাশে একেবারে মাটির কাছাকাছি। পশ্চিম আকাশের সন্ধ্যা তারা হালকা আলো ছড়িয়ে মিটিমিটি করে জ্বলছে। এখন সবাই পশ্চিম আকাশের দিকে তাকিয়ে আছে। ঠিক পশ্চিম আকাশেই যেখানে সূর্যটা ডুবে গেছে তার একটু উপরেই ছোট ছোট কয়েকটা কালো মেঘের ভেলা। এই একটা রহস্য। সব সময় দেখেছি ঈদের নতুন চাঁদ ওঠার সময় সবাই যখন সূক্ষ্ণ একফালি হালকা ফ্যাকাসে রঙের চাঁদ খুঁজতে ব্যস্ত থাকতো কোত্থেকে যেন কয়েক খণ্ড মেঘের ভেলা ঠিক ওই আকাশেই এসে হাজির হতো। সবাই মাথা উঁচু করে পশ্চিম আকাশে চাঁদ খুঁজছে। এক চিলতে চিকন চাঁদ- যেন এই দেখি, এই নেই। নজরে পড়ত, আবার মুহূর্তেই মিলিয়ে যেত। ফের খুঁজে পেলে আঙুল ঘুরিয়ে চিৎকার করে অন্যদেরকে দেখাতো। কেউ দেখতে পেত, কেউ পেত না। এ যেন কি এক অপূর্ব প্রতিযোগিতা।

স্বচোখে চাঁদ না দেখে ঈদ উদযাপনে যেন কোন মজাই নেই। হঠাৎ কেউ একজন চেঁচিয়ে উঠত, ঐ যে, ঐ যে চাঁদ । সবাই, বিশেষ করে আমরা ছোটরা দৌড়ে তার কাছে ছুটে যেতাম। কই, কই চাঁদ? ভিতরে প্রচণ্ড উৎকণ্ঠা আমি কি দেখতে পাবো না। আমার সমবয়সী ছেলে মেয়েরাও এক সময় দেখতে পায়। আমি পাইনে। কি যে কষ্ট বুকের ভিতর। সবাই যেদিকে তাকাচ্ছে, যেভাবে বলছে সে ভাবেই তাকাচ্ছি, যেদিকে আঙ্গুল দিয়ে দেখাচ্ছে সেদিকেই তাকিয়ে আপ্রাণ ভাবে খুঁজি, চোখ জ্বালা করে তারপরেও চোখের পাতার পলক ফেলি না।

পাড়ার মুরুব্বিরা কেউ কেউ কাছে এসে বলে, কিরে চাঁদ দেখছিস? কালো মুখ উজ্জ্বল করে, আমি ফ্যাকাসে হেসে বলি "দেখছি"। আমার আবারও কান্না এসে যায়। আমি তখনও দেখতে পাইনি।

বাবা কিংবা বড়চাচা পাশে এসে দাঁড়িয়েছেন- “কি রে চাঁদ দেখতে পাসনি”? বলেই আমাকে কাঁধে তুলে নেয়, নিজের কাঁধে বসিয়ে বলেন “ঐ যে দুরে যে একটা তারা দেখা যাচ্ছে তার ডান দিকে তাকিয়ে থাক, খুব আবছা আলোর রেশ, খুব চিকন আর বাঁকা”। আমি পশ্চিম আকাশে তাকাতেই মূহূর্তেই দেখতে পাই। বিশ্বাস হয় না, আবারও তাকাই, “বাবা ও বাবা আমি দেখতে পাচ্ছি, আমি দেখতে পাচ্ছি চাঁদ”, চিৎকার করে বলে উঠি। বাবা বলেন, “পাগল ছেলে। চাঁদ কে সালাম দাও। ঈদের চাঁদকে সালাম দিতে হয়”।

বাসায় গিয়েই মাকে বলি, দাদি কে বলি “আমি ঈদের চাঁদ দেখেছি”। দাদি বলেন, “ঈদের চাঁদকে সালাম দাও নাই”? বলতে বলতে দাদি আবার রান্না ঘরে চলে যান, কত কাজ তার।

