গাজীপুর জেলার রাজেন্দ্রপুর চৌরাস্তা পেছনে ফেলে ডানদিকে ঊনিশ কিলোমিটার এগোলেই কাপাসিয়া বাজার।
তারপর ফকির মজনু শাহ সেতুর উপর দিয়ে শীতলক্ষ্যা নদী পার হয়ে তরগাঁও।
লতাপাতা বাজার অতিক্রম করার পর আমরাইদ চৌরাস্তা।
সেখানে নেমে ভূমিকর্ষণ যন্ত্রচালিত গাড়ি টমটমে চড়ে দরদরিয়া গ্রাম, যে গ্রামে জন্মেছিলেন আমাদের মুক্তিসংগ্রামের অন্যতম দিকপাল বাংলাদেশের প্রথম প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দিন আহমদ।
তাজউদ্দিন আহমদের জন্ম ১৯২৫ সালের ২৩ জুলাই।
শাল-গজারির ছায়াঘন লাল মাটির এই গ্রামেরই একটি টোলে শুরু তাঁর শিক্ষাজীবন।
তারপর কাপাসিয়া, কালীগঞ্জের নানা স্কুল বদলে পুরোনো ঢাকার সেন্ট গ্রেগরিজ স্কুল।
তবে মেধা তালিকায় চতুর্থ স্থান অধিকার করে ম্যাট্রিকুলেশন সম্পন্ন করেন তিনি মুসলিম বয়েজ স্কুল থেকে ১৯৪৪ সালে।
স্কুলের গণ্ডী পেরিয়ে জগন্নাথ কলেজ। সেখান থেকে ১৯৪৮ সালে তাজউদ্দিন আহমদ পাশ করেন আই.এ.।
তারপর অর্থনীতি বিষয়ে ভর্তি হন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে।
তাজউদ্দিন আহমদের রাজনৈতিক দায়বোধের স্পষ্ট পরিচয় পাওয়া যার তাঁর স্কুলজীবন, কলেজ জীবনের প্রতিটি কর্মকাণ্ডেই। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হবার পর সেই দায়বোধ আগের চাইতে বেড়ে যায় আরও।
১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলনের উত্তাল সময়ে তাজউদ্দিন আহমদ কারাবরণ করেন প্রথমবারের মতো।
এরপর কারাবন্দীত্ব ও কারামুক্তি তাঁর জীবনে হয়ে দাঁড়ায় নৈমিত্তিক ঘটনা।
১৯৫৩ সালে তাজউদ্দিন আহমদ লাভ করেন অর্থনীতি বিষয়ে সম্মানসহ স্নাতক ডিগ্র্রী। তারপর রাজনৈতিক ব্যস্ততায় ব্যাহত হয় তার শিক্ষাজীবন।
১৯৫৪ সালে যুক্তফ্রন্টের প্রার্থী হিসেবে তাজউদ্দিন আহমদ নির্বাচিত হন পূর্ব পাকিস্তান প্রাদেশিক পরিষদের সদস্য এবং ঐ বছরই কারাবন্দী হন আবার। যদিও এর কিছুদিন পরই পুনরায় কারামুক্তি ঘটে তাঁর, তবু ১৯৫৮ সালে দেশে সামরিক শাসন জারী হবার পর আওয়ামী লীগ নিষিদ্ধ ঘোষিত হলে কারাবন্দীত্বের পুনরাবৃত্তি ঘটে, যা থেকে মুক্তি পান তিনি আবার ১৯৫৯ সালে।
১৯৬২ সালে শহীদ সোহরাওয়ার্দীর নেতৃত্বে ন্যাশনাল ডেমোক্রেটিক ফ্রন্টের গনতন্ত্র পুনরুদ্ধার আন্দোলনে অংশগ্রহণের প্রেক্ষিতে আবারও ঘটে সেই একই ঘটনা। ১৯৬৪ সালে কারাবন্দী অবস্থায় তিনি লাভ করেন আইনশাস্ত্রের ডিগ্র্রী এবং এর কিছুদিন পর কারামুক্তি।
১৯৬৪ সালে আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক, ১৯৬৬ সালে সাধারন সম্পাদক নির্বাচিত হয়েই তিনি অংশগ্রহণ করেন ঐতিহাসিক ৬দফা আন্দোলনে। বলাই বাহুল্য এ পরিপ্রেক্ষিতেও আবার কারাবন্দীত্ব; আবার মুক্তি।
১৯৬৯ সালের গণঅভ্যুত্থানের পর ১৯৭০ সালের সাধারণ নির্বাচনে আওয়ামী লীগের প্রার্থী হিসেবে জাতীয় পরিষদের সদস্য নির্বাচিত হন তিনি।
এরপর ১৯৭১।
