এইটি আমাদের গ্রামের একজন অতি দরিদ্র মাতার কাহিনী।
আমার ছেলেবেলায়, আমাদের গ্রামর বেশীরভাগ পরিবারই ছিলো দরিদ্র; এরমাঝে ২টি পরিবার ছিলো একেবারেই হত-দরিদ্র; তাদের বাড়ীটি ছিলো গ্রামের ঠিক মাঝখানে; দুই ভাইয়ের সংসার। আমার বয়স যখন ৫/৬ বছর, তখন থেকেই আমি সেই বাড়ীতে যেতাম; ওদের উঠানে ২টি কুল গাছ ছিলো, আমরা গিয়ে কুল খেয়ে আসতাম।
বর্ষাকালে ঐ বাড়ী যেতে হলে লেংটা, পেংটা হয়ে পানি ভেংগে যেতে হতো; সে রাড়ী থেকে বের হওয়ার কোন রাস্তা ছিলো না, রাড়ীর উত্তর ও পশ্চিম পাশ দিয়ে অগভীর প্রাইভেট খাল ছিল, যা' পুর্ব-মাঠের পানি নিয়ে যায় পশ্চিম-মাঠে; বাড়ীর পুর্ব পাশে ধানের জমি, দক্ষিণ দিকে অন্যদের বাড়ী।
দুই ভাই'এর ২ পরিবার; বড় ভাই জহুরুল হক, ছোট ভাই রেনুমিয়া মাষ্টার। রেনুমিয়া মাষ্টার আমার চেয়ে ৮/৯ বছরের বড় ছিলেন; ইনি জীবনে ১ দিনও স্কুলে যাওয়ার সুযোগ পাননি; কিন্তু বাংলা যেকোন বই ভালোভাবে পড়তে পারতেন ও বুঝতেন; গ্রামের স্বশিক্ষিত এক পন্ডিতের কাছে পুঁথি পড়া শিখেছিলেন; পেশায় কৃষি কাজের কামলা।
জহুরুল হক ছিলেন খুবই রোগা, তিনি চাষের কাজকর্ম পারতেন না; তবে, সপ্তাহে ২ দিন গ্রামের বাজারে, শহর থেকে আগত তরিতরকারী-ফলমুলের পাাইকারী ক্রেতাদের এজেন্ট হিসেবে কাজ করে মোটামুটি কিছুটা আয় করতেন। তিনি গ্রামবাসীকে না জানিয়ে, খাগড়াছড়ির এক মেয়েকে বিয়ে করে নিয়ে এসেছিলেন ১ কাপড়েই; বউয়ের নাম ছিলো আনোয়ারা, ডাক নামছিলো আনু। আনু খাগড়াছরির পাহাড়ের ভেতরে, সরকারী খাস জমিতে বস্তির মত এক পাড়ায় বড় হয়েছিল। আনুর মা নাকি লতাপাতা হয়ে জহুরুল হকের খালা হতো; গ্রামের লোকেরা এই বিয়ে মেনে নিচ্ছিলো না, তাদের না জানিয়ে বিয়ে? কিন্তু বউ দেখার পর, সবাই চুপ; বউ বেশ লম্বা, অনেক বেশী সুন্দরী।
হককে এত সুন্দরী মেয়ে দেয়ার কারণটা অল্পদিনের ভেতর বুঝ গেলো, মেয়েটা মোটাকুটি পাগলাটে ধরণের। দরিদ্র ও রোগা হক কাজকর্ম তেমন করতে পারতো না; অসুবিধা নেই, আনু গ্রামের চাষী পরিবারগুলোকে সাহায্য করে নিজের দরিদ্র সংসার মোটামুটি চালিয়ে নিচ্ছিল। আমি ৯ম শ্রেণীতে পড়ার সময়, হকের মৃত্যু হলো, ছেলেমেয়ে মিলে ৩ জন। বাচ্চা হওয়ার পর থেকে আনুর নাম হয়ে গেছে হাবাধনের মা; বড় মেয়ের ডাক নাম হাবাধন।
