একটি অনৈতিক বা অন্যায্য কাজ করে পার পেয়ে গেলেই তা নৈতিক এবং ন্যায্য হয়ে যায় না। একাত্তুর সালে যারাই অপরাধ করেছে তারা যেখানেই যেভাবে ভালো থাকুক সেটা ন্যায্য নয়। যা অপরাধ তা চিরকালই অপরাধ। হুমায়ূন আজাদের একটা উক্তি অনেকটা এমন- আবর্জনাকে রবীন্দ্রনাথ প্রশংসা করলেও তা আবর্জনাই থেকে যায়।
গত কয়েকদিন ধরে কয়েকটা খবর বেশ কৌতূক জন্ম দিচ্ছে- ভারতের পর এবার রাশিয়াও স্বীকৃতি দিলো সরকারকে। কী বিভৎস খবর!! অথচ এগুলো সরকার সমর্থকরা গর্বিত বুকে জানানও দিচ্ছেন।
তবে এই জানান দেয়ার মধ্যে একটা ভালো বিষয়ও আছে। সেটা হচ্ছে তাদের অপরাধবোধ। তারা জানেন যেটা হয়েছে সেটা অন্যায়। অতীতে নির্বচনের পর বিদেশী দেশগুলো সরকারকে অভিনন্দন জানাতো আর এখন সমর্থন দিচ্ছে কী-না সেটাই হয়ে গেছে বড় বিষয়।
এই সমর্থন আদায় করার জন্য এখন সরকার কী কী করবে? সবই করতে পারে। পৃথিবীর তাবত জবরদস্তিপ্রবন শাসকেরা যা যা করেছেন তার সবই করতে পারেন। এবং বলাবাহুল্য সেগুলো কোনটাই দেশের স্বার্থে হবে না। হবে যাদের সমর্থন কিনছেন তাদের স্বার্থে।
ঠিক একারণেই একটি দেশে নৈতিকভাবে শক্তিশালী একটি সরকার থাকতে হয়। যাতে বিদেশীদের সাথে যেকোন আলোচনায় দরকষাকষিতে সে শক্ত অবস্থানে থাকতে পারে।
আমরা ৪২ বছর পূর্বের স্বাধীনতা সংগ্রামের কথা বলতে বলতে বলতে আরো কত বছরের জন্য স্বাধীনতাকে অন্যের দয়ারপাত্র বানিয়ে ফেলছি সেটা হয়তো এই মুহূর্তে ভাবাই হচ্ছে না।
কিন্তু আমাদের ভাবা উচিত। ভীষণভাবে ভাবা উচিত। এই যে লোকগুলো এখন ক্ষমতা আকড়ে আছে এরা অনেকটা সিন্দাবাদের ভুতের মতো। একবার নানান বাহানায় কাধে চড়ে বসলো তো আর নামবে না। হাজার পীড়াপীড়িতেও নামবে না।
কিন্তু তাদের দূর্নীতি তাদের দেশের স্বার্থবিরোধী কার্যকলাপ কিন্তু সীমাহীন। সেগুলো সূর্যের মতোই দৃশ্যমান। কিন্তু আমরা সেগুলো দেখেও নির্বিকার।
তার মানে সুযোগটা আমরাই দিলাম তাদের। কেন দিলাম? দিলাম আমাদের রাজনৈতিক দাসত্বের কারণে। মাই পার্টি-রাইট অর রং। এই অবিবেচনা কট্টর জাতীয়তাবাদীদের থাকে দেশের জন্য- মাই কান্ট্রি রাইট অর রং। সেটার এক ধরনের রূপ। ধরেই নিলাম বিবেক টিবেক বিসর্জন দিয়ে দেশের পক্ষে একসাথে থাকলাম। বলাবাহু্ল্য এটা ভীষণ ধ্বংসাত্মক পৃথিবীর জন্য। পৃথিবীর অনেক সংঘাতের পেছনে দায়ী এই কট্টর জাতীয়তাবাদ।
কিন্তু রাজনৈতিক দল বা ব্যক্তিতে গিয়ে যখন এই বিবেচনহীনতা ঠেকে তখন দেশের সর্বনাশ অনিবার্য। এটাকে অন্ধ দলীয় দাসত্ব বলা যায়। দল যা-ই করছে তাতেই সমর্থন দিচ্ছি। এক সময়ে দল দেশটাকেই বেঁচে দিলো সেটাও সমর্থন করলাম।
বিষয়টা অনেকটা এক ট্রাক ড্রাইভারের গল্পের মতো । পানিতে ডুবতে বসা দুর্ঘটনাগ্রস্ত এক ট্রাক ড্রাইভারকে হাসপাতালে নিলে ডাক্তার বললো- এক্সিডেন্টটা হলো কী করে?
ড্রাইভার বললো- গাড়ি চালাচ্ছিলাম। পথে দেখলাম একটা গরু, সাইড দিলাম। একটু পর দেখলাম একজন বৃদ্ধ যাচ্ছেন তাকেও সাইড দিলাম। কিছুক্ষণ পর দেখলাম নদীর উপর ব্রিজ। ব্রিজটাকেও সাইড দিলাম।
রাজনৈতিক দলের প্রতি আমাদের মনোভাবটা এরকমই হয়ে গেছে। একটি রাজনৈতিক দল আমাকে খাওয়ায়, না পড়ায় না। সে ক্ষমতায় যায় কারণ তাকে আমরাই নির্বাচিত করি। আমরা যদি তার অন্যায়কে 'না' বলি তাহলেই হলো। রাজনৈতিক আদর্শ আর রাজনৈতিক চরিত্র আলাদা বিষয়। কিন্তু আমরা বিষয় দুটোকে স্থুলভাবে এক করে ফেলেছি। অনেক রাজনৈতিক দলই তার আদর্শ থেকে বিচ্যুত হয়ে এক এক সময় চরিত্র গ্রহণ করে। সে যখন সচ্চরিত্র তখন তাকে মেনে নিলাম। কিন্তু যখন সে দুশ্চরিত্র তখনও তাকে কেন মেনে নেব?
কিন্তু আমরা মেনে নিচ্ছি, আর সে কারণেই আমরা আজীবন একটা দলের অন্ধ সমর্থক রয়ে যাচ্ছি।
দেশে যে প্রহসন হলো এবং হচ্ছে এবং কতদিন হবে তার নাক-মুখ বুঝা যাচ্ছে না সেটা এ কারণেই হতে পারলো। অথচ বিষয়টা আওয়ামীগের না বিষয়টা বিএনপির না- বিষয়টা ন্যায়ের। সেই মানদণ্ডে যা অন্যায়- তা অন্যায়ই। হয়তো ভারতের পর, রাশিয়ার পর, আমেরিকার পর, ব্রিটেনের পর, জাতিসংঘের পর সারা পৃথিবীই তার স্বীকৃতি দেবে। কিন্তু তাতেই তা ন্যায্য হয়ে যাবে না। আবর্জনাকে রবীন্দ্রনাথ প্রশংসা করলেও তা আবর্জনাই থেকে যায়।
উইনচেষ্টার রোড
অক্সফোর্ড
১২.১.১৪