প্রথম পথচলা :-
১৫ এপ্রিল মঙ্গলবার ১৯৯৫ সাল । পড়ন্ত বিকাল। সূর্যের তীর্যক রশ্মী গাছের ফাক দিয়ে গড়িয়ে পড়ছে ৪০/৫০ জন উপস্থিত তরুণের উপর। নির্বিকার তাকিয়ে আছে সবাই সামনের টেবিলের দিকে। অতিথি চেয়ারে বসে আছেন :- ১. মাও.কেরামত আলী ২. মু .জাফর আলী ৩. মু. ইউসূফ আলী৪. মু.সেতাউর রহমান ৫. হাফেজ গোলাম আযম । কুরআন তেলাওয়াতের মাধ্যমে প্রগ্রাম শুরু হলো। একটা সাংস্কৃতিক সংগঠন প্রতিষ্ঠার জন্যে এ আয়োজন। তাই আগ্রহটা সবার ছিল অপ্রত্যাশিত। অতিথি, উপস্থিতি সবার উন্মুক্ত আলোচনায়, ইসলামী সংস্কৃতি, শিল্পী, সাংস্কৃতিক সংগঠন, পরিবেশনার পরিধি ,গুরুত্ব ইত্যাদি বিষয়ে পর্যালোচনা হলো। সিদ্ধান্ত হলো একটি শিল্পী গোষ্ঠী প্রতিষ্ঠার । নামের জন্যে শুরু হলো প্রস্তাবনা। ১. দুর্জয় ২. হেরার আলো ৩. মোহনা ৪. আলোর দিশারী ৫. উত্তরণ ৬. আলোড়ন । আরও কত কি প্রস্তাব আসলো। কিন্তু কোন নাম সামগ্রীক উপস্থিতিকে পরিতৃপ্ত করতে পারলো না। সূর্য তার আলো হারিয়ে রাতের সন্ধানে। প্রাণীকূল দিনের কর্মক্লান্তিতে ফিরছে ঘরের সন্ধানে। উপস্থিত সাংস্কৃতিক কর্মীরাও অধীর আগ্রহে প্রহর গুণছে একটি ঠিকানার প্রতীক্ষায়। সবাই চিন্তামগ্ন। নীরবতা ভাঙলেন শিবগঞ্জের সুপরিচিত, বিশিষ্ঠ ব্যবসায়ী নেতা জনাব ইউসুফ আলী। বল্লেন, নামটি সন্ধানী হলে কেমন হয়? সবাই খুশি হলো। সম্মিলিত আনন্দের স্ফুট উচ্চারণ যেন ধ্বনীত হলো।পথভোলা তরুণ সমাজকে সত্য-মুক্তি স্বাধীন জীবনের সন্ধান দিবে সন্ধানী । থাকবে কালের সাক্ষী হয়ে পাঞ্জেরীর ভূমিকায়। সে প্রত্যাশায় সবার পরামর্শে পিঠালীতলার মোশাররফ হোসাইনকে পরিচালকের দায়িত্ব দেয়া হলো। শুরু হলো পথচলা। সবার কন্ঠে যেন সেই দৃঢ়তার সুর ঝংকারিত হলো --
সময়ের প্রয়োজনে, জীবনের প্রতিক্ষণে,
আগামীর সন্ধিক্ষণে, সত্য ন্যায়ের পণে,
শোন হে বন্ধু শোন, তৌহিদের গানে গানে,
নাটকের মঞ্চায়নে, আমাদের উচ্চারণী,
আমরা সন্ধানী! আমরা সন্ধানী!
