গল্পের প্রথম পর্বটি পড়তে এখানে ক্লিক করুন
এর পর প্রায় মাসচারেক সময় পার হয়ে গেছে। সিমিন পুরোপুরি প্রফেশনাল হয়ে উঠেছে এরই মধ্যে । বেশ দক্ষতার সাথেই ব্যবস্থাপনা পরিচালকের দায়িত্ব পালন করে যাচ্ছে। অর্কের সাথে তার সম্পর্কের তেমন কোনো পরিবর্তন হয়নি সবকিছু আগের মতই আছে। এই জীবনে কোন কিছুই তাকে কোনোদিন চাইতে হয়নি। কোটিপতি বাবার একমাত্র কন্যা সে। কোনো কিছু চাওয়ার আগেই পেয়ে যেতে অভ্যস্ত। অথচ আজ যাকে মনেপ্রানে চাইছে, সে আগেই অন্য কারো হয়ে বসে আছে। এই অপ্রিয় সত্যটা কিছুতেই মানতে পারছেনা সিমিন। কেনো অর্কের সাথে তার আরো আগে দেখা হল না? কেনো!!! সিমিনের মাঝে মাঝে খুব ইচ্ছে করে অর্ককে তার ভালোবাসার কথা জানিয়ে দিতে। কিন্তু এর পরিনামের কথা চিন্তা করে শিয়রে উঠে সিমিন। অর্ক যদি তাকে অপমান করে বসে? অর্কের মনে যদি তার প্রতি তীব্র ঘৃনা জেগে উঠে? সিমিনকে যদি খুব বাজে চরিত্রের মেয়ে ভেবে বসে অর্ক? প্রশ্নগুলো প্রতিটি মুহুর্ত যন্ত্রনা দেয় সিমিনকে। অসহ্য মানসিক যন্ত্রনায় মাঝে মাঝে চিৎকার করে কেঁদে উঠে সিমিন। সে জানে, তার মনে যে কষ্ট; যে তীব্র যন্ত্রনা; তা কেউ বুঝবে না। বুঝতে চাইবেও না!!
সিমিনদের কোম্পানী বিশাল একটা প্রজেক্টের কাজ শুরু করেছে। প্রজেক্টের লোকেশন চট্রগ্রাম। এই মুহুর্তে সাইট ভিজিট করা খুবই জরুরী হয়ে পড়েছে । ওখানে নাকি ছোটখাটো একটা সমস্যও চলছে ইদানিং। অর্কের সাথে এই ব্যাপারটা নিয়ে কথা বলে খুব দরকার। সে ছাড়া এসব ঝামেলাগুলো এত স্মুথলি কেউ ম্যানেজ করতে পারবে বলে সিমিনের মনে হয়না।
--ম্যাডাম কি আমাকে ডেকেছিলেন?
--অর্ক সাহেব, প্লিজ বসুন। আমরা চিটাগং-এ যে নতুন প্রজেক্ট শুরু করেছি ইমিডিয়েটলি ওখানটায় যাওয়া জরুরী হয়ে পড়েছে। আর ওখানে যে ইদানিং কিছু সমস্যা চলছে তাতো আপনি আগেই জানেন। আমি আপনাকে ছাড়া আর কাউকে ভরসা করতে পারছিনা।
--ম্যাডাম, আমার প্রতি আপনার ভরসা বোধ হয় একটু বেশীই! মুচকি হেসে রসিকতার সুরে বলল, অর্ক।
--হাহাহাহাহা! হুম ঠিকই বলছেন আপনি।
--আমার তাহলে কখন রওনা দিতে হবে?
--আগামীকাল সকাল সকাল হলে ভালো হয়।
--ম্যাডাম, ইফ ইউ ডোন্ট মাইণ্ড আমার একটা প্রস্তাব ছিল।
--দেখুন অর্ক সাহেব আমি কিন্তু আপনাকে বন্ধুর মতই মনে করি। আপনার কাছে আমি কখনোই এত ফর্মাল বিহেভ আশা করিনা। আর আমি আপনার যেকোনো প্রস্তাবে চোখ বন্ধ করে রাজী হয়ে যাবো, তবে এক শর্তে! আপনি প্লিজ আমাকে আর ম্যাডাম ম্যাডাম ডাকতে পারবেন না! বলুন রাজী??
অর্ক হো হো করে উচ্চস্বরে হেসে উঠল। অর্ককে এভাবে হাসতে সিমিন কখনো দেখেনি। অর্ক যে এত সুন্দর করে প্রান খুলে হাসতে পারে সিমিনের জানা ছিলনা।
--সরি একটু বেশীই হেসে ফেললাম বোধ হয়! বাই দ্যা ওয়ে ম্যাডাম, শত হলেও আপনি কিন্তু আমার বস।
--নো আমি আপনার বস না। আমি আপনার বন্ধু। এখন থেকে আপনি আমাকে সিমিন বলে ডাকবেন। ওকে??
--জো হুকুম ম্যাডাম!
