অরেঞ্জ জুস সাক্ষাৎকার পড়ার পর এই লেখাটা লিখতে চেয়েছিলাম। কিন্তু সময় হয়নি। খেলা দেখতে অফিস বাদ দিয়ে চট্টগ্রাম থেকে ছুটে গিয়েছিলাম ঢাকা। তাই আরো দেরী হলো।
খুব বেশি ম্যাচ দেখার সুযোগ পাইনি। নেপাল, হংকং ও অস্ট্রেলিয়ার সাথে বাংলাদেশের খেলা দেখেছি মাঠে বসে। আমি জানি, মাঠে হারের কি কষ্ট, তা শুধুমাত্র মাঠের খেলোয়াড় ই সম্পূর্ন অনুভব করতে পারে। আমি যত বড় দেশপ্রেমিক হই, যত বড় ক্রিকেট ফ্যান ই হই, সাকিব কিংবা তামিমের থেকে আমার কষ্ট বেশি হবে না কখনোই।
তারপরেও কিছু ঘটনা চোখে পড়েছে। সেগুলোই লেখার চেষ্টা করছি।
১৯৯৯ সালে পাকিস্থানকে হারানোর পরে থেকে ভয়ানক একটা সময় পার করেছিলো বাংলাদেশ, আমরা কেউ সেটা ভুলে যাইনি। কিন্তু তারপরেও সেই দলে চেষ্টার কোন কমতি ছিলো না। যদিও প্রতি ম্যাচ হারের পর ক্যাপ্টেনকে বলতে হতো, "আমরা আজকের ভুল থেকে শিক্ষা নিয়ে সামনে ভালো করবো।" কিন্তু সেই শিক্ষার আর কোন নমুনা দেখা যেতো না।
তারপর একদিন হঠাৎ করে সব পাল্টে গেলো। দাপুটে অস্ট্রেলিয়াকে চমকে দিয়ে ঘুরে দাড়ালো বাংলাদেশ। হোয়াটমোর সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন, "এরা সবাই ই খেলতে জানে, শুধু দরকার আত্মবিশ্বাস।"
কিন্তু একটা নতুন সমস্যা শুরু হলো এখান থেকে।
ক্রিকেট ভদ্রলোকের খেলা। তাই, ক্রিকেটে অনেক সময়ই মাঠের বাইরে এক দেশের খেলোয়াড়ের সাথে অন্য কোন দলের খেলোয়াড়ের সম্পর্ক নজর কাড়ে। প্রমান স্বরূপ আমরা মাশরাফি এবং যুবরাজের কথা বলতে পারি।
অনেকবার দেখেছি লিজেন্ডদেরকে কাছে পেলে প্রায় সব দেশের ক্রিকেটারেরাই আগ বাড়িয়ে গিয়ে আলাপ করতে চায় খেলা নিয়ে। বাংলাদেশের খেলোয়াড়দের মাঝেও ছিলো এটা, কিন্তু এখন আর নেই।
একবার ইংল্যান্ডের মাটিতে বাংলাদেশের বোলারদের বেধড়ক মার খাওয়া দেখে ইয়ান বোথাম 'বিনা পয়সায়' টিপস দিয়েছিলেন বোলারদের।
প্রথম আলোর একটা লেখার কথা মনে পড়ছে এখন, ঢাকায় ওয়াসিম আকরামের আগমন উপলক্ষ্যে ছিলো লেখাটা। ধারাভাষ্য দিতে এসেছিলো সে। আর তখন ঢাকায় থাকা অস্ট্রেলিয়া দলের থেকে ব্রেট লি সবার আগে ছুটে যান লিজেন্ডের কাছে। পত্রিকায় সেই ছবি ছাপা হয়, এবং শেষে লেখা ছিলো, "কি দরকার ছিলো ব্রেট লির আরো কিছু শেখার? তিনি নিজেও তো অনেক জানেন। অথচ কোন বাংলাদেশী বোলারকে ওয়াসিম আকরামের আসে পাশে দেখা যায়নি।"
এই ঘটনা বারবারই ঘটেছে। দানিয়েল ভেট্টরি মোহাম্মদ রফিকের কাছে ছুটে এসেছিলেন আর্ম বলের কারুকার্য রপ্ত করতে। কখনো শুনেছেন কি মোহাম্মদ রফিক কাছে এভাবে ছুটে গিয়েছিলেন?
আমি কাউকে অপমান করছি না। সকলের প্রতি সম্মান রেখেই বলছি, আমাদের চিন্তাধারার পরিবর্তন দরকার।
আজ আমরা ক্রিকেটারদের দেশপ্রেম নিয়ে কথা তুলছি। কিন্তু ভেবে দেখেছি কি, আসল সমস্যা কোথায়?