দুই-পাঁ এগিয়ে, পেছন ফেরা :-
আমাদের স্বপ্ন আর বাস্তবতার মধ্যে একটা ছন্দপতন ঘটলো। লক্ষ্যহীন নাবিকের কিনারাহীন ত্বরী। সম্মিলিত না হয়ে ব্যক্তি কেন্দ্রীক পরিবেশনের প্রতিযোগিতায় ব্যস্ত হলো । সে সমস্তু শিল্পী, যাদের উপর সন্ধানী নির্ভরশীল ছিলো সে সময়ে। চলার পথ হলো রুদ্ধ। কুয়াশাচ্ছন্ন সন্ধানীর ভবিষ্যত। সব কিছুই ফাইল বন্দী হয়ে গেল । ৯৫ থেকে জুন ৯৬ । কর্ম ক্ষমতাহীন সন্ধানী তার সব হারিয়েছে। শুধু নামটিই পড়ে রইলো আমার মত কিছু তরুণের হৃদয়ের গহীনে।
প্রতিষ্ঠার পটভূমি :-
মে ১৯৯৬ সাল। ক্লাস পরীক্ষা মুক্ত অবসর সময়। মনের মধ্যে একটা উদ্যম কিছু করতে উৎসাহ দিচ্ছে। কিন্তু দৃঢ়তার পিছুটান। আদৌ কি আমার দ্বারা কিছু সম্ভব। এমন এক মহূর্তে কালুপুর মধ্যপাড়াই ইসলামী নাটকের আয়োজন হচ্ছে শুনলাম। সে সময়ের ইলামী গানে সুপরিচিতি একজনের ব্যক্তিগত উদ্যোগে। তার বাড়ির সামনে স্বল্প পরিসরে আয়োজন। এলোমেলো ভাবে দাড়ানো হাতে গণাকজন উপস্থিতি । মাইকে একজনের অনবরত ঘোষণা। দ্রুত শ্রতা-দর্শককে প্রোগ্রামে আসার জন্য। প্রগ্রাম হওয়ার কোন লক্ষণ না দেখে তাদের প্রস্তুতি রুমে ঢুকলাম। ছোট একটা রুমে প্রচণ্ড ভিড়। কৌতূহল বৃদ্ধি পেলো। সুদর্শন এক অতিথিকে দেখে বুঝলাম তিনি এ আয়োজনের মধ্যমণি। আয়োজকদের সার্বিক প্রস্তুতিতে অনেকটা বিরক্তি প্রকাশ করে ফিরে যাচ্ছেন। জানতে পারলাম তিনি তৌফিকুল হাসান। আমিও পিছনে বের হলাম। একেতো অন্ধকার অন্যদিকে রাস্তা প্রচুর খারাপ। দুজনে হেটে আসলাম কোর্ট বাজার পর্যন্ত। চলার পথে বললাম আমি একটা নাটকের আয়োজন করতে চাই। আপনাকে বই এবং উপিস্থিতি দিয়ে সহযোগিতা করতে হবে। প্রথমে বিরক্ত হলেও পরে বাসায় ডাকলেন।
তার দেয়া সময়, স্থান মত উপস্থিত। ছত্রাজিতপুর বাজার সে রেস্টুরেন্টে উকি দিতেই ভিতর থেকে একটি আওয়াজ ভাই আসেন। টেবিলে বসতেই চা-নাসতা হাজির। খেতে খেতে অনেক কথা। তার স্বপ্ন একটা সফল আয়োজনের। সেই স্বপ্ন বাস্তবায়নে আমার দৃঢ়তা, পারতেই হবে। নাটকের খাতা নিয়ে ফিরলাম । আদ্যোপ্রান্ত পড়ে মনের কল্পনায় ছবি খুজি। কোন চরিত্রে কেমন ব্যক্তির দরকার। শুরু হলো গ্রাউন্ড-ওয়ার্ক। প্রথম প্রোগ্রাম বাস্তবায়নের জন্য কোটপাড়া, সেলিমাবাদকে বেছে নিলাম। আলোচনার জন্য ইসলামী একাডেমীতে বৈঠক ডাকলাম। সেই সময় প্রত্যক্ষভাবে আমাকে প্রেরণা যুগিয়েছেন তাদের মধ্যে উপস্থিত ছিলেন। মোশাররফ, আমিনুল, আনোয়ার, জিয়াউর, সেলিম, মাইনুল, মাসুদ প্রমুখ। সে বৈঠকে আমরা সিদ্ধান্ত নিলাম। তিন মাস রেহার্সাল। এক মাস প্রোগ্রাম বাস্তবায়নের প্রস্তুতি। একে একে চরিত্র অনুযায়ী অভিনেতা খুজে বের করলাম। মনোনীত অভিনেতাদের মধ্যে উল্লেখযোগ্যরা হলেন,নায়ক- আল হেলাল, খলনায়ক- তৌফিকুল হাসান, সাইড নায়ক- মাসুদ পারভেজ, ভিলেন- সেতাউর রহমান অন্যান্য চরিত্রে- আমিনুল ইলাম, মোশাররফ হোসেন, আনোয়ার হোসেন, কায়েস উদ্দীন, সেলিম আলী, বিশারত প্রমুখ।