শুরু হয় মুক্তিসংগ্রাম। বাঙালি জাতিসত্তার নিজস্ব ভূখণ্ড প্রতিষ্ঠার যুদ্ধ। নিপুণ পরিচালন এবং বুদ্ধিদীপ্ত নিয়ন্ত্রণের মাধ্যমে সেই যুদ্ধকে অভীষ্ট লক্ষে পৌঁছে দিতে যে ভূমিকা পালন করেন মুজিবনগরে গঠিত প্রবাসী সরকারের প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দিন আহমদ, তা বাঙালি জাতির জীবনে স্মরণযোগ্য চিরকাল।
টমটম থেকে নেমে নির্জন বন ঘেরা একটা পাকা পথ ধরে মিনিট দশেক হাঁটলেই দরদরিয়া সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয়; তার পাশ দিয়ে আরো একটা অপ্রশস্ত রাস্তা, যেটি একটু এঁকেবঁকে চলে গেছে মাঠ-মসজিদ-মাদ্রাসা-পুকুর-পাঠাগার পেছনে ফেলে, সেই রাস্তার শেষ মাথায় তাজউদ্দিন আহমদের ঐতিহাসিক বাড়িটি।
চারপাশে হাজারো বৃক্ষলতা শোভিত বাড়িটি মৃৎনির্মিত, দ্বিতল, দক্ষিণমুখী। দরজা জানালা কাঠের। বাড়িটির মৃন্ময়গাত্র সাদা চুনকাম করা। দোতলায় রেলিং দেওয়া কাঠের বারান্দা।
এখন তেমন কেউ থাকে না এখানে, জানালেন নুরুল ইসলাম। তিনি ছাড়াও বর্তমানে আরো কয়েকজন লোক জনমানুষহীন এই বাড়িটি দেখেশুনে রাখার কাজ করেন।
কী রয়েছে প্রথম প্রধানমন্ত্রীর এই বাসভবনের অভ্যন্তরে?
কৌতূহল মেটাতে নুরুল ইসলাম উন্মোচন করলেন বন্ধ দরজার তালা। চৌকাঠ অতিক্রম করতেই চোখে পড়লো বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমানের ছবি, আর তার ঠিক পাশেই বঙ্গবন্ধুসখা তাজউদ্দিন আহমদের একটা পোষ্টার।
এছাড়া ঘরে আছে চৌকি, চেয়ার, টেবিলের মতো একেবারে আটপৌরে সব জিনিস।
দোতলায় ওঠার চমৎকার কাজ করা সিড়িটা ঘরের ভেতরেই। উপরের ঘরেও বেশ কিছু সাধারণ জিনিস ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে, কিন্তু প্রিয় নেতার স্পর্শের চিহ্ন খুঁজে পাওয়া দুষ্কর সেখানে।
স্বাধীন বাংলাদেশে বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে নতুন মন্ত্রীসভা গঠিত হলে তাজউদ্দিন আহমদ প্রথমে অর্থ এবং পরবর্তীতে অর্থ ও পরিকল্পনা মন্ত্রীর দায়িত্বপ্রাপ্ত হন।
তারপর শুরু হয় গ্রহণের কাল, শুরু হয় ব্যাক্তি-জাতি-রাষ্ট্রজীবনে নানা অবনমনের ঘটনা।
১৯৭৪ সালে তিনি পদত্যাগ করেন মন্ত্রীত্ব থেকে। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধু সপরিবারে নিহত হলে পরিবর্তিত হয় রাজনৈতিক পট। সেই পরিবর্তিত অশুভ পটে ২৩ আগস্ট গ্রেফতার হন তিনি।
৩ নভেম্বর ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে বন্দী অবস্থায় আরো তিন জাতীয় নেতার সাথে নির্মমভাবে হত্যা করা হয় তাজউদ্দিন আহমদকে। কিন্তু কি অপরাধে?
অকৃত্রিমভাবে দেশ আর দেশের মানুষকে ভালবাসার অপরাধে?
উঠানের খোলা হাওয়া গায়ে মেখে এলোমেলো কতো কিছু ভাবি। ভাবতে ভাবতে ফেরার সময় ঘনিয়ে আসে। একটা দীর্ঘশ্বাস নেমে আসে বুক চিরে। নিরাশ্রিত সেই দীর্ঘশ্বাসটিকে যত্ন করে রেখে আসি প্রথম প্রধানমন্ত্রীর বাসভবনের বাতাসে শ্রদ্ধাঞ্জলি হিসেবে, কারণ, এছাড়া যে আর দেবার মতো কিছুই নেই চলতি পথের একজন সাধারণ মানুষের কাছে!!
সর্বশেষ এডিট : ০৩ রা নভেম্বর, ২০১৫ রাত ৮:৪৬