২০০৬ সালের কথা, এইচ এসসি বাংলা ২য় পত্র পরীক্ষার আগের দিনের ঘটনা। বাসার গেট খুলে রাস্তায় তাকিয়েই দেখি দুজন মানুষ রাস্তায় পড়ে আছে ২০ থেকে ২৫ হাত দূরত্বে। মাঝখানে বিদ্যুতের তার। সামনের জনের গলা কেটে গলগল করে রক্ত বেরোচ্ছে। পিছনের জনের কোন নড়াচড়া কিংবা কোন গোঙ্গানী ও শোনা যাচ্ছে না। ঘটনা হলো, দুজন ছিলো এক বাসের ছাদে। কোন এক বাসায় বিদ্যুতের কাজ করার কারনে তারগুলো স্বাভাবিকের থেকে ছিলো নিচে। দুজনের কেউই হয়ত সেটা খেয়াল করেনি, অথবা খেয়াল করলেও কিছু করার ছিলো না। একজন স্পট ডেড, অন্যজনকে হাসপাতালে নেয়ার পরের ঘটনা আমার জানা নেই।
কাহিনী শুরু এরপর। যারা বিদ্যুৎ লাইনে কাজ করছিলো, তারা সঙ্গে সঙ্গে বহিষ্কার, অভিযোগঃ দ্বায়িত্বে অবহেলা। বিকালে এদের ই একজন রাস্তা দিয়ে যাওয়ার সময় আক্ষেপ করতে করতে বলছিলো, "আমার বিরাট বাশ হয়ে গেছে রে। পুরো এক সপ্তাহ বহিঃষ্কার"
দুঃখের বিষয়, তার দ্বায়িত্বে অবহেলার কারনে যেই লোকটা মারা গেলো, সেটা নিয়ে তার কোন অনুতাপ নেই। এমন কি সেই লোকটা তার পরিবারের একমাত্র আর্নিং মেম্বার জানানোর পরেও তার কোন ভাবান্তর দেখা গেলো না।
আমরা জাতিগত ভাবেই একরোখা হতে পচন্ড পছন্দ করি। বিশেষত আমাদের ড্রাইভার সম্প্রদায় এই ব্যপারে সব থেকে এগিয়ে। তাদের কথা শুনলে মাঝে মাঝে মনে হয় আইনের সৃষ্টি হলো এই দুনিয়ার সব থেকে ভুল সিদ্ধান্ত। একদল মানুষের জীবন যে তার চার হাত-পায়ের মাঝে বন্দী সেটা এতোই তুচ্ছ একটা বিষয়, যে সেটা নিয়ে ভাবার চাইতে আমেরিকাতে কোন গ্রাম আছে কিনা সেটা নিয়ে চিন্তা করা বেশি গুরুত্বপূর্ন।
যাইহোক, আমি এখন ড্রাইভারের দোষ ধরতে আসিনি। এই দেশে বুদ্ধিমান এবং দুঃসাহসী মানুষের পরিমান আশংকা জনক হারে বেশী। দুঃসাহস দেখাতে দেখাতে কখন যে সাহস দেখানো উচিত আর কখন ধৈর্য্য ধরা উচিত, সেই জ্ঞান অনেকের ই থাকে না। তাই, সব সময় ড্রাইভারের কিছু করার ও থাকে না।
আমাদের দেশে আরেক শ্রেণীর ভয়ানক মানুষ আছে, যারা কিনা যে কোন ধরনের সমস্যার সমাধান করতে অসম্ভব পটু। যেমন ধরা যাক ব্যাটারি চালিত অটোরিক্সার কথা। হঠাৎ একদিন একজন আবিষ্কার করলেন, এই গাড়ির মাধ্যমে পরিবেশ দূষণের প্রতিকার হচ্ছে। কিভাবে? কারন হলো, এই গাড়ি থেকে ধোয়া বেরোচ্ছে না।
কিন্তু এটা চিন্তা করলেন না, আপনি রিচার্জ করতে বিদ্যুৎ ব্যবহার করছেন, সেই বিদ্যুৎ পরিবেশ দূষণ করেই তৈরী হচ্ছে।
যাক সে কথা। বিদ্যুৎ তো লাগবেই। কিন্তু এই ব্যাটারি যারা ব্যবহার করছেন, ব্যবহার শেষে এই ব্যাটারিকে কোথায় পরিত্যাগ করতে হবে, তা কি তাদের কে শেখানো হয়েছে? এই ব্যাটারিকে যেখানে সেখানে ফেললে এর মধ্যে থাকা জিংক ও সীসা যে মিউনিসিপ্যাল ওয়েস্টের ধোঁয়ার সাথে মিশে ধোঁয়াশা সৃষ্টি করে আপনার আমার শ্বাষ-প্রশ্বাস বন্ধ করে দেবে না তার গ্যারান্টি কি দিতে পারেন? এই দূষন যে এখনকার অবস্থার থেকে অনেক বেশী বাজে অবস্থা সৃষ্টি করতে পারে তা কি চিন্তা করতে পারছেন?