প্রশিক্ষণ ও রেহার্সাল :-
শুরু হলো রুটিন মাফিক রেহার্সাল মহড়া। প্রতিদিন বিকাল ৫টা থেকে রাত ১২টা। ইসলামী একাডেমীতে রেহার্সাল দেখার জন্য প্রতিদিনে দর্শক ও বাড়তে লাগলো। নিজেদের অর্থায়নে চা-নাস্তার আয়োজনটা বেশ উপভোগ্য ছিলো। সপ্তাহে ২/১ দিন তৌফিক ভাইয়ের আগমন উৎসাহকে করে আরো তেজদৃপ্ত। গানের রেহার্সাল ও চলছে সমান তালে। সকালে গানের কর্মশালা, রাতে নাটকের মহড়া। এভাবেই জীবনের সব থেকে ব্যস্ততম সময় গুলোর পরিসমাপ্তি ঘটলো। একটানা ৩ মাস পাহাড়সম মমতা, ভালবাসা, দায়িত্ববোধ, নিরবচ্ছিন্ন প্রচেষ্টা, নিবিড় প্রশিক্ষণ, পারস্পারিক পর্যালোচনা ও পরামর্শ, প্রত্যেকের প্রোগ্রাম সফলতার দৃঢ়তা এং মহান আল্লাহর প্রত্যক্ষ মদদের ভিত্তিমূলে আমরা আশান্বিত হলাম।
বাস্তবায়নের চ্যালেঞ্জ:-
আমরা নৈতিকভাবে প্রস্তুত। চ্যালেঞ্জ সামনে প্রোগ্রাম বাস্তবায়নের। এ পথে দরকার এজন অভিভাবকের। আব্দুল খালেক ভাইকে আমাদের উপদেষ্টা মেনে তার অফিসেই বৈঠকে বসলাম। বৈঠকে অর্থনেতিক সাপোর্ট, প্রাচার, উপস্থিতির লক্ষ্যমাত্রা, স্থান, অতিথি এবং সফল উপস্থাপনার বিষয়ে পর্যালোচনা করে অনুষ্ঠানের উপস্থিতি ও অতিথির বিষয়ে বৃহত্তর সংগঠনের প্রত্যক্ষ সহযোগিতা ও অনুমতি গ্রহণের সিদ্ধান্ত হলো। বাকি সকল বিষয় সুসম্পন্ন করার জন্য নিম্নোক্ত ভাইদের দায়িত্ব দেয়া হলো-
১. সার্বিক তত্বাবধান ও পরিচালনা- মোশাররফ হোসাইন
২. অর্থ সংগ্রহ- আমিনুল ইসলাম
৩. স্টেজ ডেকোরেশন, প্রচার, আনোয়ার হোসেন ও সেলিম আলী
৪. প্রচার- জিয়াউ রহমান, মাসুদ পারভেজ
৫. খাদ্য ও আপ্যায়ন- মাইনুল ইসলাম
সেই মাহেন্দ্রক্ষণ :-
২৫ সেপ্টেম্বর বিকাল ৫টা। একাডেমী পাড়ার একটা মাঠে সন্ধানীর প্রথম আনুষ্ঠানিক পরিবেশনা। আলোচনা সভা ও ইসলামী সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান । ২/৩ হাজার উপস্থিতিতে প্রোগ্রাম শুরু করলাম।
অতিথির আসন গ্রহণ করলেন- জনাব নজরুল ইসাম, জনাব লতিফুর রহমান, জনাব কেরামত আলী, জনাব জাফর আলী, হাফেজ শহিদুল ইসলাম, সেতাউর রহমান, গোলাম আযম সহ ছাত্রনেতৃবৃন্দ।