--আবার ম্যাডাম!! দিজ টাইম আই এম রিয়েলী গেটিং এংরি, অর্ক! মৃদু হেসে বলল সিমিন।
--অল রাইট মিস সিমিন! ইউ আর নট মাই বস এনিমোর! হেপী?
--থ্যাক্স এ লট অর্ক! এবার আপনার প্রস্তাবটা শুনতে চাই। যদিও আমার উত্তর পজিটিভই হবে।
--মিস সিমিন, আমি চাই আপনিও আমার সাথে চলুন চিটাগং। চিটাগং খুব সুন্দর একটা শহর। প্রজেক্টের কাজের ফাঁকে আমি আপনাকে শহরটা ঘুরিয়ে দেখাবো। আপনার ভালো লাগবে। তাছাড়া আপনি তো জানেন এই প্রজেক্ট আমাদের কোম্পানীর জন্য কতটা গুরুত্বপূর্ণ। আপনি সাথে থাকলে আপনার সাথে ডিসকাস করে অনেক প্রব্লেম ইজিলি সল্ভ করতে পারতাম!
অর্কের কথাগুলো সিমিনের কাছে সপ্নের মত মনে হচ্ছিল। অর্ক কি কথাগুলো আদৌ বলেছে? আচ্ছা অর্ক কি সত্যিই তাকে চিটাগং শহর ঘুরিয়ে দেখাতে চায়?
--মিস সিমিন আপনি কি যাচ্ছেন আমার সাথে? অবশ্য আপনার পারসোনাল প্রব্লেম থাকলে আমি কখনোই ইনসিস্ট করবনা।
--আপনি কি আমাকে পাগল ভেবেছেন? এত সুন্দর একটা প্রস্তাবে আমি কিভাবে অরাজী হই? এন্ড ইউ নো অর্ক, আমি একদম ছোটবেলায় আমেরিকায় চলে গিয়েছিলাম। ওখানেই আমার বেড়ে উঠা। দেশে খুব কম আসা হত আর আসলেও অল্প কদিনের জন্য। বাংলাদেশের বেশীরভাগ জায়গা এখনো আমার ঘোরা হয়নি। এই প্রজেক্টের বাহানায় চিটাগং শহরটা একটু ঘুরে দেখা হবে। আমি কিন্তু দারুন এক্সাইটেড!
--থ্যাঙ্ক ইউ মিস সিমিন। ইটস মাই প্লেজার টু হেভ ইউ ইন দি জার্নি। তাহলে আমরা কাল সকালে রওনা হচ্ছি।
অর্ককে যতই দেখছে ততই মুগ্ধ হচ্ছে সিমিন। কাজের প্রতি অর্কের সিনসিয়ারিটি, রেসপন্সিবিলিটি, ডেডিকেশন অ্যান্ড পেশন চোখে পড়ার মত।
--কাজ করতে করতে তো বোধ হয় আমাকে চিটাগং ঘুরিয়ে দেখানোর কথা ভুলেই গিয়েছেন, অর্ক।
--আমি আসলেই ভাবতে পারিনি কাজের মধ্যে এতটা সময় ব্যয় হয়ে যাবে। আমাদের তো প্রায় ফেরার সময় হয়ে গেল।
--কিন্তু আমি প্রচন্ড টায়ার্ড অর্ক। এই মুহুর্তে ঢাকায় ফিরে যাওয়ার এনার্জি আমার একেবারেই নেই। কেন ইউ কান্ডলি বুক মি এ হোটেল রুম প্লিজ? আর আপনি ঢাকা চলে যান। আমি আজকের রাতটা হোটেলে কাটিয়ে কালকে ঢাকা ব্যাক করব।
--হুম বুঝলাম। আপনি আসলে আমাকে আপনার বন্ধু ভাবেন না। বন্ধু ভাবলে এভাবে অন্তত বলতে পারতেন না। আর আপনাকে এখানে একা রেখে আমার পক্ষে ঢাকা ব্যাক করা সম্ভব না।
--অহ মাই গড...আই ওয়াজ জাস্ট থিংকিং এবাউট ইউ। এবাউট ইউর ফ্যামিলি। আমার জন্য আপনাকে খামাখা ঝামেলায় ফেলতে চাচ্ছিলাম না অর্ক।
--ইউ ডোন্ট হ্যাভ টূ অরি এবাউট ইট। আই উইল ম্যানেজ মাই ওয়াইফ। ইউ নো সি ইজ কোয়াইট সুইট এন্ড আন্ডারস্ট্যানডেবল গার্ল। তাছাড়া আমাকে অফিসের কাজে তো প্রায়ই ঢাকার বাইরে এমনকি দেশের বাইরেও থাকতে হয়। নীলা একা থেকে অভ্যস্ত। আমার পরিচিত খুব ভালো একটা হোটেল আছে এখানে। আমি ওখানে ফোন করে দুটা রুম বুক করে রাখছি।
“সো হার নেইম ইজ নীলা, রাইট? সাচ এ লাকি গার্ল”! কথাটা মুখ ফসকে বলে ফেলেছে সিমিন। ভাগ্যিস অর্ক সেভাবে খেয়াল করেনি!