এরপরে আসছে ব্যাটারি চালিত রিক্সা। ব্যাটারি সম্মন্ধীয় সকল সমস্যা তো আছেই। তার উপর দ্রুতযানের যেমন ব্রেকিং সিস্টেম থাকা উচিত, তার কিছুই নেই। নেই কোন Rear view সিস্টেম। যার ফলে এক্সিডেন্টের ও কোন কমতি নেই এই রিক্সার। তারপরও সেই মূলার দিকে আমাদের চোখ। পরিবেশ দূষণ কমাচ্ছি আমরা।
বাংলা একটা প্রবাদ আছে না, কেমন জানি, "সামনে এক টাকা আর পিছনে হাজার টাকা"
একটা অনুরোধ, এই 'সকল সমস্যা সমাধানকারী' মানুষগুলো থেকে একটু সাবধান থাকুন। নিজের চোখ-কান খোলা রাখুন। সাময়িক লাভের আশায় আত্মহুতি দেবেন না।
পরিশেষে, আমরা কেউ ই সাধু পুরুষ নই। দ্বায়িত্বে অবহেলা আমরা সবাই করি, কম আর বেশি। কিন্তু আমার অবহেলা যেনো কারো মৃত্যুর কারন না হয়ে দাঁড়ায়, সেদিকে লক্ষ্য রাখা উচিত। কথায় বলে, একজন ডাক্তার কিংবা উকিল একবার ভুল করলে মারা যায় একজন করে মানুষ। আর একজন প্রকৌশলীর এক ভুলে মারা যেতে পারে এক দল মানুষ। সে যাই হোক, সকল মানুষের জীবন ই মূল্যবান। সে একজন হোক আর একদল।
সচেতন হোন, অন্যের জীবনের কথা ভাবতে ইচ্ছা না হলে নিজের নিরাপত্তার কথা ভাবুন। আপনার একরোখা স্বভাব কিংবা সেচ্ছাচারিতায় দ্বায়িত্বে অবহেলা আপনার নিজের ও জীবন কেড়ে নিতে পারে, সেকথা অন্তত চিন্তা করুন। রেলগাড়ি কোন এক টনী প্রাইভেট কার নয় যে হুইসেল দিয়ে দুই গজের মাঝখানে থেমে যাবে। তাই নিজের জীবন বাঁচাতে নিজে সচেতন হোন। সেই সঙ্গে আসুন দেশের সকল লেভেল ক্রসিঙ্গের নিরাপত্তা জোরদারের দাবী তুলি।
বিগত কয়েকদিনে রেল দুর্ঘটনায় যারা প্রান হারিয়েছেন, তাদের পরকালীন শান্তি কামনা করছি ও তাদের পরিবারবর্গের প্রতি সমবেদনা।