২০০৮ সালের বিশ্ব ক্রিকেটকে যদি কেউ উত্তাপহীন মনে করে থাকেন তাহলে ভুলই করবেন। হয়তো বিশ্বকাপের মতো বড় কোনো আসর বসেনি এই বছর , হয়নি চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফিও , এ্যাশেজও হয়নি। তারপরও এ বছরটি মাঠ এবং মাঠের বাইরের বিভিন্ন ঘটনার কারণে ঘটনাবহুলই । শেন ওয়ার্নের ক্যারিশমাতে তার দলের আইপিএল জয়, পাকিস্তানের মাটিতে কোনো টেস্ট না হওয়া, বেশকিছু খেলোয়াড়ের দল থেকে অবসর, খেলার মাঠে বোমাতংক, বোমার আতংকে সিরিজ বাতিল। অস্ট্রেলিয়ার একক আধিপত্যে শক্ত আচড়, শচীনের রেকর্ড, টোয়েন্টি-২০ ক্রিকেটের আসন পাকাপোক্ত এবং এর মাধ্যমে ক্রিকেটকে সর্বোচ্চ বাণিজ্যিকীকরণের দিকে সফল হওয়া ,আইসিএল, আইপিএল এর চাপে পিষ্ট হয়ে অন্য দেশের ক্রিকেটের অপূরণীয় ক্ষতি এবং সেটাকে আইসসির চোখ বুঝে নীরব দর্শকের ভূমিকা পালন করা, বিশ্বক্রিকেটে ঘুর্ণি বলের নতুন জাদুকর অজন্তা মেন্ডিসের আবির্ভাব। এরকম আরো অনেক কিছুই হয়েছে এই ক্যালেন্ডার ইয়ারে। মাঠের বাইরের ঘটনাগুলো যেমন আলোচিত ছিলো ঠিক তেমনি মাঠের ভেতরের ঘটনাগুলোও ছিলো সমান আলোচিত।
এ বছরের সবচেয়ে আলোচিত টুর্নামেন্ট ছিলো আইপিএল। আর সেখানে ক্রিকেটের পাশাপাশি হয়ছে বাণিজ্যেরও এক অভূতপূর্ব বিনোদন। এখানে ক্রিকেটের পাশাপাশি বাণিজ্যেরও জয় হয়েছে। বিশ্বের প্রায় সব দেশের নামিদামি ক্রিকেটোররা তাদের পকেট পুরে অর্থ নিয়ে গেছেন । এর পরিমাণ তাদের সারাজীবনের আয়েরও প্রায় কয়েকগুণ আর এর কারণেই তখনকার সময়ে হওয়ার কথা বেশ কিছু আন্তর্জাতিক ক্রিকেটের বিঘ্ন ঘটেছে। আর এরই শিকার হয়েছে পাকিস্তান। কারণ অস্ট্রেলিয়া জাতীয় দল পাকিস্তান সফর বাতিল করে দেয়। তবে আইপিএল বিশ্ব ক্রিকেটকে যে বিনোদন দেয়নি তা বললে ভুলই হবে। শেন ওয়ার্ন দেখিয়েছেন তার ক্যারিশমা। এখানে তিনি বল হাতে যতোটা না সফল হয়েছেন তার চেয়ে বরং অধিনায়কত্ব কিংবা কোচের ভূমিকায় তিনি ছিলেন সপ্রতিভ। তার দল রাজস্থান রয়েলস চ্যাম্পিয়ন হয় অসাধারণ ক্রিকেট নৈপুণ্য উপহার দিয়ে। আইপিএল এর কথা যেহেতু আসলো সেহেতু আইসিএল নিয়ে কিছু না বললেই নয়। এটাকে বলা হয় বিদ্রোহী লীগ। আর এই বিদ্রোহী লীগটার নামকরণ কিন্তু ভারতীয় ক্রিকেট বোর্ডের কাছ থেকেইে পাওয়া। কিন্তু এখানে খেললে আন্তর্জাতিক ক্রিকেট থেকে কোনো খেলোয়াড়দের নিষিদ্ধ করা হবে তার কারণ আমাদের কাছে ধোয়াশার মতোই কিন্তু এতে যে বিশ্বের বেশ কিছু দেশ ক্ষতিগ্রস্থ হচ্ছে তা আর বলার অবকাশ রাখেনা। বাংলাদেশের সেরা সেরা খেলোয়াড়রাও হয়েছেন নিষিদ্ধ এই আইসিএল এর কারণে। সেখানে খেলতে গিয়েই আমাদের আফতাব- কাপালীরা আজ দলের বাইরে।
