ঢাকা নামের উৎপত্তি নিয়ে নানা মুনির নানা মত। এরমধ্যে উল্লেখ্যযোগ্য মতামত গুলি হলো -
১. রাজা বল্লাল সেন একবার বেড়ানোর সময় এক জঙ্গলাকীর্ণ স্থানে দেবী দূর্গার একটি বিগ্রহ (মূর্তি) খূঁজে পান। তিনি সে স্থানে একটি মন্দির প্রতিষ্ঠা করেন। যেহেতু বিগ্রহটি জঙ্গলে 'ঢাকা' বা লুকানো (গুপ্ত) অবস্থায় পেয়েছিলেন, তিনি মন্দিরটির নামকরণ করেন 'ঢাকেশ্বরী মন্দির' আর সেখান থেকেই জনপদটির নাম হয় ঢাকা।
২. এই অঞ্চলকে মূঘল সুবা বাংলার রাজধানী ঘোষনার পর সুবেদার ইসলাম খান আনন্দে 'ঢাক' (Drum) বাজানোর নির্দেশ দেন। কথিত আছে যে ঢাকের শব্দ যতদূর যায়, ততদূর পর্যন্ত তিনি তার রাজধানীর সীমানা নির্ধারণ করেন। এই ঢাক থেকেই ঢাকা।
৩. এই অঞ্চলে 'ঢাক' (Butea Frondosa) গাছ অত্যন্ত সহজলভ্য হওয়ায়, এই অঞ্চলোর নামকরণ করা হয় ঢাকা। এটি হচ্ছে আমাদের অতি পরিচিত পলাশ গাছ।
৪. প্রাকৃত উপভাষা (dialect) 'ঢাকা ভাষা' থেকে এই অঞ্চলের নাম ঢাকা।
৫. ডাক্কা মানে ফাঁড়ি (watch station), সেখান থেকে ঢাক্কা এরপর ঢাকা। শব্দটি প্রাকৃত উপভাষা থেকে নেয়া আর এর উল্লেখ পাওয়া যায় 'রাজতরঙ্গীনি' নামের এক বই এ। এলহাবাদের প্রাচীন শিলালিপিতে সমূদ্র গুপ্তের পূর্বাঞ্চলীয় রাজ্য 'ডবাক' ই হলো ঢাকা।
১৬০৮ সালে ইসলাম খান ঢাকা অধিকার করার পর থেকে আজ পর্যন্ত এই ৪০০ বছরের ইতিহাসকে আমরা ৪টি আমলে ভাগ করতে পারি।
ক. মূঘল আমল ১৬০৮ - ১৭৬৫ সাল
খ. ব্রিটিশ আমল ১৭৬৫ - ১৯৪৭ সাল
গ. পাকিস্তান আমল ১৯৪৭ - ১৯৭১ সাল
ঘ. বাংলাদেশ আমল ১৯৭১ -
মূঘল আমলে ঢাকায় সুবে বাংলার প্রথম সুবেদার হিসেবে নিয়োগ পান ইসলাম খান, যার আসল নাম শেখ আলাউদ্দিন চিশতি। তিনি ছিলেন শেখ বদরুদ্দিন চিশতির পুত্র এবং ফতেহপুর সিক্রির শেখ সেলিম চিশতির নাতি। ইসলাম খান বাল্যকালে ছিলেন শাহজাদা সেলিম (পরবর্তীতে যিনি বাদশাহ জাহাঙ্গীর হিসেবে পরিচিত হন) এর খেলার সাথী। শাহজাদা সেইসময় শেখ সেলিম চিশতির খানকায় ছিলেন।
সুবেদার ইসলাম খান সর্বপ্রথম ঢাকার গুরুত্ব উপলব্ধি করেন এর অবস্হানের কারণে। বুড়িগঙ্গা এবং এর মূল নদী ধলেশ্বরীর মাধ্যমে ঢাকাকে পূরো বাংলার সাথেই যুক্ত করা সম্ভব ছিল। মজার ব্যাপার হলো ইসলাম খানের পূর্বসূরিরা ৩২ বছর ধরে চেষ্টা করেও ঢাকাসহ পূরো বাংলাকে করায়ত্ব করতে পারেন নাই, সেখানে যুদ্ধবিদ্যার প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষাবিহীণ ইসলাম খান মাত্র ৫ বছরের চেষ্টায় পূরো বাংলা জয় করেন। তারই একান্ত চেষ্টায় ১৬১০ সালের ১৬ জুলাই বাদশাহ জাহাঙ্গীর এক ফরমানবলে ঢাকাকে সুবে বাংলার রাজধানী হিসেবে ঘোষনা করেন। ইসলাম খান বাদশাহ'র প্রতি সম্মান জানিয় এর নতুন নামকরন করেন 'জাহাঙ্গীরনগর'। যদিও বাদশাহ জাহাঙ্গীরের মৃত্যুর পর ঢাকা আবার স্বনামে ফিরে আসে। সুবে