বাদ মাগরীব প্রধান অতিথির বক্তৃতার পর পর্দা উঠলো সাংস্কৃতিক সন্ধ্যার। ইসলামী গানের পবিত্র সুরের মূর্ছনায় বিমোহিত যুব, ছাত্রজনতা, আবাল, বৃদ্ধ-বনিতার ঢল নামলো। পুরো মাঠ কানাই কানাই ভর্তি ততক্ষণে। বাদ ইশা নাটক শুরু হয়ে চললো রাত ১টা পর্যন্ত। মোমের মত মেতে রইলো পুরো উপস্থিতি। সুদীর্ঘ ৪ মাসের অক্লান্ত পরিশ্রমের ফল। এই সফল এক স্বপ্নাতীত পরিসমাপ্তি। আমাদের শিল্পী, অভিনেতা, উদ্যোক্তাদের দ্ক্ষতাকে একটা প্রাতিষ্ঠানিক শক্ত ভিত্তির উপর অধিষ্ঠিত করলো। যে উদ্যোগ টা সম্পূর্ণ ব্যক্তিগত ভাবে শুরু। তার সাফল্য আজ আমাদের পরিচিতিকে রুপান্তরিত করলো সন্ধানীতে। এ পথ পরিক্রমায় প্রতিষ্ঠাতা হিসেবে ১৯৯৬ নভেম্বর পর্যন্ত আমিই অঘোষিত পরিচালক।
মেঘলা আকাশে প্রতীক্ষার সূর্যোদয় :-
নভেম্বর ১৯৯৬ সাল । সাথী বৈঠকে সন্ধানী শিল্পীগোষ্ঠী স্বতন্ত্র একটি শাখার মর্যাদা পেলো। সেখানেই আনুষ্ঠানিক ভাবে আমাকে পরিচালক নিযুক্ত করা হলো। ইসলামী ছাত্র আন্দোলনে এটাই আমার প্রথম দায়িত্ব। তাই শপথের দাবি, নতুন উদ্যম আর বিগত অভিজ্ঞতার সমন্বয়ে সন্ধানী শিল্পীগোষ্ঠীর গঠনমূলক আহ্ববান জেলাব্যপি প্রসারের লক্ষ্য নিয়ে কর্মী সংগ্রহ ও প্রশিক্ষণ এর ঝটিকা অভিযান পরিচালনা করলাম। পক্ষব্যাপী শিল্পী সংগ্রহ অভিযানে ফলাফল ও লক্ষ্যমাত্রা অতিক্রম করলো। নতুন শিল্পীদের একদিনের কর্মশালায় অতিথি হিসেবে ছিলেন মাহফুজুর রহমান । উপস্থিতি ৭০-৮০ জন। তাদের মধ্যে ১৫ জনের একটা শক্তিশালী গ্রুপ বাছাই করে গানের শিল্পী সংকট দূর করতে সক্ষম হলাম। এবং সুখের বিষয়, সেই সমস্ত শিল্পীদের অনেকেই পরে জাতীয় পর্যায়ের সাংস্কৃতিক সংগঠনের নিয়ামক শক্তি হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে। সন্ধানীর এটি ও একটি বড় অর্জন। ১৯৯৬ থেকে ১৯৯৯ সাল পর্যন্ত আমি থানার বিভিন্ন দায়িত্ব পালন করলেও সময়ের প্রয়োজনে পরিচালকের পদটি আমার থেকে বিচ্ছিন্ন হয়নি। সে থেকে আজ পর্যন্ত শুধু ধারাবাহিকতা রক্ষ হয়েছে। বছরে বছরে পরিচালক পরির্তন হলে ও নতুন কর্মী সংগ্রহ, তেমন সম্ভব হয়নি। ফলে প্রতিষ্ঠালগ্নের শিল্পী ও নাট্য কর্মীদের নির্ভরশীলতা থেকে আজ ও বেরিয়ে আতে পারেনি। এটা আমাদের পরিচালকদের দূরদর্শীতা ও কর্মপরিকল্পনার সংকট বলেই মনে হয়। তবে উত্তরোত্তর সমৃদ্ধি অর্জন না হলে ও অস্তিত্বের উপর অবিচল রাখাও যথেষ্ট চ্যালেঞ্জ। এ অসামান্য অবদানের স্বীকৃতি ও পুরস্কার অবশ্যই আল্লাহ তাদের দান করবেন।আল্লাহ আমাদের সকল ত্রুটি ক্ষমা করে দ্বীনের পথে কবুল করুন । আমিন ।
যাদের হাতে সন্ধানীর পতাকা :-
১. মোশাররফ হোসেন
২. মোশাররাফ হোসাইন
৩. জহির রায়হান
৪. আলম হোসেন
৫. বাবর আলী
৬. নেফাউর রহমান
৭. তৌহিদুল ইসলাম ডলার
৮. আবুল কাসেম
৯. এনায়েতুল্লাহ।
১০.আলম হোসেন
সর্বশেষ এডিট : ০৬ ই মার্চ, ২০১০ বিকাল ৪:১৩

অনুগ্রহ করে অপেক্ষা করুন। ছবি আটো ইন্সার্ট হবে।




