জেলেপল্লীতে রাত সহজে শেষ হতে চায় না।
তাই শেষরাত্রে চাদ ঢলে পড়ার সময় হতেই অনেকে এক এক উঠে পড়তে শুরু করে। পিতেম অনেন ধরে উঠি উঠি করে শেষপর্যন্ত বিছানার আয়েশ ত্যাগ করে বাইরে এসে দাড়ায়। আকাশের কালো রঙ ফিকে হতে শুরু করেছে । সমুদ্রের দিকে তাকালে দৃষ্টি এমনিতে দিগন্তে চলে যায় আর এখনতো দুর সমুদ্রে যাত্রাকরা নৌকোগুলোর ফিরে আসার সময়। যতদুর দেখা যায় কোথাও সমুদ্রের বিশালত্ব ছাড়া কিছু নেই। পিতেমের বুক থেকে একটা দীর্ঘ নিঃশ্বাস সমুদ্রেও নোনা বাতাসে মিশে যায়। এতটা বছর এই সমুদ্র দাপিয়েও সে একটা জলপরী দেখল না। সে যখন ছোট তার বাবা আর দাদু নৌকা নিয়ে মাঝ সমুদ্রে চলে গেলে তাদের ফিওে আসার অপোয় সারাদিন সমুদ্রে চোখ মেলে সারাটা দিন কাটাতো। যে কোন নৌকা কালো বিন্দুর মতো ভেসে উঠলেই সে চিৎকার কওে জানাতো বাবা আসছে - দাদু আসছে। দাদুর কাছে সে সমুদ্রেও গল্প শুনে সেও সমুদ্রকে ভালবেসে ফেলেছিল। দাদু বলতো সমুদ্রকে যে ভালবাসে সমুদ্রের কন্যারা তাদের দেখা দেয়।
তুমি দেখেছো তাদের?
- হ্যা।
দাদুর চোখ তখন কোথায় জানি চলে যেত।
দরিয়ার বুকে খুব বাতাস ওঠে, ঢেউ এর মাথায় মাথায় নৌকা নাচতে থাকে আর সবাই ওদলুর নাম ডাকতে ডাকতে ত্রস্ত হয়ে ওঠে। একটুকু ভুল হলেই মহা বিপদ, গোটা সমুদ্র আরো ফুসে উঠতে থাকে। প্রবল বাতাসের সাথে আসে বৃষ্টি আর আসে মাছের দল। ঢেউ এর তান্ডব বাড়তে থাকে মনে হয় এই বুঝি সব তলিয়ে যাবে। সবার চোখে তখন মৃত্যুও ছায়া কাপে এসন সময় তারা আসে। দরিয়ার অশান্ত চেহারা হটাৎ যেন শান্ত হয়ে যায় কিন্তু একটু দুরেই ঝড় যেন আরো ফুসে ওঠে। কিন্তু তার কোন চি এইটুকু জায়গায় নেই। নীল আলো জ্বেলে ওরা তখন আসে। কি সুন্দর তাদের চেহারা, গোটা পৃথিবীতে তাদেও মতো কেউ নেই। একবার যে তাদের দেখেছে সে কখনো কোন মেয়েকে ভালবাসতে পারে না। দাদু যখন তাকে দেখেছিল তখন তার বিয়ের মাত্র আট মাস বয়স। জলপরীরা হাসতে হাসতে উঠে আসার আগেই অন্যরা তাকে সাবধান করেছিল সে যেন চোখ বন্ধ করে রাখে কিন্তু মূহূর্তের জন্য সে তার বউটার কথা ভুলে গিয়েছিল। এরপর সে আর চোখের পলক ফেলতে পারে না .. একথাগুলো পিতেমকে দাদু কখনো বলে নি। আশেপাশের সবাই দাদুকে নিয়ে বলতো।
এরপর দাদু কখনোই আর বাড়িতে থাকতো না। আকাশের দিকে তাকিয়ে সে খালি দূর্যোগের চিহ্ন খুজে বেড়াতো। সমুদ্র উত্তাল হতে শুরু করলে একে একে সব নৌকা তীওে ফিরতে শুরু করলে দাদুর রোখ চাপতো আরো গভীর সমুদ্রে চলে যেতে। শেষে এমন হলো যে তার সাথে আর কেউ দরিয়ায় যেতে রাজী হতো না। সে তখন একাই নৌকা কওে গভীর সমুদ্রে চলে যেত। দাদীর দিকে দাদু আর কখনো নাকি মুখ তুলে দেখে নি। দাদীও যেদিন বুঝতে পারলো জলপরীরা তার স্বোয়ামী খেয়েছে এরপর থেকে বিধবার বেশে আরো পাচটি বছর কাটিয়ে পৃথিবী ছেড়ে চলে যান। দাদু তখন ঝড়ের মাঝখানে একটুকরো শান্ত সমুদ্রে জলপরীর স্বপ্ন দেখে, আর ্যাপাটের মতো সমুদ্রে দাবরিয়ে বেড়ায়। একদিন তাকে অনেকদিন পর অনেক হাসিখুশি দেখে গ্রামের সবাই অবাক কিন্তু সে কাউকে কিছু বলে না। সারাদিন সবার সাথে রঙ্গ তামাসায় কাটিয়ে মাঝরাত্রে নৌকা নিয়ে উধাও হয়ে যায় আর কথনোই ফিরে আসে নি।
দাদু কি জলপরীর দেখা পেয়েছিল।
পিতেমের মাথায় খালি এইসব ঘুরতো। সমুদ্রে ঝড় উঠলে তার মধ্যে একটা আশার আলো ফুটতো হয়ত এবার। কিন্তু চুরাশী বছরের জীবনে কখনোই সেটা পুরণ হয়নি।
সমুদ্রের দিকে তাকিয়ে এই শেষরাত্রে পিতেমের এইসব পুরোনো জীবন্ত কথা মনে পড়ে। ঠিক তখনই সে দেখতে পায় একটি নৌকা... কালো বিন্দুর মতো তীরের দিকে ছুটে আসছে।

অনুগ্রহ করে অপেক্ষা করুন। ছবি আটো ইন্সার্ট হবে।



