মহাআড়ম্বরে গতকাল পালিত হলো জাতীয় হতবাক দিবস! সবকিছু ঘোষণা দিয়ে হয় না। তাই অঘোষিতভাবে হতবাক দিবস পালিত হলো, বিশেষত ঢাকা এবং চট্টগ্রামে। বিরোধীদলের অবহেলা এবং সরকারি দলের অতি আগ্রহের কারণে জাতি একটি 'হতবাক করা' নির্বাচন উপহার পেলো। নিজেদের বিজয়ী করার জন্য যে নগ্নভাবে দেশের সরকার নির্বাচনী প্রক্রিয়ায় হস্তক্ষেপ করেছে, তা রেকর্ড হয়ে থাকবে।
সিটি কর্পোরেশনের নির্বাচন সবদিক দিয়ে ছিলো একটি গুরুত্বপূর্ণ নির্বাচন। গত বছরের ৫ জানুয়ারির নির্বাচনকে প্রত্যাখ্যান করে এবং নির্দলীয় সরকারের অধীনে আগাম নির্বাচনের দাবি জানিয়ে বিএনপি এবং তাদের শরিক দলগুলো এবছরের ৫ জানুয়ারি থেকে সহিংস আন্দোলনের আয়োজন করে। তিন মাসের অধিক সময় পর্যন্ত প্রায় একনাগারে সারাদেশে অবরোধ ও অবরোধ দিয়েই ক্ষান্ত হয়নি, দেশের অধিকাংশ গণমাধ্যমের মতে তারা পেট্রোল বোমা, চলন্ত গাড়িতে যাত্রীদেরকে জীবন্ত পুড়িয়ে দেশের হাসপাতালগুলোর বার্নই্উনিটগুলো পরিপূর্ণ করে দেয় দগ্ধ মানুষে। সরকার তাদের সমস্ত শক্তি আরোপ করে আংশিক নিয়ন্ত্রণে আনলেও জ্বালাও-পোড়াও আন্দোলনকে পুরোপুরি থামাতে পারে নি। এরকম পরিস্থিতিতে রাজনৈতিক কৌশল হিসেবে হঠাৎ করে ঢাকা ও চট্টগ্রামে সিটি নির্বাচনের ঘোষণা দেওয়া হলে, আন্দোলনকারী দলগুলো দ্বিধায় পড়ে যায়। অবশেষে 'রাজনৈতিক কৌশল' হিসেবে তারা নির্বাচনে অংশগ্রহণের ঘোষণা দেবার ফলশ্রুতিতে তারা আন্দোলনে শীতিলতা আনে। ততদিনে দেশের মানুষসহ তাদের রাজনৈতিক কর্মীরাও দীর্ঘ আন্দোলনের কারণে ক্লান্ত হয়ে পড়ে। অবরোধ কোন ঘোষণা ছাড়াই অকার্যকর পরিণত হয়। তাই জনবিধ্বংসী আন্দোলন থেকে বের হয়ে আসার কৌশল হিসেবেও তারা নির্বাচনে যোগ দেবার সিদ্ধান্ত নেয়।
সিটি নির্বাচনের বাতাস বইতে শুরু করলে দেশের সুশীল সমাজ, দেশের আপামর জনগণ এবং বাংলাদেশের শুভাকাঙ্ক্ষী দেশ ও আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলো স্বস্তির নিঃশ্বাস ছাড়ে। সকলের দৃষ্টি তখন সিটি নির্বাচনের দিকে। জাতিসংঘও নির্বাচনকে গ্রহণযোগ্য করার অনুরোধ পাঠায়। ততক্ষণে বিএনপিও নির্বাচনকে সরকারের সততার জন্য 'টেস্ট কেইস' হিসেবে ঘোষণা দেয়। দুখিনী দেশমাতৃকা আবারও একটি শান্তিময় সমাজের স্বপ্ন দেখতে শুরু করে।
কিন্তু দেশের শান্তিপ্রিয় জনগণকে হতবাক করে সকল নির্বাচনী আচরণকে লঙ্ঘন করে সরকারি দল প্রশাসনের সহযোগিতাকে কাজে লাগিয়ে প্রায় সবগুলো ভোটকেন্দ্র তাদের আয়ত্বে নিয়ে আসে। নিজেদের বিজয়ী করার জন্য এমন কোন অনিয়ম নেই যা তারা করে নি। বিরোধীদলের পূর্ব পরিকল্পনামতো তাদের 'কৌশল' প্রয়োগের সুযোগ পায় এবং তারা ভোট শুরুর কয়েক ঘণ্টা পরই নির্বাচন থেকে নিজেদেরকে প্রত্যাহার করে নেয়।
গত বছরের ৫ জানুয়ারির প্রশ্নবিদ্ধ নির্বাচনে সরকার গঠিত হবার পরে সংঘটিত ৫টি সিটি নির্বাচনে সরকারি দল হেরে যায়। সেই নির্বাচনগুলোতে বিএনপি জোট অংশ নেওয়ায় এবং সরকারের আন্তরিক সহযোগিতা থাকায় ভোটগ্রহণ ছিল নির্বিঘ্ন এবং অনেকটাই সুষ্টু। কিন্তু সরকার হেরে যাওয়ায় আস্থার সংকট সৃষ্টি হয় এবং বিরোধীদল একথা বুঝাতে সক্ষম হয় যে, সরকারের প্রতি জনগণের আস্থা নেই। অতএব এবছরের ঢাকা ও চট্টগ্রাম সিটি নির্বাচনে সরকার বহুমুখী সংকটে পড়ে যায়। একদিকে তাদেরকে নির্বাচন সুষ্টু করতে হবে আবার বিজয়ীও হতে হবে। তা না হলে বিরোধীদলের অনাস্থার দাবিটি আরও জোড়ালো হবে। উভয়মুখী সংকটে পড়ে সরকার মন্দদিকটিই বেছে নিল অবশেষে। নির্বাচনে সকল প্রকার হস্তক্ষেপ করে তারা তিনটি সিটিতে নিজেদের বিজয় নিশ্চিত করে । সরকারি দলের বিজয় হলেও পত্রিকাগুলো একে 'গণতন্ত্রের পরাজয়' হিসেবে চিহ্নিত করে।
আওয়ামিলীগ ক্ষমতায় আসলেই এর সাথে বোনাস হিসেবে আমরা যা পাই তা হলো, একটি অথর্ব বিরোধী দল। এরা না জানে জনগণকে সম্পৃক্ত করতে, না জানে জনগণকে আকৃষ্ট করতে। এর প্রধান কারণ হলো, আমাদের অধিকাংশ রাজনৈতিক দলের কোন নিজস্বতা নেই। এমন কোন স্বকীয়তা এদের নেই, যা অন্য দল থেকে তাদেরকে আলাদা করে। এরা জানে শুধু শক্তি প্রয়োগ করে কীভাবে জনগণকে ক্ষতিগ্রস্ত করা যায়। এর ফলে যা হবার তা-ই হয়: সরকার হয়ে যায় সর্বশক্তিমান ফ্রাঙ্কেনস্টাইন। এবারও বিরোধীদল জনসম্পৃক্ততা সৃষ্টি করতে ব্যর্থ হবে, কারণ এদের কোন আকর্ষণীয় আদর্শ নেই।
*ছবিটি আজকের ডেইলি স্টার থেকে নেওয়া।
সর্বশেষ এডিট : ২৯ শে এপ্রিল, ২০১৫ দুপুর ১:৪৯