এ বছরের সবচেয়ে আলোচিত সিরিজ ছিলো ভারত - অস্ট্রেলিয়ার মধ্যে টেস্ট সিরিজ আর এই সিরিজে ভারত ২-০ তে সিরিজ জয় করে অস্ট্রেলিয়ার আধিপত্যে আচড় দিয়েছে ভারত। আর চলতি সাউথ আফ্রিকার বিরুদ্ধে সিরিজের প্রথম ম্যাচে অষ্ট্রেলিয়ার বিরুদ্ধে ৪১৪ রানকে তাড়া করে ম্যাচ বের করে আনাও ছিলো অস্ট্রেলিয়ার দিনবদলের স্বাক্ষী হিসেবে। পার্থে অনুষ্ঠিত এ টেস্টে অস্ট্রেলিয়া যে রান তাড়া করে জয় তুলে আনলো তা ছিলো দ্বিতীয় সর্বোচ্চ রান। এর আগে সর্বোচ্চ রানকে টপকে যাওয়ার রেকর্ডও ছিলো এই অস্ট্রেলিয়ার বিরুদ্ধেই । আর সেটা করেছিলো ব্রায়ান লারার ওয়েস্ট ইন্ডিজ। ম্যাকগ্রা, ওয়ার্ন কিংবা গিলক্রিস্টের বিদায়ের পর অস্ট্রেলিয়ার পতন হবে এটার আশংকা তো ছিলোই কিন্তু এতে কিছু সময় লাগবে সেটাই সকলে মনে করেছিলো তবে তাদের পতনের লক্ষণ কিন্তু ইতিমধ্যেই দেখা গিয়েছে। তারা এ পর্যন্ত ১৩ ম্যাচ খেলে (সাউথ আফ্রিকার সঙ্গে প্রথম টেস্টসহ) ৫টিতে জয় পায় আর ৪ টিতে পরাজিত হয় আর এতেই এটা প্রমাণিত। আর ওয়ানডেতেও তারা পরিসংখ্যানের বিচারে বেশ কয়েকটি দলের পেছনেই থাকবেন। এতে বিশ্বক্রিকেটে একক আধিপত্য কিছুটা হলেও ক্ষুন্ন হয়েছে।
এ বছর তারকা ক্রিকেটাররা তেমন সফল না হলেও কয়েকজন দেখিয়েছেন তাদের সেরা পাফরমেন্স। এই যেমন ধরুন শিবনারায়ন চন্দরপল। ক্যারাবিয়ান ক্রিকেটের দুর্দশার চিত্র আমরা সকলেই জানি। তবে এরই মাঝে তিনি কিন্তু নিজেকে ঠিকই প্রমাণ করেছেন। তিনি আইসিসির সেরা খেলোয়াড়ের মর্যাদা পান টেস্টে অসাধারণ পারফরমেন্স প্রদর্শন করে। তিনি মাত্র নয় ম্যাচ খেলে করেছেন ৯০৯রান।
সাউথ আফ্রিকার ডেল স্টেইন বোলিংয়ে ছিলেন অদ্বিতীয়। ১৩ ম্যাচে তার উইকেট সংখ্যা ৬৬। সাউথ আফ্রিকার এ বছরের বোলিংয়ের তুরুপের তাস ছিলেন এই বোলারটিই।
এ বছরই ক্রিকেট বিশ্বে নতুন এক বিস্ময়ের আবির্ভাব হয়েছে যিনি তার ঘুর্নি জাদুর মায়াজালে যে কাউকে আটকানোর ক্ষমতা রাখেন। মুরালীর দেশে মুরালীকে ছাপিয়ে যাওয়ার ক্ষমতাসম্পন্ন বোলার হয়তো মুরালীও মনে মনে খুঁজছিলেন এবং তার শুন্য স্থান পূরনের জন্যই হয়তো বিশ্ব ক্রিকেটে অজন্থা মেন্ডিসের আবির্ভাব হয়। ২০০৮ সালে মাত্র ১৮ টি ওয়ানডে ম্যাচ খেলে তিনি নিয়েছেন ৪৮ টি উইকেট। আর টেস্টে তিন ম্যাচে তার উইকেট সংখ্যা ২৬টি। ক্যারিয়ারে এরচেয়ে ভালো সূচনা আর কি হতে পারে। সুতরাং নতুন বছরটি তিনি নায়ক হিসেবেই শুরু করতে পারবেন। ভারতীয় ক্রিকেটের জন্য যতো সফলতা এসেছে তার সবগুলো একসঙ্গে জড়ো করলে এবং শচীনের সফলতা তারসঙ্গে পরিমাপ করলে কারটা ভারী হবে তা বলা মুশকিল তবে শচীন তার ক্যারিয়ারে যা করেছেন তা বিশ্ব ক্রিকেটের জন্য বিরল। তিনি ক্যারিয়ারের শেষ চাওয়াটাও পূরণ করলেন এই বছর। ব্রায়ান লারার টেস্টের সর্বাধিক রানের রেকর্ড ভেঙ্গে নিজেকে ছাড়িয়ে যাওয়ার লাইনআপে।