বাংলার রাজধানী রাজমহল থেকে ঢাকায় স্থানান্তরের পর সুবেদার ইসলাম খান এর উন্নয়নের দিকে নজর দেন। তিনি আফগানদের তৈরী করা 'ঢাকা দূর্গ' কে সংস্কার করে সুবেদারের বাসভবন হিসেবে ব্যবহার করেন। এর আগে পর্যন্ত সুবেদাররা তাদের কাজের ধরন (সাময়িক ও বদলিযোগ্য) অনুযায়ী তাবুতে বাস করতেন। এই 'ঢাকা দূর্গ' এর অবস্থান ছিল বর্তমান ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারের অভ্যন্তরে, যদিও কালের বিবর্তনে এর আর কোন অস্তিত্ব নেই। এটি ইট নির্মিত ছিল নাকি মাটির সেটাও এখন আর স্পষ্ট নয়। সুবেদার ইসলাম খানের সময়ের আরেকটি স্থাপনা হলো বুড়িগঙ্গার তীরে চাঁদনী ঘাট। এখানে রাজকীয় নৌবহরের আনাগোনা ছিল এবং নৌসেনাদের অবতরনের ব্যবস্থা ছিল। সৈয়দ আওলাদ হোসেন লেনের মসজিদটি ইসলাম খান নির্মাণ করেছিলেন বলে অনুমান করা হয়। রমনার একাংশ একসময় তার বংশের নামানুসারে মহল্লা চিশতিয়ান বলে পরিচিত ছিল। পূরান ঢাকার ইসলামপুর তার নামানুসারেই হয়েছে।
১৬১৩ সালে ইসলাম খান ঢাকার অদূরে (২৫ মাইল উত্তরে) ভাওয়ালে এক রহস্যজনক ঘটনায় নিহত হন। তাকে প্রথমে বাদশাহীবাগে (বর্তমানের পূরাতন হাইকোর্ট এলাকা) দাফন করা হয় পরবর্তীকালে তার দেহাবশেষ ফতেহপুর সিক্রিতে নিয়ে তার দাদা শেখ সেলিম চিশতির কবরের পাশে পূনরায় দাফন করা হয়।
মূঘল আমল থেকে ঢাকা নিরবিচ্ছিন্নভাবে রাজধানীর মর্যাদা ভোগ করতে পারে নাই। সম্রাট শাহজাহান আর সম্রাজ্ঞী মমতাজ মহলের দ্বিতীয় পুত্র শাহ সূজা সুবে বাংলার সুবেদার নিযুক্ত হলে ব্যক্তিগত ও রাজনৈতিক কারণে রাজধানী রাজমহলে সরিয়ে নেন। তবে তার সুবেদারীর শুরুতে কয়েক বছর রাজধানী ঢাকায় ছিল এবং তিনি নিজেও ঢাকায় ছিলেন বলে জানা যায়। সম্রাট শাহজাহান এর ছেলেদের মধ্যে উত্তরাধিকার নিয়ে যুদ্ধ শুরু হলে শাহ সূজা একসময় পরাজিত হয়ে আরাকান (বর্তমানের চট্টগ্রাম অঞ্চল) এ পালিয়ে যান। ১৬৬০ সালে সুবেদার মীর জুমলা ঢাকায় আবার রাজধানী স্থানান্তর করেন। সেই সময় থেকে অষ্টাদশ শতাব্দির শুরু পর্যন্ত রাজধানী ঢাকাতেই ছিল। সুবেদার শাহজাদা আজিমুদ্দিন এবং দেওয়ান মূর্শিদ কুলি খান এর ব্যক্তিগত দ্বন্দের কারণে সুবেদারী পাটনায় আর দেওয়ানী মূর্শিদাবাদে স্থানান্তরিত হয়। ১৭১৭ সালে মূর্শিদ কুলি খান সুবেদার নিযুক্ত হলে তিনি রাজধানী মূর্শিদাবাদে নিয়ে যান। তখন থেকে ঢাকা নায়েবে-নাজিম দিয়ে শাসন করা হতে থাকে। ১৮৪০ সালে (ব্রিটিশ আমল) এই পদটি বিলুপ্ত হয়।
(ক্রমশ ....)
ঢাকা - ৪০০ বছরের পূরানো এক শহর - পর্ব ১
ছবি : ১৮১৪ সালে চার্লস ড'য়লির আকা লালবাগ দূর্ঘের দক্ষিন পাশের প্রাচীর। এর পাশেই ছিল বুড়িগঙ্গা নদী। বর্তমানে নদী বহু দূরে সরে গেছে। উইকিপিডিয়া থেকে সংগ্রহ করা।
সর্বশেষ এডিট : ১৯ শে জানুয়ারি, ২০১১ রাত ১২:০৯