ওদিকে চাচাতো বোনেরা পাটায় মেহেদির পাতা বাটছেন। বোনেরা হাতে মেহেদি লাগাবে, আমরা ছোটরাও লাগাবো। ছেলেরা শুধু দুই কেনি আঙ্গুলে লাগায়। আর আমার মতো বেশি ছোট ছেলে হাতের তালুতে গোল করে লাগাতে পারে। মেহেদি লাগিয়ে হাত উচু করে ঘুমাতে যাই, যেন মেহেদি বিছানায় না লাগে, মেহেদি হাত থেকে খুলে না পড়ে। সকালে আবার বোনদের সাথে মিলিয়ে দেখতে হবে কারটা বেশি লাল হলো। প্রথমেই পানি দিয়ে ধুয়ে ফেললে লাল রঙও কিছুটা চলে যেতে পারে। তাই মেহেদি আলতো করে তুলে ফেলে সরিষার তেল দিয়ে মুছে নিয়ে কিছুক্ষণ পর পানি দিয়ে ধুয়ে ফেলতাম।

নামাজে যাওয়ার আগে সকালে আমরা সবাই সেমাই খেয়ে নামাজে যাবো। নামাজ শেষে বাসায় এসেই গরুর মাংশ আর কালাই এর ডালের ভুনা খিচুড়ি খাবো। তার প্রস্তুতি এই রাতেই হচ্ছে। খাঁটি ঘিয়ে সেমাই ভাজা হচ্ছে। মুগের ডাল ভেজে রাখছেন। পাটায় মসলা বাটা হচ্ছে। মা খুব ভোরে আমরা ঘুম থেকে ওঠার আগেই রান্নাগুলি চুলোয় চড়িয়ে দেবেন।

ঈদের দিনের সকাল। বের হওয়ার সময় দাদা ছেলেদের সবার গায়ে একটু আতর মেখে দিতেন। চোখে সুরমা দিয়ে দিয়েছেন। নতুন জামার গন্ধ, সেই সাথে আতরের, এটাই বুঝি ঈদের গন্ধ, আনন্দের গন্ধ।

সবাই পাঞ্জাবি পড়লেও আমরা ছোটোরা নতুন শার্ট আর পাজামা পড়ে দাদা, বাবা, চাচা আর ভাইদের সাথে নামাজে যাই। বার বার আড়চোখে নিজেকে দেখি, অন্যদের দেখি, মনে হয় সবাই আমার নতুন শার্টটার দিকে তাকিয়ে আছে। সুরমা চোখে দিলে বেশ কিছু সময় চোখে কচ কচ করে ফোটে। তবুও চোখে হাত দিয়ে ডলি না। মুখে মৃদু হাসি হাসি ভাব, বুক ভরা এক অনাবিল আনন্দ।

নামাজ থেকে এসেই আমাদের প্রথম কাজ ছিল বাবা মা আর দাদা-দাদি কে সালাম করা। এর মধ্যেই মা গোসল সেরে নতুন শাড়ি পরে আসতেন, চুল আঁচড়াতেন, কিন্ত ভেজা চুল দিয়ে তখনো টপ টপ করে পানি পড়ত। বাবাকে আর দাদাকে সালাম করে দাদীকে সালাম করতাম, দাদি নিচু হয়ে বুকে চেপে ধরতেন। বুকে টেনে আলতো করে কপালে ছোট একটা চুমু দিয়ে বলতেন, “আমার সোনামনিকে আল্লাহ অনেক হায়াত দাও।”

আবার মায়ের কাছে সালাম করতে গিয়ে মায়ের বুকের ভিতর থেকে সরতে ইচ্ছে হতো না। সদ্য গোসল করা, ঠাণ্ডা শরীর, মুখে পন্ডস ক্রিম, গায়ে ট্যালকম পাউডার, নতুন শাড়ির গন্ধ সব মিলিয়ে অদ্ভুত সুন্দর একটা গন্ধ- যে গন্ধের জন্ম এই পৃথিবীতে না।

আমরা নামাজে থাকাকালীন, মা গরুর মাংশ আর চিকন চাল এর সাথে সাথে কালাই এর ডালের খিচুড়ি রেঁধে ফেলতেন। পুরো বাসা চমৎকার এক ধরনের গন্ধে ভরে উঠতো। এটি কোনো তীব্র গন্ধ না, খাওয়ার লোভে জিভের পানি আসা গন্ধ না। এটি একটি ইচ্ছে জাগানিয়া গন্ধ, আনন্দের গন্ধ। বাসার কোথাও কোনো পারফিউমের গন্ধ নেই, কেউ কোনো পারফিউম মাখেনি, তবুও কী চমৎকার একটা গন্ধে সারা বাসা ভরে থাকতো। দুপুর বারোটার ভিতর দুই চোট খাওয়া হতো। তারপর দুপুরে বিটিভি তে সিনেমা দেখতাম।