এবছর বেশ কিছু মহাতারকার ক্রিকেট ক্যারিয়ারের যবনিকা ঘটেছে এর মধ্যে ভারতের সৌরভ, কুম্বলে, আমাদের রফিক কিংবা মাসুদ,অস্ট্রেলিয়ার গিলক্রিস্ট, কিংবা ইংল্যান্ডের মাইকেল ভন। এরা প্রত্যেকেই সেদেশের জন্য এক একটি নক্ষত্র। আর এই নক্ষত্রদের অবসরে বিশ্ব ক্রিকেটে যে শুন্যতার সৃষ্টি হয়েছে তা কাদের মাধ্যমে পূরণ হবে সেট দেখার জন্য আরো অনেক সময় অপেক্ষা করতে হবে।
সন্ত্রাসীরা যে ক্রিকেটকেও গিলে খেতে চায় সেটারই একটি নমুনা আমরা দেখতে পেলাম আইসিসি চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফি বাতিল হয়ে যাওয়ার মাধ্যমে। পাকিস্তানে সন্ত্রাসী হামলার ভয়ে বেশকিছু দল চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফি খেলতে পাকিস্তান আসতে অপরাগতা প্রকাশ করায় বাতিল হয়ে যায় বিশ্বকাপের পর দ্বিতীয় জনপ্রিয় ক্রিকেট টুর্নামেন্ট। মুম্বাই বোমা হামলায় ্পন্ড হয়ে যায় ইংল্যান্ড-ভারত ওয়ানডে সিরিজ। আগামী দিনে আরো বেশ কিছু সফর হুমকির মুখে। এতো প্রতিকূলতার মধ্যে ক্রিকেট নিয়ন্ত্রক সংস্থা আইসিসির কাছে আমাদের প্রত্যাশা অনেক থাকলেও তাদের উদাসীনতা আর দায়িত্বজ্ঞানহীনতা ক্রিকেটকে ক্ষতির সম্মুখীন করেছে। এই যেমন ধরুন আইসিএল - আইপিএল দ্বন্দ্বের কারণে ক্ষতির সম্মুখীন হচ্ছে বেশ কিছু দেশের ক্রিকেট। তাছাড়া নানা অজুহাতে সফর বাতিল করছে বিভিন্ন দেশ। এটা কি ভাবা যায় পাকিস্তানের মতো বড় দল এ বছর কোনো টেস্টই খেলতে পারে নাই তারপরও আইসিসিও কোনো উদ্যেগ নেয়নি এ বিষয়ে। যে বোমা হামলার অজুহাতে পাকিস্তানে খেলা সম্ভব হয় না সেই বোমা হামলার পরও ভারত তাদের দেশে খেলা চালিয়ে যায়। আর এতেও আইসিসি সজাগ হয়না । সত্যিই এটা ক্রিকেটামোদীদের মধ্যে সংশয়েরই সৃষ্টি করে। তাদের নীরব দর্শকের ভূমিকায় থাকার জন্যই যদি রাখা হয় তবে কারা ক্রিকেটের স্বার্থে এগিয়ে আসবে সে প্রশ্ন আজ সকলের।
বাংলাদেশ সম্পর্কে আসলে লেখার কিছুই নেই আর যদি লিখতেই হয় তাহলে তাদের ভরাডুবির কাহিনী সকলকে শোনাতে হবে। তবে কিউইদের বিরুদ্ধে যদি একটি ওয়ানডে না জেতা যেতো তাহলে হয়তো বাংলাদেশের জন্য বছরটা হতো কালিমালিপ্ত।
সূত্রঃ ইন্টারনেট ।

অনুগ্রহ করে অপেক্ষা করুন। ছবি আটো ইন্সার্ট হবে।