হকদের বাড়ীটা অনেক আগেই হকের বাবা বিক্রয় করে ফেলেছিলো পাশের বাড়ীর এক ধনী লোকের কাছে; হকেরা বাড়ীতে থাকতো, তবে মালিকানা তাদের ছিলো না। বাড়ীর বর্তমান মালিকের নাম ফারুক মাষ্টার, উনি হাইস্কলের শিক্ষক ছিলেন। হকের মৃত্যুর পর, ফারুক মাষ্টার বাড়ীটা নিজের দখলে নেয়ার চেষ্টা করেন; কিন্তু গ্রামের কিছু মানুষের সহানুভুতি থাকায়, আনুকে আরো বছর খানেক বাড়ীতে থাকার অনুমতি দেয়া হলো; গ্রামের মানুষগুলোকে আমি ও রেনুমিয়া মিলে অনুরোধ করেছিলাম। বছর চলে যাবার পর ফারুক মাষ্টার তাগাদা দিতে লাগলো, এবং আনুকে সামান্য টাকা দিয়ে আনুর মায়ের কাছে চলে যাবার বুদ্ধি দিয়ে, চলে যাবার দিন তারিখ ঠিক করে দিলো। কিন্তু সে মায়ের কাছে যেতে চাহে না, ওখানে সবাই দরিদ্র।
আনুদের বাড়ীর উত্তর দিকের খালের উত্তর পাড়টা ছিলো আমাদের জমির সাথে লাগানো; বর্ষাকালে, খালে জাল ফেলে আমি প্রায়ই মাছ ধরতাম; খালের দক্ষিণ পারে আনুর ঘর, আনু প্রায়ই এসে কিছু মাছ নিয়ে যেতো; এবার তার বাড়ী ছেড়ে চলে যাবার দিন চলে এসেছে; আমি খুুব ভোরে, বেলা উঠার আগে গিয়ে মাছ ধরতে ছিলাম; হঠাৎ দেখি, আনু পরণের কাপড় কোমরের উপরে তুলে পানি ভেংগে এপারে এসে উঠলো, আমি হতবাক; উনি কিছুই মনে করেনি। তিনি বললেন,
-আমি মাছের জন্য আসিনি; আমি এই গ্রাম ছেড়ে যাবো না, আমার যাওয়ার মতো যায়গা নেই!
-আমি ছাত্র মানুষ, আমার কথা ফারুক মাষ্টার কি তা মানবেন?
-আমি জানি না, আপনারা আছেন, আমার ভিটায় আমি ছেলেমেয়ে নিয়ে থাকবো, আমি কোথায়ও যাবো না।
-আমি চাই আপনি থাকেন; কিন্তু গ্রামের মানুষ তো ফারুক মাষ্টারের পক্ষে কথা বলবেন।
-মানুষ যা বলে বলুক, আপনি আমার থাকার পক্ষে বলবেন, আমি আপনার বন্ধু-বান্ধবদের সাথে কথা বলেছি, তারা আপনার কথা বলেছে।
আমি অবশ্য গ্রামের এটাসেটার সাথে যুক্ত আছি; কিন্তু ফারুক মাষ্টারের সাথে এই ব্যাপারে কিছু করতে পারবো বলে আমার মনে হচ্ছি না। সেদিন সন্ধ্যায় মাষ্টার সাহেব আমাকে ডেকে পাঠালেন; আমি উনার বাড়ি গেলাম; তিনি একটু নীচু গলায় বললেন,
-তুমি ছোট ছেলে, আনু গ্রামে কি করছে তুনি জানো না, সে ছেলেদের চরিত্র নষ্ট করছে; শুনলাম, তোমাকে ভুলানোর চেষ্টা করছে।
-আপনি ভুল শুনেছেন; সে তার বাচ্চাদের নিয়ে কষ্টে বেঁচে আছে; তাকে ঘরে থাকতে দেন, ৩ টা বাচ্চা নিয়ে সে মায়ের কাছে গিয়ে কিভাবে চলবে?
-সে কিভাবে চলবে, সেটা ভাবার আগে আমাকে গ্রামের ছেলেদের চরিত্র নিয়ে ভাবতে হবে; তুমিও ঠিক হয়ে যাও।
আমি বিদায় নিয়ে চলে এলাম; গ্রামের অনেকের সাথে আলাদাভাবে কথা বললাম, সবাই চায়, আনু নিজ ঘরে থাকুক।
সর্বশেষ এডিট : ২০ শে অক্টোবর, ২০২০ রাত ১০:৪১