এক সময় ক্রিকেটারেরা আমাদের আপন মানুষের মত ছিলো। তারা আমাদের মত রাস্তায় চলাচলের জন্যে রিক্সা ব্যবহার করতেন। জাতীয় লিগের খেলা দেখতে গেলে তাদের সাথে কথা বলার সুযোগ হত।
আর আজ ক্রিকেটারেরা সাধারন মানুষের থেকে উপরের অবস্থানে চলে গেছেন।তাই তারা সাধারন মানুষের সেন্টিমেন্ট বোঝার ক্ষমতা রাখেন না। আর তাই এইসব দ্বায়িত্বজ্ঞানহীন মন্তব্য করার দুঃসাহস দেখাতে পারেন।
এবার বাংলাদেশ ক্রিকেট সম্পর্কে ষ্টিভ ওয়াহের করা দুইটি মন্তব্য তুলে ধরছি।
প্রথমত, যখন তাকে জিজ্ঞেস করা হয়েছিলো, ক্রিকেটে উন্নত ও অনুন্নত দেশগুলোর মাঝে মূল পার্থক্য কোথায়?
তিনি উত্তর দিয়েছিলেন, "আমাদেরকে টাকা দেয়া হয় প্রতিটা রান করার জন্যে, প্রতিটা বল করার জন্যে, প্রতিটা উইকেট নেয়ার জন্যে"
(তখনো বাংলাদেশ ক্রিকেটে প্রফেশনালিজম চালু হয়নি। প্রাপ্য টাকা আদায় করার জন্যে আন্দোললন করছিলেন আকরাম, বুলবুলেরা)
এর অনেক দিন পর, তাকে জিজ্ঞাসা করা হয়েছিলো, বাংলাদেশে এতো বড় সংখ্যক ক্রিকেট পাগল জনগোষ্ঠী থাকা স্বত্তেও মাঠে সমর্থন এতো কম থাকে কেনো?
তিনি উত্তর দিয়েছিলেন, "বাংলাদেশের খেলোয়াড়দেরও সুযোগ আছে দেশের মানুষের কাছে কিংবা বিশ্বের ক্রিকেট পাগল মানুষের কাছে রোলমডেল হবার। কিন্তু তার জন্যে তাদের দলগত পারফর্ম্যান্স ভালো হতে হবে আর দলে এমন খেলোয়াড়ে সংখ্যা বাড়তে হবে যাদেরকে দর্শক দূর থেকেও চিনতে পারে"
ষ্টিভ ওয়াহ একটা কথা বলবেন, আর মাঠে সেটা সত্য হবে না, এমন ঘটনা ক্রিকেটে বিরল। মোহাম্মদ আশরাফুল, মাশরাফি কিংবা সাকিব আল হাসানের আগমনের পর থেকে মাঠে দর্শক উন্মাদনা বাড়তে থাকে। আজ বাংলাদেশ বুঝতে শিখেছে হোম কন্ডিশন কাকে বলে।
কিন্তু সব থেকে অবাক লাগে যখন শুনি এই দর্শক উন্মাদনা নাকি আমাদের খেলোয়াড়দের উপর অতিরিক্ত চাপ প্রয়োগ করে।
বাংলাদেশের অনেক দুঃসময়ে গ্যালারিতে থাকার সুযোগ হয়েছে আমার। এটুকু গর্বের সাথে বলতে পারি, এই যূগের দর্শকেরা বিপদের দিনে ক্রিকেট দলকে ফেলে যায়নি। নিশ্চিত পরাজয় জেনেও মাঠে বসে চিৎকার করে গলা ফাটিয়েছে।
এটাকে আপনারা প্রত্যাশার চাপ বলেন? তাহলে আমি দুঃখিত, আপনারা প্রত্যাশার সজ্ঞা জানেন না। আমরা শুধু এটাই আপনাদেরকে জানাই, আমরা আপনাদের পাশে আছি। তার মানে এই না যে আপনারা রাতারাতি বিশ্ব জয় করবেন সেই স্বপ্ন দেখি আমরা। প্রত্যাশা করি আপনারা আমাদের আরো বড় স্বপ্ন দেখার সাহস জুগাবেন।
পাইপ লাইনের খেলোয়াড় প্রসঙ্গঃ এখনকার খেলোয়াড়েরা দেশকে কিছু দিয়েছেন, তাই তারা অনেক কিছু বলার ক্ষমতা রাখেন। এক সময় দল নির্বাচনে বোর্ডের সিদ্ধান্ত ছিলো চুড়ান্ত। আজ সেটা হলে আমরা ক্যাপ্টেনকে প্রেস কনফারেন্স করতে দেখি।
মনে পড়ে সেই দিনগুলোর কথা, যেদিন একজন মুশফিক কিংবা একজন এনামুলের খোঁজে দৈনিক ৩/৪ জন করে নতুন খেলোয়াড়কে নামানো হতো মাঠে? আপনারা কি তার থেকে ভালো অবস্থায় নেই আজ?