রাতে আমরা তারাবাজি, হাউইবাজি পটকা পোড়াতাম। হাউইবাজি পটকার বেড়িয়ে আসা সুতাতে ম্যাচের কাঠি জ্বালিয়ে আগুন দেওয়ার সাথে রকেটের মতো, হাওয়ার বেগে আকাশে অনেক উচুঁতে উঠে যেত। উপরে উঠে এক সময় ফুটে উঠতো। আগুনের ফুলকি ছড়াত। আমরা, ওরা সবাই আকাশের পানে চেয়ে থাকতাম। কি অপূর্ব দৃশ্য, কি আনন্দ! যেন প্রকৃতি গেয়ে উঠতো, “আনন্দধারা বহিছে ভুবনে, দিন রজনী কত অমৃতরস উথলি যায় অনন্ত গগনে ”

*
আমার কল্পনা করতে ভালো লাগে। শিশুকাল থেকেই, আমার মাথার ভিতর হরেক রকম ইচ্ছের পোকা সব সময় কিলকিল করতো, এখনও করে। অনেক ছোট বেলায় যখন গ্রামে ছিলাম, শীতের সূর্য পশ্চিমে হেলে পড়া দুপুরে, খেজুর গাছ কাটা গাছি যখন কোমরে বাঁধা ছোট ঝুড়িতে ধারালো দা, বাঁশরে নল, মাটির হাঁড়ি আর মোটা দড়ি নিয়ে খেজুর গাছের আগায় উঠে কোমরে মোটা দাড়িটি দিয়ে নিজেকে বেঁধে ধারালো দা দিয়ে কুচকুচ করে খেজুর গাছ চাঁছতো । আমি মুগ্ধ নয়নে উপরে চেয়ে গাছিটির খেজুর গাছ চাঁছা দেখতাম। পরের দিন সুর্য ওঠার আগেই গাছি এসে খেজুরের রসের হাঁড়ি নামিয়ে আনতো। গাছি গাছ তলায় আসার আগেই আমি ঘুম থেকে উঠে মাঘ মাসের শীতের সকালে ঠান্ডায় কাঁপতে কাঁপতে গাছ তলায় এসে বসে থাকতাম। প্রতিটি গাছ থেকে গাছি রসের হাঁড়ি নামিয়ে আনতো । আমি তার পিছু পিছু ঘুরতাম । মুগ্ধ নয়নে তার প্রতিটি কর্মকান্ড দেখতাম। গাছি হয়ে ওঠে আমার কাছে শ্রেষ্ঠ মানুষ। মনের ভিতর কল্পনার স্বপ্ন করতাম, আমি বড় হয়ে খেজুর গাছ কাটা গাছি হবো।

তবে অতীত নিয়ে, শৈশব নিয়ে ভাবতে আমার ভালো লাগে। এটুকু বুঝি আমার শৈশব, আমার অতীত, আমার আত্মাকে বাঁচিয়ে রাখছে। শুধু তাই নয় আমার শৈশবকে সম্বল করেই আমি কল্পনার হাওয়ায় ভাসতে থাকি। আমি আনন্দের সাগরে হাবুডুবু খাই। আমার কল্পনার রাজ্যে শুধু ঈদের দিনটি নয়, প্রতিটা দিন হয়ে ওঠে আনন্দময়। আনন্দে আমার চোখ দুটি ভিজে ওঠে।

