রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের যুগে কোনো ভূমিকম্প অথবা আগ্নেয়গিরির বিস্ফোরণের ঘটনা সংঘটিত হয়নি। একারণে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম থেকে এ বিষয়ে কোনো আহকাম পাওয়া যায় না, যা সরসরি ভূমিকম্প অথবা আগ্নেয়গিরির বিষয়ক বলা যায়। ইবনে আব্দুল বারর্ তামহিদ গ্রন্থে (৩-৩১৮) বলেন,‘বিশুদ্ধ কোনো বর্ণনায় আসে নি যে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের যুগে ভূমিকম্প হয়েছিল। এ ব্যাপারে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম থেকে কোনো সুন্নত আছে বলে জানা নেই।’
ইবনে আব্দুল বারর,্ মুরসাল ও যয়িফ সনদে ইবনে আবি শায়বা তার মুসান্নাফে যা বলেছেন, তার প্রতি ইঙ্গিত করে বলেন, ( শাহর থেকে বর্ণিত তিনি বলেন, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের যুগে মদিনা কম্পিত হয়েছে, অতঃপর তিনি বলেছেন, (নিশ্চয় তোমাদের প্রতিপালক তোমাদের উপর থেকে ভর্ৎসনা উঠিয়ে নিতে চাচ্ছেন। অতঃপর তোমরা ভর্ৎসনা মুক্ত হও।)
আমিরুল মুমিনিন উমর রাদিয়াল্লাহু আনহুর যুগে মদিনায় ভূমিকম্প হয়েছে, সাফিইয়া রাদিয়াল্লাহু আনহা বলেন, ‘উমর রাদিয়াল্লাহু আনহুর যুগে মদিনায় ভূমিকম্প সংঘঠিত হয়, এমনকী চকির খটখট শব্দ পর্যন্ত শোনা যায়। তবে একই মুহূর্তে আব্দুল্লাহ ইবনে উমর সালাত আদায়রত ছিলেন, তিনি টের পান নি। (বর্ণানকারী বলেন, ‘উমর রাদিয়াল্লাহু আনহু লোকদের উদ্দেশ্যে বক্তৃতা করেন এবং বলেন, ‘হে মদীনাবাসী! তোমরা কত দ্রুতই না বিদআত সংযোজন করেছ। আল্লাহর কসম, যদি (ভূমিকম্প) আবার ফিরে আসে তবে আমি তোমাদের মধ্য থেকে অবশ্যই বেরিয়ে যাব।) [ইবনে আবি শায়বা]
হাদীসবেত্তা আইনি উমদাতুলকারি গ্রন্থে (৭-৫৭) বলেন, ‘মুহাল্লাব বলেছেন, ‘ভূমিকম্প ও অন্যান্য নিদর্শন আল্লাহর পক্ষ থেকে পৃথিবীবাসীর জন্য ভীতিপ্রদর্শন। আল্লাহ তাআলা বলেন, {আমি নিদর্শসমূহ প্রেরণ করি না তবে ভীতিপ্রদর্শনের উদ্দেশ্যে}[সূরা আল ইসরা:৫৯] আর এই নিদর্শনাবলির মাধ্যমে ভীতিপ্রদর্শন সে সময় হয় যখন মানুষ পাপ-গুনাহ প্রকাশ্যে করতে শুরু করে। এরপর তিনি উমর রাদিয়াল্লাহু আনহুর ঘটনা উল্লেখ করে বলেন, ‘ তিনি ভয় পেয়েছেন যে, আল্লাহর শাস্তি, সবার সাথে, তাঁকেও পেয়ে বসবে; কেননা রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে একদা জিজ্ঞাসা করা হয়েছিল- ‘সৎ মানুষ আমাদের মধ্যে থাকা সত্ত্বেও কি আমরা ধ্বংস হব?’ উত্তরে তিনি বলেছিলেন, ‘হ্যা, যখন অসৎকর্ম বেড়ে যাবে (তখন এরূপ ঘটবে), তবে সৎ লোকদেরকে তাদের নিয়ত অনুযায়ী পুনরুত্থিত করা হবে।’ তবে দারামিতে (৩০) এর বিপরীত ভাববোধক একটি বর্ণনা রয়েছে, (আলকামা থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন,‘রাসূলুল্লাহ সাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সময় ভূমিকম্প হয়েছে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে এ ব্যাপারে খবরও দেওয়া হয়েছে। তিনি বলেন, ‘আমরা মুহাম্মাদ সাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সাহাবিরা নিদর্শনসমূহকে বরকত মনে করতাম, আর তোমরা এটাকে ভীতিপ্রদর্শন মনে কর।)
একটি শুদ্ধ বর্ণনায় এসেছে, ইবনে আব্বাস রাদিয়াল্লাহু আনহুর সময়ে একবার ভূমিকম্প সংঘটিত হয়, অতঃপর এর জন্য তিনি সালাতুল কুসুফের মতোই সালাত আদায় করেন। আমিরুল মুমিনিন আলি ইবনে আবি তালেবও কুসুফের সালাতের ন্যায় সালাত আদায় করেছেন বলে বর্ণনায় এসেছে, তবে আলি রাদিয়াল্লাহু আনহুর এ বর্ণনাটির সনদ সম্পর্কে হাদীস বিশেষজ্ঞ কেউ কেউ সমালোচনা করেছেন। হুযায়ফা রাদিয়াল্লাহু আনহুও অনুরূপ করেছেন বলে বর্ণনায় পাওয়া যায়।
উল্লিখিত বর্ণনাগুলোর নিরিখে ইমাম আহমদ ইবনে হাম্মল র. বলেছেন যে, দীর্ঘস্থায়ী ভূমিকম্পের ক্ষেত্রে সালাতুল কুসুফতুল্য সালাত আদায় করা শরীয়তসিদ্ধ হবে, তবে মুহূর্তকালের কম্পনের ক্ষেত্রে নয়। তিনি এর পক্ষে দলিল হিসেবে একটি হাদীস উল্লেখ করেন। হাদীসটি হল, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, (নিশ্চয় সূর্য ও চন্দ্র আল্লাহর দুটি নিদর্শন, যা কারও মৃত্যু বা জীবিত থাকার কারণে গ্রহণগ্রস্ত হয় না, তাই তোমরা যখন তা দেখবে, সালাত আদায়ের জন্য ছুটে যাবে)। ভূমিকম্পও আল্লাহর নিদর্শনমালার একটি, অতঃপর এর জন্যও সালাত আদায় শরীয়তসিদ্ধ হবে। ইমাম মারদাবি আল হাম্মলি ইনসাফ কিতাবে (২-৪৪৯) বলেছেন (হাম্মলি মাযহাবের বিশুদ্ধ মত হল -ভূমিকম্পের জন্য- কুসুফের সালাতের ন্যায় সালাত আদায় করা হবে, হাম্মলি মাযহাবের অধিকাংশ ইমাম এ কথাই বলেছেন।)
ইমাম শাফি ভূমিকম্পের জন্য জামাতে সালাত আদায় করা শরীয়তসিদ্ধ বলেন নি। কেননা তার নিকট, সাহাবায়ে কেরাম থেকে এই ক্ষেত্রে সালাত আদায়ের বিষয়টি প্রমাণিত নয়। তিনি আল উম্ম কিতাবে (৭-১৬৮) বলেন,‘ সূর্য ও চন্দ্রগ্রহণ ব্যতীত এ জাতীয় অন্য কোনো নিদর্শনের জন্য সালাত আদায় করা হবে না। যদি আলি রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে হাদীসটি আমাদের কাছে প্রমাণিত হত, তাহলে এর পক্ষে মত ব্যক্ত করতাম। ইমাম নববি আল মাজমু কিতাবে (৫-৫৯) বলেন, ‘ ইমাম শাফি বলেছেন, ‘ আমি ভূমিকম্পের ক্ষেত্রে জামাতের সাথে সালাত আদায়ের কথা বলি না... তবে এককী সালাত আদায়ের নির্দেশ দিই। তবে আমাদের মাযহাবের আসহাবগণ ঐক্যমত্য পোষণ করেন যে, এ ক্ষেত্রে একাকী সালাত আদায় মুস্তাহাব, অতঃপর দুআ করবে, মিনতি করবে যাতে গাফেল না হয়ে পড়ে।’
