শীতনিদ্রায় ছিলাম। ছিলাম এক ধরণের স্বেচ্ছা নির্বাসনে।
জাগিয়ে তুললো শাহবাগের জনতরঙ্গের গর্জন। পাঁচ হাজার মাইল দূর থেকে ভেসে আসা সহস্র কন্ঠের সেই আওয়াজ আমার ঘুম কেড়ে নিল।
এমন নয় যে এত বড় জনসমাবেশ আগে দেখিনি। জনতার এমন বহু বাঁধভাঙ্গা জোয়ারের সাক্ষী আমাদের যৌবনকাল।
এমন নয় যে তরুণদের এমন বিদ্রোহ আর দেখিনি। আমাদের যৌবনের নয়টি বছর কেটেছে লাঠি-গুলি-টিয়ার গ্যাসে।
সে এক আশ্চর্য সময় ছিল। সাম্যবাদের স্বপ্ন তখনো গুঁড়িয়ে যায়নি।
সে এক অমানিশার কাল ছিল। স্বদেশ তখন চাপা পড়ে ছিল জলপাই রঙাদের বুটের নীচে।
গণতন্ত্র তখনো এক স্বপ্ন, আজকের প্রহসন নয়।
তারপর একদিন আজকের শাহবাগের মতোই রাস্তায় জনস্রোত নেমেছিল।
জলের কাতারে যুক্ত হয় জল। বেড়ে যায় স্রোতের সাহস....
সেই স্রোতের তোড়ে একদিন খড়কুটোর মতো ভেসে যায় সবকিছু...
এরপর বাকীটা ইতিহাস।
স্বপ্ন ভঙ্গের ইতিহাস। কপটতার, শঠতার, বিশ্বাসঘাতকতার ইতিহাস।
এর মধ্যে পেরিয়ে গেছে ২২ বছর।
আমাদের যৌবন গতায়ু।
আমরা স্বপ্নহীন।
আমরা নিদ্রাতুর।
আমার শীতনিদ্রার শুরু।
---------------------------------------
পাঁচ হাজার মাইল দূর থেকে ভেসে আসা শাহবাগের গর্জন সমূদ্রের সহস্র ঢেউয়ের মতো আছড়ে পড়ে আমার কানে।
আমাকে পাশ ফিরতে হয়। আমাকে চোখ খুলতে হয়। আমাকে উঠে দাঁড়াতে হয়।
২৫ বছর অনেক দীর্ঘ সময়। তারপরও আমাকে শাহবাগে ফিরতে হয়।
পল্টন মোড় থেকে পুলিশ ভ্যানে কতক্ষণের রাস্তা?
এইতো, পুলিশ কন্ট্রোল রুম।
এটাই তো সেই কয়েদখানা।
কতজন ছিলাম আমরা? তিরিশ? চল্লিশ? পঞ্চাশ?
ডান হাতটা টন টন করছে ব্যাথায়। ফুলে উঠেছে বেশ।
হাত উঁচিয়ে ঠেকাতে গিয়ে পুলিশের লাঠির বাড়িটা পড়েছিল ওখানটায়।
মেঝের ওপর টপ টপ করে রক্ত পড়ছে।
আমার নয়, পাশের জনের। থেঁতলে যাওয়া আঙ্গুল, মাথাও কি ফেটেছে?
দৈনিক সংবাদের পাতাটা পেতে দেই।
আপনি কি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র ?
না, আমি সাংবাদিক, সচিত্র সন্ধানীতে লিখি।
খুব লেগেছে বোধহয়।
হ্যা, মাথাটা ঝিমঝিম করছে।
কয়েদখানার মুখে দাঁড়িয়ে পুলিশ।
ভাই এক গ্লাস পানি হবে।
চুপ শুয়োরের বাচ্চা। এই শালারে এক গ্লাস পেচ্ছাব এনে দে।
দেয়ালের ওপর দিয়ে এক ফালি আকাশ উঁকি দিচ্ছে। পায়ের পাতার ওপর ভর করে দাঁড়ালে জাদুঘরটাও চোখে পড়ে।
এখান থেকে মুক্তি মিলবে কি?
ঘটাং করে দরোজা খুললো। আরও জনা দশেকের চালান এসেছে।
ভাই, পাশের সেলের অবস্থা দেখেছেন? গুলি খাওয়া তিন জনের লাশ পড়ে আছে।
একজনের খালি গা। বুকে-পিঠে শ্লোগান লেখা।
বুক তার বাংলাদেশের হৃদয়।
নুর হোসেনের বয়স কত হতে আজ? ৪৫? ৪৭?
আমি শাহবাগের জনস্রোতে নুর হোসেনের মুখ খুঁজে বেড়াই।
খুঁজি আত্রাই বাবু, এনায়েত কবীর, নাসির-উদ-দুজার মুখ।
টেলিভিশনের পর্দায় চেহারাগুলো ঝাপসা।
একটা মেয়ে দুলে দুলে শ্লোগান দিচ্ছে।
চশমাটা খুঁজে পাচ্ছি না।
আমার চোখে বাস্প জমছে।
আমার রক্তে বান ডাকছে।
আমি বাতাসে আরেক ফাল্গুনের গন্ধ পাচ্ছি।
আমাকে জাগতে হয়।
এখন জেগে উঠার সময়।
সর্বশেষ এডিট : ০৯ ই ফেব্রুয়ারি, ২০১৩ দুপুর ১:৩১

অনুগ্রহ করে অপেক্ষা করুন। ছবি আটো ইন্সার্ট হবে।