মনে পড়ে সেই আনোয়ার হোসেনের কথা, ফার্স্ট ক্লাসে সেঞ্চুরী করে জাতীয় দলে সুযোগ পাওয়া এই উইকেট কিপার ব্যাটস্ম্যান, যাকে পাইলটের উত্তরসুরি ভাবা হতো, তিনি হারিয়ে গেলেন মাত্র এক ম্যাচ খেলেই? সেদিন তার পক্ষে কথা বলার জন্যে কাউকে পাননি তিনি ।
আজকে আপনাদের পক্ষে কথা বলার জন্যে আমরা হাজার হাজার মানুষ এক কাতারে দাঁড়িয়ে। সেটাই কি তবে আপনাদের গলার কাটা?
ঠিক একইভাবে প্রত্যাশার চাপের কথা বলেছিলেন মোহাম্মদ আশরাফুল। সেদিন মানুষ হেসে গড়াগড়ি খেয়েছিলো তার কথায়। আজ কিন্তু কেউ হাসছে না। কারন আজ আপনাদের প্রতি মানুষের শ্রদ্ধা অনেক অনেক বেশি ।
এই শ্রদ্ধা কিন্তু এই কারনে নয় যে আজ আপনারা মন্ত্রীদের মত ভিয়াইপি প্রটোকল পান। এটা এই জন্যেই যে আপনারা আমাদের বিশ্বাসের প্রতিদান আপনাদের পূর্বসুরিদের থেকে বেশি দিয়েছেন।
আজ দেখি খেলোয়াড়দের মধ্যে সিন্ডিকেট তৈরী হয়েছে। যা মোটেও ভালো লক্ষ্যন নয়। আমি একতা না বলে সিন্ডিকেট বলছি এই কারনে, শুধুমাত্র কয়েকজন খেলোয়াড়কে বাদ দিলেই অন্য কয়েকজনকে সেটা নিয়ে কথা বলতে দেখছি । এবং সব থেকে অবাক বিষয়, সেই সব খেলোয়াড়দের মাঝে চেষ্টার কমতি মাঠের বাইরে থেকে ও চোখে পড়ছে।
মাহমুদুল্লাহ এর কথা না বললেই নয়। মাঠে তার আলস্য এবং বিগ ডেথ ওভারে তার বিগ শট খেলার প্রতি অনীহা সন্দেহ জাগাতে বাধ্য। যদিও তার ক্ষমতা নিয়ে কোন প্রশ্ন নেই। তারপরেও তিনি চেষ্টা করেননা কেনো কিংবা চেষ্টা না করার পরেও দলে থাকা এবং দলে থেকে বাদ পড়লে কয়েকজন খেলোয়াড়ের তার প্রতি সমর্থন দেয়া কি সন্দেহজনক নয়?
এখনো কেউ ম্যাচ ফিক্সিঙ্গের কথা তুলছে না। কিন্তু এভাবে চলতে থাকলে অবশ্যই তুলবে। টিমে যদি সিন্ডিকেট থাকতে পারে, ফিক্সিং থাকতে অসুবিধা কোথায়?
কিছুদিন আগে আমার ভাই তামিম এবং সোয়েব মালিকের সঙ্গে এক বিজ্ঞাপনে কাজ করেছিলো। সেদিন দেখা গেলো, তার ফেসবুক প্রোফাইল ভরা সোয়েব মালিকের ছবি। আমি বললাম, "এ কি? দেশী খেলোয়াড় বাদ দিয়ে পাকির সাথে ছবি কেনো?"
উত্তর দিলো, "তামিম ঠিকমত কথাই বলেনি। ছবি তোলার কথা বলার সাথে সাথেই "না" করে দিয়েছে।"
এর কাছাকাছি অভিজ্ঞতা আমারও আছে, সেগুলো আর বলে লেখা বড় করছি না।
এখন ক্রিকেট দলের দুঃসময় চলছে। আগে যেমন ছিলাম, এখনো তেমনি সাথে আছি। নিজেদের দোষ পারিপার্শ্বিকতার উপর চাপানো বন্ধ করুন। আসল সমস্যা খুঁজে বের করে সেটার সমাধান করুন।
না পারলে দূর হন। একসাথে ১৩/১৪ জন আইসিএলের যাওয়ার পরেও যদি আমরা দল ঠিক রাখতে পারি, আপনারা গেলেও আমাদের কিছু যাবে আসবে না।
আবোল - তাবোল বকে নিজেদের মন্ত্রীস্থানীয় বলদ প্রমান করার দরকার নেই।
ছবিটা বিশ্বকাপে দক্ষিণ আফ্রিকার সাথে সেই ভয়াবহ ব্যাটিং ধ্বসের সময়ের
সর্বশেষ এডিট : ০৩ রা এপ্রিল, ২০১৪ দুপুর ১২:৪০