মালেকি মাযহাবের ফেকাহবিদগণ ভূমিকম্পের সময় বিচ্ছিন্নভাবে সেজদা করাকে মাকরুহ বলেছেন। তবে পূর্ণাঙ্গরূপে সালাত আদায়কে মুস্তাহাব বলেছেন। সম্ভবত তাদের মাযহাব ইমাম শাফির মাযহাবের মতোই। অর্থাৎ জামাতের সাথে নয়, বরং একাকী সালাত আদায় করা মুস্তাহাব।
সে যাই হোক, ভূমিকম্পের সময় সালাত আদায় শরীয়তসিদ্ধ। কয়েকজন সাহাবি থেকে, এ ক্ষেত্রে, জামাতের সাথে সালাত আদায়ের বর্ণনাও এসেছে।
আর আগ্নেয়গিরির ব্যাপারে বলা যায় যে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের মুজেযার মধ্যে একটি হল তাঁর ভবিষৎবাণী, ( কেয়ামত সংঘটিত হবে না যতক্ষণ না হেজাযের ভূমি থেকে একটি আগুন বের না হবে, যার দ্বারা বসরা এলাকার উটের ঘার পর্যন্ত আলোকিত হয়ে যাবে। (বুখারি, মুসলিম)। ইমাম কুরতুবি তাযকেরা গ্রন্থে বলেন,‘ হেজায এলাকার মদীনা থেকে একটি আগুন বের হয়েছে, যা জুমাদাল উখরা (৬৫৪ হি.) মাসের তিন তারিখ বুধবার রাতে শুরু হয় এবং চলমান থাকে শুক্রবার সকাল পর্যন্ত। এরপর তা শান্ত হয় এবং হাররা এলাকার প্রান্তদেশে তানয়িমের নিম্নভূমি হতে আগুন বের হয়ে আসে। আগুনটি যেসব পাহাড় দিয়ে অতিক্রম করেছে, তা সমান করে দিয়েছে, গলিয়ে দিয়েছে, আর এগুলো সম্মিলিত হয়ে একটি লালবর্ণের নদী সৃষ্টি করেছে যার গর্জন ছিল ঠিক বজ্রের মতো, পাথর ও পাহাড়, যা সামনে পেত, ভাসিয়ে নিয়ে চলত।’ আবু শামা রাওযাতাইন গ্রন্থের টিকায় বলেন, ‘বিশাল এক আগুন প্রকাশ পেয়েছে, মদীনা থেকে যার দূরত্ব ছিল অর্ধদিবসের পথ। আগুনটি ভূমি বিস্ফারিত হয়ে বের হয়েছে,আর তা থেকে আগুনের এক উপত্যকা প্রবাহিত হয়েছে যা উহুদ পাহাড় বরারব হয়ে গিয়েছিল।
এ ধরনের নিদর্শন আল্লাহর কুদরতের বহি:প্রকাশ। আল্লাহর কাছে ছুটে যাওয়া, তার কাছে আশ্রয়গ্রহণ যে কত প্রয়োজন, এ জাতীয় ঘটনা, এ বিষয়ে মানুষের উপলব্ধিকে শানিত করে। ইরশাদ হয়েছে,{আর তোমাদের রব বলেছেন,‘ তোমরা আমাকে ডাক, আমি তোমাদের জন্য সাড়া দেব। নিশ্চয় যারা অহঙ্কার বশতঃ আমার ইবাদত থেকে বিমুখ থাকে, তারা অচিরেই লাঞ্ছিত অবস্থায় জাহান্নামে প্রবেশ করবে।} [সূরা গাফির:৬০]
সমাপ্ত
ভূমিকম্প বিষয়ক কিছু আহকাম
(البنغالية- evsjv-bengali)
মূলঃ ড. সাদ বিন নাসের আশ্ শাছরি
অনুবাদক : আবু শআইব মুহাম্মাদ সিদ্দীক
copied from http://www.bd222.blogspot.com
সর্বশেষ এডিট : ২৪ শে মে, ২০০৯ রাত ১১:০৮

অনুগ্রহ করে অপেক্ষা করুন। ছবি আটো ইন্সার্ট হবে।




