''ঝাউ তলার ঐ পাশ দিয়ে বহে বেত্রবতী
অশান্ত হয়না কভূ ধীর তার গতি
পাশে আছে হাট বাজার হয় বেচাকেনা
ঝাউডাংগা নাম তার সবার আছে জানা!''
(পল্লী কবি শামসুল হক)
ছোটবেলায় তখন কাঠের ব্রীজ ছিল বেতনা নদীর উপর। আমরা স্কুলে যেতাম। গ্রামের মানুষ হাটে যেত সকালে বিকালে। দুবার জোয়ার ভাটা হতো। জোয়ারে পানি উপচে পড়তো কিনারে। স্বচ্ছ টলমলে পানি। আমার খুব ইচ্ছে হতো এই বেতনা কোথায় শেষ হয়েছে সেই উৎসমূল দেখার। তখন নদী বলতে আমরা বেত্রবতী বুঝতাম। কাঠের ব্রীজের ঐ মাথায় ছিল বিশাল আকারের ঝাউগাছ। ঝাউগাছের একটু পাশে বড় বড় নৌকা বাঁধা থাকতো। ঝাউডাংগার কাপড়ের ব্যবসায়ীরা বড়দল বাজারে যেত হাট করতে। মূলত অধিকাংশ ব্যবসায়ী ছিল পাথরঘাটা গ্রামের। জামাল সাহেবের নৌকাটি ছিল সবচেয়ে বড়। সন্ধ্যায় নৌকা ছাড়ার মুহূর্তে একটা জমজমাট ভিড় লেগে যেত ঘাটে। জোয়ারে ব্যবসায়ীরা নৌকা ভাসাতো।
আমাদের গ্রামের ভেতর একটা ঘাট ছিল। কাপালিঘাট। এখানেও নৌকা ভিড়তো। আমি জানি না এখানে কাপালিক থাকতো কিনা, তবে নীবিড় বাঁশবন এবং নদীর চরের নির্জনতা একরকম খাঁ খাঁ করতো এই এলাকায়। তাঁতের সুতো প্রসেস করার জন্য দরমুজে টানা হতো লম্বা সুতোর বহর। আমরা গরমের ছুটিতে দুপুরে মার্বেল খেলতাম আর কাচা আম বিটলবণ দিয়ে মাখিয়ে খেতাম।
বড়পূজোয় বেতনা জুড়ে বিকাল থেকে বোঝায় থাকতো প্রতিমাবাহী নৌকা। হিন্দীগান, কিশোর কুমারের গান মাইকে করে বাজাতে বাজাতে বাজি পুড়াতো আশেপাশের কয়েক গ্রামের সনাতন ধর্মাবলম্বীরা। গভীর রাতে প্রতিমা বিসর্জন দিত বেতনার বুকে। জগন্নাথ মন্দিরের সামনে বসতো পূজোর মেলা। মাটির পুতুল, গরুর গাড়ি, হাঁড়িপাতিল সহ নানা রকমারি জিনিস বিক্রি হতো।
বেতনা নদীতে সেসময় খুব মাছ পাওয়া যেত। একবার আমরা কজন বন্ধুরা নদী থেকে মাছ আর কাঁকড়া ধরেছিলাম ছাপ্পার ফকিরের চরের দিকে। এই চরে সন্ধ্যায় নাকি গাঁজার আসর বসতো। ছাপ্পার ফকির ছিল আধ্যাত্মিক বাউল সাধক। জীবনকে বাউলিয়ানায় বেঁধে রাতভর মজমা বসতো তার চরে। নিষিদ্ধ সেই গুপ্ত রজনীর কথকথা জনান্তিকে ফিসফাস করতো বেতনার দুরস্ত জলমালায়।
একবার এসএসসির পর বন্ধুরা মিলে নৌকা ভ্রমনে গিয়েছিলাম এই বেতনায়। সে এক অভূতপূর্ব স্মৃতি!! বিনের পোতা পর্যন্ত আমরা নৌকা নিয়ে গিয়ে ভাতের হোটলে ট্যাংরা মাছ আর ডাল দিয়ে পেট ভরে খেয়েছিলাম। নৌকায় সাউন্ডবক্স ভাড়া করে ক্যাসেটে ডিফারেন্ট টার্চের ‘শ্রাবণের মেঘগুলো জড়ো হলো আকাশে’ শুনেছিলাম সারাটা পথ। কিছু ছবি ছিল তা কালের ধূলোয় হারিয়ে গেছে কোথায়….
এই বেতনা ছিল আমাদের গর্বের, আমাদের ঐতিহ্যের আখ্যান।
সেদিন ফেসবুকে একটা পোষ্ট দেখলাম। বেতনা এখন স্থবির এক পানার জলাশয়। বদ্ধ এবং মৃত।
চোখ ভরে পানি এলো, জলহীন বেতনার জলাবদ্ধতায়!! আহা-
নদীটা কি শেষে মরেই গেল!!

সর্বশেষ এডিট : ২২ শে মে, ২০২৩ দুপুর ১২:৪৯

অনুগ্রহ করে অপেক্ষা করুন। ছবি আটো ইন্সার্ট হবে।