--হোটেল তো বুক হয়ে গেল। চলুন হোটেলে যাই। আপনার বিশ্রাম দরকার। খুব ক্লান্ত দেখাচ্ছে আপনাকে।
--আমার এখনই হোটেলে যেতে ইচ্ছা করছেনা অর্ক। আসুন না কোথাও বসে কিছুক্ষন গল্প করি।
--তাহলে তো খুবই ভালো হয়। আপনার সাথে এখন পর্যন্ত তো কাজের বাইরে তেমন কোনো কথাই বলা হয়নি। এই সুযোগে আপনার সাথে জমিয়ে কিছুক্ষন আড্ডা দেয়া যাবে।
--হুম আমার ও খুব ভালো লাগবে আপনার সাথে আড্ডা দিতে। ইউ নো ওয়ান থিং অর্ক...আমি তো ভেবেছিলাম আপনি আড্ডাই দিতে পারেন না।
--হাহাহাহাহা। আপনি বোধ হয় আমাকে একটু বেশিই বোরিং ভাবেন, তাই না?
অনেকক্ষন ধরে আড্ডা চলছে ওদের মধ্যে। সিমিন তার প্রবাস জীবনের কিছু মজার ও তিক্ত অভিজ্ঞতা শেয়ার করল অর্কের সাথে। এদিকে অর্কও নীলার সাথে তার প্রথম পরিচয়, প্রেম অতঃপর বিয়ের ঘটনা গুলো শেয়ার করল।
--নীলাকে খুব খুব ভালোবাসেন, তাই না অর্ক?
--হ্যা অনেক ভালোবাসি। তবে আমার মনে হয় নীলা আমাকে তার চেয়েও কয়েকশগুন বেশী ভালোবাসে।
অর্ক যখন হেসে হেসে এসব কথা বলছিল, প্রচন্ড কষ্ট হচ্ছিল সিমিনের। ইচ্ছে করছিল চিৎকার করে বুক ফাটিয়ে কিছুক্ষন কাঁদতে। নিজেকে অনেক কষ্টে নিয়ন্ত্রন করল সিমিন। ভালোবাসা মানুষকে এত কষ্ট দেয় কেন?
--আপনার কথাও কিছু বলেন সিমিন। আপনি কি কাউকে ভালোবাসেন?
অর্কের কথা শুনে প্রথমে কিছুটা ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে গেল সিমিন। কি বলবে ভেবে পাচ্ছিল না। আসলে কি-ই বা বলবে সে? উত্তরে শুধুই একটা মুচকি হাসি দিল।
--মিস সিমিন আপনি কি জানেন আপনি কতটা সুন্দর? আপনার মত রুপবতী নারী আমি আমার জীবনে দেখিনি। আপনি শুধু দেখতেই সুন্দর না...আপনার মত এত অমায়িক, এত ভদ্র, এত মিষ্টি যে কোনো মেয়ে হতে পারে আমার জানা ছিল না। আপনি যাকে ভালোবাসবেন নিঃসন্দেহে সে হবে এই পৃথিবীর সবচেয়ে সৌভাগ্যবান পুরুষ।
-- একটা কথা জানেন মিঃ অর্ক, আপনি চিন্তাও করতে পারবেন না আমি কতটা দুঃখী...কতটা অভাগী একটা মেয়ে!
--এভাবে বলছেন কেন সিমিন? আপনার কেন এত দুঃখ?
--আপনাকে বলতে পারবনা অর্ক। বললে আপনি আমাকে খুব খারাপ ভাববেন। ঘৃনা করবেন আমাকে।
--আমি আপনাকে ঘৃনা করবনা। কোনো মানুষের পক্ষে আপনাকে ঘৃনা করা সম্ভব না। আমাকে আপনার দুঃখের কথা খুলে বলুন সিমিন। দেখবেন আপনার অনেক হাল্কা লাগবে।
--মিঃ অর্ক আমি আপনাকে ভালোবাসি। অনেক অনেক ভালোবাসি। আমাকে প্লিজ ক্ষমা করে দিন। কথাটা বলার পর নিজেকে আর নিয়ন্ত্রন করতে পারল না সিমিন। চিৎকার করে কেঁদে উঠল।
অর্ক পাথরের মত শক্ত হয়ে গেল। তার মনে হচ্ছিল সে একটা গাছ হয়ে গেছে। সিমিন মেয়েটা পাগলের মত কাঁদছে অথচ একটা বারের মত সান্ত্বনা দেওয়ার ক্ষমতা তার নেই। আকাশের দিকে তাকিয়ে শুধু মনে মনে বলল, হে সৃষ্টিকর্তা তুমি আমাকে এতটা অক্ষম করে কেন পাঠালে?
চলবে(পরবর্তী পর্ব শীঘ্রই প্রকাশ করব) সম্পূর্ণ গল্পের লিঙ্ক
সর্বশেষ এডিট : ২৮ শে জানুয়ারি, ২০১১ বিকাল ৪:১৫