যদি কোনো পূণ্য করে থাকি, তার বদৌলতে পরমকরুণাময় আল্লাহ তায়ালা যদি আমাকে জিজ্ঞাসা করেন আমি কী চাই- আমি মাথা নত করে, মিনমিনিয়ে আবেগে আপ্লূত হয়ে, কান্না ভেজা স্বরে তার কাছে একটা জিনিসই চাইবো, “দয়াময় আমি চাইনে ধন সম্পত্তি, চাইনে রূপবতী, ….। আমাকে আমার শৈশবের দিনগুলি ফিরিয়ে দিন– যেখানে ৫-৭ বছরের এই আমি নামজ শেষ করে বাসায় এসে প্রথমেই মায়ের পায়ে হাত দিয়ে সালাম করবো। মা তার দুই হাত দিয়ে আমাকে তুলে ধরবেন। সদ্য গোসল করে এসেছেন মা, নতুন শাড়ি পরেছেন। মুখে একটু পন্ডস ক্রীম মেখেছেন। মায়ের গায়ে নতুন শাড়ি, গায়ে মাখার সাবান আর ক্রিমের এক মিশ্রিত অপূর্ব গন্ধ। মা আমার মাথাটা নিজের বুকের সাথে চেপে ধরবেন। আমি ভেজা গলায় ফিসফিসিয়ে বলবো, মাগো আমায় একটু আদর করোনা, মা”

বড় হয়ে যাবার এই বিড়ম্বনা৷ ভালোবাসার কথা মুখ ফুটে বলতে পারিনা। দাদা দাদি বাবা মা আর আমার শৈশব তোমাদের অনেক ভালোবাসি।

- রাসেল
১৪ এপ্রিল ২০২১
বুধবার
সর্বশেষ এডিট : ১৪ ই এপ্রিল, ২০২১ দুপুর ২:৩১
২টি মন্তব্য ০টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

কুড়ি শব্দের গল্প

লিখেছেন করুণাধারা, ২৪ শে এপ্রিল, ২০২৪ রাত ৯:১৭



জলে ভাসা পদ্ম আমি
কোরা বাংলায় ঘোষণা দিলাম, "বিদায় সামু" !
কিন্তু সামু সিগারেটের নেশার মতো, ছাড়া যায় না! আমি কি সত্যি যাবো? নো... নেভার!

সানমুন
চিলেকোঠার জানালায় পূর্ণিমার চাঁদ। ঘুমন্ত... ...বাকিটুকু পড়ুন

ধর্ম ও বিজ্ঞান

লিখেছেন এমএলজি, ২৫ শে এপ্রিল, ২০২৪ ভোর ৪:২৪

করোনার (COVID) শুরুর দিকে আমি দেশবাসীর কাছে উদাত্ত আহবান জানিয়ে একটা পোস্ট দিয়েছিলাম, যা শেয়ার হয়েছিল প্রায় ৩ হাজারবার। জীবন বাঁচাতে মরিয়া পাঠকবৃন্দ আশা করেছিলেন এ পোস্ট শেয়ারে কেউ একজন... ...বাকিটুকু পড়ুন

তালগোল

লিখেছেন বাকপ্রবাস, ২৫ শে এপ্রিল, ২০২৪ সকাল ৯:৩৫


তু‌মি যাও চ‌লে
আ‌মি যাই গ‌লে
চ‌লে যায় ঋতু, শীত গ্রীষ্ম বর্ষা
রাত ফু‌রা‌লেই দি‌নের আ‌লোয় ফর্সা
ঘু‌রেঘু‌রে ফি‌রে‌তো আ‌সে, আ‌সে‌তো ফি‌রে
তু‌মি চ‌লে যাও, তু‌মি চ‌লে যাও, আমা‌কে ঘি‌রে
জড়ায়ে মোহ বাতা‌সে ম‌দির ঘ্রাণ,... ...বাকিটুকু পড়ুন

মা

লিখেছেন মায়াস্পর্শ, ২৫ শে এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ১২:৩৩


মায়াবী রাতের চাঁদনী আলো
কিছুই যে আর লাগে না ভালো,
হারিয়ে গেছে মনের আলো
আধার ঘেরা এই মনটা কালো,
মা যেদিন তুই চলে গেলি , আমায় রেখে ওই অন্য পারে।

অন্য... ...বাকিটুকু পড়ুন

কপি করা পোস্ট নিজের নামে চালিয়েও অস্বীকার করলো ব্লগার গেছে দাদা।

লিখেছেন প্রকৌশলী মোঃ সাদ্দাম হোসেন, ২৫ শে এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ২:১৮



একটা পোস্ট সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে বেশ আগে থেকেই ঘুরে বেড়াচ্ছে। পোস্টটিতে মদ্য পান নিয়ে কবি মির্জা গালিব, কবি আল্লামা ইকবাল, কবি আহমদ ফারাজ, কবি ওয়াসি এবং কবি... ...বাকিটুকু পড়ুন

×