একদিন মুখখানা বিষণ্ণ করে বারান্দায় বসে আছেন, এমন সময় আমাদের প্রাইমারী স্কুলের হেডস্যার এসে বললেন, 'কি হে কেদারকেষ্ট, মুখ হাঁড়ির মত করে রেখেছ কেন?"
কেদারবাবু বললেন, "আর স্যার, বলবেন না। আমার সেই সিলভারের হুঁকোটা ভেঙে টুকরো টুকরো হয়ে গেল— মুখ হাঁড়ির মত হবে না তো বদনার মত হবে নাকি?"
হেডস্যার বললেন, 'বল কিহে? এ তো কাচের বাসন নয়, কি মাটির পুতুল নয় অমনি অমনি খামখা ভেঙে গেল, এর মানে কি?'
কেদারবাবু বললেন, 'খামখা ভাঙতে যাবে কেন— কথাটা শুনুন না। কাল রাত্রে আমার ভালো ঘুম হয় নি। সকালবেলা উঠেছি, মুখ হাত ধুয়ে তামাক খেতে বসব, এমন সময় কলকেটা কাত হয়ে আমার ফরাসের উপর টিকের আগুন পড়ে গেল। আমি তাড়াতাড়ি যেই আগুনটা সরাতে গেছি অমনি কিনা আঙ্গুলে ছ্যাক করে ফোস্কা পড়ে গেল।
আচ্ছা, আপনিই বলুন— এতে কার না রাগ হয়? আরে, আমার হুঁকো, আমার কলকে, আমার আগুন, আরাম ফরাস, আবার আমার উপরেই জুলুম! তাই আমি রাগ করে— বেশি কিছু নয়— ঐ যে বাঁশের মুগুরখানা দিয়ে পাঁচ দশ ঘা মারতেই কিনা হতভাগা হুঁকোটা ভেঙে খান খান!'
হেডস্যার বললেন, 'তা যাই বল বাপু, এ রাগ বড় চণ্ডাল— রাগের মাথায় এমন কাণ্ড ক'রে বস, রাগটা একটু কমাও।' 'কমাও তো বললেন - রাগ যে মুখের কথায় বাগ মানবে— এ রাগ আমার তেমন নয়।'
'দেখো, আমি এক উপায় বলি। শুনেছি, খুব ধীরে ধীরে এক দুই তিন ক'রে দশ গুনলে রাগটা নাকি শান্ত হয়ে আসে। কিন্তু তোমার যেমন রাগ, তাতে দশ-বারোতে কূলোবে না— তুমি একেবারে একশো পর্যন্ত গুনে দেখো।'
তার কয়েকদিনপর একদিন কেদারবাবু স্কুলের সামনে দিয়ে যাচ্ছেন। তখন দুপুরে টিফিনের সময়, ছেলেরা খেলা করছে। হঠাৎ একটা মার্বেল ছুটে এসে কেদারবাবুর পায়ের হাড়ে ঠাঁই করে লাগল। আর যায় কোথা! কেদারবাবু ছাদের সমান এক লাফ দিয়ে লাঠি উঁচিয়ে দাঁড়িয়েছেন। ছেলের দল যে যেখানে পারে একেবারে সটান চম্পট মারল। তখন কেদারবাবুর মনে হল হেড মাস্টারের কথাটা একবার পরীক্ষা করে দেখি। তিনি আরম্ভ করলেন, এক-দুই-তিন-চার-পাঁচ--
স্কুলের মাঝখানে একজন লোক দাঁড়িয়ে বিড়বিড় করে অঙ্ক বলছে, তাই দেখে ইস্কুলের দারোয়ান ব্যস্ত হয়ে কয়েকজন লোক ডেকে আনল। একজন বলল, 'কী হয়েছে আপনার?'
কেদারবাবু বললেন, 'ষোল-সতেরো-আঠারো-উনিশ-কুড়ি-'
সবাই বলল, 'এ কী? লোকটা পাগল হল নাকি?— আরে, ও মশাই, বলি অমনধারা কচ্ছেন কেন?' কেদারবাবু মনে মনে ভয়ানক চটলেও— তিনি গুনেই চললেন, 'ত্রিশ-একত্রিশ-বত্রিশ-তেত্রিশ-'
আবার খানিক বাদে আর একজন জিজ্ঞাসা করল, 'মশাই, আপনার কি অসুখ করেছে? কবরেজ মশাইকে ডাকতে হবে?'
কেদারবাবু রেগে আগুন হয়ে বললেন, 'উনষাট-ষাট-একষট্টি-বাষট্টি-তেষট্টি-'
এইভাবে দেখতে দেখতে লোকের ভিড় জমে গেল— চারিদিকে গোলমাল, হৈ চৈ।
তাই শুনে হেডস্যার দেখতে এলেন, ব্যাপারখানা কি! ততক্ষণে কেদারবাবুর গোনা প্রায় শেষ হয়ে এসেছে। তিনি দুই চোখ লাল করে লাঠি ঘোরাচ্ছেন আর বলছেন, 'ছিয়ানব্বুই-সাতানব্বুই-আটানব্বুই-নিরেনব্বুই-একশো ।
"কোন্ হতভাগা লক্ষ্মীছাড়া মিথ্যাবাদী বলেছিল একশো গুনলে রাগ থামে?" বলেই ডাইনে বাঁয়ে দুম্দাম্ লাঠির ঘা। ঠাস ঠুস । ধুম ধাম ।
লোকজন পড়িমড়ি করে ছুটে পালাল। আর হেডস্যার এক দৌড়ে সে যে অফিস রুমের মধ্যে ঢুকলেন, আর সারাদিন বেরোলেনই না।
{সুকুমার রায় অবলম্বনে}
মন্তব্য করতে ক্লিক করুন